সেদিনের কলিকাতা এদিনের কলকাতা

Reading Time: 8 minutes

আজ ২১ সেপ্টেম্বর কথাসাহিত্যিক রীতা রায় মিঠু’র জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


কলকাতা ঘুরে এলাম। কলকাতা ভ্রমণ আমার জন্য নতুন কোন ঘটনা নয়। অনেক ছোটবেলা থেকেই আমি কলকাতা যাওয়া আসা করি। বলতে গেলে কলকাতা আমার ‘সেকেন্ড হোম’। কারন আমাদের পরিবারের বেশ কিছু স্বজন ‘৬৪ সালের পরেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ‘কলিকাতা’ চলে গেছিলেন। আমার বাবা মায়ের সাথে আমরা আজ অবধি স্বদেশেই আছি। আগে আমার বাবা মা আমাদেরকে নিয়ে প্রতি দুই বছরে একবার কলিকাতা যেতেন। ওখানে গিয়ে আমরা আমাদের কাকাদের বাড়ীতে উঠতাম, কাকাত ভাই-বোনদের সাথে মিলে মিশে একটি মাস মহা আনন্দে পার করে দিতাম। ‘৭০ সালে আমরা প্রথম গিয়েছিলাম কলিকাতা। সেবারে আমার বাবা যেতে পারেননি, আমার মা, দাদু, দিদিমা, মাসীদের সাথে গিয়েছিলাম কলিকাতা নামের বিস্ময় নগরী দেখতে। বিস্মিত হয়েছিলাম ঠিকই। বয়স খুবই কম ছিল, তারপরেও ‘গড়ের মাঠে’ আমার তিন বছর বয়সী ছোট ভাই লাল টুকটুকে ফুলস্লীভ গেঞ্জী পড়ে দৌড়াচ্ছিল, ঘটনাটি মনে আছে। ‘শোভা বাজারের ‘পরেশনাথের মন্দির’ দেখতে গিয়ে আমার তের বছর বয়সী বড়দা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে গিয়ে সব গুবলেট করে ফেলেছিল, সবাই মিলে খুব হাসাহাসি করছিল, এটাও মনে আছে। আরও মনে আছে চিড়িয়াখানা, যাদুঘর দেখার টুকরো টুকরো স্মৃতি। ‘ইলেকট্রিক ট্রেন’ দেখার প্রাথমিক উত্তেজনা, ট্রেন স্টেশানে ঢুকার অনেক আগে থাকতেই আমার মা আমাদেরকে সাবধান করতে থাকতেন, ” সবাই দূরে থাক, নাহলে ট্রেনের বাতাসে উড়ে গিয়ে ট্রেন লাইনে পড়ে যাবে”। আমরাও দূর থেকে ট্রেনের লাইট দেখার সাথে সাথে বড়দেরকে জাপটে ধরে রাখতাম। ট্রেনে উঠা ছিল আরেকটি মজার ব্যাপার। কী যে ভীড় লেগেই থাকতো ট্রেনে! আমাদের ছোটদেরকে কেউ না কেউ কোলে তুলে নিত, তারপরেই এক ধাক্কায় ট্রেনে উঠে পড়তো। ট্রেনে একবার উঠতে পারলেই শুরু হতো নাম ধরে ডাকাডাকি,” মনা উঠছে? দেখতো মানিক, চঞ্চল উঠলো কিনা”, এগুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে।

আমার প্রথম কলিকাতা যাত্রা ১৯৭০ সালে। ‘৭০ সালে গিয়েছিলাম মাসখানেকের জন্য বেড়াতে, আমার মা বই পড়ে পড়ে দর্শনীয় স্থানগুলো আগেই পরিকল্পনায় রেখেছিলেন বলেই একমাসে অনেক দেখেছি। দ্বিতীয়বার কলিকাতা গেলাম ১৯৭১ সালে। ‘৭১ সালে অবশ্য বেড়াতে যাইনি, গেছিলাম শরণার্থী হয়ে! আট নয় মাসের মত ছিলাম কলিকাতাতে। অন্য রকম সময়, অন্য রকম এক কাল কাটিয়েছি তখন। অবশ্য কলিকাতার মানুষের জীবনের দৈনন্দিন অভ্যাসে তেমন কোন পরিবর্তন ছিলনা। সেই একরকম ভাবেই ঘুম থেকে উঠেই বাদুরঝোলা হয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন চেপে কাজে যাওয়া, অথবা ঘুম থেকে উঠেই ‘ঘুঁটে’ দিয়ে কয়লার উনুন জ্বালানো, সারাদিন রাস্তাঘাটে মানুষের কোলাহল, চায়ের স্টলগুলোতে কয়লার উনুনে সারাদিন চায়ের কেটলীতে চা ফুটতো, বিকেল হতেই তেলেভাজা, আলুকাবলী, ঝালমুড়ি, ঘটিগরম, আলুর চপ, বেগুনী ভাজা হতো। ছোটবেলার স্মৃতিতে এগুলোই ধরা ছিল। ‘৭১ সালের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে, ঐ সময় অনেকেরই চোখ লাল হয়ে এক ধরনের ইনফেকশান হতো (কনজাংটিভাইটিস) যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘জয় বাংলা’। কারো কনজাংটিভাইটিস হলেই বলা হতো “ওর জয় বাংলা হয়েছে”।, কলিকাতার অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মিলে আমরাও বলতে শিখেছিলাম, ” জয়বাংলার লোক ঢ্যাবা ঢ্যাবা চোখ’। আমাদের মায়ের কাছে একদিন খুব বকা খেয়েছিলাম এর জন্য। তারপর থেকে আর বলতামনা। সাত আট মাসে আমরা কলকাত্তাই বাংলা শিখে গেছিলাম প্রায়। ‘খেয়েচি, গিয়েছি, এলুম গেলুম’ টাইপ কথা। এরপরে দেশ স্বাধীন হতেই নতুন বাংলাদেশে ফিরে এলাম।

স্বাধীনতার পরে আমার ঠাকুরমাকে দেখতে আমরা দুই বছর পর পর কলিকাতা যেতাম একমাসের শীতকালিন ছুটিতে। আমাদের আনন্দের সীমা থাকতোনা। ইলেকট্রীক ট্রেন চড়া, আলো ঝলমলে কলিকাতা নগরী দেখা, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। আর আত্মীয়-স্বজনদের আদর সমাদরতো ছিলই। আমরা ছিলাম ছোট ছোট। বাংলাদেশে তখনও রকমারী খাবার দাবারের চল শুরু হয়নি। ঢাকার মিষ্টির দোকানগুলোতেও রসগোল্লা, চমচম, রাজভোগ, কালোজাম, সন্দেশ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যেতোনা। ‘কমলাভোগ, ক্ষীরভোগ, মিহিদানা, তালশাঁস, শোনপাপড়ি, জলভরা সন্দেশের নাম কলিকাতাতে গিয়েই প্রথম জেনেছি। চানাচুরের কত রকম বাহার যে ছিল। ঝাল চানাচুর যেমন ছিল, নরেশ কাকুর দোকানে মিষ্টি চানাচুরও পাওয়া যেত। দেশে থাকতেই আমরা পরিকল্পনা করতাম কলিকাতাতে গিয়ে কি কি খাব! দুই একটা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতে মা নিয়ে যেত, আমরাও যেতাম তবে ‘অখুশী’ মনে। কারন ঐ বাড়িগুলোর মালিক ধনী হলেও চায়ের সাথে শুধুই ব্রিটানিয়া থিন এরারুট বিস্কুট খেতে দিত। আরেকটা বাড়ীতে যেতাম খুব খুশী মনে। তারা স্বচ্ছল ছিলনা কিনতু আমাদেরকে ‘মহিষের দুধ’ এর রসগোল্লা খাওয়াতো। মহিষের দুধ দিয়েও মিষ্টি তৈরী হয়, এটা জেনেছি কলিকাতাতে গিয়ে। মাটির ভাড়ে করে চা বিক্রী হতো, রসগোল্লা আসতো মাটির ভাঁড়ে, রসের গুড় আসতো মাটির কলসীতে করে। আমার বিয়ের আগে পর্যন্ত নিয়মিতভাবেই বাবা মায়ের সাথে কলিকাতা গিয়েছি। তখনই দেখেছি, কলিকাতার মেয়েদের স্বাধীন মুক্ত জীবন। কোন মেয়েকে সাথে ভাইকে পাহারা নিয়ে কোথাও যেতে দেখিনি। কত মেয়েকেই দেখেছি রাত নয়টা দশটার পরেও টিউশানি সেরে বাড়ী ফিরতে, মেয়েদেরকে দেখেছি পুরুষদের সাথে ঠেলা ধাক্কা দিয়েই ট্রেনে উঠতে, ট্রেনের দরজায় পুরুষের পাশাপাশি মেয়েদেরকেও ঝুলে দাঁড়াতে দেখেছি।রাস্তা দিয়ে একটা ছেলে ও একটা মেয়েকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখেছি সেই কবে থেকে! এগুলো দেখতাম আর মনে মনে বিস্মিত হতাম। এগুলো দেখে দেখেই বোধ হয় আমার মা বাবা মাঝে মাঝে আমাকেও রাস্তাঘাটে একা একা চলতে দিতেন। তবে বাংলাদেশে মেয়েদের জীবন এখনও অনেকটাই প্রাচীন নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা। কলিকাতার মেয়েরা পাড়ার ছেলেদের মতই কিছুটা মাস্তান গোছের আচরনও করতো। আমার কাকার মেয়েকে আমি কী যে ভয় পেতাম। সব সময় আমাদেরকে শাসাত, ” বেশী ঘাঁটাবিনা আমাকে, ঘুষি মেরে নাক উড়িয়ে দেবো” টাইপ কথা বার্তা বলে।

আমার বিয়ের পরে কলিকাতা আর তেমন করে যাওয়া হতোনা। প্রধান কারন ছিল, আমার শ্বশুরবাড়ীর কেউ কলিকাতাতে ছিলেননা। তাছাড়া ততদিনে আমার ঠাকুমাও স্বর্গবাসী হয়েছেন। আমিও দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি, কলিকাতা যাওয়ার সময় পাইনি। কিনতু তখনও কলিকাতাকে আমার সেকেন্ড হোম মনে হতো, যেখানে আমার কাকা-কাকীমা, মামা-মামী, মাসী-মেসোর মত অতি আপনার জনেরা থাকতেন। আমার সাথে সকলের যোগাযোগ ছিল, ফলে কলিকাতা নিয়ে আমার উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েনি কখনও। আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা থাকতেন উত্তর কলিকাতাতে। উত্তর কলিকাতাতে সাধারনতঃ পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীদের বসবাস। খুবই জনবহুল এলাকা এই উত্তর কলিকাতা, চারিদিকেই বাঙ্গাল টানে কলকাত্তাই কথা শোনা যায়, অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, চারিদিকেই কয়লার উনুনের ধোঁয়া, বাড়ীর বাউন্ডারীর ওয়ালে গোবরের ঘুঁটে, রাস্তায় সাইকেলের ট্রিং ট্রিং ঘন্টি, রিক্সার প্যাঁ পোঁ, প্যাঁ পোঁ হর্ণ শুনেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। দক্ষিন কলিকাতা হচ্ছে বড়লোকের ঠিকানা এমনটাই জানতাম। আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা বড়লোক ছিলেননা বলেই উত্তর কলিকাতার আশে পাশে থাকতেন। দক্ষিন কলিকাতাতে রাস্তা ঘাট প্রশস্ত, বাস ট্রামের সুব্যবস্থা আছে কিনতু কোথাও কোন হ য ব র ল ভাব নেই, রিক্সার এত বেশী প্যাঁ পোঁ শোনা যায়না, এমনটা জেনেই বড় হয়েছি। উত্তর কলিকাতার ট্রেনে উঠলেই পকেট সাবধানে রাখার নির্দেশ থাকতো। যখন তখন পকেটমার হয়ে যেতো। ট্রেনের কামরায় উঠার মুখেই জমাট ভীড়, নামার মুখেও জমাট ভীড়, পকেটমার হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। আমার বিয়ের অনেক পরে আমি আমার বরের সাথেই গিয়েছিলাম কলিকাতাতে। বেলঘরিয়াতে নেমেছি ট্রেন থেকে, সাথে ছিল নেদারল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা দামী কাঁধ ব্যাগ। আমার বরের কাছ থেকে পাওয়া এমন অমূল্য রতনটিকে কাঁধে ঝুলিয়েই বের হয়েছিলাম। ট্রেনে ভীড় ছিলনা, কিনতু দরজার কাছে বরাবরের মতই কিছু যাত্রী দাঁড়ানো ছিল। ট্রেন থেকে নামতেই হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ব্যাগটা লম্বালম্বি করে ছুরী জাতীয় কিছু দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। বুকটা ধ্বক করে উঠতেই ব্যাগে হাত দিয়ে দেখি দুই হাজার টাকার বান্ডিলটা একেবারে ভেতরের দিকে থাকায় রক্ষা পেয়েছে। কিনতু ব্যাগটিতো নষ্ট হয়ে গেলো!

২০০১ সালে আমেরিকা যাওয়ার পর থেকে প্রতি দুই বছরে একবার করে আমি বাংলাদেশে আসি। প্রতিবারই কলিকাতাতেও যাই দিন পনেরোর জন্য হলেও। সেকেন্ড হোম বলে কথা। গিয়ে একই দৃশ্য দেখি, পরিচিত দৃশ্য দেখে খুশী হই। অতীতকে ফিরে পাই, ছেলেবেলার দিনগুলোকে ছুঁতে পারি। এরপর হঠাৎ করেই একদিন জানতে পারলাম কলিকাতাকে আর কলিকাতা বলা যাবেনা।’কলিকাতা’ থেকে নগরীটির নাম হয়ে গেছে কলকাতা। আরো অনেক কিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। আনুমানিক ছত্রিশ বা সাঁইত্রিশ বছর ধরে বাম রাজত্ব ছিল। ব্যতিক্রম ঘটেছে এবার। এবার রাজ্য সরকারের গদীতে আছেন আমাদের সেই বহুল আলোচিত মমতা দিদি। তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জী। মমতা নামের সাথে মমতা জড়িয়ে থাকারই কথা, তবে বাংলাদেশের জনগনের জন্য তাঁর মমতায় ঘাটতি আছে। মমতা দিদির ব্যবহারে তাঁর প্রতি আমাদের ভীষন রকম অভিমান হয়েছে। তিস্তা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে অনুষ্ঠানে দিদি আসেননি। বাংলাদেশে তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য কত ঘটা পটা হয়েছিল, সবই বিফল হয়েছিল। সেই মমতা দিদির কলকাতাতে গিয়েছিলাম এবার।

মমতা দিদির কলকাতাতে গিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। প্রথমেই বিস্মিত হয়েছি দমদম নেতাজী সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক এয়ার্পোর্টে পৌঁছে। খুবই সাদামাটা টাইপ বিমানবন্দর, আলো কম চারদিকে, কাস্টমস অফিসারদের ব্যবহার কেমন চোয়ারে টাইপ। আমার স্মৃতিতে দমদম এয়ারপোর্টের অন্যরকম চেহারা ছিল। সবশেষ ‘৭৪ সালে আমরা বিমানে চড়ে কলিকাতা গিয়েছি। এরপর থেকে বাসে চেপে গিয়েছি। সাধারন মধ্যবিত্তের পক্ষে প্লেন ভাড়াটা সাধ্যের বাইরে মনে হতো বলেই কম পয়সার বাস সার্ভিস ছিল ভরসা। এবার অবশ্য প্লেনে গিয়েছি সকলের চাপে পড়্বে। সবার ধারনা, আমেরিকাতে থেকে থেকে আমাদের শরীর খুব আরামপ্রিয় হয়ে গেছে, তাই বাস জার্নির ধকল সইতে পারবোনা। যাই হোক প্লেনে চড়ে যাওয়াতেই পরিবর্তনটুকু চোখে পড়লো। সেই আলো ঝলমলে দমদম এয়ারপোর্টের বদলে নেতাজী সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির সে কি ম্যারম্যরে চেহারা। তুলনায় আমাদের শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নেক বেশী সুন্দর! কত বড়, কেমন সাজানো গোছানো আলো ঝলমলে চারদিক। কাস্টমস অফিসারদের ব্বেযবহারও ভাল। আমাদের দেশের কাস্টমস অফিসারদেরকে মিডল ইস্ট থেকে আসা যাত্রীদের সাথে একটু খারাপ ব্যবহার করতে দেখেছি যা কিনা আমার কাছে পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। যাই হোক দমদম বিমান বন্দর থেকে বেরিয়েই অপেক্ষারত ট্যাক্সীতে গিয়ে বসলাম। গাড়ী বেশ ভাল গতিতেই চলতে লাগলো। মনে পড়ে গেলো, ২০০৩ সালে আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে ট্যাক্সী করেই ফিরছিলাম। গাড়ী আটকা পড়ে গেলো ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে। গরমে সিদ্ধ হচ্ছিলাম, গাড়ী নড়েনা, মেয়ের সে কী চীৎকার! ও গরম সহ্য করতেই পারেনা। তাই এবারে ছোট মেয়েকে সাথে নেইনি। অথচ রাস্তায় কোন জ্যাম নেই। অবাকতো হবোই। পরদিন সকালের ট্রেনে চড়ে বেলঘরিয়া যাচ্ছিলাম। ট্রেন একেবারেই ফাঁকা ছিল, আমি তো আবারও অবাক হলাম।যত বাড়ীতে গিয়েছিলাম, রাস্তাঘাট ছিল সাজানো গোছানো। আগের সেই চির পরিচিত ময়লা আবর্জনার স্তুপ দেখিনি কোথাও। সকাল বা বিকেল, সব সময়ই এক রকম। এবারই প্রথম কয়লার উনুন জ্বলতে দেখিনি কারো বাড়ীতে বা দোকান বা রাস্তার মোড়ে। উনুনের ধোঁয়ার সেই পরিচিত গন্ধ পাওয়া হলোনা, আদি কলিকাতাকে মিস করেছি বর্তমান কলকাতাতে থেকে। মেজো মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের সাধারন কামরায় না উঠে লেডীজ কামরায় উঠেছিলাম। এখানে অবশ্য পেয়েছি সেই পরিচিত দৃশ্য। অফিস ফেরত টাইমে ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠতে গিয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার যোগার হয়েছিল। কথিত আছে, লেডীজ কামরাতেই পকেটমার হয়। আমার ব্যাগে ছিল দামী ক্যামেরা, বেশ কিছু টাকা। কিনতু এবার কোন অঘটন ঘটেনি, বরং এক ভদ্রমহিলা আমাকে অনেক সাহায্যই করেছে।

ছয়দিন ছিলাম কলকাতাতে, রাস্তাঘাটে আগেকার দিনের মত মানুষের ঠেলাঠেলি ছিলনা, অটোরিক্সা লাইন ধরে দাঁড়ানো থাকে, রিক্সাও লাইনে থাকতে দেখেছি। নতুন যা দেখলাম তা হচ্ছে, ট্রেন থেকে নেমেই যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা করে অটো বা একটা করে রিক্সা এসে থামবে যাত্রীদের সামনে, আগে আসা যাত্রীটি সুযোগ পাবে রিক্সাতে উঠার। বিদেশে বেড়ে উঠা আমার মেজো মেয়ে আমাকে বললো, ” মা দেখো, ইন্ডিয়া যে এগিয়ে যাচ্ছে তার মস্ত বড় প্রমান হচ্ছে এমন ডিসিপ্লিন্ড হয়ে উঠা মানুষজন। কেউ আমি আগে যাব বলে ঠেলাঠেলি করছেনা! একজন যাত্রী ভুল করেই একটা রিক্সাতে উঠতে গেছিল, আমি দেখলাম রিক্সাওয়ালাটা তাকে না নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো অন্যজনকে তুলে নিল।” আরেকটি ভালো ব্যবস্থা হয়েছে মেয়েদের জন্য, মমতা দিদি ক্ষমতায় এসে শুধুমাত্র মেয়েরদের জন্য ‘লেডীজ ট্রেন’ চালু করেছেন। আমি বাংলাদেশের মেয়ে, মেয়েদের জন্য বিশেষ সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত, তাই লেডীজ ট্রেনের আইডিয়া আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে। রাস্তাতে কোথাও কোন দীর্ঘস্থায়ী ট্র্যাফিক জ্যাম হয়নি। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তবে রাস্তাঘাটে কোন আন্দোলন হতে দেখিনি। গত ছয়দিনে কোন মিটিং মিছিল দেখিনি। হয়তোবা জনগন অনেক বেশী সচেতন হয়েছে। তারা নিজেরাও চেষ্টা করছে দেশটাকে, দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে। একদিনের একটি ঘটনা মনে আছে। ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ যাচ্ছিলাম। স্টেশানে নেমেই মাইকে যাত্রী সাধারনের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছিল, ” কল্যানী লাইনে কন্সট্রাকশানের কাজ চলছে, যাত্রী সাধারনের সুবিধার জন্য কল্যানী রুটে বাড়তি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। আপনারা অত নাম্বার প্ল্যাটফর্মের গেইট ধরে বের হলেই বাস রেডী পাবেন” জাতীয় কথা। ছয়দিনে কলকাতা চষে বেড়িয়েছি। চারিদিকে কন্সট্রাকশানের কাজ চলছে কলকাতাকে আধুনিক নগরী বানানোর উদ্দেশ্যে। ভোটের আগে দিদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কলকাতাকে আধুনিক নগরী বানাবেন। রাস্তাঘাটে আরেকটি জিনিসের উপর নজর পড়েছে আমার। চারিদিকে মমতা দিদির ছবি সংবলিত ফেস্টুন। মমতা দিদির হাত জোড় করা বিনম্র ভঙ্গীতে তোলা ছবিটি চারিদিকে শোভা পাচ্ছে। ছবিটি দেখে আমার মনে হয়েছে, জনগনের নেতা নেত্রীদের ভঙ্গী এমনই হওয়া উচিত।

আমার খুব কাছের মানুষ, বয়সে তরুন তরুনীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম মমতা দিদি সমপর্কে তাদের কি ধারনা। সকলের এক কথা, দিদি যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন নাকি জনগনের কথা বেশী বলতেন, যখন তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়তেন, সরকারী অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তার উপর শুয়ে পড়তেন। এখন নাকি ক্ষমতায় গিয়ে আর কিছুই করেননা। নিজের দলের লোকের জন্যই তাঁর সকল দরদ, নিজের দলের ক্যাডারদেরকেই কাজ দেন, সন্ত্রাসীও যদি তাঁর দলের হয়, তাহলে সাতখুন মাফ। পুলিশ বাহিনী নাকি দূর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রথম শুনলাম কলকাতায় মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, এমন কথা শুনে অবশ্যই আঁতকে উঠেছি। কলকাতার মেয়েরা কত স্বাধীনভাবে চলতে পারে, নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখতাম আর এক ধরনের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগতাম। সেই কলকাতায় মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা! বিশ্বাস হয়নি আমার। ওদের বলেছি, “ছয়টা দিন মেয়েকে নিয়ে চষে বেড়িয়েছি সারা কলকাতা, কোন রকম অসঙ্গতি চোখে পড়েনি, কেউ শিস মারেনি আমার মেয়েকে দেখে, বাসে উঠতেই অনেকেই নিজের সীটটি ছেড়ে দিয়ে আমাদের বসতে দিয়েছেন।” এগুলো বলতেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, ” এরা সবকটাই সিপিএমের ক্যাডার, তাই মমতার নামে অমন দূর্নাম ছড়াচ্ছে”।

অয়ন নামে একজনকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি, আমেরিকাতে ছিল বেশ কয়েক বছর, পিএইচডি করতে গিয়েছিল, সে ছিল কট্টর ‘দিদিপন্থী’। সে জোর গলায় দাবী করতো, একদিন মমতা ব্যানার্জী রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় আসবে। তাকে অনেকেই ক্ষ্যাপাত এই কারনে। আমিও মনে মনে ভাবতাম, এটা কি কখনও সম্ভব হবে নাকি! কিনতু বাস্তবে তা ঘটেছে। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে, পরিবর্তন এসেছে। অয়নের সাথে এবার দেখা করেছি, দেখা হতেই তার কাছে জানতে চাইলাম দিদির রাজকার্য দেখে সে কতটা সন্তুষ্ট, তার কি মূল্যায়ন! সে বললো, ” এক বছর খুবই কম সময় একজনকে মূল্যায়ন করার জন্য। ভালো বা মন্দ, কোনটারই মূল্যায়ন সম্ভব নয় এত তাড়াতাড়ি”। এটা খুবই সত্যি কথা। তারপরেও আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে, দিদি কাজ করছেন। বেশ আন্তরিকভাবেই কাজ করে চলেছেন। সাথে যোগ হয়েছে জনগনের ব্যক্তি সচেতনতা। যদিও আমি আমার চির পরিচিত কলিকাতাকে দেখতে পাইনি, আমার ছেলেবেলাকে পাইনি, অতীতের ভালোলাগাকে ছুঁতে পারিনি, তারপরেও সেদিনের কলিকাতার পুরানো খোলস ভেঙ্গে এদিনের নতুন কলকাতাকে দেখে এলাম। আমি খুবই ইমোশনাল, অতীতকে পাইনি বলে কষ্ট লেগেছে, তারপরেও ভালো লেগেছে ভেবে যে জনগনের নেত্রী জনগনকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তিনি তাঁর কথা রাখার চেষ্টা করছেন। আমাদের এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের সম্পর্কে বহুল প্রচলিত একটি ধারনা আছে, ” যেই যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ”! ক্ষমতায় যাওয়ার আগে নেতা নেত্রীরা জনগনকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে থাকেন, ক্ষমতায় যেতে পারলে নিজেরাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এবং তড়িঘড়ি করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, জনগনের কথা বেমালুম ভুলে যান। মনে হয় মমতা দিদি বাংলাদেশের জনগনের প্রতি অবিচার করলেও নিজ দেশের জনগনের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা করছেন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>