ফরিদ কবিরের ভাবনায় ভাষা
সেনাবাহিনীর তরফ থেকে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি একটা টেক্সট ম্যাসেজ এসেছে। তাতে লেখা, ‘দুঃসাহসীক নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে যোগ দিন।’
শব্দটা হবে, ‘দুঃসাহসী’ বা ‘দুঃসাহসিক’। কিন্তু তারা লিখেছেন, ‘দুঃসাহসীক’! ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালিরা যখন ভাষা বিষয়ে কিছুটা বেশিই স্পর্শকাতর, খানিকটা আবেগপ্রবণও সে সময়টায় এমন ভুল বানান চোখে পড়ার মতোই।
আমার ধারণা, বাঙালিরা যতোটা ভুল বানান, ভুল বাক্য এবং বিকৃত ও গোঁজামিল ভাষা ব্যবহার করেন, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষাভাষী মানুষ তা করেন না। অন্তত ইংরেজি ও হিন্দিভাষায় এ ধরনের কোনো ভুল আমার চোখে কখনো পড়েনি!
সরকারি চিঠিপত্রে বানান ভুল চোখে পড়ে বেশি। শব্দের ভুল ব্যবহারও। যেমন, ‘অত্র মন্ত্রণালয়’, ‘চলাকালীন সময়ে’, ‘প্রতিপাদ্য বিষয়’, ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’, ‘জাতী’ ইত্যাদি। অনেকেই মনে করেন, ‘অত্র’ মানে ‘এই’! আসলে ‘অত্র’ মানে ‘এখানে’! ‘চলাকালীন’ মানেই ‘চলার সময়ে’, ‘প্রতিপাদ্য’ মানেই ‘বিষয়’।
প্রমিত বাংলার বিপরীতে এক ধরনের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও আমাদের চোখে পড়ে। সাহিত্যে এর ব্যবহার চলতে পারে, কোনো কোনো কবি তাদের কবিতায় মুখের ভাষা ব্যবহার করে কিছুটা চমক তৈরি করার পর এ ভাষায় গদ্য লেখার প্রবণতা গত এক দশকে কিছুটা বেড়েছে। বেড়েছে না বলে বলা দরকার, এ ভাষা এখন এক অর্থে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে।
আঞ্চলিক এই ভাষায় ক্রিয়াপদের ব্যবহার একেক জনের একেক রকম। একই ক্রিয়াপদের বানান একেকজন একেকভাবে লিখছেন! যেমন, কেউ লিখছেন, ‘খাইতেছে’, কেউ ‘খাইতাছে’, কেউ ‘খাইত্যাছে’!
ফেসবুকে বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করতে গিয়ে বা মন্তব্য করতে গিয়ে অপ্রমিত ভাষা ব্যবহার করাটাকে আমার ততোটা অসঙ্গত মনে হয় না। এমনকি, গল্প-উপন্যাস বা কবিতায় এর ব্যবহারকেও আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু সাহিত্যিক গদ্য রচনার ক্ষেত্রে গুরুচন্ডালী ভাষার ব্যবহার আমার কাছে অন্তত কাঙ্ক্ষিত মনে হয় না।
যারা বাংলিশ ভাষা ব্যবহার করেন, সেটাকে যদি আমরা ভাষার বিকৃতি হিসেবে দেখি, তবে গুরুচন্ডালী ভাষাকেও আমার একই রকমের বিকৃতি বলেই মনে হয়।
তা ছাড়া, বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর ভাষাও এখনো আদ্দিকালে পড়ে আছে। ‘আজকের কাগজ’-এ থাকতে আমার কবিবন্ধু আবু হাসান শাহরিয়ার একটা বানানরীতি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই বানানরীতির পাশাপাশি আমরা সেই কাগজের একটা সহজ ভাষারীতি তৈরিরও চেষ্টা করেছিলাম। ‘আজকের কাগজে’ এ বিষয়ে পুরোপুরি সফল না হলেও ‘ভোরের কাগজে’ অনেকটাই আমরা সফল হয়েছিলাম।
আমাদের দৈনিকগুলোতে যে ভাষারীতি চালু আছে তাতে এখনো তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের যথেষ্ট আধিক্য আছে। সেখানে এখনো, ‘তিনি পুষ্পস্তবক গ্রহণ করলেন’, ‘তিনি সনদপত্র প্রদান করলেন’ জাতীয় বাক্য লেখা হয়। অথচ এর বদলে ‘ফুলের তোড়া নিলেন’ বা ‘সনদপত্র দিলেন’ ব্যবহারই বেশি যুক্তিযুক্ত।
আমাদের অনেকেই এখনো মুখে বলি এক রকম, কিন্তু লিখতে গেলেই সাধু রীতি-চলিত রীতিকে গুলিয়ে ফেলি। কেউ কেউ তার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলি আঞ্চলিক ভাষা ও ইংরেজি ভাষাকেও।
এক সময় পশ্চিমবঙ্গের ভাষার অনুকরণে এদেশের সাহিত্যেও ‘গেলুম’, ‘খেলুম’, বা ‘করলুম’ জাতীয় ক্রিয়াপদের ব্যবহার আমার চোখে পড়েছে। কথাশিল্পী মাহমুদুল হক তো এমন ক্রিয়াপদ ব্যবহার করতেনই। আরো অনেকেই করতেন। এখন এ ধরনের ক্রিয়াপদ এ অঞ্চলের মানুষ যেমন ব্যবহার করেন না, সাহিত্যেও এ ধরনের ক্রিয়াপদের ব্যবহার নেই।
আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ভাষার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভাষার বিস্তর তফাৎ আছে। আর সেটা নিহিত আছে আমাদের নৈমিত্তিক ভাষা ব্যবহারের মধ্যেই।
আমাদের ভাষায় এদেশের মাটির যে-গন্ধ ছড়ানো, সেটা পশ্চিমবঙ্গের ভাষায় ততোটা নেই। বাংলাদেশের বাংলাভাষার স্বাতন্ত্র্যও সেখানেই। ভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাও যতোটা আবেগমেশানো, ততোটা হয়তো নয় পশ্চিমবঙ্গের ভাষার সঙ্গে সেখানকার বাঙালিদের।
কেন নয়?
সূর্য যেমন পুবে উদিত হয় এবং পশ্চিমে অস্ত যায়, তেমনি আমার মনে হয়, আবেগের জন্মও পুবেই, আর সেটা পশ্চিমে গিয়ে নিঃশেষিত হয়ে যায়!