| 19 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

ছোটগল্প: মৃত্যুর মত অন্ধকার । লতিফ জোয়ার্দার

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আজ ১ মার্চ কবি ও কথাসাহিত্যিক লতিফ জোয়ার্দারের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

বেশ অনেক সময় ধরে অন্ধকারে তাকিয়ে আছি। চারদিকে ছোপ ছোপ অন্ধকার। দশ হাত দূরের বস্তুও চোখে পড়ছে না। নারিকেলের চিরুল পাতাগুলো তখন চোখের সীমানার বাইরে জেগে আছে। খোলা জানালায় বিষণ্ণ চোখ আমার। মাঝে মাঝে ধেইয়ে আসছে হাসনাহেনার তীব্র গন্ধ। কিছু জোনাকি অবলিলায় আমার ঘরে আসছে, আবার কখনো অকারণেই চলে যাচ্ছে তারা। এমন তো কতদিন হয়। কত অন্ধকার চোখের তারায় এলোমেলো হয়। আমি ঠিক বুঝতে পারি না। এই যে আলো আঁধারির খেলা, কখনো আমার ভেতর বাহির একাকার করে দেয়। আমি মোমের আগুনে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকি। কেন যে এমন হয় আমার! সেই যে কবে জোসনা রাতে, উঠোনে মাদুর বিছিয়ে আকাশমুখি তাকিয়ে নক্ষত্র দেখেছিলাম। সেই কবে আলপথ ধরে দিগন্তের পথে হেঁটেছিলাম । পথ থকে পথে হৃদয়ের অব্যাক্ত কথামালাগুলো কখনো ফেরি করে বেড়াই আমি। পিছনের অনেক স্মৃতির জঞ্জাল এসে ভিড় করে আমার চারদিকে। তারপরও ছুটে চলি আমি! চলমান পথে থমকে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমার গন্তব্য কোথায়? আবার কখনো মনে হয়, আমি তো কোন এক সু-দূরের পথযাত্রী। জন্মের পর থেকেই ছুটে চলেছি মৃত্যুর কাছে। তার রূপ আমি দেখেনি। তার অনেক গল্প শুনেছি। সেই মৃত্যুই আমাকে বিভাজনের সাগরে ভাসবে একদিন। সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে আবার ফিরে যাব অন্ধকারে।

এসব প্রশ্নের কোন উত্তর জানা নেই আমার। আমার কেবলি মনে হয়, আমি তো একদিন ছিলাম না। মনে হয় এই পৃথিবীর রূপ আমি দেখিনি। হয়তো আবার থাকবো না। হয়তো আবার হারিয়ে যাব। নয়তো আবার ফিরে যাব। এই যে আমার থাকা না থাকার দিনগুলির কোলাহল। আমার অব্যাক্ত মনের ব্যঞ্জনা। সুরের জীবন থেকে সুরহীন নৈঃশব্দের দিনগুলিতে আমি হারিয়ে যাই। কিছু সময়ের জন্য আমার কেমন জানি লাগে। তার রূপমুগ্ধতা আমাকে অস্থির করে। ভেজা শিশিরের সাথে কথা বলি আমি। আমার মনে হয়, আমি ছিলাম কোন যুদ্ধবাজ সৈনিক। দীর্ঘপথের ক্লান্তি আমাকে একদিন আলোর সামনে নিয়ে এলো। পথের যাত্রী ছিলো যারা তারা আবার ফিরে গেল অন্ধকারে। একদিন আমার যে জগত ছিলো, মায়ার সংসার আমাকে বিভাজনের স্বর্গ এনে দিলো। আমি আমার আমিত্ব খুঁজে খুঁজে বহমান স্রোতের ধারায় হারালাম। যে বেষ্টনীতে আবদ্ধ থাকি। তার ভেতরে আলো, বাইরে অন্ধকার। মাঝে মাঝে আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। একদিন যে ঠিকানা ছিলো আমার, তার মায়াবী মুখ দেখে দেখে আলোর সংসার থেকে পালাতে চাই আমি। এক অন্ধকার গুহায় আবার ফিরে যেতে চাই । একাকী একদিন যেভাবে এসেছিলাম আমি…

