| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ চিঠি সংখ্যা: মৃণালিনীদেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ভাই ছুটি
আজ ঢাকা থেকে ফিরে এসে তোমার চিঠি পেলুম। আমি তাহলে একবার শীঘ্ৰ কালিগ্রামের কাজ সেরে কলকাতায় গিয়ে যথোচিত বন্দোবস্ত করে আসব। কিন্তু ভাই, তুমি অনৰ্থক মনকে পীড়িত কোরো না। শান্ত স্থির সন্তুষ্ট চিত্তে সমস্ত ঘটনাকে বরণ করে নেবার চেষ্টা কর। এই একমাত্র চেষ্টা আমি সৰ্ব্বদাই মনে বহন করি এবং জীবনে পরিণত করবার সাধনা করি। সব সময় সিদ্ধিলাভ করতে পারিনে— কিন্তু তোমরাও যদি মনের এই শান্তিটি রক্ষা করতে, পারতে তাহলে বোধ হয় পরস্পরের চেষ্টায় সবল হয়ে আমিও সন্তোষের শান্তি লাভ করতে পারতুম। অবশ্য তোমার বয়স আমার চেয়ে অনেক অল্প, জীবনের সবর্বপ্রকার অভিজ্ঞতা অনেকটা সীমাবদ্ধ, এবং তোমার স্বভাব একহিসাবে আমার চেয়ে সহজেই শান্ত সংযত এবং ধৈর্য্যশীল। সেইজন্যে সৰ্ব্ব প্রকার ক্ষোভ হতে মনকে একান্ত যত্নে রক্ষা করবার প্রয়োজন তোমার অনেক কম। কিন্তু সকলেরই জীবনে বড় বড় সঙ্কটের সময় কোন না কোন কালে আসেই– ধৈৰ্য্যের সাধনা, সন্তোষের অভ্যাস কাজে লাগেই। তখন মনে হয় প্রতিদিনের যে সকল ছোট খাট ক্ষতি ও বিঘ্ন, সামান্ত আঘাত ও বেদনা নিয়ে আমরা মনকে নিয়তই ক্ষুঃ ও বিচলিত করে রেখেছি সে সব কিছুই নয়। ভালবাসব এবং ভাল করব— এবং পরস্পরের প্রতি কৰ্ত্তব্য সুমিষ্ট প্রসন্নভাবে সাধন করব— এর উপরে যখন যা ঘটে ঘটুকু। জীবনও বেশি দিনের নয় এবং সুখদুঃখও নিত্য পরিবর্তনশীল। স্বার্থহানি, ক্ষতি, বঞ্চনা — এ সব জিনিষকে লঘুভাবে নেওয়া শক্ত, কিন্তু না নিলে জীবনের ভার ক্রমেই অসহ্য হতে থাকে এবং মনের উন্নত আদর্শকে অটল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই যদি না হয়, যদি দিনের পর দিন অসন্তোষে অশান্তিতে, অবস্থার ছোট ছোট প্রতিকূলতার সঙ্গে অহরহ সংঘর্ষেই জীবন কাটিয়ে দিই — তা হলে জীবন একেবারেই ব্যর্থ। বৃহৎ শাস্তি, উদার বৈরাগ্য, নিস্বার্থ প্রীতি, নিষ্কাম কর্ম— এই হল জীবনের সফলতা। যদি তুমি আপনাতে আপনি শান্তি পাও এবং চারদিককে সান্তনা দান করতে পার, তাহলে তোমার জীবন সাম্রাজ্ঞীর চেয়ে সার্থক। ভাই ছুটি— মনকে যথেচ্ছ। খুৎখুৎ করতে দিলেই সে আপনাকে আপনি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। আমাদের অধিকাংশ দুঃখই স্বেচ্ছাকৃত। আমি তোমাকে বড় বড় কথায় বক্তৃত দিতে বসেছি বলে তুমি আমার উপর রাগ কোরো না। তুমি জান না অন্তরের কি সুতীব্র আকাজক্ষার সঙ্গে আমি এ কথাগুলি বলচি। তোমার সঙ্গে আমার প্রীতি, শ্রদ্ধা এবং সহজ সহায়তার একটি সুদৃঢ় বন্ধন অত্যন্ত নিবিড় হয়ে আসে, যাতে সেই নিৰ্ম্মল শান্তি এবং স্থখই সংসারের আর সকলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, যাতে তার কাছে প্রতিদিনের সমস্ত দুঃখ নৈরাশু ক্ষুদ্র হয়ে যায়— আজ কাল এই আমার চোখের কাছে একটা প্রলোভনের মত জাগ্রত হয়ে আছে। স্ত্রী-পুরুষের অল্প বয়সের প্রণয়মোহে একটা উচ্ছসিত মত্ততা আছে কিন্তু এ বোধ হয় তুমি তোমার নিজের জীবনের থেকেও অনুভব করতে পারচ— বেশি বয়সেই বিচিত্র বৃহৎ সংসারের তরঙ্গদোলার মধ্যেই স্ত্রী-পুরুষের যথার্থ স্থায়ী গভীর সংযত নিঃশব্দ প্রীতির লীলা আরম্ভ হয়— নিজের সংসার বৃদ্ধির সঙ্গে বাইরের জগৎ ক্রমেই বেশি বাইরে চলে যায়— সেইজন্যেই সংসার বৃদ্ধি হলে এক হিসাবে সংসারের নির্জনতা বেড়ে ওঠে এবং ঘনিষ্ঠতার বন্ধনগুলি চারদিক থেকে দুজনকে জড়িয়ে আনে। মানুষের আত্মার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই, যখনি তাকে খুব কাছে নিয়ে চিঠিপত্র এসে দেখা যায়, যখনি তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ মুখোমুখি পরিচয় হয় তখনি যথার্থ ভালবাসার প্রথম সূত্রপাত হয়। তখন কোন মোহ থাকে না, কেউ কাউকে দেবতা বলে মনে করবার কোন দরকার হয় না, মিলনে ও বিচ্ছেদে মত্ততার ঝড় বয়ে যায় না— কিন্তু দূরে নিকটে সম্পদে বিপদে অভাবে এবং ঐশ্বর্যে একটি নিঃসংশয় নির্ভরের একটি সহজ আনন্দের নিৰ্ম্মল আলোক পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকে। আমি জানি তুমি আমার জন্যে অনেক দুঃখ পেয়েছ, এও নিশ্চয় জানি যে আমারই জন্যে দুঃখ পেয়েছ বলে হয়ত একদিন তার থেকে তুমি একটি উদার আনন্দ পাবে। ভালবাসায় মার্জন এবং দুঃখ স্বীকারে যে সুখ, ইচ্ছাপূরণ ও আত্মপরিতৃপ্তিতে সে মুখ নেই। আজকাল আমার মনের একমাত্র আকাজক্ষ। এই, আমাদের জীবন সহজ এবং সরল হোক, আমাদের চতুর্দিক প্রশান্ত এবং প্রসন্ন হোক, আমাদের সংসারযাত্র আড়ম্বর-শুন্য এবং কল্যাণপূর্ণ হোক, আমাদের অভাব অল্প উদ্দেশ্য উচ্চ চেষ্টা নিঃস্বার্থ এবং দেশের কার্য্য আপনাদের কাজের চেয়ে প্রধান হোক,— এবং যদি বা ছেলেমেয়েরাও আমাদের এই আদর্শ থেকে ভ্ৰষ্ট হয়ে ক্রমশঃ দূরে চলে যায় আমরা দুজনে শেষ পর্যন্ত পরস্পরের মনুষ্যত্বের সহায় এবং সংসারক্লান্ত হৃদয়ের একান্ত নির্ভরস্থল হয়ে জীবনকে সুন্দরভাবে অবসান করতে পারি। সেইজন্যেই আমি কলকাতার স্বার্থদেবতার পাষাণ মন্দির থেকে তোমাদের দূরে নিভৃত পল্লীগ্রামের মধ্যে নিয়ে আসতে এত উৎসুক হয়েছি— সেখানে কোনমতেই লাভক্ষতি আত্মপরকে ভোলবার যে নেই— সেখানে ছোটখাট বিষয়ের দ্বারা সৰ্ব্বদ ক্ষুব্ধ হয়ে শেষ কালে জীবনের উদার উদেশ্যকে সহস্ৰ ভাগে খণ্ডীকৃত করতেই হবে। এখানে অল্পকেই যথেষ্ট মনে হয় এবং মিথ্যাকে সত্য বলে ভ্রম হয় না। এখানে এই প্রতিজ্ঞ। সৰ্ব্বদা স্মরণ রাখা তত শক্ত নয়, যে—
সুখং বা যদিবা দুঃখং প্রিয়ং বা যদিবাপ্রিয়ংপ্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা।তোমার রবি

প্রমথ সুরেন এবং প্রমথদের একটি গুজরাটী বন্ধু শিলাই-দহে আছে।

[ শিলাইদহ
জুন, ১৮৯৮]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত