| 18 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস কোথায় কি বিনোদন ভ্রমণ লোকসংস্কৃতি

লালন কে নিয়ে লালন মেলার উৎস ভ্রমণ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

জনশ্রুতি আছে কথিত বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইজি ছেঁউড়িয়া গ্রামে দোল উৎসবে সাধুসঙ্গ করতেন তার ভক্তবৃন্দদের নিয়ে। তারই পরম্পরায় এখনো ফাল্গুন মাসের দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠানটি পালিত হয়ে থাকে। কালের বিবর্তনে সেটি এখন মেলায় পরিণত হয়েছে, শুধু মেলা নয় বৃহত্তরও মেলায় লালন উৎসব নামে পরিণত হয়েছে।

সারা পৃথিবীর বাউল মতবাদীরা, বাউল ভাবনার মানুষেরা একত্রিত হন এই দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠানে। লালন সাঁইজি নিজেই এই দোল উৎসবের প্রবর্তক। দোল উৎসবের জের ধরেই সাঁইজির মৃত্যুর পরে সংযুক্ত হয়েছে তিরোধান দিবস। এইতো কয়দিন আগে ১২৮ তম তিরোধান দিবস পালিত হয়ে গেল কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া গ্রামে, এটা হয় পহেলা কার্তিক। আসলে মেলার ইতিহাসতো অনেক বড়, বাংলাদেশের মেলা নিয়ে অনেক কাজও হয়েছে। তবে লালন মেলার মধ্যে অন্য সমস্ত মেলার একটি আলাদা তফাৎ রয়েছে। কারণ এখানে মরমী সাধক বাউল স¤্রাট লালন সাঁইজি জড়িত। সাধুদের পদ্ধতি প্রথা প্রকরণ মেনে এই মেলা হয়ে থাকে। সাধারণত আড়াইদিন লাগে লালন সাঁইজির অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে। অনুষ্ঠানটি অধিবাস থেকে শুরু করে আল্লা আলেক সাই ডেকে শেষ করে থাকে। ভিন্নমতে সন্ধায় কাকডাকা বা রাখাল সেবা দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এতে চাল পানি পান করে সাধু ও ভক্তবৃন্দরা। তারপরে চলে গুরুভক্তি। এর পরে চলে গান-বাজনা। এ সময় লালন শাহের গুরুভক্তি গানই গেয়ে থাকেন সাধুরা। পরে গুরু দৈন্য মাঝরাতে অধিবাস সেবা শেষে আবার গান চলে ভোর পর্যন্ত। শেষে চলে গৈষ্ঠোর গান। সকালে বাল্যসেবা, পরে দুপুরে পূর্ণসেবা দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।

এটি এমন একটি অনুষ্ঠান যেখানে কেবলমাত্র মেলার মানুষের ভিড় বা উপচে পড়া আনন্দই নয় এখানে আধ্যাত্মিক চেতনা বোধের মত বিনিময়ের জন্য যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে। একজন সাধুর সঙ্গে আর একজন সাধুর মত বিনিময় এবং মানুষিক লেনদেনের জায়গা রয়েছে এবং সারা বিশ্বের মরমী বাদীদের একটি চমৎকার মিলন মেলা বলা যেতে পারে।

লালন ফকির দোল পূর্ণিমাতে কেন সাধুসঙ্গ করতেন?

লালন ফকিরের যখন ছেঁউরিয়ায় আবির্ভাব হয় তখন প্রথম অনুষ্ঠান এই দোল পূর্ণিমায় শুরু হয়। তবে দোল পূর্ণিমাকে লালন ফকির বেছে নিলেন কেন এ বিষয়টা আমরা অধিকাংশই অবগত নই। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে জানা যায় পৃথিবীর বুকে এই দোল পূর্ণিমায় এমন একটা মহাপুরুষের আবির্ভাব হয় তার নাম হল নিমাই। নদীয়াই আবির্ভাব হয় বর্তমানে যেটা কুষ্টিয়া জেলা। তখনতো অভিন্ন বাংলা কুষ্টিয়া নদীয়ার আওতাভূক্ত একটা মহাকুমার ছিল। সেই অভিন্ন নদীয়াই জন্ম নেয় সেই কালপুরুষ মহাপুরুষ নিমাই। নিমাইয়ের জন্মের আবার একটা বিশেষত্ব আছে। বিশেষত্বটা হল এমন কোন ইতিহাস বা এমন কোন মানুষের জীবনি আমি পড়ে দেখিনি যে একটা শিশু মাতৃগর্ভে ১৩ মাস ছিল, সেটা হল নিমাই।

এর বিশেষত্বটা কি?

নিমাইয়ের মায়ের নাম হল শচিমাতা, লালন শাহের একটি ঘারানাও আছে শচিমাতার নামে। পাঁচটি ঘারানা মিলে লালন ফকির, তার মধ্যে শচিমাতার নামে একটি। জগন্নাথ মিশ্র নিমাইয়ের বাবার নাম, তাদের রাজগুরু, ধর্মগুরু ছিলেন অদৈত ঠাকুর। ঐ সময় নিমাই যখন তার মাতৃগর্ভে ছিল তখন ১০ মাস হয়ে যায় সে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয় না। এ সময়ে পরিবারের সবাই জগন্নাথ মিশ্র সহ আত্মীয়-¯^জন ব্রাক্ষণ পরিবারগুলো বিশাল চিন্তায় পড়ে গেল। এটা আবার কেমন কথা তখন সবাই জিজ্ঞেস করে তোমার কি কোন অসুবিধা হয় না? শচিমাতা বলছে আমারতো কোন অসুবিধা হয় না। তখন সবাই মিলে তাদের গুরু অদৈত ঠাকুরের কাছে যায়। গিয়ে বলেন গুরুজি শচিমাতার তো এই অবস্থা, তখন বিশাল একটা মানুষিক বিভ্রাটের মধ্যে পড়ে অদৈত ঠাকুর। তখনতো প্রযুক্তি ছিল না, মানুষ যা করতো ধ্যান লগ্ন থেকেই করতো। অদৈত ঠাকুর বললেন তোমরা এখন যাও, এ বিষয়টা নিয়ে আমি আরো একটু ভেবে দেখি। এটা আমার বলার জানার বাহিরের ব্যাপার। ১১ মাস হয়ে যাচ্ছে শিশু ভূমিষ্ট হয়না অথচ মায়ের কষ্ট হয়না সে কে? তার পরে সে তার যোগ ধ্যান শেষে জানতে পারে যে, এটা নিয়ে ভাবনা চিন্তার কিছু নেই। পৃথিবীতে একটা মহাপুরুষের আবির্ভাব হবে এবং একটা যোগ তিথী অনুযায়ী সে পৃথিবীতে আসবে সেটা আরো দেরী হতে পারে সে তিথীতেই আসে। তখন পুরো ব্রাক্ষণ সমাজ চিন্তায় আছে মহাপ্রভূ বাণী দিয়েছে একটি মহাপুরুষের আবির্ভাব হতে যাচ্ছে পৃথিবীতে সে কে? তখন ১৩ মাস পরে এই যোগ হয় দোল পূর্ণিমায়, এই দিনেই নিমাইয়ের জন্ম হয়।

নিমাই কে?

একটা গোত্র বলে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পুনঃজনম আত্মা, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূ কলিযুগের অবতার সে নদীতায় আসে তার জন্মের দিনটা দোল পূর্ণিমায়। সেই দোল পূর্ণিমাতে এই মহা প্রভূর উদ্দেশ্যে গোটা নদীয়ায় শুরু হল সর্বপ্রথম আনন্দের একটা হোলী। পরবর্তীতে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তারপরে দেখা যায় নিমাই একটা শিশু। তার শৈশবের বিষয় উপলব্দি করলে দেখা যায় সে আসলেই মহাপুরুষ। সেই মহাপুরুষের আবির্ভাবের কারণে ওই দিনে সাধুসঙ্গ করতেন লালন ফকির। নিমাই ২৪ বছর বয়সে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে এবং তারপর থেকে নিমাইয়ের নাম হয় শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য দেব।

লালন ফকির কতদিন ধরে সাধুসঙ্গ করতেন?

এভাবে তো বৈজ্ঞানিক ভাবে বলা সম্ভব নয় আর সে সকল মানুষেরাও এখন জীবিত নেই, কবে কখন শুরু করেছিলেন সেটা না জানা গেলেও আামার মনে হয় বা আমরা ধারণা করতে পারি যেহেতু তার জীবন দশায় করেছিলেন শেষ প্রান্তেই নয়, হয়তো মাঝামাঝি বয়সে করেছিলেন। তার ভক্তবৃন্দরা যখন বেড়ে গেছে, চারিদিকে ভক্ত ছড়িয়ে গেছে তখন থেকেই। এভাবে হিসাব করলে আনুমানিক তার জন্মসাল যদি ১৭৭৪ হয়ে থাকে, তাহলে যৌবন বয়স থেকেই শুরু করেছে ১৮ শতকের প্রথমে বা প্রথম আর্ধেই হয়েতোবা।
মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করা যায় অন্যান্য মেলার থেকে লালন মেলা ভিন্ন কারণ এখানে সাধুসঙ্গ ও গাঁজার ব্যবসায় হয়ে থাকে এবং উন্মুক্ত ভাবে। বর্তমান প্রজন্ম সেখানে সাধুদের সাথে গাঁজা সেবন করছে এবং মেলার নির্দিষ্ট একটি স্থানে গাঁজার হাটও বসেছে। ১৪-২৪ বছরের ছেলে-মেয়ে উভয়েই সেখানে গাঁজা সেবন করছে। এছাড়াও অনেক বেশধারী সাধুরা সেখানে গাঁজার ব্যবসায়ও করছে। জানা যায় তারা লালনকে ভালবেসে মেলায় আসেনা তাদের মূল লক্ষ্য গাঁজা ব্যবসায়। গাঁজাকে তারা সিদ্ধি, তামাক, মাল ও জিনিস নামে সম্বোধন করে থাকে।

এ বিষয়ে বাউল শফি মন্ডল বলেছেন- সাঁইজির পরম্পরা যে সাধুগুলো তারাতো এখন নেই। আর সেই সময়ে অল্প বয়সে যারা গাঁজা খেত সাধুদের সাথে তারাই এখন বাউল বা সাধু, আসল কেও নেই।

তারমানে আপনি বলছেন যারা গাঁজা খাচ্ছে সাধুদের সাথে তারাই আমাদের ভবিষৎ সাধু?
আমি সেটা মনে করছি না, কারণ সাধু হওয়া আলাদা ব্যাপার। আর গাঁজার ব্যাপারটিও আলাদা। গাঁজা হল নেশা আর নেশা কখনও মানুষকে ভাল পথে নেয় না। যে গাঁজা খায় সে লালন ফকিরের লোক এটাও ভূল। লালন নিজেও গাঁজার বিরুদ্ধে ছিলেন। এটা নিয়ে সাঁইজির গানও আছে।

“গাঁজায় দম চড়িয়ে মনা
বোম কালী আর বলো না রে”

তাছাড়া আমি শুনেছি সারা বিশ্বে গাঁজা খাওয়া লোক আছে, তবে শোনার চেয়ে একটা কথা আছে সেটা হল মানুষ ধর্ম, মানুষকে ভালবাসার ধর্ম গুরুকে ভালবাসার ধর্ম। কারণ গুরু প্রেম যার অন্তরে লাগে তার অন্য নেশা কাজে লাগে না, অন্য নেশা তার দরকারও নাই। গুরু প্রেমের যে নেশা আছে সে নেশা এতই কঠিন নেশা যে ভোমই কাটেনা, প্রেমের নেশা, সেখানে সাধারণ একটা গাঁজার নেশা দিয়ে মানুষকে বিচার করা যায় না। গাঁজা একটা মাদক দ্রব্য। আর গাঁজা একটা সিদ্ধ পুরুষের খাবার। যারা সিদ্ধ পুরুষ তাদের জন্য কোন সমস্যা নয় গাঁজা খাওয়া, আর সেই সিদ্ধ পুরুষের জের ধরে বর্তমান যারা বেছে নিয়েছে সাধুত্ব বা গাঁজা আমি মনে করি তারা খুব মেধাবী। এটা সবাই বুঝতো না এখন কিন্তু ছেলে-মেয়েরা বোঝে।

অজ্ঞতা মূর্খতার মধ্যেই আমরা আছি ঘোরের মধ্যে। সাঁইজির মাজারের একটা নির্দিষ্ট স্থানে জায়গা আছে গাঁজা খাওয়ার। ওখানে গিয়ে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু সেখানে ৩০ জন খাচ্ছে তার মধ্যে ১ জন হয়তো আছে তার যোগ্যতা আছে গাঁজা খাওয়ার। লালন বলেছে- “গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়”। নারী আর গাঁজার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই কারণ দুইটাই গোপনে খাওয়ার জিনিস এটা খোলা নয়। এমনকি ভক্তের সামনেও খাওয়া যাবে না তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝবেও না খাবেও না। যে সাধনার সন্ধান পাবে সেই সেটি খুঁজে পাবে মেলায় গিয়ে খুঁজতে হবে না। গোপনের কাজ গোপনেই করা উচিৎ। এটা মেলায় বসে খাওয়ার কাজও না, যার যেইটা সেই বুঝে খাচ্ছে। এটা নিতান্তই যারা সিদ্ধ পুরুষ তারা গোপনে খায়।
নাজমুল হুদা সজীব

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত