| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

কৃষ্ণকথা দ্বিতীয় তরঙ্গ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

[ আমাদের পুরাণগুলিতে, মহাভারতে, কৃষ্ণকথা আছে। রাধাকথা এসেছে আরও অনেক পরে। তবে কী কৃষ্ণ নিছক পৌরাণিক চরিত্র ? সম্পূর্ণ কাল্পনিক? আমার তা মনে হয় না। রামায়ণের উপর কাজ করতে গিয়ে আমার সে কথা মনে হয়েছে। ময়মনসিংহের গৌরব, ‘সৌরভ’ পত্রিকা সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারের ‘রামায়ণের সমাজ’ বইটি সম্পাদনা করতে গিয়ে সে দিকে আমার দৃষ্টি পড়ে। কলকাতার এডুকেশন ফোরাম আমার সে বই প্রকাশ করেছেন। কেদারনাথই বলেছেন, তিন/চার হাজার বছর আগে মানুষের মৌলিক কল্পনাশক্তি এত প্রখর ছিল না, যাতে পূর্ণাঙ্গ রামকাহিনি লেখা যায়। অন্যদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক শ্লীম্যান প্রমাণ করেছেন যে হোমারের লেখা মহাকাব্যের বস্তুভিত্তি আছে, যখন ট্রয়ের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল। নিরপেক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হলে রামকথা ও কৃষ্ণকথারও বস্তুভিত্তি পাওয়া যেত বলে আমাদের ধারণা। দুঃখের বিষয়, আমাদের গবেষণাক্ষেত্রেও ঢুকে গেল রাজনীতি; বাল্মীকির ‘পুরুষোত্তম রাম’ হয়ে গেলেন বিষ্ণুর অবতার, তারপর তিনি হয়ে গেলেন হিন্দুত্ব প্রচারের হাতিয়ার। কৃষ্ণকথাও একদিন রাজনীতির হাতিয়ার হবে। আমরা শুনেছি সমুদ্রগর্ভ থেকে দ্বারাবতীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। তারপরের কাজ আর এগোয় নি। যাঁরা রামচন্দ্রকে মানুষ হিসেবে দেখতে দেবেন না, তাঁরাই এরপরে কৃষ্ণকে নিয়ে পড়বেন, তাঁর মানবত্বকে আড়াল করে দেবত্ব প্রচার করবেন।

আমাদের এই কৃষ্ণকথায় আমরা মানুষ কৃষ্ণকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। তাই পরে পরে গড়ে ওঠা নানা অলোকিক প্রসঙ্গের লৌকিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। ‘ইরাবতী’র পাঠকরা লেখাটি পড়ে মতামত দিলে খুব ভালো লাগবে। নিন্দা বা প্রশংসা নয়, আমি সমালোচনার ভক্ত বরাবর। ]


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,krishna

কংস নিধনের পরে মথুরার রাজসিংহাসনে আবার বসেছেন উগ্রসেন। রাজসভায় উপস্থিত আছেন কৃতবর্মা, উদ্ভব, সাত্যকি, কঙ্ক, বিদূরথ, অক্রূর, বসুদেব, দেবক, গর্গাচার্য প্রভৃতি। উগ্রসেনকে অভিনন্দন জানিয়ে কৃষ্ণ কয়েকটি গুরু দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। কংসের অত্যাচারে যাঁরা মথুরা ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করে তুলতে হবে দেশকে, অধিকার ভোগের সঙ্গে জনগণকে দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে।

এরপরে আছে দেশরক্ষার প্রশ্ন। কংসের আহ্বানে মগধরাজের বিশাল বাহিনী এসেছে মথুরায়। বিশাল তাদের ব্যয়ভার। মথুরার পক্ষে তা বহন করা অসম্ভব। তাই সে বাহিনীকে ফিরে যেতে বলতে হবে। এর ফল খারাপ হতে পারে। মগধরাজ জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করতে পারেন। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলির সঙ্গে স্থাপন করতে হবে প্রীতির সম্পর্ক।

কৃষ্ণ প্রয়াত কংসের পারলৌকিক ক্রিয়ার কথাও বললেন। কংস তাঁর শত্রু হতে পারেন কিন্তু তিনি ছিলেন মথুরার রাজা। তাই তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া রাজকীয় মর্যাদায় করতে হবে।

এর মধ্যে নন্দ ঘোষ একদিন আকুল হয়ে কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন। যশোদার কথা ভেবেই বলেছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ বিনম্রভাবে জানালেন যে তাঁর পক্ষে এখন বৃন্দাবনে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অচল মথুরাকে সচল করার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। স্বেচ্ছায়। সে কাজ সবে শুরু হয়েছে। পুত্রের যুক্তি অস্বীকার করতে পারলেন না নন্দ। বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায় নিলেন মথুরা থেকে।

কৃষ্ণ-বলরামের উপনয়নের তোড়জোড় শুরু হল। এই অনুষ্ঠানে হস্তিনাপুর থেকে পিতৃস্বসা কুন্তীকে নিয়ে আসার কথা বিশেষভাবে বলে দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। কুন্তীর জন্য তাঁর বিশেষ মনোবেদনা আছে। বাল্যে কুন্তী পিতা-মাতার স্নেহচ্ছায়ায় মানুষ হতে পারেন নি। দিনাতিপাত করেছেন ভোজগৃহে। কুমারীকালে এক পুত্রের জন্ম দিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। তারপরে হস্তিনাপুরের যুবরাজ পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ। রোগগ্রস্ত পাণ্ডু স্বামীধর্ম পালনে অসমর্থ। এই স্বামীর নির্দেশে তাঁকে তিন ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্ম দিতে হল। এখানেই শেষ নয়। পাণ্ডুর আর এক পত্নী মাদ্রী স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হলে তাঁর দুই পুত্রেরও ভার নিতে হল তাঁকে। পিতৃস্বসা কুন্তী এখন কেমন আছেন, সে কথা জানতে চান কৃষ্ণ।

কিন্তু তিনি কুন্তীর মুখে যা শুনলেন, তাতে তাঁর দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পেল। হস্তিনাপুরের কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র। তিনি অন্ধ। অন্ধ তিনি অন্তরে বাহিরে। আপন পুত্রদের অবিচার-অত্যাচার সম্বন্ধে তিনি নির্বিকার।  সেই পুত্ররা পাণ্ডবদের নানাভাবে ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করেন।  বলশালী ভীমসেনকে তাঁরা বিষপ্রয়োগে হত্যা করারও চেষ্টা করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র কোন প্রতিবাদ করেন নি। এ সব কাহিনি শুনে কৃষ্ণ চিন্তিত ও বেদনার্ত হলেন। প্রতিকারের কথা ভাবতে লাগলেন। পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক। বিশেষ করে সমবয়েসী অর্জুনের সঙ্গে।

এদিকে দেখতে দেখতে দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠল মথুরার আকাশে। কংসের দুই পত্নী, জরাসন্ধের দুই কন্যা, স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণে চঞ্চল। তাঁরা তাঁদের পিতা জরাসন্ধকে উত্তেজিত করে তুলেছেন। জরাসন্ধও কৃষ্ণ-বলরামকে সহ্য করতে পারেন না। মথুরাকে এঁরাই রক্ষা করছেন। বিপুল সৈন্য নিয়ে জরাসন্ধ আক্রমণ করলেন মথুরা। কৃষ্ণের যাদবসৈন্যরা সংখ্যায় স্বল্প, কিন্তু তাঁদের ছিল দেশপ্রেমিক আবেগ। জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে যাদবসৈন্যরা সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। দেখতে দেখতে কেটে গেল আঠারো দিন। খাদ্যাভাব দেখা দিল মথুরায়। বাসুকি তাঁর অনার্য সেনা নিয়ে মথুরা ত্যাগ করলেন।

এভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাতে মথুরার ক্ষতি হবে। জরাসন্ধের আসল লক্ষ্য তো কৃষ্ণ-বলরাম। তাই তাঁরা মথুরা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। কৃষ্ণ-বলরামের মথুরা ত্যাগের ফলে হতচকিত হলেন জরাসন্ধ। যুদ্ধ তো শুধু অস্ত্রে হয় না। বুদ্ধিতেও হয়। কৃষ্ণের বুদ্ধির কাছে হেরে গেলেন জরাসন্ধ।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,krishna

মথুরা ত্যাগ করে তিন দিন অশ্বচালনার পরে কৃষ্ণ-বলরাম উপস্থিত হলেন সহ্যাদ্রির পূর্ব সীমান্তে পর্বতের পাদদেশে। সেখানে তাঁরা দেখলেন এক জ্যোতির্ময় তাপসকে। বৃক্ষচ্ছায়ায় ধ্যানমগ্ন সেই তাপস । তাঁর ধ্যানভঙ্গের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন কৃষ্ণ-বলরাম।

এই তাপস হলেন পরশুরাম। ক্ষত্রিয়নিধনের জন্য তিনি ভুবনবিখ্যাত। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তিনি একবিংশতিবার ক্ষত্রিয়নিধন করেন। ধ্যানভঙ্গ হবার পরে কৃষ্ণ-বলরাম তাঁকে তাঁদের পরিচয় দিয়ে জরাসন্ধের কথা বললেন। পরশুরাম তাঁদের জানালেন যে এ স্থান তাঁদের পক্ষে নিরাপদ নয়। জরাসন্ধ আক্রমণ করলে এখানকার করবীরপুরের নৃপতি তাঁদের সাহায্য করবেন না, তাই এ স্থান ত্যাগ করে তাঁদের নিরাপদ স্থানে যেতে হবে।

সহ্যাদ্রির পাশ্ববর্তী গোমন্তক পর্বত নিরাপদ স্থান। বেনানদী অতিক্রম করে তাঁরা উপনীত হলেন যজ্ঞগিরিতে। তারপরে খট্টাঙ্গনদী অতিক্রম করে এলেন গোমন্তক পর্বতে। নানাবিধ বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণীশোভিত সে পর্বত বড় মনোরম। সেখানে কুটির নির্মাণ করে তাঁরা তিনজন বাস করতে লাগলেন। ইত্যবসরে পরশুরামের কাছে শিখতে লাগলেন যুদ্ধকৌশল।

জরাসন্ধ তাঁদের অনুসরণ করছিলেন। অনুসরণ করতে করতে তিনি এসে পড়লেন সেই পর্বত পাদদেশে, যেখানে কৃষ্ণ-বলরাম মিলিত হয়েছিলেন পরশুরামের সঙ্গে। কৃষ্ণ-বলরামের অশ্বদুটি দেখে জরাসন্ধ অনুমান করলেন পার্শ্ববর্তী কোন পর্বতশৃঙ্গে  তাঁরা  আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। জরাসন্ধের নির্দেশে তাঁর সৈন্যরা কৃষ্ণ-বলরামের সন্ধান শুরু করলেন।

কৃষ্ণ-বলরাম লক্ষ্য করলেন জরাসন্ধের সৈন্যরা গোমন্তক পর্বতে আরোহন করার চেষ্টা করছেন। তখন তাঁদের বাধা দেবার জন্য উপর থেকে শিলাখণ্ড গড়িয়ে ফেলা হল। এতে বহু সৈন্য নিহত হলেন। চেদিরাজ দমঘোষের পরামর্শে গোমন্তক পর্বতের চতুর্দিকে অগ্নি প্রজ্বলিত করে কৃষ্ণদের জব্দ করার চেষ্টা হল। পরশুরাম কৃষ্ণকে ধৈর্য ধরতে বললেন। কারণ অনতিবিলম্বে বারিপাতের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরে আকাশে মেঘের সঞ্চার হল । দেখতে দেখতে সে মেঘ ঘনীভূত হল। তারপর বিদ্যুতের ঝলক, মেঘের গর্জন। শেষে বর্ষণ। আকাশ ভাঙা জলে ভেসে যেতে লাগল চারদিক। জলের তোড়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল বড় বড়  শিলাখণ্ড। সারারাত চলল সে প্রলয়। পরদিন প্রভাতে দেখা গেল জরাসন্ধের বহু সৈন্যের  মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে পর্বতগাত্রে, তার পাদদেশে। প্রাণভয়ে অবশিষ্ট সৈন্য পলায়ন করেছে। কৃষ্ণ বুঝতে পারেন নি যে স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে চেদিরাজ পর্বতের পাদদেশে তাঁরই প্রতীক্ষায় ছিলেন।

কৃষ্ণ অবতরণ করতেই চেদিরাজ দমঘোষ বিনীতভাবে এগিয়ে এলেন তাঁর দিকে। প্রথমে অবাক হলেও নিজেকে সংযত করে নিলেন কৃষ্ণ। আসলে দমঘোষ একটা কৌশল অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণের পিতৃস্বসা শ্রুতশ্রবার স্বামী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি জানালেন যে জরাসন্ধের সঙ্গে যোগ দিয়ে ভুল করেছিলেন তিনি। জরাসন্ধের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাঁকে তিনি বর্জন করেছেন। দমঘোষের ছলনা সহজেই বোঝা যায়। বলরাম তখুনি তাঁকে শাস্তি দিতে চান। কৌশলী কৃষ্ণ তাঁকে নিবৃত্ত করেন। দমঘোষ ভাবলেন কৃষ্ণ তাঁর ফাঁদে পা দিয়েছেন। তখন ভালোমানুষের মতো তিনি জানালেন যে  কৃষ্ণদের জন্য আশ্রয় ঠিক করে রেখেছেন তিনি। যাদব বংশের শৃগাল-বাসুদেবের করবীরপুরে কৃষ্ণদের নিয়ে যাবেন তিনি। শৃগাল-বাসুদেবের পরিচয় কৃষ্ণ পেয়েছিলেন পরশুরামের কাছে। তবু তিনি ঝুঁকি নিলেন। করবীরপুরে তাঁরা পা দিতেই শৃগাল-বাসুদেব আক্রমণ করলেন তাঁদের। কিন্তু কৃষ্ণের রুদ্ররূপের কাছে তিনি পরাস্ত হলেন। রাজার মৃত্যুসংবাদে হাহাকার পড়ল অন্তঃপুরে। ছুটে এলেন রানি পদ্মাবতী। তিনি ভেবেছিলেন তখনকার প্রথানুযায়ী কৃষ্ণ তাঁদের সব সম্পদ দাবি করবেন। তিনি তাই তাঁর ও তাঁর শিশুপুত্রের জীবনভিক্ষা প্রার্থনা করলেন।

রানির কথা শুনে কৃষ্ণ বিনীতভাবে যা বললেন, তা শুনে রানি হতবাক। কোন বিজয়ী মানুষের মুখে এ কথা শোনা যায় না। হিংস্রতার কোন ছাপ নেই কৃষ্ণের মুখে। স্মিতমুখে কৃষ্ণ রানিকে বললেন যে রাজ্যাধিকারের কোন দুরভিসন্ধি তাঁর নেই। তিনি শুধু নৃপতি শৃগালের অপরাধের শাস্তি দিয়েছেন। পররাজ্যগ্রাসের নীতিকে ঘৃণা করেন কৃষ্ণ । করবীরপুর রাজ্য তিনি শৃগালপুত্র শত্রুদেবের হস্তে সমর্পণ করলেন। তিনি জানালেন নৃপতি শৃগালের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও রাজকীয় মর্যাদায় হবে।

পরদিন বিদায় নিলেন কৃষ্ণ-বলরাম। প্রচুর উপঢৌকন দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু রথ ও সামান্য কিছু ব্যবহায্য সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নিতে সম্মত হলেন না কৃষ্ণ।

করবীরপুর থেকে তাঁরা এলেন সুর্পারকে। পরশুরামের সন্ধানে। কিন্তু সেখানে তাঁকে পাওয়া গেল না। তখনওদমঘোষ তঁদের সঙ্গ ত্যাগ করেন নি। শৃগাল-বাসুদেবের উপর ছদ্মক্রোধ বর্ষণ করে তিনি কৃষ্ণদের মথুরায় নিয়ে যেতে চাইছিলেন। তখন মথুরা অবরোধ করে রেখেছিলেন তাঁর পুত্র শিশুপাল। সেখানে গেলে বাগে পাওয়া যেত কৃষ্ণকে। এবার কৃষ্ণ দমঘোষের ফাঁদে পা দিলেন না।

জরাসন্ধের অতর্কিত আক্রমণের বিপদ ছিল। তাই কৃষ্ণ যাদবদের নিয়ে এমন এক স্থানে বসতি গড়ে তুলতে চাইছিলেন, যার নাগাল জরাসন্ধ বা তাঁর পক্ষের নৃপতিরা পাবেন না সহজে। সে স্থান হবে প্রকৃতিগতভাবে সুরক্ষিত। রৈবতক পর্বতের পশ্চিমদিকে সমুদ্রতীরবর্তী কুশস্থলিতে এসে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলেন কৃষ্ণ। কুশস্থলীর পশ্চিমে সাগরবেষ্টিত একটি নতুন দ্বীপের সন্ধান পাওয়া গেল। দ্বারাবতী তার নাম। দ্বীপটি দ্বাদশ ক্রোশ দীর্ঘ, দশ ক্রোশ প্রস্থ। স্বল্পসংখ্যক অনার্য মানুষ বাস করে সেই দ্বীপে। তাঁরা দরিদ্র কিন্তু সৎ ও বিশ্বাসী । কৃষ্ণ-বলরামকে দেখে তাঁরা ভীত হলেন। ভাবলেন বোধহয় তাঁরা তাঁদের বাস্তুচ্যুত করতে এসেছেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁদের আশ্বাস দিলেন। বললেন এই দ্বীপ ত্যাগ করে কোথাও তাঁদের যেতে হবে না। এখানে নগর নির্মাণ হলে তাঁদের জীবিকার সুরাহা হবে।

দ্বারাবতী হবে যাদব নগরী। নগর নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থপতি প্রয়োজন। বিশ্বকর্মার কথা মনে পড়ল কৃষ্ণের। তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁর কথাশুনে সংশয় দেখা দিল বিশ্বকর্মার মনে। পরিকল্পনামাফিক নগর নির্মাণের ব্যয়ভার বিপুল। সেই ব্যয়ভার কী বহন করতে পারবেন এই যুবক! সে কথা অনুধাবন করে কৃষ্ণ বিশ্বকর্মাকে তাঁর মূল্যবান রত্নখচিত রথটি দেখালেন। তখন আশ্বস্ত হলেন বিশ্বকর্মা।

বহুদিন দ্বারাবতীতে পড়ে আছেন কৃষ্ণ । তাঁর জন্য চিন্তিত বসুদেব, গর্গাচার্য, উগ্রসেন প্রমুখেরা। কৃষ্ণকে মথুরায় আনার জন্য তাঁরা দূত পাঠালেন। সৌরাষ্ট্রে সেই দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল কৃষ্ণের। মথুরায় যাবার জন্য তিনিও উৎকণ্ঠিত। বলরামকে দ্বারাবতীর দায়িত্ব দিয়ে কৃষ্ণ এলেন মথুরায়। রাজভবনে বাসের জন্য তাঁকে অনুরোধ করলেন উগ্রসেন। কিন্তু কৃষ্ণ সে অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে পিতা বসুদেবের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

দ্বারাবতীর নতুন উপনিবেশের কথা কৃষ্ণ জানালেন তাঁদের। নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে তিনি তাঁদের নিয়ে যাবেন দ্বারাবতীতে। দেখানে নিশ্চিন্তভাবে বসবাস করতে পারবেন। জরাসন্ধের আক্রমণের ভীতিতে প্রহর গণনা করতে হবে না।

মথুরায় থাকাকালীন কৃষ্ণ সংবাদ পেলেন বিদর্ভের রাজধানী কুণ্ডিন নগরে রাজকন্যা রুক্মিনীর স্বয়ংবরসভার আয়োজন করে হয়েছে। অথচ মথুরাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের সঙ্গে মথুরার সৌহার্দ্য থাকা সত্ত্বেও কেন এটা হল? মথুরার পক্ষে ব্যাপারটা অবমাননাকর। এ অবমাননা মেনে নেওয়া যায় না।

কারণটা জানার জন্য কৃষ্ণ এলেন কুণ্ডিন নগরে। ভীষ্মক ও তাঁর দুই ভ্রাতা সবিনয়ে জানালেন যে এর জন্য তাঁরা দায়ী নন। দায়ী হলেন ভীষ্মকপুত্র রুক্মি। স্বয়ংবরসভা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন ভীষ্মক। এতে আমন্ত্রিত রাজন্যবর্গের সঙ্গে রুষ্ট হলেন রুক্মি। রুক্মির প্রশ্ন : কৃষ্ণ রাজা নন, কেন তাঁদের আমন্ত্রণ করা হবে? রাজকন্যা রুক্মিনী কিন্তু ঠিক করলেন যে তিনি কৃষ্ণকেই বরণ করে নেবেন পতিরূপে।

জরাসন্ধের কাছে এ সংবাদ যেতে তিনিও রুষ্ট হলেন। তিনি কৃষ্ণবধের উপায় চিন্তা করতে লাগলেন। করুষাধিপতি দন্তবক্র  কৃষ্ণনিধনের ব্যাপারে অনার্য কালযবনের সাহায্য গ্রহণের প্রস্তাব দিলে জরাসন্ধ দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। কিন্তু সৌভপতি শাল্ব ও অন্যান্য নৃপতিরা প্রস্তাবটি অনুমোদন করায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও জরাসন্ধকে সম্মত হতে হল।

কুণ্ডিন ত্যাগ করার পূর্বে কৃষ্ণ কিছু গুপ্তচর রেখে গিয়েছিলেন সেখানে। তাঁদের কাছ থেকে তিনি শুনতে পেলেন কালযবনের মথুরা আক্রমণের পরিকল্পনা। তিনিও পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করে দিলেন। গর্গাচার্য, উগ্রসেন, নন্দ, বসুদেবসহ প্রজাদের তিনি পাঠিয়ে দিলেন দ্বারাবতীতে। বলরাম চলে এলেন মথুরায়।

কৃষ্ণ যুদ্ধ পরিহার করার পক্ষপাতী। যুদ্ধের অর্থ প্রাণনাশ ও রক্তক্ষয়। নিরুপায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি যুদ্ধকে পরিহার করে চলতে চান। কালযবনের সঙ্গে যুদ্ধ পরিহার করার জন্য তিনি অবলম্বন করলেন এক কৌশল। একটি কুম্ভে বিষধর সর্প রেখে সেটি দূতের মাধ্যমে প্রেরণ করলেন কালযবনের কাছে। সেই কুম্ভ উন্মোচন করার পরে কালযবন বিষধর সর্প দেখে বুঝতে পারবেন কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধের ফল কী হবে। তখন তিনি বিরত হবেন যুদ্ধ থেকে। কিন্তু কালযবন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি সেই কুম্ভে মাংসভূক পিপীলিকা স্থাপন করে কৃষ্ণের কাছে প্রেরণ করলেন। কৃষ্ণ কুম্ভ উন্মুক্ত করে সর্পের কঙ্কাল দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন যুদ্ধ থেকে কালযবনকে বিরত করা যাবে না।

তখন কৃষ্ণ যুদ্ধকৌশল ঠিক করতে লাগলেন। ছদ্মবেশ ধারণ করে কিছু যাদবসৈন্য কালযবনের সৈন্যদের মধ্যে মিশে গেল। সেখানে তারা সৃষ্টি করতে লাগল নানা বিশৃঙ্খলা। কৃষ্ণ কালযবনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। কৃষ্ণকে করায়ত্ত করার জন্য কালযবন যত অগ্রসর হন, ততই কৃষ্ণ পিছু হটতে থাকেন। কালযবন ভাবলেন ভীত হয়ে কৃষ্ণ পিছু হটছেন। কালযবন তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করছেন। এভাবে কৃষ্ণ চলে এলেন গোবর্ধন পর্বতে। এ পর্বত তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। কৃষ্ণ ঢুকে গেলেন একটা গুহায়। কালষবনও তাঁকে অনুসরণ করে গুহায় ঢুকলেন। কৃষ্ণ অন্যদিক দিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গুহার দুই মুখ পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিলেন।

কৃষ্ণকে একা ফিরে আসতে দেখে কালষবনের সৈন্যরা হতবাক। যখন তাঁরা জানতে পারলেন কালযবনের পরিণামের কথা, তখন ভীত হয়ে পলা্য়ন করলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে।

যুদ্ধব্যতীত যুদ্ধজয় হল।

 [ক্রমশ]

                                 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত