Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,krishna-koth

কৃষ্ণকথা প্রথম তরঙ্গ

Reading Time: 9 minutes

[ আমাদের পুরাণগুলিতে, মহাভারতে, কৃষ্ণকথা আছে। রাধাকথা এসেছে আরও অনেক পরে। তবে কী কৃষ্ণ নিছক পৌরাণিক চরিত্র ? সম্পূর্ণ কাল্পনিক? আমার তা মনে হয় না। রামায়ণের উপর কাজ করতে গিয়ে আমার সে কথা মনে হয়েছে। ময়মনসিংহের গৌরব, ‘সৌরভ’ পত্রিকা সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারের ‘রামায়ণের সমাজ’ বইটি সম্পাদনা করতে গিয়ে সে দিকে আমার দৃষ্টি পড়ে। কলকাতার এডুকেশন ফোরাম আমার সে বই প্রকাশ করেছেন। কেদারনাথই বলেছেন, তিন/চার হাজার বছর আগে মানুষের মৌলিক কল্পনাশক্তি এত প্রখর ছিল না, যাতে পূর্ণাঙ্গ রামকাহিনি লেখা যায়। অন্যদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক শ্লীম্যান প্রমাণ করেছেন যে হোমারের লেখা মহাকাব্যের বস্তুভিত্তি আছে, যখন ট্রয়ের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল। নিরপেক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হলে রামকথা ও কৃষ্ণকথারও বস্তুভিত্তি পাওয়া যেত বলে আমাদের ধারণা। দুঃখের বিষয়, আমাদের গবেষণাক্ষেত্রেও ঢুকে গেল রাজনীতি; বাল্মীকির ‘পুরুষোত্তম রাম’ হয়ে গেলেন বিষ্ণুর অবতার, তারপর তিনি হয়ে গেলেন হিন্দুত্ব প্রচারের হাতিয়ার। কৃষ্ণকথাও একদিন রাজনীতির হাতিয়ার হবে। আমরা শুনেছি সমুদ্রগর্ভ থেকে দ্বারাবতীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। তারপরের কাজ আর এগোয় নি। যাঁরা রামচন্দ্রকে মানুষ হিসেবে দেখতে দেবেন না, তাঁরাই এরপরে কৃষ্ণকে নিয়ে পড়বেন, তাঁর মানবত্বকে আড়াল করে দেবত্ব প্রচার করবেন।

আমাদের এই কৃষ্ণকথায় আমরা মানুষ কৃষ্ণকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তাই পরে পরে গড়ে ওঠা নানা অলোকিক প্রসঙ্গের লৌকিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। ‘ইরাবতী’র পাঠকরা লেখাটি পড়ে মতামত দিলে খুব ভালো লাগবে। নিন্দা বা প্রশংসা নয়, আমি সমালোচনার ভক্ত বরাবর। ]


                         Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,krishna


মথুরার রাজা উগ্রসেন। তাঁর নয় পুত্র, পাঁচ কন্যা। কংস হলেন তাঁদেরই একজন। কংস অবশ্য অবৈধ সন্তান। উগ্রসেনের পত্নী প্রবণরেখার গর্ভে, দানব দ্রুমিলের ঔরসে কংসের জন্ম। তাই কংসের দানব-স্বভাব। আচার-আচরণে হিংস্রতা, উগ্রতা, নিষ্ঠুরতা। পিতা উগ্রসেন সে কারণে পছন্দ করতেন না তাঁকে। কংস সে কথা জানতেন। তিনিও ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়।

অবশেষে এলো সেই সুযোগ। পিতাকে বন্দি করে কংস করায়ত্ত করলেন ক্ষমতা। মথুরাপতি হলেন তিনি। মথুরায় নেমে এলো আতঙ্ক ও ত্রাস। অন্তরে-বাহিরে স্বৈরাচারী কংস প্রজাদের সুখ-দুঃখের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন।

মগধের রাজা জরাসন্ধ কংসের দিকে বাড়িয়ে দিলেন বন্ধুত্বের হাত। অকারণে নয়। এর পেছনে ছিল স্বার্থ। মথুরাকে করায়ত্ত করার অভিপ্রায় ছিল জরাসন্ধের। এতদিন বাধা ছিলেন উগ্রসেন। কংসের সঙ্গে তিনি শুধু বন্ধুত্বই করলেন না। সম্পর্কের বন্ধনেও জড়ালেন। তাঁর দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তির সঙ্গে বিয়ে দিলেন কংসের। প্রতাপশালী জরাসন্ধকে পেয়ে কংস আরও ক্ষমতামদমত্ত হয়ে উঠলেন।

মানুষের কণ্ঠরোধ করেছিলেন কংস। নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি। তাই নির্যাতিত মানুষের ক্ষোভ ধিকিধিকি করে জ্বলছিল তুষের আগুনের মতো। এঁদের মধ্যে ছিলেন মথুরার রাজপুরোহিত গর্গাচার্য, কংসের পারিষদ অক্রূর, শূরসেনের পুত্র বসুদেব। জ্যোতিষ গণনায় দক্ষ ছিলেন গর্গাচার্য। গণনার সাহায্যে তিনি অবগত হলেন বসুদেব-দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসকে নিধন করে মথুরাকে স্বৈরাচার থেকে মুক্ত করবেন।

বসুদেব বিবাহিত ছিলেন। তাই তিনি উগ্রসেনের ভ্রাতা দেবকের কন্যা দেবকীকে বিবাহ করতে সম্মত হন নি। গর্গাচার্যের সর্নিবন্ধ অনুরোধে তাঁকে সম্মত হতে হল। গর্গাচার্য ও বসুদেবের কথোপকথন কানে গিয়েছিল সূর্যদত্তের পুত্র চক্রায়ুধের। কংসের অত্যাচারের অবসান তাঁরও কাম্য ছিল।

দেবকীকে একটু বেশি ভালোবাসতেন কংস। তাঁর বিবাহের কথা শুনে কংস খুশি হলেন। খুশি হলেন আরও একটা কারণে, বসুদেব ছিলেন তাঁর বিরোধী। ভগ্নীর সঙ্গে এই বিবাহে সে বিরোধের অবসান ঘটবে। আনন্দিত কংস দেবকী-বসুদেবের রথের সারথি হলেন। রথ চালনা করতে করতে এক সময় তিনি শুনতে পেলেন অদ্ভুত এক কণ্ঠস্বর…. ‘দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে কংসের নিধন’…। কার কণ্ঠস্বর? কার? মানুষটিকে সনাক্ত করতে পারলেন না তিনি। আসলে সেটা ছিল চক্রায়ুধের স্বর। এই কণ্ঠস্বর শুনে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হলেন কংস। মুহূর্তেই তিরোহিত হল তাঁর ভগ্নীপ্রেম। দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন তিনি। স্বৈরাচারী মানুষরা আগাগোড়া স্বার্থপর। দেবকী-বসুদেব কংসের ভোলবদল দেখে হতচকিত। বসুদেব দেবকীর সন্তানদের কংসের হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে অস্ত্র সংবরণ করলেন কংস।

তারপর থেকে শুরু হল কংসের শিশুহত্যালীলা।

দেবকীর প্রথম সন্তান কীর্তিমান ভূমিষ্ঠ হবার পর সত্যসন্ধ বসুদেব তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কংসের কাছে। সাময়িকভাবে অভিভূত হয়ে কংস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কীর্তিমানকে। তারপরে নারদের কুমন্ত্রণায় কংস দেবকীর ঘরে গিয়ে হত্যা করে আসেন নবজাতককে। এভাবে একে একে দেবকীর ছয়পুত্র নিহত হল। দেবকীর সপ্তম গর্ভসঞ্চারের সময় বসুদেবের আর এক পত্নী রোহিণীরও গর্ভসঞ্চার হয়। কংসের হাত থেকে দেবকীর কোন সন্তানের রেহাই নেই, জানতেন বসুদেব। ক্রুদ্ধ কংস রোহিণীর সন্তানকেও হত্যা করতে পারেন, এই ভেবে বসুদেব রোহিণীকে বন্ধু নন্দ গোপের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। তখন  নন্দপত্নী যশোদাও সন্তানসম্ভবা ছিলেন। দেবকীর সপ্তমগর্ভের সন্তান পৃথিবীর আলো দেখল না। অসময়ে গর্ভপাত হল দেবকীর। দেখে গেলেন কংস।  এরপরে আসছে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান। বাজতে শুরু করেছে চরম বিপদঘন্টা। কোন ঝুঁকি নিতে চান না কংস। তিনি বসুদেব ও দেবকীকে প্রেরণ করলেন কারান্তরালে। কারাগারেও নিযুক্ত হল প্রহরীরা।

বসুদেবের শুভার্থীরা আলোচনায় বসেছেন। কিভাবে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানকে রক্ষা করা যাবে, সেই আলোচনা। এই সন্তানই যে মথুরার স্বৈরাচারের অবসান ঘটাবে। খাণ্ডবনিবাসী অনার্য সর্দার অনন্ত নাগ, বসুদেবের নবম ভ্রাতা শমীক, এবং গালবের সঙ্গে গোপনে আলোচনা হল গর্গাচার্যের। পরিকল্পনা ঠিক হল। অক্রূর কারারক্ষীদের একাংশকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে এলেন। নন্দগোপকেও জানানো হল সে কথা। ঠিক হল দেবকীর সন্তানকে তাঁরা কারাগৃহের বাইরে নিয়ে আসবেন, তার জায়গায় রেখে আসবেন যশোদার সন্তানকে। দুঃখভারাক্লান্ত দেবকীর জন্য আত্মত্যাগ করতে সম্মত হলেন নন্দ। এই আত্মত্যাগে যে দেশের পরম হিত হবে। যশোদাকেও সন্তান পরিবর্তনের কথা জানতে দেওয়া হবে না। দেবকীর সন্তানকে যশোদা নিজের সন্তান বলে জানবেন, দেবকীও জানবেন না এ সব কথা।

ভাদ্রমাসের অষ্টমী। পরবর্তীকালে এটাই কৃষ্ণাষ্টমী নামে পরিচিত হবে। ঘন মেঘে আচ্ছন্ন আকাশ। দুর্যোগের আভাস। সন্ধ্যার পর থেকে ঝড়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পেল। রাত্রি দুই প্রহরের সময় ভূমিষ্ঠ হল দেবকীর পুত্রসন্তান। অচৈতন্য হয়ে আছেন দেবকী। সেই সুযোগে বসুদেব নবজাতককে কোলে তুলে নিয়ে কারাগৃহের বাইরে এলেন। যেতে হবে যমুনানদীর অপর পারে গোকুলে। সেখানেই নন্দ ঘোষের বাড়ি। নদী পারাপারের ব্যবস্থা করা আছে। বৃষ্টি হচ্ছে। অনার্য সর্দার অনন্ত নাগ ছাতা ধরে আছেন। বসুদেব নন্দ ঘোষের বাড়ি গিয়ে আপন সন্তানকে অচৈতন্য যশোদার পাশে রেখে যশোদার কন্যা সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে চলে এলেন কারাগৃহে।

পরদিন প্রভাতে সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন কংস। দেখলেন কন্যাসন্তান। হোক কন্যাসন্তান, তবু সেও তো বিপদের কারণ হতে পারে। শত্রুর শেষ রাখা ঠিক নয়। সেই শিশুকন্যাকে শিলাপৃষ্ঠে নিক্ষেপ করে হত্যা করলেন কংস। তাঁর পাপীমনে একটা অন্য ধরনের বোধ জাগছিল। এটাই বসুদেব-দেবকীর সন্তান তো!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,janmashtami


গোকুলে নন্দের গৃহে বসুদেবের আর একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। দুই সন্তানের নামকরণের জন্য নন্দ অনুরোধ করলেন গর্গাচার্যকে। সন্তানদ্বয়ের কোষ্ঠিবিচার করে গর্গাচার্য রোহিণীর সন্তানের নাম দিলেন –বলরাম, আর দেবকীর সন্তানের নাম দিলেন কৃষ্ণ। স্নেহময় পরিবেশে মানুষ হতে লাগলেন কৃষ্ণ-বলরাম। দুজন হরিহর আত্মা। বাল্য বয়েস থেকে কৃষ্ণ তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। সরল বলরামও চালিত হন তাঁর দ্বারা।

হঠাৎ একটা দুর্বিপাক দেখা দিল গোকুলে। নেকড়ে বাঘের উপদ্রবে ত্রাহি ত্রাহি রব। নন্দ ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করলেন গ্রামবাসীরা। পাহাড়ের পাদদেশে বৃন্দাবনে বসতি স্থাপন করলেন তাঁরা। এখানে এসে কৃষ্ণ-বলরাম ছাড়পত্র পেলেন গোচারণের। শিশু বয়সে কৃষ্ণ বংশীবাদন শিখেছেন। সে বাঁশির সুর মোহিত করে মানুষকে। গরুগুলি আপনমনে বিচরণ করতে থাকে মাঠে। নতুন নতুন ক্রীড়া-কৌতুক উদ্ভাবনে জুড়ি নেই কৃষ্ণের। রাখালশিশুরা তাই কৃষ্ণানুরাগী। তাঁর শরীরের লাবণ্য ও ক্ষুরধার বুদ্ধির জন্য সবাই তাঁকে ‘রাখালরাজা’ বলে ডাকে।

গোচারণকালে রাখালসখাদের কৃষ্ণ অনেক বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। শৃগালসদৃশ যে প্রাণীটি গো-বৎসদের জলপানের বাধা হয়েছিল, তাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। অজগরজাতীয় এক সর্পের মুখবিবরে তিনি প্রবেশ করিয়ে দেন পাঁচনবাড়ি। ভবলীলা সাঙ্গ হয় তার। হিংস্রপ্রাণীদের বাধা কৌশলে ছিন্ন করে তালবন থেকে নিয়ে আসেন তাল। যে কালীয় নাগ কালীদহের জলে বিষ মিশ্রিত করত, তাকেও তিনি শিক্ষা দেন। গোপনারীদের শালীনতা শিক্ষা দেবার জন্য তিনি তাঁদের বস্ত্রহরণ করেন। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার উদ্ভাবনাতেও কৃষ্ণ দেন তাঁর দক্ষতার পরিচয়।

তাঁর আর এক খেলার নাম রাসনৃত্য। তাঁর চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়াবে গোপ বালক-বালিকা। তিনি বাঁশি বাজাতে শুরু করলে তারা শুরু করবে নাচ। তাঁর রূপ ও গুণে আবিষ্ট গোপ বালিকারা।  বৃষভাণুপুরের বৃষভাণুর কন্যা রাধা একদিন এলেন বৃন্দাবনের নন্দগ্রামে। তিনিও মোহিত হলেন কৃষ্ণকে দেখে। অংশগ্রহণ করলেন ঝুলন উৎসবে।

কৃষ্ণের এ সব সংবাদ গর্গাচার্য রাখতেন। কৃষ্ণের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, লোকসমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা গর্গাচার্যকে আশ্বস্ত করছিল। যৌবনে যে এই বালক বুদ্ধি ও বীরত্বে অসাধারণ হবেন, এ ব্যাপারে আর সন্দেহ ছিল না। ইতিমধ্যে কৃষ্ণ একটি অজগরজাতীয় সর্পের হাত থেকে রক্ষা করেছেন নন্দ ঘোষকে, গোপনারীদের রক্ষা করেছেন দস্যু শঙ্খচূড়ের হাত থেকে, বধ করেছেন অরিষ্ট আর  কেশীকে।

গর্গাচার্য ভাবলেন কৃষ্ণের সহজাত বুদ্ধি আর বীরত্বকে শান দেওয়া প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাদীক্ষার। বলরামের বয়স এগারো, আর কৃষ্ণের দশ। শিক্ষালাভের উপযুক্ত সময়। তাই তাঁদের কাশীতে পাঠাতে চাইলেন গর্গাচার্য।   বৃন্দাবন থেকে দূরে পাঠাবার আরও একটা কারণ ছিল। লোকমুখে কৃষ্ণের বীরত্বের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। কংসও জেনেছেন সে কথা। কংস যদি সন্দেহ করেন! গর্গাচার্য কংসের স্বভাব জানেন বলেই ভীত হন। তাই কংসের থেকে দূরে রাখতে হবে বালক কৃষ্ণ-বলরামকে। কৃষ্ণের মনকে প্রস্তুত করার জন্য গর্গাচার্য কৃষ্ণকেও বললেন কংসকাহিনি। বললেন মথুরাবাসী কংসের হাত থেকে মুক্তি চায়। কংসকে ধ্বংস করার ভার নিতে হবে কৃষ্ণ-বলরামকে। তাই শরীর ও মনকে সুগঠিত করতে হবে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে শুনে কৃষ্ণ-বলরাম উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন।

কাশীতে অঙ্গিরাবংশীয় ঘোর ঋষির আশ্রমে উঠলেন কৃষ্ণ-বলরাম। আশ্রমের নিয়ম-কানুনে অভ্যস্ত হতে লাগলেন ধীরে ধীরে। একদিকে পাঠানুশীলন, অন্যদিকে আশ্রমের নানা কাজ—যেমন যজ্ঞের কাঠ সংগ্রহ, যজ্ঞবেদী পরিচর্যা, শস্যাদি আনয়ন, গো-সেবা ইত্যাদি। তাঁদের নিষ্ঠায় গুরু অতীব সন্তুষ্ট হন। বিশেষ করে কৃষ্ণের মেধা ও স্মৃতিশক্তি বিস্ময়ান্বিত করে তাঁকে। সেখানে শাস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ করে কলাবিদ্যা ও শস্ত্রশিক্ষার জন্য দুইভাই এলেন অবন্তীপুরে। সান্দীপনি ঋষি পরমাদরে গ্রহণ করলেন তাঁদের। এখানে সুদামার সঙ্গে বন্ধুত্ব হল।

স্বল্পদিনে তাঁরা চৌষট্টি কলাবিদ্যা ও নানাবিধ শস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করে ফেললেন। বিদায়ের সময় গুরু- দক্ষিণা দেবার কথায় গুরু  তাঁর হৃতপুত্রের সন্ধান এনে দেবার কথা বললেন। কৃষ্ণ-বলরাম খোঁজ-খবর করে জানলেন যে পঞ্চজন নামক এক দস্যু গুরুপুত্রকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। প্রভাস ক্ষেত্রের নিকট সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে তাঁরা পঞ্চজনকে যুদ্ধে পরাস্ত করে উদ্ধার করলেন গুরুপুত্রকে।

গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে তাঁরা এলেন রৈবতকের পূর্বে সানুদেশে অবস্থিত ব্যাসদেবের নয়নাভিরাম  আশ্রমে। ঋষির কাছে তাঁরা জানতে চাইলেন বেদ অধ্যয়ন ও যজ্ঞাদি ধর্মের শেষ কথা কি না! ব্যাসদেব জানালেন পরহিতব্রত ও জীব সেবাই আসল ধর্ম। ফলের আকাঙ্খা না করে কর্ম সম্পাদন করে যেতে হবে মানুষকে।

শিক্ষা শেষ করে বলরামের সঙ্গে ঘরে ফিরলেন কৃষ্ণ। গর্গাচর্যের কথাগুলি তাঁর মনে আলোড়ন তোলে । কংস তাঁর মাতুল। রক্তের সম্পর্ক। অথচ কী নিষ্ঠুর তিনি। আপন ভগ্নীর ছয়-ছয়টি সন্তানকে হত্যা করেছেন তিনি। বসুদেব- দেবকীকে অন্ধকার কারায় আবদ্ধ করে রেখেছেন। তাঁর অত্যাচারে অবিরত অশ্রুজল ঝরে প্রজাদের। সেই স্বৈরাচারী মাতুলের বিনাশের দায়িত্ব নিতে হবে কৃষ্ণকে। নিতেই হবে সে দা্য়িত্ব। আর সেজন্য তৈরি করতে হবে সংঘশক্তি। মানুষকে, বিশেষ করে তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যে একা সে ক্ষুদ্র। ঐক্যই শক্তি। নানা দেশের নানা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন গর্গাচার্য। কৃষ্ণের মনে গেঁথে আছে সে সব কথা। উঠে পড়ে লাগলেন তিনি। অস্ত্রবিদ্যা শেখাতে লাগলেন তরুণদের। বলতে লাগলেন অন্যায় সহ্য করলে বৃদ্ধি পায় অন্যায়। তিনি দেখলেন তাঁর কথা ও কাজে উদ্দীপ্ত হচ্ছে তরুণরা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,krishna


