আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট[ আমাদের পুরাণগুলিতে, মহাভারতে, কৃষ্ণকথা আছে। রাধাকথা এসেছে আরও অনেক পরে। তবে কী কৃষ্ণ নিছক পৌরাণিক চরিত্র ? সম্পূর্ণ কাল্পনিক? আমার তা মনে হয় না। রামায়ণের উপর কাজ করতে গিয়ে আমার সে কথা মনে হয়েছে। ময়মনসিংহের গৌরব, ‘সৌরভ’ পত্রিকা সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারের ‘রামায়ণের সমাজ’ বইটি সম্পাদনা করতে গিয়ে সে দিকে আমার দৃষ্টি পড়ে। কলকাতার এডুকেশন ফোরাম আমার সে বই প্রকাশ করেছেন। কেদারনাথই বলেছেন, তিন/চার হাজার বছর আগে মানুষের মৌলিক কল্পনাশক্তি এত প্রখর ছিল না, যাতে পূর্ণাঙ্গ রামকাহিনি লেখা যায়। অন্যদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক শ্লীম্যান প্রমাণ করেছেন যে হোমারের লেখা মহাকাব্যের বস্তুভিত্তি আছে, যখন ট্রয়ের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল। নিরপেক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হলে রামকথা ও কৃষ্ণকথারও বস্তুভিত্তি পাওয়া যেত বলে আমাদের ধারণা। দুঃখের বিষয়, আমাদের গবেষণাক্ষেত্রেও ঢুকে গেল রাজনীতি; বাল্মীকির ‘পুরুষোত্তম রাম’ হয়ে গেলেন বিষ্ণুর অবতার, তারপর তিনি হয়ে গেলেন হিন্দুত্ব প্রচারের হাতিয়ার। কৃষ্ণকথাও একদিন রাজনীতির হাতিয়ার হবে। আমরা শুনেছি সমুদ্রগর্ভ থেকে দ্বারাবতীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। তারপরের কাজ আর এগোয় নি। যাঁরা রামচন্দ্রকে মানুষ হিসেবে দেখতে দেবেন না, তাঁরাই এরপরে কৃষ্ণকে নিয়ে পড়বেন, তাঁর মানবত্বকে আড়াল করে দেবত্ব প্রচার করবেন।
আমাদের এই কৃষ্ণকথায় আমরা মানুষ কৃষ্ণকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তাই পরে পরে গড়ে ওঠা নানা অলোকিক প্রসঙ্গের লৌকিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। ‘ইরাবতী’র পাঠকরা লেখাটি পড়ে মতামত দিলে খুব ভালো লাগবে। নিন্দা বা প্রশংসা নয়, আমি সমালোচনার ভক্ত বরাবর। ]

বসুদেব, গর্গাচার্য, উগ্রসেন প্রভৃতিরা দ্বারাবতীতে এসে বিরাট কর্মকাণ্ড দেখে বিস্মিত হলেন। রাজপুরীর অলঙ্করণ পারিপাট্য দৃষ্টিনন্দন। নিধিপতি শঙ্খের আর্থিক অনুদানে নগরবাসীদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর কোন অভাব নেই। সমুদ্রবেষ্টিত বলে দ্বারাবতী বাণিজ্য সহায়ক। এখানে নানা দেশের বণিকদের সমাগম। জাতিভেদের কোন কঠোরতা নেই। বৃত্তি ও কর্ম অনুযায়ী নগরে নানা শ্রেণির মানুষের বাস। বাস্তবিক দ্বারাবতী এক সুরক্ষিত নগরী। একদিকে প্রাকৃতিক সুরক্ষা, অন্যদিকে বিচক্ষণ কৃষ্ণের প্রচেষ্টায় সুরক্ষার অন্যবিধ আয়োজন। সমুদ্রবেষ্টিত, তাই বহিঃশত্রুর আক্রমণভীতি নেই। তার উপর প্রধান দ্বারের সম্মুখে রৈবতক দুর্গে আছেন সজাগ প্রহরী। যে কেউ যখন-তখন দ্বারাবতীতে প্রবেশ করতে পারেন না। প্রবেশ করতে হলে রৈবতক দুর্গ থেকে অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। কৃষ্ণ বৃন্দাবনের আভীরজাতীয় গোপসেনাদের নিয়ে তৈরি করেছেন নারায়ণী সেনা। তাঁরাও নগরী রক্ষার কাজে সতর্ক। দ্বারাবতীর অধিবাসীদের দেওয়া হয়েছে এক স্মারকচিহ্ন। দ্বাররক্ষককে সেই স্মারকচিহ্ন দেখিয়ে বাহিরে যাওয়া যায়, বা বাহির থেকে ভিতরে আসা যায়। একেবারে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা।
স্বৈরাচারের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই কৃষ্ণের কাম্য ছিল। দ্বারাবতীতে সেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করলেন তিনি। নাগরিকরা যাতে সুনাগরিক হতে পারে, অধিকার ভোগ করার সঙ্গে পালন করতে পারে নিজ নিজ কর্তব্য, তার ব্যবস্থা করেন তিনি। রাজকার্যের বিবিধ বিভাগও সুসজ্জিত করেন। নৃপতিপদে উগ্রসেনকে, মন্ত্রীপদে বিকদ্রুকে, পুরোহিতপদে কাশ্যপকে, প্রধান সেনাপতিপদে অনাধৃষ্টিকে, সারথীপদে দারুককে, সৈনাধ্যক্ষপদে সাত্যকি ও কৃতবর্মাকে নিয়োগ করা হল। যদুবংশের মোট আটটি শাখার দশজন প্রবীণকে নিয়ে গঠন করা হল মন্ত্রীমণ্ডলী। এসব করার সঙ্গে সঙ্গে দাদা বলরামের বিবাহেরও ব্যবস্থা করলেন কৃষ্ণ। রেবত জাতির কন্যা রেবতীর সঙ্গে বিবাহ হল বলরামের।
এর মধ্যে একদিন বিদর্ভের রাজপুরোহিত সুদেব হাজির হলেন দ্বারাবতীতে। বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিনীর এক গোপন পত্র তিনি নিয়ে এসেছেন কৃষ্ণের কাছে। রুক্মিনী জানিয়েছেন পুনর্বার তাঁর স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে তিনি অপমানিতা বোধ করছেন। কারণ প্রথম স্বয়ংবরসভাতেই তিনি কৃষ্ণকে পতিরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবার তাঁর ইচ্ছাকে মর্যাদা দেন নি। তাই সংকটকালে তিনি কৃষ্ণের শরণাপন্ন। কৃষ্ণ যদি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে তিনি আত্মঘাতিনী হবেন। অন্য কোন বিকল্প তাঁর নেই।
পত্রপাঠ করে কৃষ্ণ বিমূঢ় হলেন। এই মুহূর্তে বিবাহের কোন ইচ্ছা তাঁর নেই। ব্যক্তিগত সুখের জন্য তিনি তাঁর কর্তব্য বিসর্জন দিতে পারেন না। অন্যদিকে তিনি যদি প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে এক নিরপরাধা নারী প্রাণ বিসর্জন দেবেন। উভয় সংকট একেই বলে। কৃষ্ণ যদি রুক্মিনীকে হরণ করে নিয়ে আসেন, তাহলেও সৃষ্টি হবে নতুন সংঘর্ষ। যে শিশুপালের সঙ্গে রুক্মিনীর বিবাহের আয়োজন করা হয়েছে, সেই শিশুপাল জরাসন্ধের অনুগামী। দাদা বলরাম রুক্মিনীহরণের পক্ষেই মত দিলেন। এর ফলে জরাসন্ধ যদি আক্রমণ করেন, তাহলে বলরামই প্রতিরোধ করতে পারবেন।
রুক্মিনীর পত্রে হরণ পরিকল্পনার একটা সূত্র ছিল। তদনুযায়ী অগ্রসর হবেন বলে কৃষ্ণ বৃষ্ণিদের সঙ্গে বিদর্ভ নগরীতে উপস্থিত হলেন। পরদিন প্রভাতের অপেক্ষা করতে লাগলেন। প্রভাতে রুক্মিনী রথারোহিতা হয়ে মন্দির যাচ্ছেন দেখে কৃষ্ণ তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করলেন। পূজাপর্ব সমাপ্ত করে রুক্মিনী মন্দিরের বাহিরে এলে কৃষ্ণ তাঁকে হরণ করে তুলে নিলেন নিজের রথে। রাজরক্ষীদের প্রতিহত করতে লাগল বৃষ্ণিরা। সংবাদ শুনে দলবল নিয়ে হাজির হলেন জরাসন্ধ। বৃষ্ণিদের সঙ্গে তাঁর তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। বলরামের সুযোগ্য নেতৃত্বে পরাজিত হল জরাসন্ধের বাহিনী। বিদর্ভ রাজপুত্র রুক্মি কৃষ্ণের রথের পশ্চাদ্ধাবন করছিলেন। নর্মদা নদীতীরে কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলেন তিনি। রুক্মিনীর অনুরোধে কৃষ্ণ তাঁকে প্রাণভিক্ষা দিলেন। তবে শাস্তি হিসাবে বৃষ্ণির মস্তক মুণ্ডন করলেন।
দ্বারাবতীতে ঘটা করে কৃষ্ণ-রুক্মিনীর বিবাহ হল। রুক্মিনীর মনে আনন্দের প্লাবন। একজন বিবেচক, হৃদয়বান স্বামী লাভ করেছেন তিনি। তিনি ভেবেছিলেন যে কৃষ্ণের হৃদয়রাজ্যের অধিশ্বরী হবেন, হবেন কৃষ্ণের ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারলেন যে স্নেহ-প্রেমের আবেগ কৃষ্ণের যেমন আছে, তেমনি কঠোর তাঁর কর্তব্যজ্ঞান। কর্তব্য সাধনের জন্য কৃষ্ণ কখনও কখনও স্নেহ-প্রেমের আবেগকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এজন্য প্রথমদিকে রুক্মিনীর অভিমান হয়। সে অভিমানের কথা তিনি অবশ্য মুখ ফুটে বলেন নি কৃষ্ণের কাছে।
যাদব বংশের সত্রাজিৎ ছিলেন রত্নব্যবসায়ী। তাঁর কাছে ছিল এক দুর্লভ স্যমন্তক মণি। মণিটি যে মহামূল্যবান, সেকথা কৃষ্ণই বলেছিলেন তাঁকে। তাই সত্রাজিৎ মণিটিকে খুব যত্নে রাখেন। নিরাপত্তার কারণে মণিটি তিনি তাঁর ভ্রাতা প্রসেনজিতের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। প্রসেনজিৎ সে মণি তাঁর কণ্ঠহারে সংলগ্ন করে রাখতেন। একদিন ঋক্ষবান পর্বতাঞ্চলে মৃগয়া করতে গিয়ে তিনি নিহত হন এক সিংহের হাতে। সে অঞ্চলের অনার্য সর্দার জাম্ববান বনভ্রমণকালে প্রসেনজিতের মৃতদেহ ও তাঁর কণ্ঠহারসংলগ্ন স্যমন্তক মণি দেখতে পান এবং মণিটি হস্তগত করেন। সত্রাজিত কিন্তু সন্দেহ করেন যে মণিলোভাতুর হয়ে কৃষ্ণই প্রসেনজিতকে হত্যা করেছেন। সত্রাজিতের এই সন্দেহ লোকমুখে প্রচারিত হয়। কৃষ্ণ তখন অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কারণ এরপরে মানুষ তাঁর সমূহ কার্যকলাপ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবেন। ঐক্যবদ্ধ যাদবনগরী গঠনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হবে যাবে।
সন্দেহাপবাদ দূর করার পথসন্ধান করতে থাকেন কৃষ্ণ। নিজস্ব গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি প্রসেনজিতের মৃত্যুর কারণ অবগত হন। সে অঞ্চলের অনার্য সর্দার জাম্ববানের কথাও অবগত হন তিনি। তাঁর মনে হয়, মণিটি জাম্ববানের কাছে থাকতে পারে। কৃষ্ণ জাম্ববানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাম্ববান স্বীকার করেন যে মণিটি তাঁর কাছে আছে কিন্তু তা ফেরৎ দিতে অসম্মত হন তিনি। কৃষ্ণ যুদ্ধ পরিহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাম্ববান অনড় থাকায় যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে উঠল। যুদ্ধ আরম্ভ হবার পরে জাম্ববান বুঝতে পারলেন যে তাঁর পক্ষে জয়লাভ সম্ভব নয়। তখন তিনি একটি শর্তে মণিটি ফেরৎ দেবার কথা বললেন। শর্ত হল, কৃষ্ণকে তাঁর কন্যা জাম্ববতীকে বিবাহ করতে হবে। প্রথমে কৃষ্ণ এই শর্ত অনুমোদন করেন নি। তারপর তিনি ভাবলেন শর্তটি মেনে নিলে দুটি সমস্যার সমাধান হয়। প্রথমত, চৌর্যাপরাধ থেকে মুক্ত হবেন তিনি এবং তাঁর ভাবমূর্তি অমলিন থাকবে। দ্বিতীয়ত বন্ধ হবে অনর্থক রক্তক্ষয়। অতঃপর কৃষ্ণ মণিটি ফেরৎ দিলেন সত্রাজিতকে। তখন কৃষ্ণকে কালিমালিপ্ত করার জন্য অনুশোচনা করলেন সত্রাজিৎ এবং কৃষ্ণকেই উপহার দিলেন স্যমন্তক মণি। সেই সঙ্গে উপহার দিলেন আপন কন্যা সত্যভামাকে।
কিছুদিন পরের কথা। মর্মান্তিক একটা সংবাদ পাওয়া গেল। কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডব অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের বিদ্বেষপরায়ণ পুত্ররা যে পাণ্ডবদের অনিষ্ট করেন, সে কথা জানতেন কৃষ্ণ। কিন্তু তাই বলে তাঁরা যে পাণ্ডবদের প্রাণনাশে অকুণ্ঠিত, সেকথা তিনি ভাবতে পারেন নি। কী ভাবে পাণ্ডবদের হত্যা করা হয়েছে, সেকথা শুনলেন কৃষ্ণ। বারণাবতে এক জতুগৃহ নির্মাণ করেছিলেন কৌরবরা। লাক্ষা, গালা, ধূপ প্রভৃতি দাহ্যবস্তু দিয়ে সে গৃহ নির্মিত। কিন্তু বাহিরের দিক থেকে দেখলে তাকে এক সুরম্য বাসগৃহ বলে ভ্রম হয়। শিব চতুর্দশীর উৎসব উপলক্ষে সে গৃহে পাণ্ডবদের প্রেরণ করেন ধৃতরাষ্ট্র। সেখানে রাত্রিকালে পাণ্ডবরা নিদ্রিত হলে পূর্বপরিকল্পনামতো পুরোচন গৃহে অগ্নিসংযোগ করেন।
মর্মান্তিক সংবাদটি শুনলেন কৃষ্ণ। মর্মাহত হলেও তাঁর মনে সংশয় দেখা দিল। পাণ্ডবরা কী সত্যই নিহত হয়েছেন? বিদূর তো তাঁদের হিতার্থী, তিনি কী কৌরবদের পরিকল্পনা জানতে পারেন নি? আর জানলে কী কোন প্রতিবিধান করেন নি? কৃষ্ণ আবার তাঁর গুপ্তচরদের কাজে লাগালেন। অনতিবিলম্বে গুপ্তচরেরা প্রকৃত ঘটনার বিবরণ দিলেন।
দুর্যোধনের পরিকল্পনার কথা অবগত হয়ে বিদুর সেকথা পাণ্ডবদের জানান এবং সেখান থেকে সংগোপনে পলায়নের পরিকল্পনা করেন। তদনুযায়ী রাত্রিকালে পুরোচনকে একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখে গৃহে অগ্নিসংযোগ করে কুন্তীসহ পাণ্ডবরা গুপ্তপথ দিয়ে পলায়ন করেন। ঘটনাচক্রে এক ব্যাধ রমণী তাঁর পাঁচপুত্রকে নিয়ে জতুগৃহে অবস্থান করছিলেন। সেকথা অবগত ছিলেন না পাণ্ডবরা। তাঁরা অগ্নিদগ্ধ হন। পরদিন ছয়টি ভস্মীভূত দেখ দেখে কৌরবরা ভাবেন যে তাঁদের মনস্কামনা সিদ্ধ হয়েছে।
এদিকে পাণ্ডবরা ছদ্মবেশ ধারণ করে একচক্রপুরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখান থেকে তাঁরা যান এক কুম্ভকারের গৃহে। এসব শুনে আশ্বস্ত হন কৃষ্ণ। সেই পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর দেখা হল দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায়। নাটকীয়ভাবে। দ্রৌপদী হলেন পাঞ্চালরাজের কন্যা। দ্রুপদ নগরে কন্যার স্বয়ংবরসভার আয়োজন করেছেন তাঁর পিতা। স্বয়ংবরের শর্ত বড় কঠিন। মাটির উপর এক স্ফটিকপাত্রে থাকবে জল। ঠিক তার উপরে আছে ঘূর্ণায়মান চক্রের ভিতরে একটি মৎস্য। জলে তার ছায়া দেখে শর নিক্ষেপ করে মৎস্যটির চক্ষু বিদ্ধ করতে হবে। ধনুর্বিদ্যায় সবিশেষ পারদর্শী না হলে এ কাজ সম্ভব নয়। তাই কৃষ্ণের মনে হল স্বয়ংবরসভায় অর্জুন আসতে পারেন।
দাদা বলরাম ও কয়েকজন অনুচর নিয়ে কৃষ্ণ হাজির হলেন সভায়। সতর্কদৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। দুজন ব্রহ্মণকে দেখে সন্দেহ হল। এঁরাই কী ভীমার্জুন?
একে একে লক্ষ্যভেদের দিকে অগ্রসর হলেন সদস্যরা। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে ফিরে আসতে লাগলেন। লক্ষ্যভেদ করতে যাঁরা আসছিলেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁদের পরিচয় দিচ্ছিলেন। কর্ণ রঙ্গমঞ্চে আসতে সূতপুত্র হিসাবে তাঁর পরিচয় দিতে দ্রৌপদী বলে দিলেন সূতপুত্রের কণ্ঠে তিনি বরমাল্য দিতে পারবেন না। ক্ষত্রিয়রা আর কেউ অংশগ্রহণ করবেন না দেখে ডাক পড়ল ব্রাহ্মণদের। উঠে দাঁড়ালেন এক ব্রাহ্মণ। তাঁর জীর্ণ পোশাকের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। কৃষ্ণ মনে মনে বললেন, ইনিই অর্জুন। শর নিক্ষিপ্ত হল। বিদ্ধ হয়েছে মৎস্যের চক্ষু। তা দেখে রাজন্যবর্গ উত্তেজিত। দরিদ্র সেই ব্রাহ্মণের কণ্ঠে বরমাল্য দিচ্ছেন দ্রৌপদী।এটা মেনে নিতে পারলেন না রাজন্যবর্গ। তাঁরা বলপূর্বক হরণ করতে চান দ্রৌপদীকে। কৃষ্ণ তাঁদের শান্ত করলেন ধীরে ধীরে। বললেন, ব্রাহ্মণ অন্যায় কিছু করেন নি, নিয়মের পথেই তিনি রাজকন্যাকে জয় করেছেন, আশ্রয় নেন নি কোন ছল-চাতুরীর।
স্বয়ংবরসভা শেষ হল। বীর্যশুল্কে লব্ধা দ্রৌপদীকে নিয়ে চলে গেলেন অর্জুন। যাবার সময় কৃষ্ণের সঙ্গে চোখাচোখি হল । কী ছিল অর্জুনের দৃষ্টিতে! কৌতুক! কৃষ্ণ অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন। আরও নিশ্চিন্ত হতে চান তিনি। কৃষ্ণের দূত গোপনে জেনে এলেন যে পঞ্চপাণ্ডব আশ্রয় গ্রহণ করেছেন ভার্গবের গৃহে। বলরামকে নিয়ে কৃষ্ণ চলে গেলেন ভার্গবের গৃহে। দেখা হল পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে। কথা হল পিতৃস্বসা কুন্তীর সঙ্গে। কৃষ্ণ শুনলেন দ্রৌপদীকে নিয়ে দেখা দিয়েছে সমস্যা। বুঝলেন এক নারীকে নিয়ে পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে মনোমালিন্যের ছায়াপাত হতে পারে । সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় তাঁকে নির্ধারণ করতে হবে। তিনি আঞ্চলিক রীতির দোহাই দিলেন। এক পরিবারের একাধিক সহোদরের একই পত্নীর আঞ্চলিক রীতির কথা বললেন। সম্মত হলেন কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব।
হস্তিনাপুরে বিদুরের কছে এক দূত পাঠালেন কৃষ্ণ। পাণ্ডবদের বিবাহের কথা, কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁদের হস্তিনাপুরে আগমনের কথা শুনে বিদুর আনন্দিত হলেন। একথা ধৃতরাষ্ট্রকে জানাবার সময় বিদুর একটু চাতুর্য অবলম্বন করলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন যে জতুগৃহের ঘটনায় কৌরবরা প্রজাবর্গের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। নিজেদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ ধৃতরাষ্ট্রকে নিতে হবে। তিনি যদি কুন্তীসহ পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে এনে পুরুরাজ্যের অর্ধাংশের অধিকার দেন, তাহলে তাঁদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের কথার সারবত্তা অনুধাবন করে আলোচনার জন্য ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শকুনিদের ডেকে পাঠালেন। তাঁর বক্তব্যে তাঁর সন্তানরা অসন্তুষ্ট হলেও অন্য সকলে তা অনুমোদন করলেন। বিদুর কুন্তী ও পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন। দুর্যোধনরা হাস্তিনাপুর থাকলেন, পাণ্ডবরা পেলেন খাণ্ডবপ্রস্থের অধিকার।
খাণ্ডবপ্রস্থ ছিল এক বনাকীর্ণ অঞ্চল। কৃষ্ণের সহায়তায় অনতিবিলম্বে সেখানে গড়ে উঠল ইন্দ্রপ্রস্থ নগর। নগর বিস্তৃত করার জন্য বনাঞ্চল উচ্ছেদ করতে হল। ফলে বনবাসী নাগ পরিবারকে আশ্রয়চ্যুত হয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করতে হল। অসাবধানবশত অর্জুন সেই নাগ পরিবারের এক সদস্যকে হত্যা করলেন। একদিন ইন্দ্রপ্রস্থের এক ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে অভিযোগ করলেন খাণ্ডবনের এক অনার্য তাঁর গরু চুরি করে নিয়ে গেছে। ব্রাহ্মণের সঙ্গে অর্জুন চোরের সন্ধানে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন। সন্ধান পেলেন সেই চোরের। দেখলেন তার সঙ্গে আছে এক কিশোরী ও অপহৃত গাভীটি। অর্জুনের তিরে বিদ্ধ হয়ে অনার্যটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ভীত কিশোরী ঢুকে গেল গভীর অরণ্যে। গরু নিয়ে ব্রাহ্মণ চলে যাবার পরে অর্জুন সেই অনার্যের মুখে শুনলেন এক করুণ কাহিনি। নাম তাঁর চন্দ্রচূড়। ইন্দ্রপ্রস্থ নগর নির্মাণের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে তিনি গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একদিন তাঁর কন্যা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি পূর্বোক্ত ব্রাহ্মণের কাছে একটু দুধ ভিক্ষা করেন। কিন্তু তিনি অনার্যের আবেদনে সাড়া দেন নি। তখন বাধ্য হয়ে তিনি গাভী অপহরণ করেছেন। এটুকু বলার পরে অনার্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
এ কথা শুনে, বিশেষ করে অসহায়া কিশোরীর কথা ভেবে অর্জুনের গভীর অনুশোচনা হতে লাগল। তারপর থেকে অর্জুন সেই কিশোরীর অনুসন্ধান করে চলেছেন। দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে মনের অশান্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কিশোরী কন্যার ব্যাপারে অপরাধবোধ। কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, এ সবের জন্য অর্জুন এখন কেন্দ্রভ্রষ্ট। তাঁকে সমে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা লাভের প্রয়োজন আছে। তাহলেই তাঁরা তাঁদের রাজ্যের প্রশাসনিক কাজ ভালোভাবে করতে পারবেন। কৃষ্ণ বললেন অর্জুনই বিভিন্ন রাজ্য পরিভ্রমণ করবেন কতিপয় রক্ষী নিয়ে। যুধিষ্ঠির রাজ্যের নিরাপত্তার প্রশ্ন উথ্থাপন করলে কৃষ্ণ ভীমকে সে ভার গ্রহণ করতে বললেন। দ্রৌপদীও মনঃক্ষুণ্ণা হন। তিনি কৃষ্ণের অভিপ্রায় বুঝতে চাইছিলেন। তবে তাঁর এ বিশ্বাস ছিল যে কৃষ্ণ তাঁদের মঙ্গলকামী।
Related