| 28 নভেম্বর 2024
Categories
দেশ মুক্তিযুদ্ধ রাজনীতি সাক্ষাৎকার

বঙ্গবন্ধু হত্যার দশদিন আগে (অনুবাদ)

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

১৯৭৫ সালের ৬ আগস্টের তার বার্তা “প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমানের সাথে মতবিনিময়।” অতিগোপনীয় এই তার বার্তাটি উইকিলিকস ফাঁস করে দেয় এবং সাংবাদিক প্রবীর বিধান তার ব্লগে প্রকাশ করেন।    

আততায়ীর হাতে খুন হওয়ার আগে শেখ মুজিবের শেষ সাক্ষাৎকার

ঢাকার নিজ বাসভবনে আততায়ীর হাতে সপরিবারে খুন হওয়ার মাত্র ১০ দিন আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস বোস্টার বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করেন। আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনায় যেসব বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছেন সেগুলো কিভাবে অতিক্রম করা যায় তার পরিকল্পনা ডেভিস বোস্টারের সাথে বিশদ আলোচনা করেন।

সাক্ষাৎকারের সারাংশঃ

প্রেসিডেন্ট মুজিবের সাথে আমার গতকালের সাক্ষাৎকারে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সাহায্যের জন্য উচ্ছসিত ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, খাদ্য সাহায্যের কারণে এখন তিনি নির্ভারচিত্তে সরকারের অন্যান্য কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারবেন। কিছু অত্যাবশ্যকীয় সমবায়ী ব্যবসায় উদ্যোগের পরিকল্পনা তিনি আমার কাছে পরিষ্কার করেছেন এবং সেসব ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করতে চান। যেমন বাকশাল পার্টি নিয়ে তার পরিকল্পনা হলো, দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা থাকবে সংখ্যায় কম এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনের কর্মীর সংখ্যা হবে বিশাল পরিমাণ। তিনি ইজরায়েল বিষয়ে জাতিসংঘের অবস্থান কোন উল্লেখযোগ্য সমালোচনা ছাড়াই মেনে নেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের উপর বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হবে যা হবে মুজিবের ধারণা বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কোম্পানীকে জাতীয়করণ করা হয়েছে সেসব কোম্পানীর ক্ষতিপূরণ দাবী মিটিয়ে দেয়া হবে বলে তিনি ইতিবাচক মন্তব্য করেন। দাবী মেটানোর জন্য তিনি তার দুইটা মন্ত্রণালয়ের বিশদ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন।

নিয়মিত মতবিনিময়ের পরিক্রমায় পরিস্থিতি অবগত হওয়ার জন্য গতকাল আমি প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক আয়োজন করতে অনুরোধ করি। তিনি আমাকে একান্তে আধাঘন্টা আলাপাচারিতার সময় দেন। মুজিব নিম্নলিখিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাঃ

প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে জুনে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দাতা সংস্থাগুলোর সাথে মিটিংয়ে বাংলাদেশ সরকার অন্যান্য দাতা দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার জন্য অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রেসিডেন্ট প্রথম মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূয়সী প্রশংসা করেন বিশেষ করে উদারভাবে খাদ্য সহায়তার জন্য। প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি কৃতজ্ঞ, সত্যিই আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ এবং আমি অনুরোধ করছি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা আপনার সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন।”

প্রেসিডেন্ট বলেন, “কোথা থেকে খাদ্য আসবে এই দুশ্চিন্তা কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহযোগিতার কারণে তিনি সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিরবিচ্ছিন্ন মনোনিবেশ করতে পারছেন।” তিনি বলেন, “ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনায় খাদ্যের অবৈধ মজুদ ঠেকাতে তিনি দেশব্যাপী খাদ্যের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে তিনি সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছেন। সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে তিনি গ্রামাঞ্চলে খাদ্যগুদাম নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন।” আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম, “আপনার সরকার পক্ষের লোক এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের দরকষাকষিতে চলতি বছরের শুরুতে Agricultural Trade Development and Assistance Act of 1954 সংক্ষেপে পিএল-৪৮০ বা খাদ্যের বিনিময়ে শান্তি চুক্তির আওতায় ৪০০০০০ টন খাদ্যশস্য এবং ১৫০০০ টন ভোজ্য তেল সহায়তার ঘোষণা দেয়। তখন প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেন, “ এই সাহায্যের কারণে আমরা পরবর্তী বছর পর্যন্ত খাদ্য চিন্তায় নির্ভার।”

 

 

 

বাধ্যতামূলক সমবায়ঃ

প্রেসিডেন্ট বাধ্যতামূলক সমবায় প্রকল্পের পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আলাপচারিতা শুরু করলেন। তিনি জানালেন আসছে বছরের মধ্যেই তিনি ৬১টি জেলায় ৬১টি সমবায় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করবেন। পরবর্তী বছরে আরও সমবায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা লাগবে কিনা তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন না এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমবায়ের সুবিধা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কমপক্ষে দুইবছর সময় লাগতে পারে। তিনি বললেন, “বাংলাদেশের কৃষকদের জোর করে সমবায়ের আওতায় নিয়ে আসার ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু যদি তার ধারণা অনুযায়ী ৬১টি সমবায় প্রতিষ্ঠান সফলতার মুখ দেখে তাহলে সামনের বছরগুলোতে কৃষকরা সুবিধা পেতে সমবায়ে যোগ দেবে।” যখন আমি বললাম, “আমি সমবায় বিষয়ে কিছু সাংঘর্ষিক প্রতিবেদনের খবর জেনেছি যে বাংলাদেশ সরকার সমবায় প্রতিষ্ঠান থেকে লভ্যাংশ গ্রহণ করবে। তখন প্রেসিডেন্ট ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন সমবায় প্রতিষ্ঠান সার, কীটনাশক এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণের জন্য সরকারকে উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করবে এবং উপরন্তু সমবায়ের লভ্যাংশের দুই শতাংশ সরকারকে প্রদান করবে। সেই দুই শতাংশ সরকার জনগণের জন্য খাদ্যশস্য সরবরাহ এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ব্যয় করবে।” অন্যদিকে সমবায় প্রতিষ্ঠানের কৃষকদের কাছে প্রত্যাশা তারা যেন তাদের লভ্যাংশের একটা অংশ সঞ্চয় করে যাতে নিজেদের বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। তিনি এসব সমবায়কে গ্রামে এলাকাভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে গড়ে তুলতে চান। তারা মাছ চাষ এবং অন্যান্য গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সমন্বিত করবে। প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি লক্ষ্য করেছি কৃষকরা রক্ষণশীল সম্প্রদায় এবং তারা সহজে কোন পরিবর্তন মেনে নিতে পারে না। বাংলাদেশের কৃষকদের ক্ষেত্রেও একথা সত্য এবং এই কারনেই তিনি কৃষকদেরকে জোর করে সমবায়ে নিযুক্ত করতে চান না। প্রেসিডেন্ট মুজিব তার ১৯৫৭ সালের চীন পরিদর্শনের কথা স্মরণ করলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, চীনের সমবায় ব্যবস্থা যেখানে পরিবার বিচ্ছিন্ন কেউ যৌথভাবে কাজ করতে পারে না।    

বাকশাল এবং মুজিবের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ

কেমন বড় রাজনৈতিক দলের স্বপ্ন দেখেন আমার এমন একটা প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, নিয়ন্ত্রক দল হবে সংখ্যায় সীমিত। দলের সদস্যকে অবশ্যই বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতে হবে। সেই রাজনৈতিক দলের পুরোভাগে বিশাল সদস্যদের সমন্বয়ে শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত হবে। আলাপচারিতার মাঝখানে প্রসঙ্গান্তরে তিনি মার্ক্সবাদী নন বলে নিজের অবস্থান খোলাসা করেন। “আমি মার্ক্সবাদী নই। আমি সমাজতন্ত্রী কিন্তু সেই সমাজতন্ত্র আমার একান্ত নিজস্ব পন্থা। আমি সব দেশের সাথে বন্ধুত্ব চাই কিন্তু কোন দেশ প্রভাব বিস্তার করে আমাকে বলে দিবে আমার কী করা উচিৎ সেটা আমি চাই না। আমি একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার ভালো বন্ধু হতে চাই। কিন্তু আমি কখনোই যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার প্রতিনিধি হতে চাই না।” প্রেসিডেন্ট ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলেন কেন তিনি এমন কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। সম্প্রতি একটা মিটিংয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, “ বাংলাদেশের আতিথেয়তা আর উদারতাকে অপব্যবহার করে অন্য দেশের বিরুদ্ধাচরণ করবেন না।” আমি বললাম, আমি আপনার এই মতামতকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি এবং সাধুবাদ জানাচ্ছি। আমি মনে করি, কোন দেশ এমন করে থাকলে এখন সময় এসেছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। মুজিব বললেন, “সত্যি, কিছু মানুষ ষড়যন্ত্রে অনেকদূর এগিয়ে গেছে।”

বাংলাদেশ সরকারের অর্থনীতি সংস্কারঃ

আমি প্রেসিডেন্টকে জানালাম সাম্প্রতিক সময়ে তার সরকারের আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের সুপারিশকৃত মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণ এবং অর্থনীতির সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কারণে যেসব পরিবর্তন এসেছে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সন্তোষ প্রকাশ করেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় স্থিতিশীল আছে এবং কমে এসেছে অন্যান্য খরচের হার। তখন প্রেসিডেন্ট বললেন যেভাবে সংস্কার পদক্ষেপের কারণে সফলতা এসেছে তার জন্য আমিও সন্তুষ্ট। এই সফলতা অর্জনের জন্য খাদ্যশস্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিগত বছরের তুলনায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে আমার এমন পর্যবেক্ষণে প্রেসিডেন্ট সহমত প্রকাশ করলেন।      

দুর্নীতিঃ

প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের আলোচনা প্রেসিডেন্ট মুজিবকে ভিন্ন আলোচনায় নিয়ে যায় এবং সেখানে তিনি জানান দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা তার এখনকার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। তার সরকার পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের কাজের ৬০ ভাগ সময় যেন তারা দুর্নীতি নির্মূলে ব্যয় করেন। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয়, সামাজিক অবস্থা বা সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা যেই হোক না কেন সে যদি দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতিতে জড়িত থাকে তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেসিডেন্টকে জানানোর দরকার নাই। তিনি মনে করেন, দুই তিনটি চিহ্নিত দুর্নীতিপ্রবণ ক্ষেত্র আছে সেদিকে ইতিমধ্যেই নজর দেয়া হয়েছে এবং পরিস্থিতি এখন অনেকটাই উত্তোরণের পথে।    

সম্পদ জাতীয়করণের ক্ষতিপূরণঃ

আমি প্রেসিডেন্ট মুজিবকে বললাম, আমেরিকান কোম্পানির সম্পদকে জাতীয়করণের ফলে উদ্ভূত দীর্ঘ অমিমাংশিত ক্ষতিপূরণ পাবার প্রত্যাশায় আমি আপনার শিল্প এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্প্রতি কথা বলেছি। সংকট হয়ত আর্থিক বিবেচনায় সামান্য পরিমাণ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতীয়করণ দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির পথে বড় বাঁধা। মুজিব বললেন, তার সরকারের মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার বিষয় তাকে জানিয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে রিপোর্ট করতে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের জাতীকরণের ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে। পাকিস্তানী মালিকানার সব সম্পত্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হবে কিন্তু তিনি মনে করেন আমেরিকার মালিকানায় থাকা যে কোন সম্পত্তির জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো তার বার্তায় ডেভিস বোস্টার লিখেছেন তিনি প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে বলেছেন, বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্য দেয়া লাখ লাখ ডলারের সাহায্যের তুলনায় দুই তিন লাখ ডলার ক্ষতি আসলে তেমন কিছুই না। কিন্তু ব্যবসায়ের নীতিমালানুসারে জাতীয়করণকৃত সম্পদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমি খুব সংক্ষেপে আমাদের কূটনৈতিক পন্থায় তাকে বুঝিয়ে বলেছি।       

আমাদের আলোচনায় প্রেসিডেন্ট মুজিবকে বলেছিলাম, “যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ১৪ জুলাইতে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণের সময় এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংসদের সপ্তম বিশেষ অধিবেশনে সাধারণ সভায় আমাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আলোচ্য বিষয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে জানাতে চেয়েছিলাম। যদি তার পড়ার সময় হয় তবে প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সচিবের কাছে আলোচনার বিশদ বিবরণ রেখে যেতে পারি।” আমি প্রেসিডেন্ট মুজিবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘United States Exports of Domestic and Foreign Merchandise’ বিভিন্ন ধারার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশ এবং উন্নত দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘকে আরও বেশি গঠনমূলক ভুমিকায় দেখতে চায়। কিন্তু আমরা পারস্পারিক বিরুদ্ধাচরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

গোষ্ঠীবদ্ধতা জাতিসংঘের কার্যকারিতা এবং সফলতার জন্য হুমকি স্বরূপ। আমি তাকে বলেছিলাম জাতিসংঘের সাধারণ সভা থেকে ইজরায়েলকে বহিষ্কার করাকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। মুজিব পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের জাতিসংঘ সাধারণ সভার বক্তৃতা প্রতিটি শব্দ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়তে চান। তিনি বলেন, জাতিসংঘের কর্মকান্ডে কেউ বিঘ্ন ঘটাতে চায় না। জাতিসংঘ কোন সদস্য রাষ্ট্রকে কোন বিষয়ে বাধ্য করতে পারে না। কিন্তু সদস্য হিসেবে থাকতে হলে ইজরায়েলকে জাতিসংঘের সব নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। প্রেসিডেন্ট আশাবাদ ব্যক্ত করেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে আমাদের পারস্পারিক সমস্যার অবসান ঘটবে এবং আমাদের উচিৎ ইজরায়েলকে দখলকৃত ভূমি ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা।

আমি প্রেসিডেন্ট মুজিবকে বললাম, আমরা কোন বিশেষ কার্যসিদ্ধির জন্য কেউকে বাধ্য করতে পারি না এবং আমি মনে করি, শান্তির জন্য সব পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। ঠিক এই কারণেই জাতিসংঘ থেকে ইজরায়েলকে বহিষ্কার করলে সমস্যার সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই উপরন্তু এর ফলাফল হবে ভয়ানক। মুজিব আমার কথার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলেও তিনি মনে করেন, ইজরায়েলের কার্যক্রমকে এখনো প্রভাবিত করার সুযোগ আছে।    

মন্তব্যঃ প্রেসিডেন্টের মনমেজাজ ছিল ফুরফুরে। আমাদের কথোপকথনে তিনি সব সময় সদালাপী এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। এমনকি তিনি গতকালের থেকেও আজ বেশি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ছিলেন। আমি মনে করি প্রেসিডেন্টের অনুরোধে বিভিন্ন দাতাদেশ বিশেষকরে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সাহায্যের তুলানায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আমেরিকার সহানুভূতিপূর্ণ বিশাল পরিমাণ খাদ্য সাহায্যের জন্যই তিনি এত হাসিখুশি নির্ভার ছিলেন। সম্ভবত তিনি দেখিয়ে দিলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের আলোকে তিনি কতটা স্পর্শকাতর হতে পারেন। যেমন তিনি নিজ দেশেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার খোলনলচে পালটে দিয়েছেন।

তিনি বারবার জোর দিয়ে বলছিলেন, তিনি মার্ক্সবাদী নন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, কোন শক্তিই তাকে বলতে পারে না তার কী করা উচিৎ এবং তিনি নিজে থেকেই চীনের কমিউনিজমের সমালোচনা করেন। আমার মনে হয়েছে আমরা যদি তার প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করতে পারি তাহলে তিনি আমাদের নির্দেশিত রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণ করতে পারেন।   

 

 

 

মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রবীর ঘোষের ব্লগেঃ

https://probirbidhan.com/2017/12/16/sheikh-mujibs-last-interview-before-assassination/

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত