আজ ২১ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
ব্যারিস্টার গগনবিহারী পাকড়াশীর মনটা আজ সকাল থেকে বড়ো খারাপ। কারণ, কোনও পুরুত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঠাকুমার ইচ্ছেমতো ছাতের দশফুট ওপরে অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি ঠাকুরঘর একদম রেডি। এখন গৃহপ্রবেশের পালা। যাগযজ্ঞ বা হোমের উপচারও সব তৈরি । শুধু পুজো করার জন্য পুরোহিত নেই।
তবে গগনবিহারীর কাছে ওটা কোনও সমস্যাই নয়। ভাগ্যিস পদার্থবিজ্ঞানী স্বয়ম্ভূ শর্মার টাইম-মেশিনটা মিনি-মাগনা পেয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই তো দরকার পড়লেই টুক্ করে চড়ে বসেন টাইম-মেশিনে, টিপে দেন বোতাম, আর শোঁ করে অন্য কোনও শতাব্দীতে গিয়ে নিয়ে চলে আসেন দরকারি জিনিসটা। এই মহান উপকারটা স্বয়ম্ভূ করে গেছেন বলেই বন্ধুবিচ্ছেদের মতো মহাসাংঘাতিক শোকও গগন কোনওক্রমে ভুলতে পেরেছেন।
ঘটনাটা বছর দুয়েক আগের। সেদিন সকালে সিন্থেটিক হালুয়া দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে গগনবিহারী টেবিলে ভেসে ওঠা নিউজ পোর্টালে চোখ রেখেছিলেন। হঠাৎ তিনি খবরটা দেখলেন আর দেখে হাঁ হয়ে গেলেন। সেই হাঁ বুজোতে সময় লাগল পাক্কা বারো মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ড! হবেই তো। তাঁর প্রাণের বন্ধু স্বয়ম্ভূ শর্মা হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, কী জানি কী রিসার্চ করার জন্যে চলে যাচ্ছেন ইউরেনাসে, আর তিনি বিন্দুবিসর্গ জানেন না এ ব্যাপারে!
স্বচক্ষে ব্যাপারটা দেখার জন্যে গগন ছুটলেন আর তিনঘন্টা পরে বিমর্ষমুখে বাড়ি ফিরে এলেন সঙ্গে সেই টাইম-মেশিনটা নিয়ে। সেদিন আর তাঁর কোনও কাজকর্ম হল না, খাওয়াদাওয়াতেও রুচি হল না। তাঁরই চোখের সামনে দেশবাসীকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে স্বয়ম্ভূ শর্মা পাড়ি দিলেন ইউরেনাসের গহন গভীর দুর্ভেদ্য পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলে।
আসলে ব্যাপারটা হল কী, স্বয়ম্ভূর বাড়ির পুরনো একটা বাক্স থেকে তাঁর ঠাকুদ্দার বাপের একটা ল্যাপটপ হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছিল। তা থেকেই স্বয়ম্ভূ উদ্ধার করেছেন তাঁর পূর্বতন চোদ্দপুরুষের ইতিহাস। আর সেই থেকেই প্রতিভাধর স্বয়ম্ভূ শর্মার মস্তিষ্কের কলকব্জা গেছে বিগড়ে।
সেই ইতিহাস বলছে, ঊনিশশো আটাশ সালে স্বয়ম্ভূর বারোতম পূর্বপুরুষ নাকি মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান। তিনি গিয়েছিলেন হিমালয় পাহাড়ে, ‘তপস্যা’ নামে কী জানি কী একটা গূঢ় রহস্যময় রিসার্চ করার জন্যে। আর সেই গবেষণায় সফল হয়ে বাইশ বছর পরে তিনি যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল ‘সন্ন্যাসী’। কিন্তু মুশকিল হল কী, সেই গবেষণার কোনও ফর্মূলা বা তথ্য কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ তার নানান আশ্চর্যরকম ফলাফল দেখে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। স্বয়ম্ভূর সেই পূর্বপুরুষ কোনওরকম যানবাহন ছাড়াই নাকি মিনিটে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে পারতেন। কিচ্ছু না খেয়ে কয়েক মাস দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারতেন। এইরকম আরও অদ্ভুত সব ক্ষমতার তিনি নাকি অধিকারী হয়েছিলেন।
তা এইসব দেখেশুনেই স্বয়ম্ভূর এই নাছোড়বান্দা সিদ্ধান্ত। ঐ রিসার্চ তাঁকে নাকি করতেই হবে। আর তার জন্যে তিনি অত্যন্ত গোপনে তৈরিও হচ্ছিলেন। সেই ল্যাপটপ থেকেই তিনি খুঁজে বার করলেন সেই প্রাচীন গবেষণার উপকরণ। তারপর বহু চেষ্টার পর সেই ‘লোটা’ আর ‘কম্বল’ নামক উপকরণ দুটি যোগাড় করলেন মিউজিয়ম থেকে। তারপর একটা গেরুয়া রঙের স্পেসস্যুট তৈরী করে নিয়ে বিজ্ঞানী স্বয়ম্ভূ শর্মা প্রস্তুত হলেন ইউরেনাসে পাড়ি দেবার জন্যে। কারণ, পৃথিবীতে ঐ অদ্ভুত গবেষণা হবে না, পৃথিবীতে আর নির্জন কোনও পাহাড় নেই। যাবার আগে তাঁর সমস্ত জিনিস তিনি সরকারকে দিয়ে গেলেন। কেবল প্রাণের বন্ধু গগনবিহারীকে দিয়ে গেলেন তাঁর সাধের টাইম-মেশিনটা।
সেই থেকে গগনবিহারী খুব বিমর্ষ হয়ে আছেন। যখনই বন্ধুর কথা মনে পড়ে, তখনই প্রাণের মধ্যেটা হু হু করে ওঠে। এই যে এতবড়ো একটা সমস্যা, পুরুত-সমস্যা — স্বয়ম্ভূ থাকলে তিনি তো তাঁর সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে পারতেন!
যাই হোক, কা কস্য পরিবেদনা। এই ব্রহ্মান্ডে কেউ আপনার নয়, এই ভেবে গগন বিংশ শতাব্দীতে যাবার জন্য তৈরি হলেন। পুরুত ওখান থেকেই আনতে হবে। কারণ, তিনি খোঁজ নিয়েছেন, ঐ সময়টাতেই পৃথিবীতে পুরুত-টুরুত ছিল সুলভ।
টাইম-মেশিন থেকে বেরিয়েই গগনবিহারী দেখলেন, তিনি একটা কাঁটাঝোপের ভেতর ল্যান্ড করেছেন। এহ্ হে হে, গগন ভাবলেন, বিংশ শতাব্দীর যাত্রাটা তো এবারে ঠিক শুভ হল না।
শুভকাজে যদি কিছু বিঘ্ন ঘটে, মনটা একটু মুষড়েই পড়ে। তাই মুষড়ে পড়া মন নিয়ে গগন কাঁটাঝোপ থেকে বেরিয়ে এলেন। এসে দেখলেন, সামনে একটা বিশাল ফাঁকা জায়গা, একপাশে একটা পুকুর, আর বহুদূর পর্যন্ত ধানজমি। এতখানি ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে দেখলে চমকে উঠতে হয়। শুধু অনেকবার বিংশ শতকে আসা হয়ে গেল বলে এখন আর গগন অবাক হন না।
পুকুরের পাশ দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে তিনি এগিয়ে চললেন। দূরের দিকে কয়েকটা ছোটো ছোটো মাটির বাড়ির মতো দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে গগন উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। এই তো! এই গ্রাম-ট্রামের দিকেই পুরুত পাওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি।
এগিয়ে চললেন গগনবিহারী। কাঁচা রাস্তাটা যেতে যেতে ক্রমশ সরু হয়ে গিয়ে একটা ধানজমির আল শুরু হয়েছে। সেই আল ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই গগন দেখলেন, ধারেকাছে লোকজন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু দু-চারটে পশু ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে। গগন পশুগুলোকে বিলক্ষণ চেনেন। ওদের নাম হল ‘বস টরাস’, যাকে আগেকার দিনে চলতি ভাষায় বলা হত গরু।
এইবার গগনবিহারীর মনের জোর আরও বেড়ে গেল। কুছ পরোয়া নেই। গরু যখন আছে, মানুষও আসবে। তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেই হবে। আপাতত এখানেই অপেক্ষা করা যাক। এই ভেবে খানিকটা দূরে ধানজমির সীমানায় যে কয়েকটা নারকেলগাছ ছিল, গগনবিহারী তার একটার তলায় গিয়ে বসলেন।
দূরে গরুগুলো নির্বিবাদে চরে বেড়াচ্ছে। কখন যে কোন মানুষ এসে দেখা দেবে, পুরুতের খবর দিয়ে তাঁকে ধন্য করবে, এই ভাবতে ভাবতে তিনি গাছটায় ঠেস দিয়ে চোখ বুজলেন আর তারপরেই বিকট চিৎকার করে তাঁকে লাফিয়ে উঠে পড়তে হল। কয়েকটা ডেয়োঁ পিঁপড়ে তাঁর স্পেসস্যুটের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে এবং বসিয়েছে মোক্ষম কামড়। তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে লাফাতে গগনবিহারী স্পেসস্যুটটা খুলতে লাগলেন গা থেকে। পুরোটা খুলে পিঁপড়েগুলো গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েও শান্তি নেই। পিঁপড়ের কামড়ে তিন-চারটে জায়গা দেখতে দেখতে লাল হয়ে ফুলে উঠল। কী মুশকিল! কোনও ওষুধও এখন সঙ্গে নেই। অগত্যা সেই ফুলে ওঠা জায়গাগুলোয় হাত বুলোতে বুলোতে গগনবিহারী হেঁটে চলে বেড়াতে লাগলেন আল দিয়ে।
আর ঠিক সেই সময় পেছনে ‘গাঁক’ করে একটা আওয়াজ। সেই আওয়াজ শুনেই গগনবিহারীর পিলে চমকে গেল। কী কান্ড! একটা মস্ত পাটকিলে রঙের গরু তার লম্বা লম্বা শিং বাগিয়ে তেড়ে আসছে তাঁর দিকে। আর পুরুতের খোঁজ! দুদ্দাড় করে দৌড় লাগালেন গগনবিহারী। স্পেসস্যুট হাত থেকে ছিটকে গেল, হোঁচট খেয়ে পড়ে হাঁটু আর কনুই ছড়ে গেল। তবুও নিস্তার নেই। গরু-ব্যাটা যমদূতের মতো তাড়া করে আসছে তাঁকে। আর উপায় না দেখে ধানজমির ওপর দিয়ে কাদাজলে মাখামাখি হয়ে ছুটতে ছুটতে গগনবিহারী দেখলেন, তিনি সেই পুকুরটার সামনে এসে পড়েছেন। যা থাকে কপালে, এই ভেবে চোখ-কান বুজে পুকুরে ঝাঁপ দিলেন গগনবিহারী।
আর ঠিক সেই মোক্ষম সময়ে ঘুমটা ভেঙে গেল গগনবিহারীর। দেখলেন, তিনি ঘুমের ঘোরে কখন বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছেন। তাহলে পুরুতঠাকুর? মরেছে, সবসময় ঐ কথা ভাবতে ভাবতে তিনি কি তাহলে স্বপ্নও দেখে ফেললেন? কী সর্বনাশ!
কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনটা আনন্দে ভরে গেল। যাক, সত্যি সত্যি তাহলে সেই বিভীষণ গরুর তাড়া তাঁকে খেতে হয়নি! আর সেই সঙ্গেই বিদ্যুৎ-চমকের মতো তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, না, আর যেখানে সেখানে দৌড়নো নয়। আর্ট-মিউজিয়াম থেকে একটা পুরুত-অ্যান্ড্রয়েড ভাড়া করে এনে তিনি পুজোটা করিয়ে নেবেন। দরকারে প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে সেই রোবট-পুরুতকে তিনি মূল্য ধরে দেবেন। ব্যস, কাম খতম, পয়সা হজম। ঠাকুমাও খুশি, আর তাঁর নিজের সমস্যাও শেষ।
চনমনে গগনবিহারী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। এখন তাঁর আহ্লাদিত মনে ফুরফুরে হাওয়ার হিল্লোল।
জন্ম ১৯৬৪। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অথচ শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতি নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা। তাই অসংখ্য ছোটবড় পত্রিকায় তাঁর বিভিন্ন ধরণের লেখা প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়ে চলা নাটক ও নৃত্যনাট্য রচনা ও সুরারোপের মাধ্যমেও বিচ্ছুরিত তাঁর প্রতিভা। লেখেন ছোটবড় সকলের জন্যই। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১, যার মধ্যে ‘দুর্দান্ত দশ’, ‘পাতায় পাতায় ভয়’, ‘ভূতের বৃন্দাবন’, ‘গুহা গোখরো গুপ্তধন’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি ইতোমধ্যেই পাঠকসমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত অপেরা-নাটক “আলাদিন” বেশ কয়েকবার মঞ্চস্থ হওয়া ছাড়াও হাওড়ার একটি নাট্য কর্মশালায় ব্যবহৃত হয়েছে। একসময় সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা “আলো অন্ধকার”। পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কার, যার মধ্যে ‘কিশোর ভারতী সাহিত্য পুরস্কার”, “সংশপ্তক পুরস্কার” প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।