Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

স্মৃতি রয়ে যায় । কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

Reading Time: 4 minutes

আজ ২১ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

পূর্ববাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে আরজু ।  তার আব্বার নাম মেহের আর আম্মার নাম সোফিয়া । এই ছোট্ট আরজুকে নিয়েই আমাদের গল্প ।
এক অদ্ভুত প্রাণবন্ত ছেলে ছিল আরজু । খেলাধূলায়, সাঁতারে আর গাছে চড়ায় তার সমকক্ষ সে গ্রামে আর কেউ ছিল না । সেজন্য তার সমবয়েসী বন্ধুদের কাছে সে ছিল আদর্শ । আর সেইসঙ্গে তার মনটা ছিল দয়ামায়ায় ভরা । যদিও তাদের অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না । সামান্য চাষের জমিতে তার আব্বা যেটুকু চাষ-আবাদ করত, তাই দিয়েই কোনরকমে দিন গুজরান হত তাদের । তবু ওই কষ্টের মধ্যেও গরীব লোকগুলোর জন্যে তার প্রাণ কেঁদে উঠত, তাই সংসারের শত অসুবিধার মধ্যেও কেউ যদি তার কাছে কোনকিছু চাইত, সে নিজে না খেয়েও তার সেই চাহিদা পূরণ করতে কসুর করত না । শীতের দিনে তার আব্বাজান যদি তার জন্য কোন গরম জামা কিনে আনত, তা সে পরের দিন কোন শীতার্ত ভিক্ষুককে দেখতে পেলেই দিয়ে দিত । অন্যদিকে সে-ও যেমন ছিল আব্বাজান ও আম্মা-অন্ত প্রাণ, তারাও তাদের একমাত্র নয়নের মণি আরজুকে ঘিরেই ভবিষ্যতের নানা ছবি আঁকত ।
তাদের গ্রামটা ছিল সীমান্তের খুব কাছেই । শান্ত নিরিবিলি একটা গ্রাম । গ্রামের ঠিক পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা কাচের মতো স্বচ্ছ জলের একটা নদী । বড় বড় গাছ, পুকুর আর দিগন্তছোঁয়া মাঠ দিয়ে ঘেরা সেই গ্রাম, যেন এক মায়াময় রূপকথার পরিবেশ ।  কয়েক বছর আগেই তার আব্বা তাকে গ্রামের ছোট্ট মক্তবে ভর্তি করে দিয়েছিল । সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে পড়াশোনা আর খেলাধূলার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল আরজু । যদিও লেখাপড়ায় সে খুব একটা ভাল ছিল না, তবুও তার বুদ্ধি আর দয়ামায়ার জন্য সে সকলের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল ।

 

এইভাবে দিন কাটতে কাটতে এল ১৯৭১ সাল । আরজু তখন খানিকটা বড় হয়ে উঠেছে । তার আব্বা আর আম্মাও ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন । তাদের দেখাশোনার ভার আরজুর ওপর । সে তার লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তাদের যত্ন নেয়, সেইসঙ্গে যতটা পারে, অভাবী সংসারের দুঃখকষ্ট দূর করার স্বপ্ন দেখে ।
এর মধ্যে কখন যে তাদের দেশের চারিদিকে বিপদের বেড়াজাল ঘনিয়ে এসেছে, গ্রামের কেউ জানতে পারেনি । ফলে বড়দের কথাবার্তার মধ্যেও কোন বিপদের আঁচ টের পাওয়া যায়নি ।
এমন সময়, একদম বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন ২৫শে মার্চ তারিখের রাতে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান তার জঙ্গীবাহিনী নিয়ে পূর্ববাংলা আক্রমণ করলো ।
আগেই বলেছি, আরজুদের গ্রামটা ছিল সীমান্তের কাছেই, তাই প্রথম রাত্রিতেই তাদের গ্রাম আক্রমণ করে ইয়াহিয়া খান নৃশংস অত্যাচার শুরু করে দিল । চারিদিকে লুঠতরাজ চলছে, গোলাগুলি চলছে । খানসেনারা প্রত্যেকটা বাড়ি আক্রমণ করছে, তারপর লুঠতরাজ করে, কাউকে সঙ্গীন দিয়ে গেঁথে, কাউকে গুলি করে মেরে বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে ।
একটু আগেই এই ভয়ঙ্কর বিপদের খবরটা পেয়েছে আরজু । পেয়েই ছুটতে ছুটতে এসে তার আব্বা আর আম্মাকে জানাল সেই খবর । শুনেই আম্মা চিৎকার করে কেঁদে উঠল । আব্বাজান ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল । কিন্তু আরজুকে তো ভয় পেলে চলবে না । যদিও তার মনের ভেতরটা উদ্বেগে, আতঙ্কে কাঁপতে লাগল, কিন্তু বাইরে সে নিথর । তাকে ভয় পেতে দেখলে তার আব্বা আর আম্মা যে আরও ভেঙে পড়বে । তাই তাকে শক্ত থাকতেই হবে । সে তার আব্বা ও আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বসে চিন্তা করতে লাগল । কী করবে সে ? একবার সে ভাবছে যে এক্ষুণি সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া দরকার, আবার পরক্ষণেই ভাবছে যে, না, তার পিতৃ-পিতামহের ভিটে ছেড়ে সে পালাবে না, তাতে তার প্রাণ যায় যাক ।
এমন সময় হুড়মুড় করে দৌড়ে এল পাশের বাড়ির রাবেয়া । চিৎকার করে বলল, “এ কী চাচা ? তোমরা এখনও বসে আছ ? এক্ষুণি পালাও ।”
আব্বা বোকার মতো তাকিয়ে রইল ।
আরজু বলল, “কোথায় পালাব ?”
রাবেয়া বলল, “গ্রামের পিছন দিক দিয়ে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে সবাই ।  তোমরাও পালাও । নাহলে প্রাণে বাঁচবে না । ওরা বাচ্চা বুড়ো কাউকে রেহাই দিচ্ছে না । পালাও পালাও ।” বলে আবার ছুটতে ছুটতে রাবেয়া চলে গেল ।
এদিকে আরজু তখনও দোটানায় পড়ে আছে আর দ্রুত চিন্তা করে চলেছে, সে পালাবে কী পালাবে না । ঠিক সেই সময় একটা পুঁটলি বগলে নিয়ে দৌড়ে এল রাবেয়া । খানসেনারা নাকি রাবেয়াদের বাড়িতে এসে গেছে । খবরটা দিয়েই ঝড়ের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল সে ।
সঙ্গে সঙ্গে আরজু মনস্থির করে ফেললো যে ওরাও পালাবে । ঘরের মায়া ত্যাগ করেই চলে যেতে হবে । আগে প্রাণটা তো বাঁচুক । তারপর আল্লা যা করবেন তাই হবে ।
সে দাওয়া থেকে ঘরে ঢুকলো দরকারী কিছু জিনিষপত্র সঙ্গে নিয়ে নেবে বলে । আর ঠিক তখনই সে তার আব্বার চিৎকার শুনতে পেল । শোনামাত্র একটা অজানা ভয়ের শিহরণ নেমে এল আরজুর শিরদাঁড়া বেয়ে । কী হল ? আব্বা আর আম্মা তো দাওয়ায় বসেছিল ! এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে । এসে দেখলো, মৃত্যুদূতের মতো কয়েকটি খানসেনা তার আব্বা আর আম্মাকে ঘিরে ধরেছে, আর তাঁদের দিকে সঙ্গীন উঁচিয়ে ধরেছে । সেই দেখেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছে তার আব্বাজান, আর তার আম্মা ভয়ে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে ।
সঙ্গে সঙ্গে আরজু একবার মাত্র “আম্মা” বলে চিৎকার করে উঠেই খানসেনাগুলির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং পরক্ষণেই তার ঘাড়ে এসে লাগলো এক তীক্ষ্ণ সঙ্গীনের খোঁচা । পরমুহূর্তেই সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে ।

 

পরদিন সকাল । সারা গ্রামের আকাশে বাতাসে ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ । স্বপ্নের মতো গ্রামটা এখন গোরস্থানের মতো লাগছে । যে দু-একজন গ্রামবাসী লুকোতে পেরেছিল ঝোপেঝাড়ে, তারাই অবশেষে আরজুর, তার আম্মার এবং তার আব্বার মৃতদেহ আবিষ্কার করলো । তাদের বাড়িটা খানসেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে । সেই আগুনের ধ্বংসস্তূপ থেকে তাদের পুড়ে যাওয়া দেহগুলি বার করে এনে উঠোনে শোয়ানো হল । আর তখনই সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, কী আশ্চর্য ! আরজুর সারা দেহটা আগুনে ঝলসে বিকৃত হয়ে গেলেও মুখটা একটুও পোড়েনি । আর সেই অবিকৃত সুন্দর মুখে ফুটে আছে শুধু এক অব্যক্ত যন্ত্রণা — সে যে প্রাণ দিয়েও তার আব্বাজান আর আম্মাকে নৃশংস খানসেনাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি, সেজন্য সবাই যেন তাকে ক্ষমা করে, এই কথাই সে যেন বলে যেতে চেয়েছিল সকলকে ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>