| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

অমর মিত্র সংখ্যা: পাঠ প্রতিক্রিয়া: কৃষ্ণগহ্বর । বিশ্বজিৎ পাণ্ডা 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিজ্ঞান প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কার আমাদের জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটাচ্ছে। উন্নতি ঘটাচ্ছে সভ্যতার। এই উন্নয়ন—উন্নতি—প্রযুক্তির অগ্রগতির অনিবার্য প্রভাবে ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রকৃতি-পরিবেশ। অমর মিত্র এই বিপন্নতার একটি স্বরূপ উন্মোচন করেছেন তাঁর ‘কৃষ্ণগহ্বর’ (১৯৯৮) উপন্যাসে। একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পত্তনকে কেন্দ্র করে তিনি পরিবশের বিপন্নতার বিভিন্ন স্তরগুলিকে আলোকিত করেছেন। সভ্যতার অগ্রগতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যুতের। বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা গড়তে অপরিহার্য এই বিদ্যুৎ। তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পেরও অনিবার্যতা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু একটি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প যেমন সভ্যতার অন্ধকারকে আলোকিত করে তেমনি ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত করে প্রকল্প সন্নিহিত এলাকার পরিবেশ-প্রকৃতি— সমগ্র জীবজগৎ। 

    এই উপন্যাসে হুগলী নদী সন্নিহিত কাঁঠালবেড়ে গ্রামে তৈরি হবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র—থার্মাল পাওয়ার। বহুজাতিক আলো কোম্পানি কিনে নিয়েছে এই কাঁঠালবেড়ের আটশো বিঘে জমি। অজানা-অচেনা অজ গাঁ কাঁঠালবেড়ে এখন খবরের শীর্ষে। আলো কোম্পানির বিশাল আয়োজন। আর এই আয়োজন কত কত মানুষকে খেয়ে ফেলছে। গিলে ফেলছে কত কত মানুষের বসত ভিটে, চাষের জমি। আলো কোম্পানির কাজ চলছে জোর কদমে। লরি লরি ছাই আসছে। আটশো বিঘে জমি ভরাট করা হচ্ছে ছাই ফেলে। ছাই ফেলে উঁচু করা হচ্ছে জমি। ডেভেলপ করা হচ্ছে ফ্লাই অ্যাশ ফেলে। লেভেলিং হচ্ছে। আড়াই ফুট থেকে তিন ফুট, কোথাও চারফুট পর্যন্ত অ্যাশ ফেলা হচ্ছে। এই আটশো বিঘেতে যত গাছ ছিল কাটা হয়ে গেছে। গাছের যত পাখি, যত বাসা, যত ছায়া, যত বাতাস সব উধাও হয়ে গেছে।  

    মণ্ডল পাড়ার কোনও অস্তিত্বই নেই। জেলে পাড়া গ্রামের প্রান্তে হওয়ায় সেখানে ছাই এসেছে দেরিতে। পুকুরগুলোর জল কালো থকথকে। কালো ছাইয়ে ঢেকে গেছে চারপাশ। ঘরে বাইরে ছাই। মানুষের কাশের রোগ ধরছে। হাঁপানির ধাত বাড়ছে। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে। জমির জন্য টাকা পায় মালিক। কিন্তু অধিকাংশই ভাগচাষি। তারা কিছু পায় না। মালিক চায় জমি নিয়ে নিক আলো কোম্পানি। বর্গাদাররা ঠিক মতো ভাগ দিত না। বাস ওঠাতে হয় অন্যত্র। কোম্পানি নতুন ঘর করে দিয়েছে কাঁটালবেড়ের আটশো বিঘের মানুষদের জন্য। কিন্তু যার চার ছেলে আলাদা সংসার করেছিল তারা চারটে ঘর পায় না। একটা ঘরেই থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। মানুষের পেশার রূপান্তর ঘটে। প্রাত্যহিকতার বদল ঘটে। বুড়ো মধু ধীবরের মতো কেউ কেউ মানতে পারে না। উঠতে চায় না পূর্বপুরুষের বসত ভিটে ছেড়ে। তার আর্জি জানায় চিঠিতে বড় কাছারিতে। মুখ্যমন্ত্রীকে। লেখাপড়া জানা ছোট বউমাকে সে লিখতে বলে—

“কাঁঠালবেড়ের শো’পোকা, পরজাপতি, মাঠের গোখরো, কেউটে, চন্দরবোড়া, ইঁদুর, ব্যাঙ, মেটুলি সাপ নেই, সব ছাই চাপা পড়েচে, এদিকি যে ঢ্যামনা সাপডা ছিল, তারেও দেখিনে, ভাদ্দর মাসে জমি দখল নিল, তখন তারা ঘুমুতি গেল গত্তে। তারপর ছাই পড়ল নষ্ট ধানের উপর, ঘুমুয়ে ঘুমুয়ে মরে গেল সব, এসবও লেখ বউমা। মহাপুরুষের বট, আশুত, পাকুড়, নিম, শিরিস, আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, সব গাছ কাটা পড়ল। বাদুড়, পেঁচা উড়ে গেছে গাঙ দে, লেখ, শীত নাই কাঁঠালবেড়েতে, সব লিখে দাও।”

মধু ধীবর জানে তারা না লিখলে কেউ লিখবে না। এবার ফড়িং দেখেনি। এ ছাইয়ে কেউ বাঁচে না। লিখতে লিখতে তার বউমা টের পাচ্ছিল—“তাকে ঘিরে আছে শুধু হেলে বংশী, মধু ধীবর নয়, এই অন্ধকারে জোয়ান পুরুষ সাপটি, তরুণ গোখরোটি, মেটুলি সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, বাদুড়, টিয়া, ফড়িং, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা, কাক কোকিল সব যেন এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁঠালবেড়েতে তারা শতজন্ম বাস করেছে, শতজন্মের বাস ওঠাতে হচ্ছে।”

    এখানে মানুষ-পশু-পাখি—সমগ্র প্রাণী জগত একাকার হয়ে গেছে। তারা সকলে যে বিপন্ন আজ। মধু ধীবর সবার প্রতিনিধিত্ব করছে। এই বিপন্নতা অনিবার্যভাবে প্রভাবিত করছে ইকোলজি—ইকোসিস্টেমকে। গাছপালা বা প্রাণীরা নয়, থার্মালের করাল গ্রাসের শিকার হয়ে যায় নদীও। প্ল্যান্টের ময়লা যাবে গঙ্গায়।  

    পরিবেশের প্রশ্ন যে ওঠে না তা নয়। বিপন্ন পরিবেশ সংস্থার সদস্যরা আসে। রাখাল তুং, দিবাকর খাঁড়ারা বিরোধিতা করে। আলো কোম্পানিকে রুখতে অনেক আন্দোলন হয়। অনেক কমিটি তৈরি হয়। মেধা পাটকরের মতো পরিবেশবিদও আসেন কাঁঠালবেড়ে গ্রামে। কিন্তু বন্ধ করা যায়নি থার্মাল। থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট সমস্ত পৃথিবীতে একটা থ্রেট। ফ্লাই অ্যাশ সব শেষ করে দেবে। পরিবেশ ধ্বংস করে দেবে। দিবাকর কোলাঘাটের উদাহরণ টেনে এম এল এ-কে বোঝাতে যায়—গ্রামের পর গ্রাম কীভাবে ছাই-এ চাপা পড়ে গেছে সেখানে। নদী নষ্ট হয়ে গেছে। ফুল চাষ নষ্ট হয়ে গেছে। পান চাষ নষ্ট হয়ে গেছে। গাছের পাতা পর্যন্ত কালো হয়ে গেছে। রূপনারায়ণে মাছ নেই। বাগানে ফল নেই। পুকুরের জল কালো। ছেলে বুড়ো সবাই কাশছে। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি সে। দিবাকর কাঁঠালবেড়ে ছেড়ে চলে গেছে। রাখাল তুং সুযোগ বুঝে দু-পয়সা পকেটে ভরতে চায় এখন।

    ছ-টি ইউনিট চালু হলে বছরে প্রায় চল্লিশ কোটি টন ছাই উৎপন্ন হবে। সেই ছাই ফেলার জন্য দরকার ছাই পুকুর। আটশো বিঘে ছাড়াও পরে আরও দুশো একর জমি নেবে। কিন্তু এইটুকু ছাই পুকুরে কত ছাই ধরবে! ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে। ছাই পুকুর এখন কাটা হচ্ছে না। এই পুকুর কেটে মাটি নেওয়া যেত। ছাইয়ের উপর মাটির লেয়ার পড়বে। প্রচুর মাটির দরকার। আটশো বিঘের বাইরের চাষের জমি থেকে মাটি নিচ্ছে কোম্পানি। দেড়া দামের লোভে চাষিরা মাটি বিক্রি করছে। নতুন এক রকমের আয়ের মুখ দেখছে মানুষ। বদলে যাচ্ছে জীবিকা। চাষাবাদের জায়গায় মাটি বিক্রি। জমি চাষের উপযোগী থাকছে না আর। এসবই আসলে ছাইয়ে ভরে যাবে। 

    এই উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মালারানি। সে প্রথম থেকে আলো কোম্পানির পক্ষে সওয়াল করে এসেছে। স্বামী রতনের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক জুড়েছে। কাঁঠালবেড়ের সব আঁধার ধুয়ে দেবে আলো। তার পেটেও দানা বেঁধেছিল আলো। কিন্তু সেই আলো একদিন মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। সেই মালারানিও এখন আর আলো চায় না। ছাই চায় না। চায় না ছাই পুকুর। “জল নেই, ছাই। ছাই উড়ছে। সেই পুকুরে চানে যাও, ছাই মেখে উঠে আস। গায়ের সোনাবর্ণ তখন ছাই হয়ে যাবে। চাঁপাবর্ণ কিছুই থাকবে না। রাক্ষসী! রাক্ষসী! তার রূপ তখন রাক্ষসীর রূপ।”  

সে পাগল হয়ে যায়। তাকে রতন সমুদ্রে নিয়ে যায় হাওয়া বদলে। দিঘা যাওয়ার পথে কোলাঘাট থার্মাল প্রজেক্টের চেহারা দেখেছে। রাতে হোটেল থেকে বিচে এসে বসে। অন্ধকারে সেই সমুদ্রের মধ্যেও ছাই দেখে মালারানি। রতনের মনে হয় ছাইয়ের সমুদ্রের সামনে বসে আছে তারা। 

“ঘন কৃষ্ণ গহ্বর। তার চোখের সামনে কোলাঘাটের বিপুল ছাই-স্তূপ, ছাই-ঢাকা আকাশ জেগে ওঠে। রতন বউ-এর মুখের দিকে তাকায়। ডেকে তুলবে। কই মালারানিকেও তো দেখা যায় না। কৃষ্ণগহ্বরে মালারানিও মিলিয়ে গেছে, …উত্তরের মাঠে এলো আলো কোম্পানি, চিমনি আকাশে উঠতে লাগল, এল পুলিশ, এল ছাই-এর গাড়ি— এই তো হয়ে গেল সব। ছাই উড়তে লাগল। ছাই-এ ভরে গেল। ছাইয়ে মিলিয়ে গেল মালারানি। সব এখনই যেন হলো। …সব ধূসর হয়ে গেল রতনের মাথার ভিতরে। তার চোখে জল এল। এই লবণাক্ত জলটুকুই রয়েছে শুধু, বাকি সব কৃষ্ণগহ্বরে।”

এই গহ্বরের মধ্যেই ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি আমরা। আলো কোম্পানির অন্ধকার দিকটিকে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে বায়ুতে কার্সিনোজেন-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত। কু-পবন বহিতেছে সর্বত্র। তৃতীয় বিশ্বে এর পরিমাণ বেশি। চাই বা না-চাই প্রতিনিয়ত আমরা ডুবে আছি সেই কুবলয়ে। বাধ্য হচ্ছি এক হাঁ মুখ কৃষ্ণ গহ্বরে প্রবেশ করতে। বায়ু দূষণের বহু কারণের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণকে অমর মিত্র তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে তার ভয়ঙ্কর স্বরূপটাকে উন্মোচিত করেছেন এখানে। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত