কুহু

Reading Time: 2 minutes
বাবার জন্য বৃদ্ধাশ্রমে থাকার বন্দোবস্ত পাকা করে এলাম। একই সাথে তার জন্য একটি রেডিও কিনে এনেছি।
আমার নাম?
কুহু।
আমি বাবার একমাত্র সন্তান।
জন্মের প্রায় এক বছর বাদে বাবা-মা এই নামটি রেখেছিল। সত্তর দশকের শেষ দিকে তখনো মিডিয়ার উৎপাত এতো প্রকট হয়ে ওঠেনি। সাধারণের বিনোদন বলতে বাংলাদেশ বেতার ছিল একমাত্র ভরসা। বাবা নাকি রাত জেগে অনুষ্ঠান শুনতেন। এক গভীর রাতে ছোট ট্রানজিস্টরের এন্টেনা এদিক সেদিক ঘুরানোর পর, বেজে উঠলো কুহু কুহু কোয়েলিয়া…। গানটা শুনে তিনি এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে অনেকের আপত্তি-অনাগ্রহ উপেক্ষা করে, কুহু নামটি মেয়ের জন্য স্থায়ী করে রেখে দিয়েছিলেন।
আমি সেই কুহু এখন বড় হয়েছি। বাবা অবসর গ্রহণের পর আমার কাছেই থাকেন। তিনি পুরনো দিনের গল্প করতে ভালোবাসেন। আমার নামকরণের ইতিহাসটা তার গল্প থেকে জানতে পেরেছি। সেই সাথে আরো জানালেন বেতারে গভীর রাতে অনুরোধের আসর হতো। মানুষজন দেশের নানা প্রান্ত থেকে চিঠি লিখে তাদের পছন্দের গান শুনতে চাইতো। বাবা এই গানটি আরেকবার শোনার জন্য অনুরোধের আসর ‘দূর্বার’-এ চিঠি লিখেছিলেন। একটি ককিল কণ্ঠী গানের জন্য তৃষ্ণার্ত কাকের মতো তাকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অপেক্ষা অবসানে প্রায় মাস খানিক সময় লেগেছিল। এই ছিল বাবাদের কাল। বাবা গল্পের আচড়ে ছবির মতো ঘটনা তুলে আনতেন। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। চশমার ফাঁক ফোকর দিয়ে কিছু গড়িয়ে গেলে পুনরায় রঙের ছোয়া দিয়ে কথা সম্পন্ন করতেন। তার সময়ের দৃশ্যায়ন মগজে ধারণ করতাম অনেকটা সাদা-কালো পুরনো সিনেমার মতোন।
বাবা যখন বিয়ে করলেন নানা তার শখের বিষয়ে জানতে চাইলে, বলেছিলেন- রেডিওতে গান আর ক্রিকেট ধারাভাষ্য শোনা তার পছন্দ। স্কুল শিক্ষক বাবাকে তাঁর শ্বশুর বাবা একটি বড় রেডিও আর যাতায়াত সহজ করতে একটি বাই সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে মা নাকি বাবার বাড়ির সাইকেল সংক্রান্ত যৌতুকের খোঁটা শুনিয়ে দিতেন।
গ্রামে চাকুরির বাইরে মানুষে-মানুষে কিছু সামাজিক সংযোগ থাকে। স্কুল ছুটি হলেই তো আর সাথে সাথে বাড়ি ফেরা যায় না। রাস্তায় কুশল জিজ্ঞাসা, কারো জমির বিরোধ, কোন সেয়ানা ছেলে অভিভাবকের কথা শুনছেনা। কোন ছেলেটা সদ্য তামাক ধরেছে সব স্যারের কান অব্দি পৌঁছে দেয়া চাই। এতে একটু তো সময় ব্যয় হবেই। একবার নিমতলীতে সাত ঘরের সবাই অসুস্থ । সেখানে তার দুই ছাত্র রয়েছে। তিন দিন ধরে স্কুলে আসেনি। পথে ডাক্তার বাবুর সাথে দেখা হওয়ায় ওদের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর করলেন। বহুবিধ শলা পরামর্শ পথ চলতে লেগেই থাকতো। নিজেই দেখেছি- কেউ গুরুতর অসুস্থ  হলে এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে তিনি তাদের খোঁজ-খবর করতেন। দেরি করে বাড়ি ফিরলে মা রেগে যেতেন। খোঁটা দিয়ে বাই সাইকেলটার কথা স্মরণ করে দিতেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাবা টক-ঝল-মিষ্টি মিশ্রিত মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন।
আমার বাবা গফুর আলী দেখতে এখন অনেক শীর্ণ। তবে গোফগুলো পাটের মোটা সোনালী আঁশের মত মুখের বড় অংশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। এক সময়ে ওটা ছিল তার ছাত্রদের সমিহ আদায় করার একমাত্র অস্ত্র। তামাটে গায়ের রঙ। সত্তর বয়সেও চোখ দুটো ভীষণ দ্যুতিময়। সে এখন আমার ফ্ল্যাট বাসার দশ ফিট বাই দশ ফিট ঘরের একটি চৌকিতে বন্দি। দুটো মানুষ নেই কথা বলার।
আমি সপ্তা খানেকের মধ্যে স্বামীর সাথে দেশ ছাড়বো। তাই তার থাকার বন্দোবস্ত করে এলাম। বাবার জন্য একটা রেডিও কিনে এনেছি। বাজাতেই- বাবা বললেন, এত দ্রুত কথা বলে কেন রে? ওদের এতো তাড়া কিসের! কথার তোড়ে তিনি বাংলা বোলগুলো ঠিক বুঝতে পারেন না। উচ্চারণও তথৈবচ!
বাবার মুখখানা আজ বড় মলিন। স্থির তাকিয়ে বললেন, মা কুহু তুই তো চলেই যাবি। তোর এই রেডিওতে কুহু কুহু সেই গানটা কী আর বাজবে কখনো?
.

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>