কেন যে ভাবনাগুলো এমন হয়! ঠিক বুঝতে পারি না। তার কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় আমার। আমার দুরন্ত যৌবন চোখে ভাসে। আমার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট ছিলো শিমুল। এক স্কুলে পড়লেও খুব একটা দেখা হতো না। কথা হতো না। অথচ সেই শিমুল তার এক বান্ধবীর হাতে আমাকে প্রেমপত্র দিলো। ভাবলাম ভুলপাত্রে পত্র দান। না পড়েই ফিরিয়ে দিলাম সে পত্র। পরের দিন রাস্তায় পথ আগলে ধরলো শিমুল। তার ঠোঁট কাঁপলো। কথা বলার জন্য ব্যাকুল হলো শিমুল। অথচ একটা কথাও বলতে পারলো না। ফিরিয়ে দেওয়া পত্রখানি আবার আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এগুতে থাকলো । তখনও আমি তার যাত্রাপথে চেয়ে আছি। একবার মাত্র পিছন ফিরে তাকালো সে। আমি চেয়ে দেখলাম পথের বাঁকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে শিমুল।
কলেজে ভর্তি হবার পর শিমুলের সাথে আর দেখা হতো না। সে তখন ঘরণী। দিব্যি সংসার করছে। হেসেল ঠেলছে। বছর বছর সন্তান জন্ম দিচ্ছে। পিছন স্মৃতি আর মনে রাখতে চায় না শিমুল। আমি তার অদেখা ভুবন হয়ে গেলাম যেন। শত চেষ্টাতেও আর দেখা মিলতো না তার। তখন আমার সন্ধ্যা আসে রকমারি বিষাদ নিয়ে। মন খারাপের বার্তা ছাপা হয় আকাশের সাদা পাতায়। অসীম বেদনা নিয়ে ঘরে ফিরে প্রাণকৌড়ি। আমাদের তেতো নীমপাতা চেয়ে থাকে। আমাদের চারপাশে ধূসর মাঠ। দিগন্তরেখা থেকে ফিরে আসে অন্ধকার। মনে পড়ে এই অন্ধকারেই, জীবনের সব গভীর ক্লান্তিগুলো ফিরে আসবে আবার। মসজিদের মিনার ভেদ করে হারিয়ে যাবে সকল হাহাকার।
একদিন সেই শিমুলকেই আবার ফেসবুকে খুঁজে পেলাম আমি। প্রথমে অবশ্য আমার চিনতে কষ্ট হয়েছিলো। ফেসবুকে তো কত কত শিমুলেরা থাকে। সেখানে আমার যৌবনের ঊষালগ্ন পড়ে আছে কে জানতো! তার অবসরের সঙ্গী হয়ে গেলাম আমি। দিনে-দিনে যোগাযোগ বাড়তে থাকলো। কথা বাড়তে থাকলো। তখন তাকে ছাড়া যেন আমার ভুবন অন্ধকার। একদিন কথা না হলে অস্থির হয়ে যেতাম। ফেসবুকে না পেলে বুকের ভেতর কেমন যেন করতো। আমরা সব ভাবনা হলো সে। আমার একাকিত্বে সে হলো অধরা চাঁদ। ফেসবুকের আকাশে তার ছবির দিকে দীর্ঘসময় চেয়ে থাকতাম।

অতঃপর বছর তিনেক হবে। আবার হারিয়ে ফেললাম তাকে। বিছিন্ন যোগাযোগ। ফেসবুকে নেই শিমুল। ফোনে নেই শিমুল। মনে হয় কতদিন তার কোনো ফোন পাই না। এখন আমি নিজের সাথে নিজেই কথা বলি। বুকের গভীরে জমা একাকী কত কথা হয়! কী কথা হয় তাকে বলতে ইচ্ছে করে। মনে মনে তাকে বলি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যামালতীর কাছে জানতে চেয়ো। জোসনার প¬াবনে ভেসে ভেসে আকাশকে বলো? সে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবে একদিন। কী হাস্যকর সব, তাই না! আমার হাত ধরে রেললাইনে হাঁটবে? হঠাৎ আমার সামনে এসে আমাকে চমকিয়ে দিবে। সব মিথ্যে, সব মৃত্যুর মত অন্ধকার। জানি কোন আবেগ আকাশকে স্পর্শ করতে পারে না। ভালো পাটিগণিত জানো বলে, কত হিসেব-নিকেশ তোমার? অথচ এই এক জীবনে কষ্টের শাদা সেতু পারি দিতে দিতে আমি কত ক্লান্ত হয়েছি। বিষণœতায় ডুবে ডুবে জোনাকির আলো হয়েছি কতদিন। কবিতা ভালোবাসো! সে অনেকেই বাসে। কেউ কেউ বুকের অধরে কবিতা লালন করে। তুমি তাদেরই মত একজন। নেশায় বুদ হয়ে তোমাকে খুঁজি না ঠিক। কিন্তু যে হাহাকার থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছিলে। এখন আমার স্বাধীন সত্তা। ক্ষণে ক্ষণে আমার মৃত্যুর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। হয়তো একটা নীল শঙ্খচিল হয়ে আকাশে বিলিন হবো একদিন। তখন আমায় কেউ খুঁজবে না। কেউ বুঝবে না আমায়।

এলোমেলো সময়গুলো কখনো একাকিত্ব এনে দেয়। ঘর অথবা ঘরের বাইরে কিছুই ভালো লাগে না আমার। বেশ অনেকদিন পর, তাকে লিখতে ইচ্ছে হলো আমার। কী লিখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। জানি একদিন সে ভোরের পাখি হয়ে আসবে। ঘুম ভাঙিয়ে দিতে। তার নরম পালক ছুঁয়ে জেগে উঠবে শিশির। মেঘহীন আকাশ নীল চাদর পরে দাঁড়িয়ে থাকবে। কত কত অপেক্ষার প্রহর গুনে সবুজ টিকটিকির মত ক্ষয়ে যাওয়া পলেস্তরার সাথে করেছি দীর্ঘশ্বাস বিনিময়। যে মন্ত্র পড়ে বৃক্ষেরা বধির হয়ে তাকিয়ে দেখে লাল পিপড়ের ডিম নিয়ে পতঙ্গের কাড়াকাড়ি। তার ক্ষণকাল পড়ে তুমি এসো, আমাদের অরণ্য নিকেতনে মাটির সোদা গন্ধে ভরে দিবো বুক। অতঃপর অপেক্ষা, অতঃপর তার পথ চেয়ে বসে থাকা। তারপরও এমন আমার অনেকদিন হয়েছে। সকাল বেলায় ঘুম থেকে জেগেই মন খারাপ হয়েছে আমার। কেন খারাপ কীসের জন্যে খারাপ। এ নিয়ে তেমন বেশি একটা ভাবতে হয়নি আমায়। শীতের শুরু। হালকা কুয়াশার সাথে জমিয়ে গল্প করছে প্রকৃতি। সূর্য হারিয়ে গেছে কিছু সময়ের জন্য। বিষণœতা পেয়ে বসেছে আমায়। একটু পায়চারি একটু ঘাসের বুকে বসে থাকা শিশিরের সাথে কথা বলা। অতঃপর কাব্যময়তার ঘোর নিয়ে মাতালের মত পড়ে থাকা।

অভিমানী রাত্রী ছিলো পাশে। আমি যতবার ঘুমানোর জন্য ব্যস্ত হই! ঘুম হারিয়ে যায় একাকী। অনন্ত আকাশের দিকে ধাবমান কথার কিছু চাতুরী ঘুরে বেড়ায়। আমি অদৃশ্যমান কোন কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। আমার সামনে এখন চেনামুখগুলো ঘুরে বেড়ায়। চেনা রঙ চেনা গন্ধ এসে ভিড় করে। আরো কিছু সময় চলে যায়। দু’চোখের পাতা এক হয় না। কিছুতেই আমার চোখে ঘুম আসে না। কষ্টের সাদা পাতা পড়তে পড়তে হারিয়ে যাই একাকিত্বের ভেতর। কোনদিন কাঁটবে না এ জীবনের ঘোর অমানিশা, আসবে না ভোর।

কিছুটা দূরে কিছুটা কাছে কিছুটা ইচ্ছেয় কিছুটা অইচ্ছেয় য়তবার আমি আমার থেকে পালাতে চাই! ততবার তুমি ছায়ার মতো পিছু নাও। শাদা পালক ছুঁয়ে মমতায় জড়িয়ে রাখো। ধরে রাখো আলতো চুমুর মতো, যে মধুরাত ভেঙ্গে বিষণ্ণতা ধেইয়ে আসে, সেখানে অনাবিল চতুর বিড়ালের গল্প বলে যাও তুমি। গন্তব্য নিয়ে ভাবনার গান শোনাতে শোনাতে কষ্টবিলাস ফুঁটে মধ্যরাতে। ধ্যানমগ্ন বৃক্ষের কাছে দু’হাত প্রসারিত করে, অসল দুপুরের মত যন্ত্রণায় ভেসে যাব বিকেলের দিকে। হয়তো বিষণœ আলোয় হেঁটে যাব। নোলক বউয়ের মত সংসার ফাঁদে সব হাসির ফোঁয়ারা রেখে ফিরে যাবো অবগাহনের কালে। নিগুঢ় সব সত্যের কাছে ফিরে যাব একদিন নিবিড় বন্ধন ছেড়ে। আর তখনো কী ফেরাবে আমায় এভাবে! অজান্তে একাকী…

মনে পড়ে এক গোধূলিলগ্নে হাত ধরাধরি করে যে গন্তব্যে হাঁটতে চেয়েছিলাম আমরা। এখানে এখন কাঁটা তারের বেড়া। দুর-দিগন্ত থেকে ধেইয়ে আসা অন্ধকার স্পর্শ করে, ভেজা ধুলোর সাথে মিতালী ছিলো কিছু সময়ের। ধ্যানমগ্ন চারিপাশ থেকে জোনাকির দল পথ চিনিয়ে ছিলো একদিন হয়তো। কতটা কাছে দিগন্ত ছিলো জানা ছিলো না বলেই আবার কবরের নিস্তব্ধতায় ভেসে যাচ্ছিলাম। যে হাসির ফোঁয়ারায় মুখোমুখি আমাদের সারাটা দিন স্বপ্নের মত ছিলো। কোনো অতীত কোনো পুরাতন ভিড় করেনি আমাদের মৌনতায়। তৃষ্ণায় বুকের গভীর সরোবরে,জলের প্রত্যাশায় উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্তির মিছিল থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছিল একাকার হয়ে যাবার জন্য।
মনে নেই শেষবার আমাদের কবে দেখা হয়েছিলো। বেশ ভুলেই ছিলাম তার কথা। দু-জনার অচেনা গন্তব্য। সংসারের টানাপড়েন। দিনভর ব্যস্ততা। রাত্রী নামতো আর ক্লান্তি এসে ভিড় করতো চারদিকে। প্রতিদিন নতুন কথা নতুন স্মৃতি এসে ধুলোর মত হৃদয়ে আস্তর ফেলতো আর আমি হারিয়েফেলতাম তাকে। হয়তো তার কামনা তার আরাধনা ছিলাম না কোনদিন আমি। অবশেষে আবার তার সন্ধান পেলাম। দীর্ঘদিন পর। সে তখন মৃত্যুপথযাত্রী। মরণব্যাধি তাকে সব মায়ার বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিরঘুমের দেশে নিয়ে যাবে। আমাকে শুধুমাত্র একবারের জন্য দেখতে চায় শিমুল। জানি না! তার ম্লান হয়ে যাওয়া দৃষ্টি দিয়ে আমায় আর দেখতে পাবে কিনা!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত