গীতরঙ্গ: মেঘ ও রৌদ্র : ফিরে এসো হে । অদিতি ফাল্গুনী
‘যতদিন সিংহ লিখতে না শিখবে, ততদিন শিকারীর বিজয় কাহিনীই সবাইকে পড়তে হবে‘ বলে উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের একটি প্রবচন আছে। উপনিবেশ কেমন? শেক্সপীয়রের ‘দ্য টেম্পেস্ট‘-এ প্রসপেরো যেমন তৈরি করেছিলেন? উপনিবেশিত ক্যালিব্যান এবং ঔপনিবেশিক প্রসপেরো, সাথে ‘শুভ্র সুন্দর ঔপনিবেশিকে‘র ‘সমুজ্জ্বল‘ প্রেক্ষাপটে আরো যা যা পল্লবিত তরু লতা! যেমন, প্রসপেরো কন্যা মিরান্ডা বা ভাবি জামাতা ফার্ডিনান্ড প্রমুখ। কিন্তু ক্যালিবানদের কাহিনী কে লিখবে? তাদের কালো-বাদামি-পীত বঞ্চনার ইতিহাস? হ্যাঁ, ভারত উপমহাদেশে ১৯০ বছর বৃটিশ উপনিবেশ ছিল। সেই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময় আমাদের গোটা জাতিসত্ত্বাকে কতটা দূর্বল-পরনির্ভর-আপোষকামী ও সর্বোপরি মেরুদন্ডহীন করে দিয়েছিল সেটা সে সময়ের রচিত সাহিত্যে প্রায়ই উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সাহিত্যের উত্তর-ঔপনিবেশিকতা শুধুই কি ঔপনিবেশিক আর উপনিবেশিতের ভেতরের দ্বন্দ বা সংঘাত আর লড়াইয়ের কাহিনী? শুধুই নীলকর বিরোধী বিদ্রোহের পালাগান? এক/একটি সিপাহী বিদ্রোহ, ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন‘, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা দেশভাগে বিপুল রক্তক্ষয়, টানা-পোড়েন, দাঙ্গা, অগ্নিদাহের কথা যদি বা লেখে ইতিহাস, এই সব বড় ঘটনার ভেতর ছোট ছোট চাপা পড়ে যাওয়া অসংখ্য অপূরিত মানবপ্রেম, হাজার হাজার মানব-মানবীর পূরণ না হওয়া ছোট ছোট স্বপ্ন, স্মৃতি ও বেদনার দীর্ঘশ্বাস কি উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অংশ হবে না বা হতে পারে না?
রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘ ও রৌদ্র‘ বহুদিন পর্যন্ত পাঠ করেছি একটি গভীর বেদনাভরা প্রেমের আখ্যান হিসেবে। এই গল্প যে একটি উপনিবেশিত সমাজের ছবি – সত্যি বলতে এই তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক চেতনা প্রথম পেয়েছিলাম বহু আগে লেখা, সতীর্থ গল্পকার প্রশান্ত মৃধার একটি প্রবন্ধে। আমি যেহেতু কারো কাছ থেকে কোন ভাবনা বা কোন কিছু এক বিন্দুও গ্রহণ করলে সেটা অকপটে স্বীকার করি, কাজেই আজকের এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে প্রশান্তর সেই ভাবনাকে শুরুতে মান্যতা দিতেই হবে। প্রবন্ধটি সেই লেখকের বহু আগেই লেখা। এতদিন পর সেই মান্যতা আমার না দিলেও চলতো-আরো যেহেতু আমি হুবহু কিছু টুকছি না। তবে এটা নিজের কাছে নিজের স্বচ্ছ থাকার দায়। প্রায় ১৯৯৮/৯৯ সালে লেখা প্রশান্ত মৃধার প্রবন্ধটি নিয়ে আমি বহুদিন ভেবেছি এবং গল্পটি আরো কয়েকবার পড়েছি। এবং গল্পটির শেষে ‘ফিরে এসো হে‘ গানটি যখন কয়েক বছর আগে লাইসা আহমেদ লিসার গলায় শুনে স্তব্ধ হয়ে যাই, তখন ‘মেঘ ও রৌদ্র‘ গল্পটি এবং গল্পের শেষে এই অনির্বচনীয় গানটির সংযোজন আমাকে নতুন করে ভাবায়।
গতকাল ‘ইরাবতী‘-র সম্পাদক শৌনক দত্ত যখন আমাকে সঙ্গীত বিষয়ক কোন লেখা দিতে বললেন এবং ২২শে শ্রাবণের আগে আগে এমন অনুরোধ বলতেই রবীন্দ্র সঙ্গীত বিষয়ক কোন লেখা দিতে বলা, তখন শুরুতে ভেবেছিলাম যে এই মূহুর্তে পড়া-শুনা, একটি গবেষণার কাজ সহ নানা কিছু নিয়ে আমি এমন চাপে যে ‘না‘ করে দেয়াই ভাল। শৌনকের আগেই দেশের আর একটি নামী দৈনিকে ২২শে শ্রাবণ উপলক্ষ্যে লেখা দিতে হয়েছে। টানা গদ্য লেখা কি পরিমাণ অমানুষিক শ্রমের কাজ সেটা ভুক্তভোগী মাত্র জানেন। কিন্তু ব্যক্তি শৌনক খুব উপকারী মানুষ ও বন্ধুও বটে। তাঁর অনুরোধ ফেলতেও কষ্ট হয়। অনেক ভেবে মনে হলো যে রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা অথবা বসন্ত বা প্রকৃতি, স্বদেশ, প্রেম, পূজা বা এমন নানা বিষয়ে অনেকেই লিখবেন। রবীন্দ্রনাথের গানের সমতূল্য তাঁর অন্য যে সৃষ্টি মাধ্যমের আমি প্রবল অনুরাগী সেই ছোট গল্প নিয়েও অনেক প্রবন্ধ নিশ্চিত লেখা হয়ে গেছে? কেমন হয় যদি আমি তাঁর একটি মাত্র গল্প ও সেই গল্পেরই একটি অংশ একটি মাত্র গান নিয়ে লিখি? তাই ‘মেঘ ও রৌদ্র‘ বা ‘ফিরে এসো হে‘ গানটি নিয়েই বরং লিখি।
‘মেঘ ও রৌদ্রে‘র প্রেক্ষাপট হিসেবে আসছে বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর বাংলার একটি গ্রাম। আজ গল্পটি আবার পড়তে গিয়ে ‘তিলকুচি‘ গ্রামটিকে বোধ করি চিনেও ফেললাম। আমার বাবা যখন পাবনায় বাংলাদেশ সরকারের সমবায় বিভাগের হয়ে কাজ করতেন, তখন বৃহত্তর পাবনার আওতায় বাবা যে যে জায়গা অফিসের কাজে মাঝে মাঝে যেতেন, তার ভেতর ‘বেলকুচি‘র নাম শুনেছি। বেলকুচি থেকে বাবা খুব ভাল মানের দইও নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। রবীন্দ্রনাথের কর্মক্ষেত্র শাহজাদপুর বা শিলাইদহ তখন ঘুরেছি। সেই ‘বেলকুচি‘ নামটিই কি গল্পে ‘তিলকুচি‘ করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? গল্পের শুরু হচ্ছে আগের দিন সুপ্রচুর বৃষ্টি হয়ে যাবার পরের একটি দিন দিয়ে। একটি জীর্ণ ইটের দালানের ভেতর এক যুবক হাতে একটি পাখা নিয়ে একই সাথে ‘গ্রীষ্ম ও মশক‘ তাড়াতে ব্যস্ত। যুবক একটি তক্তাপোশে বসে ডান হাতে একটি বই নিয়ে পড়ায় মগ্ন। সামনে জানালা দিয়ে একটি বালিকা ঘুরে যাচ্ছে এবং যুবকের মনোযোগ আকর্ষণ না করতে পেরে একটির পর একটি জাম খাচ্ছে।
ধীরে ধীরে লেখক আমাদের জানান যে যুবকের নাম শশিভূষণ যে এম এ পাশ করে এবং আইন পড়ে বাবার বিষয় দেখতে গ্রামে এসেছে। তাঁর কাছে গিরিবালা নামে বালিকাটি যে প্রায়ই আসে সেটা নিয়ে গ্রামের কেউই উদ্বিগ্ন নয় যেহেতু বালিকার বয়স মাত্র দশ। এমএ পাস করেও কোথাও চাকরির চেষ্টা না করা বা চাকরি না নেয়া শশিভূষণকে তার বাবা গ্রামে বিষয়-সম্পত্তি দেখতে পাঠালেও লাজুক ও অসামাজিক শশিভূষণকে গ্রামের মানুষ ‘উদ্ধত‘ মনে করে- সে সামাজিক নয় বলেই। শান্তিপ্রিয় শশিভূষণ বিয়ে করতেও রাজি নয় বলে ‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাগণ তাঁহার এই অনিচ্ছাকে দুঃসহ অহংকার জ্ঞান করিয়া কিছুতেই ক্ষমা করিতে পারিতেন না।‘
গোটা গ্রামে গিরিবালার সাথেই শশিভ‚ষণের বন্ধুত্ব (অসম বয়সী হলেও) গড়ে ওঠার কারণ কি? এটা যে সময়ের কাহিনী ততদিনে ভারতের বড় শহরগুলোয় মেয়েদের জন্য স্কুল হলেও বা সমাজের অগ্রসর অংশের মেয়েরা কেউ কেউ স্কুলের পর কলেজে পড়া শুরু করলেও সামগ্রিক ভাবে নারীশিক্ষার হার তখনো খুবই শম্বুকগতি। কাজেই গিরিবালার ভাইরা স্কুলে গিয়ে ফিরে এসে শিক্ষা বঞ্চিত বোনকে কোনদিন পৃথিবীর আকার এবং কোনদিন সূর্য বড়ো না পৃথিবী বড়ো এসব জিজ্ঞাসা করলে গিরিবালার ভুল উত্তরে তারা ঠাট্টা করতো। এহেন গিরিবালা গ্রামের নতুন মানুষ শশিভূষণের বইয়ের তাকে মোটা মোটা ইংরেজি বই দেখে বুঝতে পারে যে এই মানুষটি তার ভাইদের থেকেও বেশি জানে। নায়েবের ঘরের মেয়ে হয়েও বাবা বা ভাইরা তাকে কখনো পড়ায়নি। অসামাজিক তবে আদর্শবাদী শশিভূষণের কাছে গিরিবালা অবশ্য আট বছর থেকে দশ বছর বয়সী হতে হতে ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালা শেখা সহ দু/চারটা সহজ বই পড়ার বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে সমর্থ হয়। একা শশিভূষণেরও বেশ সময় কাটে।
গিরিবালার বাবা হরকুমার আর দশটা গ্রাম্য, সংসারী মানুষের মতই শশিভূষণের কাছে এসে মামলা মকদ্দমার পরামর্শ চাইলে শশিভূষণের এড়িয়ে যাওয়া বা আইন সম্পর্কে বিশদ না জানার কথা স্বীকার করাকে হরকুমার ‘নিতান্তই ছল মনে করিত।‘ এমনকি এক অবাধ্য প্রজাকে শাসন করার জন্য নায়েব হরকুমার সেই প্রজার নামে ‘ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন অপরাধ ও দাবিতে নালিশ রুজু করিয়া দিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া পরামর্শের জন্য শশিভূষণকে কিছু বিশেষ পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিলেন। শশিভূষণ পরামর্শ দেওয়া দূরে থাক, শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে হরকুমারকে এমন গুটি দুই-চারি কথা বলিলেন যাহা তাঁহার কিছুমাত্র মিষ্ট বোধ হইল না।‘ সেই প্রজার বিরুদ্ধে একটি মামলাতেও জিততে না পেরে হরকুমারের সন্দেহ হয় যে শশিভূষণ সেই প্রজাকে সাহায্য করছে। ক্ষিপ্ত হরকুমার ‘প্রতিজ্ঞা করিলেন, এমন লোককে গ্রাম হইতে অবিলম্বে তাড়াইতে হইবে।‘
গ্রাম এবং গ্রামের মানুষ মানেই যে সহজ-সরল শান্তির স্বর্গ ও দেবদূত সমাজ নয়, একথা রাশিয়ার তলস্তয় থেকে বাংলার শরত চন্দ্র সবাই তাঁদের সৃজনশীল ও মননশীল রচনা সমগ্রে উল্লেখ করে গেছেন। ‘শশিভূষণ দেখিলেন, তাঁহার খেতের মধ্যে গোরু প্রবেশ করে, তাঁহার কলাইয়ের খোলায় আগুন লাগিয়া যায়, তাঁহার সীমানা লইয়া বিবাদ বাধে, তাঁহার প্রজারা সহজে খাজনা দেয় না‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। শশিভূষণ যখন পালাবেন বলে ভাবছেন, তখন গ্রামে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের তাঁবু পড়ে। জমিদারের নায়েব হিসেবে গিরিবালার বাবা হরকুমার ‘যথারীতি আতিথ্য-শিরে খরচ লিখিয়া সাহেবের মুর্গি-আন্ডা-ঘৃত-দুগ্ধ জোগাইতে লাগিলেন।‘ কিন্তু এত কিছুর পরও একদিন সকালে সাহেবের মেথর এসে সাহেবের কুকুরের জন্য চার সের ঘি আদেশ করলে সেটা হরকুমার মেনে নেন না। মেথর গিয়ে সাহেবকে বলে যে সাহেবের কুকুরের মাংস কোথায় পাওয়া যেতে পারে সেই খোঁজ নিতে গিয়ে নায়েব তাকে জাতিতে মেথর বলে অবজ্ঞার সাথে তাড়িয়েছে।
এখানে অবশ্য এই বয়সে এসে গল্পের এই জায়গাটায় রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও একটি জায়গা আমার বিশেষ ভাবে চোখ টানলো যেটা খানিকটা হলেও সমালোচনার যোগ্য। ‘একে ব্রাহ্মনের জাত্যভিমান সাহেব-লোকের সহজেই অসহ্য বোধ হয়, তাহার উপর তাঁহার মেথরকে অপমান করিতে সাহস করিয়াছে, ইহাতে ধৈর্য রক্ষা করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল।‘
অস্বীকার করার উপায় নেই যে মধ্যযুগে ইসলাম এসে ভারত উপমহাদেশে বিজয়ী বহিরাগত হিসেবে যত মন্দির ধ্বংস-লুণ্ঠন-জিজিয়াকর প্রয়োগ-হত্যা-নারী নিগ্রহই করুক না কেন (যা কিছু যে কোন বিজয়ী বহিরাগত অন্যের সাথে করে), একইসাথে সেটা জাতিভেদ বা বর্ণাশ্রমের কঠিন অর্গলকে কিছুটা হলেও ধাক্কা দেয়। অসংখ্য মানুষ ধর্মান্তরিত হওয়ায় আদি ধর্মের ধারক-বাহকরাও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তারপরও বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা একপর্যায়ে তাদের ধর্মীয় আদর্শের চেয়ে রাজ্য রাখায় মনোযোগী হওয়ায় হিন্দু ধর্মের রীতি-নীতিতে খুব বেশি হাত দেন নি। দ্বিতীয়বার ভারতীয় সভ্যতা তার ভাল-মন্দ সব মিলিয়ে প্রবল ধাক্কা খায় ইউরোপীয় ক্রিশ্চিয়ান শক্তিগুলো বিশেষত বৃটিশের শক্তি এদেশে সুসংহত হবার পরে। বাদামি ব্রাহ্মন কেন ‘জাত্যাভিমানে‘ ভুগবে এটা নিয়ে সাদা ক্রিশ্চিয়ান অবাক ও ক্রুদ্ধ হতেই পারে এবং পাল্টা ঠেকা দিতে নিজের মেথরকে ব্রাহ্মনের সাথে ‘মোরগ লড়াইয়ে‘ নামিয়ে দেবার দুষ্টুমি যে সে করবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। মেথরও হয়তো পাল্টা এই ‘ক্ষমতায়ণে‘ হর্ষিত হয়ে এবং তার যুগান্তের বঞ্চনা বোধ থেকে কিছু বাড়াবাড়ি করবে। যাহোক, হরকুমার সাহেবকে জানান যে কুকুরের পেটের কথা ভেবে চার সের ঘি-তে আপত্তি করলেও পরে নানা জায়গায় ঘি আনতে লোক পাঠিয়েছেন। সাহেব হরকুমারকে তাঁবুতে বসিয়ে সেই সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিলে হরকুমারের দাবি মিথ্যে প্রমাণিত হয় এবং শাস্তি হিসেবে সাহেবের মেথর হরকুমারকে তাঁবুর সামনে অসংখ্য মানুষের ভেতর কাণ ধরিয়ে ঘোড়দৌড় করান। হরকুমার ঘরে ফিরে আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করলে তার অনেক বাঙ্গালী শত্রু খুশি হলেও আদর্শবাদী শশিভূষণ কলকাতা ফিরে যাওয়া বাদ দিয়ে হরকুমারের সাথে দেখা করে। শশিভূষণ হরকুমারের পক্ষে মামলা লড়তে চাইলে প্রথমে ভয় পেলেও পরে শত্রুদের উল্লাসে বিমর্ষ হরকুমার মানহানির মোকদ্দমা লড়তে রাজি হন। কিন্তু বাংলার ১৭৯৩ সালের যে জমিদারি তথা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ‘ পুরোটাই বৃটিশের সাথে একধরণের অনুগত মৈত্রীর ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল, সেই ব্যবস্থায় বৃটিশের গুঁতো খেয়ে নায়েব হরকুমারকে ডেকে তার জমিদার মামলা তুলে নিতে বলবে সেটাই স্বাভাবিক। অবিস্মরণীয় কৌতুকবোধের সাথে লেখক জানাচ্ছেন: জমিদার কহিলেন, ‘তাহার পর আবার সাহেবের নামে নালিশ করিতে তোমাকে কে বলিল।‘ হরকুমার কহিলেন, ‘ধর্মাবতার, নালিশ করিবার ইচ্ছা আমার ছিল না। ঐ আমাদের গ্রামের শশী, তাহার কোথাও কোনো মকদ্দমা জোটে না, সে ছোঁড়া নিতান্ত জোর করিয়া প্রায় আমার সম্মতি না লইয়াই এই হাঙ্গামা বাধাইয়া বসিয়াছে।‘
হরকুমার তাকে কান ধরে ঘোড় দৌড় করানো বৃটিশ জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও প্রচুর পারিতোষিক সহ গিয়ে দেখা করে ক্ষমা চান এবং সাহেব সব ভুলে নায়েবকে প্রশ্ন করেন যে ‘শশী কংগ্রেস যোগ দিয়াছে কিনা।‘ নায়েব অখ্যানমুখে বলিলেন, ‘হ্যাঁ।‘ সাহেব তাঁর সাহেবি বুদ্ধিতে স্পষ্ট বুঝে যান যে এ সমস্তই কংগ্রেস চাল। মামলা স্থগিত হয় এবং ডিমস্থিনীস, সিসিরো, বার্ক, শেরিডন পড়ে এতদিন যে শশিভূষণ মামলার যুক্তি সাজাতে গিয়ে গিরিবালার আনা জাম থেকে বকুল ফুলের মালা কিছুই লক্ষ্য করেনি, মামলা স্থগিত হওয়ায় সেই গিরিবালার কথাই শশিভূষণের মনে পড়ে। তবে ততদিনে গিরিবালার বিয়ে ঠিক হয়েছে এবং দশ বছরের বালিকাকেও বিয়ের আগে ‘শশীদাদার বাড়ি‘তে যেতে দিচ্ছেন না হরকুমার। মেয়ে বিয়ে ঠিক হবার পরও যথেষ্ট লাজুক নয় বলে বকাবকিও চলছে। এমনিতেও মামলা থেকে পিছিয়ে আসার পর থেকে শশিভূষণকে দেখলেই নৈতিক অপরাধবোধ থেকে হরকুমার আক্রোশে ভুগতেন। যাহোক, শশিভূষণ যেদিন গ্রাম ছাড়ছেন সেদিন গিরিবালার বিয়ের সানাই বাজছে। আর শশিভূষণ একটি নৌকায় করে গ্রাম ছাড়ছেন।
‘অভাগা যেদিকে চায়/সাগর শুষিয়া যায়।‘ শশিভ‚ষণেরও তাই হলো। তার সামনেই স্বদেশী মানুষের আর একটি নিগ্রহ হলো। এক বৃটিশ কর্মকর্তার স্টিমার বোটের সাথে এক দেশি নৌকার মাঝি কি মনে করে গতির প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। প্রবল বায়ুতে সেই মাঝি বায়ুগ্রস্থ হয়েই বোধ করি এক পালের উপর দুই এবং তৃতীয় পাল চাপিয়ে একটি পর্যায়ে স্টিমার বোটকে দুই হাত ছাড়াতেই এতক্ষণ প্রতিযোগিতা দেখতে থাকা সাদা সাহেব নেটিভের এই ‘ম্যানুয়াল‘ নৌকার কাছে তার ‘শ্বেত যন্ত্রশক্তি‘র পরাজয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে নৌকায় গুলি করেন। নৌকার পাল ফুটে হয়ে ডুবে গেল ও স্টিমার দূরে চলে গেল। শশিভ‚ষণ তার পান্সি নৌকা নিয়ে কাছে গিয়ে মাঝি মাল্লাদের উদ্ধার করে বৃটিশ সেই পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে উদ্বুদ্ধ করলেও মাঝিরা শুরুতে রাজি হয় না। পরে শশিভূষণ নিজে উকিল ও মামলার খরচ বহন করবে জেনে রাজি হলেও শশীর গ্রামের যে মানুষেরা সেদিন সেই স্টিমারে ছিল তারা সাক্ষ্য দিতে রাজি হয় না: তাহারা শশিভ‚ষণকে কহিল, ‘মহাশয়, আমরা কিছুই দেখি নাই,…কলের ঘট্ ঘট্ এবং জলের কলকল শব্দে সেখান হইতে বন্দুকের আওয়াজ শুনিবারও কোনো সম্ভাবনা ছিল না।‘ শশিভূষণ এরপরও মামলা লড়াই করতে গেলে ‘সাক্ষীর কোন আবশ্যক হইল না। ম্যানেজার স্বীকার করিল যে, সে বন্দুক ছুঁড়িয়াছিল। কহিল, আকাশে এক ঝাঁক বক উড়িতেছিল, তাহাদেরই প্রতি লক্ষ করা হইয়াছিল। …স্টিমার তখন পূর্ণবেগে চলিতেছিল এবং সেই মুহূতেই নদীর বাঁকের অন্তরালে প্রবেশ করিয়াছিল। সুতরাং সে জানিতেও পারে নাই, কাক মরিল, কি বক মরিল, কি নৌকাটা ডুবিল।‘
বেকসুর খালাস পেয়ে বৃটিশ ম্যানেজার চুরুট খেতে খেতে ক্লাবে গেলেন হুইস্ট খেলতে আর সেই গুলিবিদ্ধ নৌকার এক যাত্রীর লাশ নয় মাইল দূরে এক ডাঙায় গিয়ে পৌঁছালো। শশিভূষণ গ্রামে ফিরে আসার দিন গিরিবালাকে শ্বশুরবাড়ির নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শশিভূষণ গিরিবালার বিদায়ী নৌকা দেখতে পেলেও ঘোমটায় ঢাকা গিরিবালা তার গুরুকে শেষ দেখা দেখতে পায় না।
এরপর শশিভূষণ আবার কলকাতায় যাবার পথে বোধ করি গ্রহ-নক্ষত্রের দোষেই পুনরায় শে^ত বৃটিশের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। দুই নদীর মোহনা পথে যেখানে শশিভূষণ মাত্রই তার নৌকা বেঁধে দুপুরের খাবার খেতে যাবেন, সেখানে জেলেদের পাতা জালে (এজন্য জেলেরা বৃটিশকে খাজনাও দিত) বৃটিশ পুলিশের মাঝি কোনদিকে না তাকিয়ে নৌকা চালিয়ে দিলে জাল নিচু হয়ে গেল। জেলেরা লালমুখো সাহেবকে দেখে পালালো আর সাহেব তার মাল্লাদের হুকুম দিলেন জাল কেটে ফেলতে। মাল্লারা সেই সময়ের সাত/আটশো টাকা দামের জাল কেটে দিল। একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে বৃটিশ আর ক‘জন এসেছিল এই বিশাল ভারতবর্ষে? তাদের ‘হুকুমের চাকর‘ হয়ে স্বজাতি বা স্বদেশের ভাইদের প্রতি মূহুর্তে অপমান কি আমরাই আমাদের করিনি? একটি উপনিবেশ ত‘ এমনি এমনি টেঁকে না? তা-ও প্রায় দুইশো বছর ধরে! তা‘ গোরা সাহেব চার পলাতক জেলেকে না পেয়ে হাতের কাছে পাওয়া অন্য চার নিরীহ বাঙ্গালীকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর তারা কাকুতি-মিনতি করছে, তখন শশিভূষণ সামনে এসে কম্পিত গলায় গোরা সাহেবকে বললেন যে এই আচরণ করার কোন অধিকার সাহেবের নেই। সাহেব তাঁকে উত্তরে গালি দিলে লাজুক শশিভূষণ হুট করে মারমুখী হয়ে সাহেবকে মারতে শুরু করেন।
এরপর কি হলো? এরপর তিনি জেগে উঠলেন পুলিশের থানার ভেতর। শশীর বাবা উকিল ব্যারিস্টার নিয়োগ করে ছেলেকে জামিন পাওয়ালেও যে জেলেদের জন্য শশী এই ঘোরতর বিপদ কাঁধে নিল, তারাও তাঁর বিপক্ষেই সাক্ষ্য দিল। পরাধীন জাতির মেরুদন্ড বলে কিছু থাকে না! শশীর পাঁচ বছরের জেল হলো।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের আর ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। শশীর জেলে ঢোকার পরই তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। বড় ভাই দূরের এক প্রদেশে চাকরি করেন। শশীদের গ্রামের সব পৈতৃক সম্পত্তি অধিকাংশই গিরিবালার বাবা নানা কৌশলে নিজের মালিকানায় নিয়ে নিয়েছে। পাঁচ বছর পর জেলখানার বাইরে এসে শশীভূষণ যেদিন দাঁড়ালেন, সেদিন যেন ‘স্বাধীনতা পাইলেন কিন্তু তাহা ছাড়া কারার বাহিরে তাঁহার আর-কেহ অথবা আর-কিছু ছিল না।‘ কোথা থেকে আবার সব শুরু করবেন এমন ভাবার সময়ে একটি বড় গাড়ি জুড়ি গাড়ি তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল এবং এক ভৃত্য নেমে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার নাম শশিভূষণবাবু?‘
গল্পের শেষটায় রবীন্দ্রনাথ কি কিছুটা ‘উইশ ফুলফিলমেন্টে‘র দিকে ঝুঁকেছেন? গিরিবালার যদি দশ বছরে বিয়ে হয়, পাঁচ বছর পর তার বয়স মাত্র পনেরোই হবে। পনেরোয় বাল্য বিধবা কেউ হতে পারে এবং তার স্বামী অনেক টাকা-কড়ি রেখে গেলে ভাল কথা। কিন্তু সেই সময়ে প্রতিটি পরিবারে কমসে কম দু/তিন জন পুত্র-সন্তান থাকতেন। গিরিবালার স্বামী মারা গেলেই গিরিবালার শ্বশুরবাড়ি শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর-দেবর এবং সর্বোপরি গিরিবালার নিজেরই বাঘের মত ভয়ানক এবং শ্বাপদের মত কুটিল বাবা হরকুমার সবার শাসন মুক্ত হয়ে এবং প্রয়াত বরের অর্থবলে বলীয়ান হয়ে খুবই ক্ষমতায়িত একজন নারীর মত ভৃত্যকে বড় গাড়িতে করে ঠিক যে জেলে এতদিন শশিভূষণ ছিলেন, তাঁর খালাস পাবার দিন-তারিখ মিলিয়ে ঠিক সেই সময়েই সেই জেলের গেটের সামনেই গাড়ি পাঠিয়েছেন, এতটা রূপকথার মতই সুন্দর, সুখকর তবে অবাস্তব মনে হয়। পথিকের কৌতূহলী দৃষ্টি এড়াতে গিরিবালার ভৃত্যের নির্দেশমত শশীভূষণ সেই জুড়ি গাড়িতে উঠে বসেন এবং পথে শোনেন ভিখিরি বোষ্টুমরা গুপিযন্ত্র ও খোল করতাল-যোগে গান গাইছে, এসো এসো ফিরে এসো- নাথ হে, ফিরে এসো!
আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত,
বঁধূ হে, ফিরে এসো!
সেই সুর শশিভূষণের মনে যে চা ল্য সৃষ্টি করলো, তাতে তিনি একটির পর একটি নিজেই মনে মনে পংক্তি সংযোজনা করতে থাকেন,
আমার নিতি-সুখ ফিরে এসো,
আমার চিরদুখ, ফিরে এসো!
আমার সব-সুখ-দুখ-মন্থন-ধন, অন্তরে ফিরে এসো!
গল্পটির শেষটি আমার মত কাঁচা লেখকদের হাতে পড়লে পুরোটাই ‘উইশ ফুলফিলমেন্টে‘র সিনেমা মনে হতে পারত। রবীন্দ্রনাথের লেখা বলেই শেষটা পড়তে একটা অপ্রাকৃত স্বপ্নদৃশ্য অথবা চোখের জলে আঁকা কোন সাদা-কালো রূপকথার মত মনে হয়। সেই জুড়ি গাড়ি একটি প্রাচীরঘেরা বাগানের মধ্যে ঢুকে একটি দোতলা দালানের সামনে থামে। শশিভূষণ ভৃত্যের নির্দেশে বাড়ির ভেতর ঢুকে যে ঘরে এসে বসেন, সেখানে ঘর জুড়ে বড়ো বড়ে কাচের আলমারিতে নানা রঙের ও নানা মলাটের সারি সারি বই সাজানো। এরপরই শশিভূষণ দেখতে পান টেবিলের উপর একটি ভগ্ন স্লেট, কয়েকটি পুরনো খাতা, ছিঁড়ে আসা ধারাপাত, কথামালা, কাশীরামদাসের মহাভারত এবং স্লেটের কাঠের ফ্রেমের উপর ‘শশিভূষণের হস্তাক্ষরে কালি দিয়া খুব মোটা করিয়া লেখা- গিরিবালা দেবী।‘ শশিভূষণ বুঝতে পারেন যে কোথায় এসেছেন এবং নষ্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অনেকটা সময় পরে মৃদু শব্দে চমকে দেখেন যে একটি রূপোর থালায় ফল ও মিষ্টান্ন রেখে গিরিবালা সামনেই অপেক্ষা করছে। ‘তিনি মস্তক তুলিতেই নিরাভরণা শুভ্রবসনা বিধবাবেশধারিণী গিরিবালা তাঁহাকে নতজানু হইয়া ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিল।…সেই কীর্তনের দল ভিক্ষা সংগ্রহ করিতে করিতে অট্টালিকার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল এবং পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করিয়া গাহিতে লাগিল- এসো এসো হে!‘
এই গল্প যে সময়ের ততদিনে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে এবং বৃটিশ শাসকের অনুমোদনে ‘হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন‘ পাশ হয়েছে বটে তবে সমাজে কি তখনো সেটা সর্বমান্য হয়ে উঠেছে? উপনিবেশই শশিভ‚ষণের যাবতীয় দূর্গতির কারণ হলেও উপনিবেশই আবার নারীশিক্ষা বা বিধবা বিবাহ সম্ভব করেছিল। গিরিবালা ও শশিভূষণের জীবন নতুন কোন পথে মোড় নেবে কিনা তার কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত গল্পকার দেন নি। অতটা প্রত্যাশা করতেও ভয় করে। তবে ইতিহাসের ভাল দিক এটাই যে সময়ের চাকা যেটা সামনে যায়, তা‘ আর পেছনে ফেরে না। বৃটিশের উপনিবেশ তাই তার সব নির্মমতা ও ভয়াবহতার পরও বিধবা বিয়ে বা নারীশিক্ষা সম্ভব করেছে এবং সেখানে গিরিবালা ও শশিভূষণরা নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজে পেলেও পেতে পারে। সম্ভব হলে এই প্রবন্ধের সব পাঠককে লাইসা আহমেদ লিসার গলায় ‘ফিরে এসো বঁধূ হে‘ গানটি শুনে দেখতে অনুরোধ করি।
কবি,কথাসাহিত্যিক