প্রতিটি মানুষই অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে চায়। উপভোগ করতে চায় পাখির ডানায় আকাশের সীমাহীন নীলিমায় উড়ে যাবার।
স্বাধীনতা, এই শব্দটির সঙ্গে মানুষ তার নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে। কারণ প্রতিটি মানুষ মাত্রই আকাঙ্ক্ষা থাকে স্বাধীনতার। আর এ স্বাধীনতা যদি হয় রক্তের বিনিময়ে, অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে তাহলে তার স্বাদটাও পাল্টে যায়। তখন এই স্বাধীনতা হয়ে ওঠে আরও বেশি অর্থবহ। অনেক বেশি আনন্দের উপলক্ষ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়ে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলেও সেই স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২২৪ বছর। অনেক সংগ্রাম, লাখো মানুষের রক্ত, নানা বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস পেছনে ফেলে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আমরা দেখা পাই স্বাধীনতার। এর মধ্যে আমাদেরকে পার করতে হয় দু’টি দেশের শাসন ও শোষণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে পাকিস্তানি শাসনের ভূত। তাদের তাড়াতে, কাঁধ থেকে নামাতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ২৫ বছর। এর মাঝের ইতিহাস শুধুই অপ্রাপ্তি, হতাশা আর শোষণের। এর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয় ১৯৭১-এ। মুক্তিপাগল বাঙালি পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লাখ লাখ প্রাণ আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনে আমাদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্তি ঘটে ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন ভূখণ্ড, স্বাধীন মানচিত্র, স্বাধীন পতাকার অবয়ব, স্বাধীন জাতীয় সঙ্গীত। আমাদের সব মানুষের প্রিয় শব্দ, স্বাধীনতা।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপক আকারে উদ্ভাসিত। গল্প কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, রম্যসহ এমন কোনো শাখা নেই যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কম বেশি প্রতিফলিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য অনিবার্য অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং হচ্ছে বাংলাদেশের লেখকদের কাছে। কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ দিনের অর্থাৎ পাকিস্তানিদের শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার উৎপীড়ন ছবির মতো ফুঠে উঠেছে। একই সঙ্গে বীর বাঙালির প্রতিবাদ প্রতিরোধের চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে অসাধারণ শৈল্পিকতায়।
বাংলাদেশের নাট্যকররা অসাধারণ দক্ষতায় নাটকের ভেতর দিয়ে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ আর এ যুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন। তবে এ কথা উজ্জ্বল সত্য, বাংলাদেশের কবিরা কবিতার ভেতর অসাধারণ শক্তিমত্তায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় দিনগুলোর চিত্র যেমন অঙ্কিত করেছেন, তেমনি বাঙালির মন-প্রাণকে প্রদীপ্ত করারও প্রয়াস পেয়েছেন। আমরা যদি জীবন ও সমাজের খুব গভীরে দৃষ্টি দেই তাহলে একটি বিষয় স্পষ্টতই ধরা পড়ে- তা হলো, অর্থে মুক্তির বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করি সে অর্থে আসলে আমাদের মুক্তি আসেনি এখনও। ফলে লড়াইটি থেমে নেই, আর এই যে থেমে নেই এর মূলে নিয়ত ক্রিয়াশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত কবিতার সঞ্জীবনী সুধা।
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে কবিতা
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবচেয়ে বেশি স্পন্দিত করেছে কবিতা শিল্পকে। চীনা কথাশিল্পী লু শুন যদিও বলেছেন, ‘কবিতা লিখে বিপ্লব করা যায় না, বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন বন্দুকের’। তারপরও এ কথা ঠিক- যুদ্ধাস্ত্রই সব নয়, কিংবা যুদ্ধাস্ত্রই একমাত্র অবলম্বন নয়! যদি তাই হতো তাহলে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয় হতো না, বর্বর পাকবাহিনীও পরাহত হতো না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। অস্ত্র আসলে লড়াই করে না, লড়াই করে মূলত মানুষই। আর লড়াকু মানুষকে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করে কবিতা ও গান। সুতরাং আমাদের মানতেই হবে যুদ্ধ জয়ের জন্য যেমন বন্দুক চাই, তেমনি কবিতাও চাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও সুকান্তের কবিতা মুক্তিফৌজের ভেতর সীমাহীন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে এ কথা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়কাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর কবিতা রচয়িত হয়েছে পর্যাপ্ত এবং বর্তমানেও হচ্ছে। এসব কবিতায় যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা উঠে আসছে এবং উঠে আসছে বাঙালির বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের গৌরব গাথা।
শামসুর রাহমানের ‘সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিনরাত্রি’ কবিতায় পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে অসাধারণ কাব্যিকতায়,
‘কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে/মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই/দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা/মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে’।
কবি হেলাল হাফিজের ভাষায়,
‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের এ কবিতাটি মুক্তিকামী মানুষের ভেতর জাগিয়ে তুলেছিল আরেক মানুষ, যে মানুষ স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বপ্নে মানসিক দৃঢ়তায় অনেক বেশি উচ্চকিত হয়েছিলো।
আত্মপ্রতিষ্ঠা আর অধিকার প্রতিষ্ঠার অপ্রতিরোধ্য তৃষ্ণাই বাঙালিকে করেছে দুরন্ত-দুর্বার। বাঙালি জানে কী করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়। যে কারণেই একাত্তর এই জাতির কাছে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা নয়, দীর্ঘদিনের লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত ফসল। হাসান হাফিজুর রহমান তার ‘গেরিলা’ কবিতায় বিষয়টির চমৎকার রেখাচিত্র অঙ্কন করেছেন,
‘বাংলার আপদে আজ লক্ষ কোটি বীর সেনা/ঘরে ও বাইরে হাঁকে রণধ্বনি একটি শপথে/আজ হয়ে যায় শৌর্য ও বীরগাথার মহান/সৈনিক, যেন সূর্যসেন, যেন স্পার্টকাস স্বয়ং সবাই’।
কোনো আন্দোলনই একক হয় না। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সংঘবদ্ধ আর সুশৃঙ্খল অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই আন্দোলন তার চূড়ান্ত রূপ লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। মানুষের এই যে সংঘবদ্ধ অবস্থান, তাও সুসংহত হয় ভাষার কারিশমায়। যে ভাষা শিল্পাশ্রয়ী, সাহিত্যাশ্রয়ী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব সাদামাটা ভাষায় যদি বাঙালিকে এক কাতারে আনার চেষ্টা করতেন তাহলে সফল নাও হতে পারতেন। তিনি যে ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন তা শিল্পাশ্রয়ী তো বটেই এর সাহিত্যমানও তর্কাতীত ও অবিসংবাদিত। হয়তো এ জন্যই নির্মলেন্দু গুণ জাতির জনকের এ ভাষণকে কবিতা বলেছেন, বলেছেন অমর কবিতা। আর তাকে বলেছিলেন, রাজনীতির কবি। এ নিয়ে ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামে নির্মলেন্দু গুণ যে কবিতা রচনা করেছেন তার অংশবিশেষ এ রকম,
‘একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।
কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠবাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতা খানি:
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’
নির্মলেন্দু গুণ তার এ কবিতার ভেতর দু’টি সংবাদ তুলে ধরেছেন। প্রথম সংবাদ ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান, দ্বিতীয় সংবাদ একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বলে ওঠা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন। শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, হাসান আজিজুল হক, রফিক আজাদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দীন, জিয়া হায়দার, আবুবকর সিদ্দিক, শহীদ কাদরী প্রমুখ যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জীবনসমগ্রতার অঙ্গীকারকে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন। সংগত কারণেই জীবনচেতনা ও শিল্পাদর্শের প্রশ্নে তারা সবাই স্বনির্মিত কাব্যাদর্শের বৃত্তেই আবর্তিত হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা কবি ও কবিতা বাংলা সাহিত্যের দরবারে এক অনিন্দ্য সুন্দর নাম। এ ধারার কবিতার মধ্যে জসীম উদ্দীনের ‘মুক্তিযোদ্ধা’, সুফিয়া কামালের ‘উদাত্ত বাংলা’, আহসান হাবীবের ‘স্বাধীনতা’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘তোমার আপন পতাকা’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘মুক্তিযুদ্ধ’, মহাদেব সাহার ‘ফিরে আসা গ্রাম’, হুমায়ুন আজাদের ‘মুক্তিবাহনীর জন্যে’, আবিদ আজাদের ‘এখন যে কবিতাটি লিখব আমি’, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ শিরোনামে কবিতার মতো অসংখ্য কবিতা রয়েছে যা পাঠ করে আমরা শুধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি না, একই সঙ্গে আমাদের নিজস্ব চেতনাকে শানিত করারও প্রয়াস পাচ্ছি। কবি সিকান্দার আবু জাফরের বিখ্যাত কবিতা ‘বাংলা ছাড়ো’। এ কবিতার নামকরণে ১৯৪২ সালের মহাত্মা গান্ধির ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মিল পাওয়া যায়। এ কবিতায় সরাসরি পাকিস্তানিদের এ দেশ ছেড়ে যেতে বলেছেন কবি। লিখেছেন,
‘আজকে যখন হাতের মুঠোয়/ কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী ছুরি/কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে/ কেউটে সাপের ঝাঁপি/আমার হাতেই নিলাম আমার। নির্ভরতার চাবি/তুমি আমার আকাশ থেকে/সরাও তোমার ছায়া/ তুমি বাংলা ছাড়ো’।
উল্লেখ্য, বাঙালির ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের যে তাৎপর্য, কেবল কাব্যবিষয়ের মধ্যে তাকে সীমিত করে দেখা ঠিক হবে না। জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তনে বস্তুজগত ও চেতনার বৈপ্লবিক রূপান্তরে কবিতার রূপ, রীতি, শব্দ অর্থাৎ সামগ্রিক প্যাটার্নেরই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন দেখেছি ইউরোপীয় রেনেসাঁর কবিতা, ফরাসি বিপ্লবের সাহিত্য-শিল্প, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কিংবা রুশ বিপ্লবের কবিতা এবং বিপ্লবমন্থিত লাতিন আমেরিকার কবিতা। আমাদের কবিরা মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী চেতনার রূপান্তরিত রূপ কতটা ধারণ করতে পেরেছেন কবিতায়, তা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। এ সময়ে কবিতাচর্চায় সক্রিয় আহসান হাবীব, আবুল হোসেন কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ নতুন বোধের উৎসমুখ হয়ে উঠেছে। যেমন,
‘কোথাও পড়ে না চোখে বধ্যভূমি/ অথচ প্রত্যহনিহতের সংখ্যা বাড়ে। কোথাও একটিও/ লাশ কিংবা কবর পড়ে না চোখে, অথচ প্রত্যহ/ শবাধার ব্যস্ত হয়ে হেঁটে যায় এবাড়ি ওবাড়ি’।
(আহসান হাবীব)
কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ
বাংলা কথাসাহিত্যে উপন্যাস নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধধারার নাম। আমাদের ঔপন্যাসিকরা সমাজের বিভিন্ন চিত্র যেমন শব্দশিল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীকে প্রতিপাদ্য করে শিল্পসার্থক উপন্যাস রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। একাত্তরের পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবর্তিত করে অগুনতি উপন্যাস রচিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে বোধ করি। আমাদের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে শওকত ওসমান এক দ্যুতিময় নক্ষত্রের নাম। শওকত ওসমানের বেশ কিছু উপন্যাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত চারটি উপন্যাস- ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘নেকড়ে অরণ্যে’, ‘দুই সৈনিক’ ও ‘জলাঙ্গী’ আমাদের অমূল্য সম্পদ। ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসটি যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটতে না কাটতেই প্রকাশিত হয়। এ উপনাসে একদিকে পাকিস্তানিদের বর্বরতা যেমন চিত্রিত হয়েছে, তেমনি বাঙালির প্রতিরোধের দুর্দমনীয় শক্তির কথাও অঙ্কিত হয়েছে। বর্বর পাকিস্তানিরা যুদ্ধকালীন এ দেশের নারীদের ওপর অকথ্য পাশবিকতা চালিয়ে মধ্যযুগীয় অসভ্যতাকেও হার মানিয়েছিলো। শওকত ওসমান তার ‘নেকড়ে অরণ্যে’ উপন্যাসে অত্যন্ত মায়াময় ভাষায় নারী নির্যাতনের বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতাই বলি আর বিপন্ন সামাজিকতাই বলি- যেকোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে মানুষের হৃদয়বৃত্তিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবদমিত থাকে না। বরং বিপন্ন সময়ের ক্যানভাসে হৃদয়ের কোমলতা যেনো আরও গভীর থেকে সাবানের ফেনার মতো বুদ বুদ করে ওঠে। শওকত ওসমান তার ‘জলাঙ্গী’ উপন্যাসের ভেতর স্বদেশ প্রেমিক এক মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ ও প্রেমে দ্বন্দ্বমুখর মানসিকতার দুয়ার উন্মোচন করেছেন এবং যুদ্ধের মাঠে সেই যোদ্ধার নিহত হওয়ার বর্ণনা দরদমাখা ভাষায় তুলে ধরেছেন। ‘দুই সৈনিক’ উপন্যাসে যুদ্ধের উত্তাল দিনে এ দেশের নারীরাও যে পিছিয়ে থাকেনি এ বাস্তবতা উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।
উপন্যাস ধারার উল্লেখযোগ্য সংযোজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবু বকর সিদ্দিক রচিত ‘জলরাক্ষস’, ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’। শহীদ জননী জাহানার ইমামের স্মৃতিচারণ ‘একাত্তরের দিনগুলি’, আনোয়ার পাশা রচিত, ‘রাইফেল রোটি আওরত’, রশীদ হায়দার রচিত, ‘খাঁচায়’, আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘জীবনতরু’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘তিমি’, রিজিয়া রহমানের ‘একটি ফুলের জন্য’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘কালো ঘোড়া’, ‘ঘেরাও’, সালাম সালেহ উদ্দীনের ‘ছায়া শরীর’, শওকত আলীর ‘যাত্রা’, ‘উত্তর খেপ’ এবং ‘অবশেষে প্রপাত’ বিশেষভাবে স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এদেশের অসহায় মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ছিলো। রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’ এবং আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’ উপন্যাসে তারই ইঙ্গিত বহন করে।
মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ উপন্যাসেও রয়েছে একই সত্যের আভাস। ব্যতিক্রম কেবল সুকান্ত চট্টোপাধ্যয়ের ‘জীবনতরু’ নামক উপন্যাসটি। এ উপন্যাসের শ্যামল মধ্যবিত্তের মানসিকতা থেকে দূরবর্তী, পিতা-মাতার অজ্ঞাতেই সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। তারুণ্য, আবেগ, উদ্দামতা, ঐকান্তিকতা ও মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনচেতনা অতিক্রম করে যায় শ্যামলের মৃত্যুকে। একটা আশাবাদী মীমাংসায় জীবন-তরু উপন্যাস যুদ্ধকালীন সময়ের মর্মমূলকে স্পর্শ করেছে। আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময় উপন্যাসেও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের নিষ্ক্রিয় আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাই প্রাধান্য লাভ করেছে। যুদ্ধরত একটি জাতির সংগ্রামশীল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এ উপন্যাসের চরিত্র-পাত্ররা সংযোগহীন। সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এ আরেকটু ভিন্ন অভিজ্ঞতার স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায়। হাঙর নদী গ্রেনেড মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রামীণ জীবনের আবেগী শিল্পরূপ। তবে, বুড়ির মাতৃ-ইমেজ হলদি গাঁয়ের সীমাবদ্ধ পরিসর থেকে সমগ্র বংলাদেশেই প্রসারিত করে দেয় যুদ্ধের চেতনাকে। গ্রামীণ জীবনকাঠামো, যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় তার রূপ-রূপান্তর, চরিত্রসমূহের বাস্তবানুগ ক্রিয়াশীলতা এবং সর্বোপরি বুড়ির আত্মোজ্জীবন এ উপন্যাসের জীবনদর্শনকে সমগ্রতাস্পর্শী করেছে। উপন্যাসের পরিণামে চিত্র, ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণে সেলিনা হোসেনের শিল্পদৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সংকেতময় ও গূঢ়ভাষী। আগের উপন্যাসগুলোতে মধ্যবিত্তের কাহিনী বর্ণিত হলেও এই উপন্যাসে তা ছিলো ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি। অসহায় বৃদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষার্থে নিজের হাবাগোবা প্রতিবন্দী সন্তানটিকে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। দেশের জন্য তার এই ত্যাগ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। কোনো কোনো লেখক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের চরিত্রগুলোকে একটি বিশ্বাসের আওতায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কারণ, লেখক মনে করেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো কেবলই পুরনো আশ্রয়কে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়। মাঝে মধ্যে তারা নতুন সমাজে বেঁচে থাকার প্রেরণা হারিয়ে ফেলে। সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এ আমরা সেই চিত্রই দেখতে পাই।
স্মরণীয় কেবল ‘রাইফেল রোটি আওরত’। কারণ, অসাধারণ বর্ণনা গুণে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার পাশা এই উপন্যাসে শুধুমাত্র ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনাই শুধু তুলে ধরেননি বরং তিনি তার সময়ের গভীর সঙ্কটকেও অনুধাবন করার প্রয়াস পেয়েছেন তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে। এই উপন্যাসে সময় ও চরিত্র স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই ‘রাইফেল রোটি আওরত’-কে অনেক সমালোচক এই সময়ের মহৎ খসড়া দলিল বলে উল্লেখ করেছেন। এই উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন প্রকৃতপক্ষে আনোয়ার পাশারই আত্মপ্রতিবাসের প্রতিচিত্র। পঁচিশে মার্চের সেই কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াল, নির্মম, জান্তব নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত সময়ের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন ঘটেছে এই উপন্যাসে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে যে অমানুষিক বর্বরতা-তাণ্ডবলীলা চলেছিলো, আনোয়ার পাশা বাস্তববাদী শিল্পীর নিরাসক্তিতে তাকে রূপদান করেছেন।
সুদীপ্ত শাহীনের অভিজ্ঞতায় সেই বীভৎস নগ্ন রূপ পাঠককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে বটে, কিন্তু প্রত্যক্ষ অবলোকনের অবিকল উন্মোচন আমাদের জীবনের এক বস্তুসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘তিমি’ উপন্যাসের প্রগতিশীল চরিত্র আসিফের জবানিতে এর সঠিক চিত্রটি ফুটে উঠেছে। রাহাত খানের ‘ছায়া দম্পতি’ আরেকটু এগিয়ে মধ্যবিত্তদের জীবন যাপনের দৈনন্দিন চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়। শওকত আলী একটু পেছনের দিকে তাকিয়ে সেই মূল্যবোধের বিনষ্টির ছবি এঁকেছেন ‘অবশেষে প্রপাত’ উপন্যাসে। রিজিয়া রহমানের ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসে সংক্রামক ব্যাধির মতো দুর্নীতির ছবি ফুটে উঠেছে খুব স্পষ্টভাবে। লাখ টাকার উৎকোচ নিয়ে আরব আলীর দল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। ‘অথচ হুইল চেয়ারে বন্দি অসহায় মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ নিরীক্ষণ করে সকল আশা আকাঙ্ক্ষার অপ্রত্যাশিত অপমৃত্যু’। রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারি সূর্য’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, রশীদ হায়দারের ‘অন্ধকথা মালা’ মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সাফল্যমণ্ডিত উপন্যাস। এসব উপন্যাসে লেখকরা মুক্তিযুদ্ধের ছবি ও যুদ্ধকালীন সময়ের বাস্তব চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতা উত্তর ও বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় উপন্যাসিকদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন তাঁদের মধ্যে হুমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হক ও হরিশংকর জলদাস অন্যতম। হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ তিনি সচক্ষে দেখেছেন। তার এই ধারার উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’, ‘১৯৭১’, ‘আগুনের পরশমনি’, ‘শ্যামল ছায়া’ ও নির্বাসন অন্যতম। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ও সবচেয়ে আলোচিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘দেয়াল’ প্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবার পাঠকের চিন্তায় নতুন ভাবনার উদয় হয়েছে বলে মনে হয়। বর্তমান সময়ের আনিসুল হক, মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাদের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকে সহজ, সরল ভাষায় উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ‘মা’ আনিসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যতম উপন্যাস। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা কিশোর উপন্যাস ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। বর্তমানে আরেকজন ঔপন্যাসিক অল্প সময়ের ব্যবধানে পাঠক নন্দিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছেন, তিনি হরিশংকর জলদাস। শিক্ষক, গবেষক ও লেখক তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘দহনকাল’ রচনা করেন গত দশকে।
নাটকের শৈল্পিকতায় মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের পর তরুণ সমাজের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে অভিনয়যোগ্য বহু নাটক বাংলাদেশে রচিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, তারপর থেকেই বেশ কয়েকখানি সাহিত্য গুণান্বিত এবং অভিনয়গুণবিশিষ্ট নাটক রচিত হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত। আসকার ইবনে শাইখের ‘তিতুমীর’ নাটকের নাট্যবস্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায় থেকে আহৃত হয়েছে। সিকান্দার আবু জাফরের ‘শকুন্ত উপখ্যান’, ‘স্মরণাতীত কালের ময়ূর’ ও ‘রাজহংসের অধিকারভুক্ত’, এর মধ্যে দু’টি দেশের মর্মান্তিক যুদ্ধকাহিনি হলো, শকুন্ত উপাখ্যান।
নাটক শিল্পের অন্যতম একটি মাধ্যম। দৃশ্যকাব্য নামে পরিচিত এই মাধ্যমটিতেও উঠে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মমতাজউদদীন আহমদ রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকগুলো হচ্ছে-স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, বর্ণচোর, বকুলপুরের স্বাধীনতা, বিবাহ, কি চাহ শচিল। জিয়া হায়দারের ‘সাদা গোলাপে আগুন’, নীলিমা ইব্রাহিমের ‘যে অরণ্যে আলো নেই’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘নিঃশব্দ যাত্রা’, ‘নরকে লাল গোলাপ’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘ফেরী আসছে’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ধারায় হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন টেলিভিশন নাটক। আলাউদ্দিন আল আজাদের নিঃশব্দ যাত্রা ও নরকে লাল গোলাপ, জিয়া হায়দারের সাদা গোলাপে আগুন ও পঙ্কজ বিভাস, নীলিমা ইব্রাহিমের যে অরণ্যে আলো নেই প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বী মঞ্চসফল কাব্যনাট্য সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনাবাহী কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে- কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’, সাঈদ আহমদের ‘প্রতিদিন একদিন’, আল মনসুরের ‘হে জনতা আরেকবার’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘ফেরী আসছে’ প্রভৃতি। আনিস চৌধুরী, মমতাজ হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফজলুল করিম, মামুনুর রশীদ প্রমুখ নাট্যকাররাও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রাণস্পর্শী সব নাটক রচনা করেছেন।
গল্পে-গল্পে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বশীর আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, ‘রণকৌশল’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’, শওকত ওসমানের ‘জন্ম যদি তবে বঙ্গে’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা’, আবু বকর সিদ্দিকের ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’, সৈয়দ ইকবালের ‘একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অপঘাত’, রাহাত খানের ‘মধ্যিখানের চর’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শীত’, ‘উনিশ শ একাত্তর’, আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘কেয়া’, ‘আমি’ ও ‘জারমান মেজর’, মইনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’, ‘ভুলবিকাশ’, রশীদ হায়দারের ‘কল্যাণপুর’, ‘এ কোন ঠিকানা’।
এছাড়া কায়েস আহমেদের ‘আসন্ন’, মাহমুদুল হকের ‘কালো মাফলার’, জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’, মামুন হুসাইনের ‘মৃত খড় ও বাঙাল একজন’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘পুঁই ডালিমের কাব্য’, আমজাদ হোসেনের ‘উজানে ফেরা’, সত্যেন সেনের ‘পরিবানুর কাহিনী’, মঞ্জু সরকারের ‘শান্তি বর্ষিত হোক’, শওকত আলীর ‘সোজা রাস্তা’, ‘আকাল দর্শন’, হুমায়ুন আজাদের ‘যাদুকরের মৃত্যু’, সুচরিত চৌধুরীর ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’, রিজিয়া রহমানের ‘ইজ্জত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন গ্রন্থের প্রতিটি গল্পই বিষয় ও আঙ্গিকের অন্তর্বয়নে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জীবনচেতনার সার্থক শিল্পরূপ। ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিমেয় জীবনীশক্তির বিন্যাস ঘটেছে। ‘ঘরগেরস্তি’ গল্পে যুদ্ধোত্তরকালের জনজীবনের অনিশ্চিত বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বরূপ হয়ে উঠেছে ইঙ্গিতময়। সর্বহারা রামশরণ ও ভানুমতির বাস্ত্তভিটায় প্রত্যাবর্তন প্রকৃতপক্ষে এক রক্তাক্ত স্মৃতিলোক থেকে আরেক হা-হা শূন্যতাময় ভবিষ্যতের অভিযাত্রা। জীবন ও শিল্পবোধের ইতিবাচক অন্বেষায় লেখক এক নির্বিশেষ সত্যের পটভূমি নির্দেশ করেছেন গল্পের সমাপ্তিতে, ‘কিন্তু লঞ্চে যাবে না রামশরণ। লঞ্চ ধরে কোথাও যাবার নেই তার। তবে কোথাও সে নিশ্চয়ই যাবে’।
শিশুসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের অমর গাঁথা
শিশু-কিশোরদের জন্যও লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, উপন্যাস, গল্প, ছড়া। ছড়া আমাদের শিশুসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ছড়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সাহিত্যে জীবনের সূত্রপাত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উঠে এসেছে ছড়া সাহিত্যেও। এক্ষেত্রে অগ্রণী ছড়াকারদের মধ্যে রয়েছেন সুকুমার বড়ুয়া, আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন- শাহরিয়ার কবির, হুমায়ূন আহমেদ, মাহমুদুল হক, আবু কায়সার প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। যুদ্ধে আমাদের ক্ষতি হয়েছে অনেক, হারিয়েছি ত্রিশ লাখ তাজা গোলাপ। তবে যুদ্ধের অনেক ক্ষতির সঙ্গে আমাদের চেতনাও হয়েছে ক্ষুরধার। আমাদের সাহিত্যের গতি হয়েছে পরিবর্তিত। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লক্ষ্য নিরূপণে সহায়তা করেছে। দিয়েছে সঠিক উদ্দেশ্যের সন্ধান। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আমাদের সাহিত্যে ছিলো আঁধারের ঘনঘটা, পরাধীনতার নিগড়ে বাঁধা। সাহিত্যের সত্তা ছিলো ধ্বংসের বিপন্ন তিমিরে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো সাহিত্যের গণ্ডি ছিলো পশ্চিমাদের নজরবন্দি। তবে সেই সব বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে অনেক লেখক, কবি, সাহিত্যিক বেরিয়ে আসেননি এমন নয়, তবে তার জন্য অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষে লেখার অপরাধে কারারুদ্ধ করা হয় কবি ফয়েজ চৌধুরীকে। স্বাধীনতাকে নস্যাতের পরিকল্পনায় হত্যা করা হয় মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আনোয়ার পাশাসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে যেমন এ দেশের স্বাধীনতাকামী আপামর ছাত্রজনতা, সৈনিক, শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী নানাভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তেমনিভাবে এ দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ও পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে কলমকে শাণিত রেখেছেন। রচনা করেছেন- গান, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক। এসব সাহিত্যকর্ম একদিকে যেমন যুদ্ধরত বাঙালিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে অন্যদিকে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকেও করেছে সমৃদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে এখনও অনেক কাছের একটি বিষয়। আবেগের স্থিতি এখনও কমেনি অনেকক্ষেত্রেই। তাই সাহিত্যিকরাও এর বাইরে আসতে পারছেন না। হয়তো আরও, আরও কয়েক দশক পর যখন থিতিয়ে আসবে সব আবেগ, যখন সব বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। গবেষণায় উঠে আসবে সব মিথ্যা ও ভ্রান্তির জাল। তখন হয়তো নতুন কোনো সাহিত্যিকের হাতে রচিত হবে মহৎ কোনো সাহিত্যকর্ম। ব্যক্তিস্বার্থ ও পরাজিত শক্তির অপ্রচারের জোয়ারে একদা কোণঠাসা হয়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি স্বাধীনতার বার্তা। আর পক্ষ-বিপক্ষের মাঝে পড়ে নতুন প্রজন্ম। আর এই গ্লোবালাইজেশনের সময়ে এক ছাতার নিচে পৌঁছার ইঁদুর দৌড়ে নিজেদের যোগ্য করে তোলার লড়াই ভুলে ছিলো জাতির ইতিহাস, পেছনের গৌরবগাথা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যা রচিত হয়েছে তাতে খুব কম রয়েছে মহৎ শিল্পকর্ম। পরিমাণে খুবই কম রয়েছে কোনো বড় ক্যানভাসের সর্বজন গ্রাহ্য সাহিত্যকর্ম। গড়ে ওঠেনি কোনো মহৎ উপন্যাস, যা হয়েছে তাতেও অনেকসময় সত্যিকার ইতিহাসের চেয়ে কোনো দলের মতবাদ প্রচারের দিকেই নজর দিয়েছেন অনেক ঔপন্যাসিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলনও এসব অনেক রচনাতেই নেই, যা আছে তা খণ্ডিত, অনেকক্ষেত্রে বিকৃত, একদেশদর্শী। তবে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও এখনও প্রত্যাশা করছি- আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, আমাদের গৌরবের, আমাদের প্রিয় স্বাধীনতার প্রতিফলন প্রকৃত অর্থেই একদিন হবে।