তবু হতাশা মাঝে মাঝে গ্রাস করে কৃষ্ণকে। তিনি দেখতে পান বিকৃতির স্রোতে আবিল করে তোলা হচ্ছে বৃন্দাবনবাসীকে। এটা শাসকদের একটা কৌশল। পথের মধ্যে যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে পানশালা, সেখানে বাড়ছে ভিড়। পানোন্মত্ত মানুষের অশালীন আচরণ বিষিয়ে দিচ্ছে পরিবেশ। সেই সঙ্গে আছে অবাধ যৌনলীলার আয়োজন। মানুষ যেন মেরুদণ্ডহীন কামার্ত এক পশু।

হতাশার মধ্যে কখনও দেখা যায় আলোর রেখা। আলাপ হয় বাসুকির সঙ্গে। পাহাড়ের তলদেশে এক বৃক্ষের ছায়ায় বসে কৃষ্ণ দেশ ও দশের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন কৃষ্ণকায়, দৈত্যসদৃশ এক যুবককে। যুবকটি তাঁকে আক্রমণ করতে এসেছেন ভেবে কৃষ্ণ ধনুকে শর যোজনা করতে যুবকটি স্মিতহাস্যে তাঁকে নিরস্ত করলেন। যুবকটি জানালেন যে তিনি বাসুকি, অনন্ত নাগের পুত্র। সেই অনন্ত নাগ যিনি নবজাতক কৃষ্ণকে কারাগৃহ থেকে গোকুলে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন বসুদেবকে। কংস বাসুকিরও শত্রু। শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। তাই এখন থেকে বাসুকি কৃষ্ণের বন্ধু। বাসুকি জানালেন কংসকে আক্রমণ করার মাহেন্দ্রক্ষণ সমুপস্থিত। মথুরা সীমান্তে অশান্তির জন্য কংস এখন ব্যস্ত ও বিব্রত। তাই এটাই আক্রমণের সঠিক সময় । কিন্তু কৃষ্ণ আর একটু সময় চাইলেন। তাঁর তরুণ বাহিনী এখনও প্রস্তুত নয়।

এদিকে কংস সীমান্তে বিপদের কালো মেঘ দেখে ভীত। তার উপর একটা সন্দেহের কীট কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁর মন। কে এই কৃষ্ণ-বলরাম? কী তাঁদের সঠিক পরিচয়? বসুদেব মিথ্যে বলেন নি তো? অষ্টম গর্ভে দেবকীর কন্যাসন্তানই জন্মেছিল তো? মনের সন্দেহের সমাধান করতে হবে। কংস একটা পরিকল্পনা তৈরি করলেন। আগামী শিব চতুর্দশীতে তিনি আয়োজন করবেন এক ধর্নুযজ্ঞের। সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবেন নন্দ ঘোষ ও কৃষ্ণ-বলরামকে। কৃষ্ণের সঠিক পরিচয় পেলে কালবিলম্ব না করে তাঁর প্রাণসংহার করবেন। এ বিষয়ে অক্রূরের সঙ্গে আলোচনা করলেন তিনি। অক্রূরকে পাঠানো হল নন্দ ঘোষদের নিমন্ত্রণ করার জন্য। অক্রূর সংগোপনে কৃষ্ণকে জানালেন কংসের বিষাক্ত অভিপ্রায়ের কথা। দ্বিপ্রহরের পূর্বে কৃষ্ণকে মথুরায় উপস্থিত হয়ে কংসের সংবাহনকারিনী কুব্জার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পরামর্শ দিলেন। এই কুব্জাই দিতে পারেন যজ্ঞগৃহের গোপন পথের সন্ধান।

কৃষ্ণ তাঁর তরুণ বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে দিলেন তৎক্ষণাৎ। ছদ্মবেশে তাঁরা মথুরায় গিয়ে জেনে এলেন পথ-ঘাটের হদিশ। অতর্কিত আক্রমণে কিভাবে কংস ও তাঁর বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দিতে হবে, সেই পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হতে লাগলেন তাঁরা।

দ্বিপ্রহরের কিছু পূর্বে বলরামকে নিয়ে কৃষ্ণ হাজির হলেন মথুরায়। বলরাম তক্ষুণি আক্রমণ করতে চান কংসকে। কৃষ্ণ তাঁকে নিরস্ত করলেন। দুজনে এ সব কথা বলছিলেন, এমন সময়ে একটা শব্দে সচকিত হলেন কৃষ্ণ। শিবিকাবাহনের শব্দ। তার মানে কুব্জা আসছেন শিবিকায়। বলরামকে একটু অপেক্ষা করতে বলে কৃষ্ণ অনুসরণ করতে লাগলেন শিবিকাকে। কুব্জাও লক্ষ্য করছিলেন কৃষ্ণকে। অনুপম এই তরুণকে দেখামাত্র তাঁর হৃদয়ে স্নেহ-প্রেমের আলোড়ন শুরু হয়ে  গিয়েছিল কেন, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। মনে হচ্ছিল এ সম্পর্ক যেন জন্মান্তরীণ।

শিবিকা থামল কুব্জার গৃহদ্বারে। কৃষ্ণও কুব্জার কাছে এলেন। প্রথমে বিরক্তির ছলনা করলেও কুব্জা কৃষ্ণকে বলে দিলেন ষজ্ঞগৃহের গোপন পথ। জানিয়ে দিলেন কংসের ফাঁদের কথা। কৃষ্ণকে সতর্ক থাকতে বলে দিলেন তিনি।

বাইরে এসে কৃষ্ণ মিলিত হলেন বলরাম, শ্রীদাম, উদ্ভব ও বাসুকির সঙ্গে। আক্রমণের কৌশল ঠিক করে নিলেন। বাসুকি আর তাঁর সৈন্যদল ঘিরে থাকবেন যজ্ঞমঞ্চ। বাহির থেকে কংসের সৈন্যরা আক্রমণ করলে বাসুকি তাঁদের প্রতিহত করবেন। কৃষ্ণ-বলরাম প্রবেশ করবেন যজ্ঞগৃহের ভিতরে।

তখন যজ্ঞের আয়োজন করছিলেন পুরোহিত। মঞ্চে প্রবেশ করলেন কৃষ্ণ-বলরাম। প্রহরীরা বাধা দিতে গেলে কৃষ্ণ তাদের নিরস্ত করলেন। তারপর বেদি থেকে ধনুক তুলে তাতে গুণ পরাবার চেষ্টা করলেন। ভেঙে গেল ধনুক। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দর্শকবৃন্দ। কে এই শক্তিমান  সুদর্শন তরুণ! একটু দূরে বসেছিলেন কংস। তাঁর কানে খবর যেতে চঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি। মিলেছে তাঁর সন্দেহ। এই তরুণই দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান। বসুদেব-দেবকী প্রতারণা করেছেন তাঁর সঙ্গে। শাস্তি দিতে হবে তাঁদের। তার আগে কৃষ্ণের বিষ দাঁত ভেঙে দিতে হবে। কংস প্রহরীকে ডেকে সেনাপতিদের প্রস্তুত হবার আদেশ দিলেন। কিন্তু প্রহরী বাইরে যাবেন কী করে! বিক্রমশালী নাগসেনারা যে পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে! প্রমাদ গুণলেন কংস। এমনি সময়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন কৃষ্ণ। সাহায্যের জন্য চিৎকার করছেন কংস, কিন্ত এগিয়ে আসছে না কেউ। কৃষ্ণ ভূপাতিত করলেন কংসকে। তাঁর বজ্রমুষ্টিতে কংসের প্রাণবায়ু নির্গত হল। কংসের অনুজ সুনামা নিহত হলেন বলরামের হাতে। অবসান হল মথুরার স্বৈরাচারী শাসনের। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন নির্যাতিত মানুষ। আনন্দের প্লাবন বয়ে যেতে লাগল দেশে। দেবকী-বসুদেবের সঙ্গে মিলিত হলেন কৃষ্ণ-বলরাম।

তারপর উগ্রসেনকে কারাগৃহ থেকে মুক্ত করে তাঁর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন কৃষ্ণ। মথুরাবাসীকে জানিয়ে দিলেন, তিনি অন্যায়কে প্রতিরোধ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তিনি, স্বৈরতন্ত্র থেকে তিনি মথুরাকে গণপ্রজাতন্ত্রে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন। তাঁর নিজের কোন রাজ্য লোভ নেই। কৃষ্ণের মহানুভবতা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হল মানুষ।

[ক্রমশ]

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>