| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

বাংলার ডাকাতদের জীবনযাপন ও তাদের ইতিহাস

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

ডাকাত শব্দ টা বা ডাকাতি পেশা টার কথা শুনলেই এখন এখন আমরা অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করি তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল করি কারন আর পাঁচটা সমাজ বিরোধী কাজ বা অপরাধের সাথে ডাকাতি বা ডাকাতের আজ কাল আর তেমন বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। দিনে দুপুরে বহুতলে বা কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে অর্থাৎ লুঠ পাঠ চালানো কে আজ কাল নির্দ্বিধায় ডাকাতি হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। তবে আগাগোড়া এমন টা ছিলো না,ডাকাতির বিশেষ করে বাংলার ডাকাত দের একটা ভিন্ন ধারার ঐতিহ্য আছে একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এ ইতিহাস কয়েকশো বছরের পুরোনো ইতিহাস এবং বাংলা তথা দেশের রাজনীতির নানা বর্ণময় অধ্যায় নানান সামাজিক উত্থান পতনের কাহিনী।

ডাকাতির পেশা টির জন্মের পেছনেও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা কে দায়ী করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ইংল্যান্ডের রানির হাতে শাসনভার অর্পিত হলে, প্রাদেশিক শাসন থেকে ক্রমে কেন্দ্রীয় শাসন শুরু হয়। তাতে দেশীয় জমিদার আর রাজাদের প্রাদেশিক ক্ষমতাভার হ্রাস পায় এবং অগণিত পাইক-লেঠেল তাদের জীবিকা হারায়, তারা অস্তিত্বর সংকটে পরে । নিজেদের টিকিয়ে রাখার তাগিদে এই বলশালী ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোক গুলোই বাধ্য হয়ে ডাকাতিকে পেশা হিসাবে নেয়, পড়ে এদের দেখা দেখি আরো অনেকে ডাকাতের দলে নাম লেখায়। শুরু হয় এক অন্ধকার জগতের বর্ণময় পেশার পথ চলা যাতে কালের নিয়মে আসে একাধিক পরিবর্তন।

অসংখ্য গল্প ও কিংবদন্তী প্রচলিত আছে বাংলার ডাকাতদের ঘিরে আর আছে একাধিক দুর্ধর্ষ ডাকাত যাদের নামে এক কালে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো|মধ্য রাতে গ্রামের মেঠো পথে যখন হাড়ে রে রে রে রে গর্জন শোনা যেতো মস্ত বড়ো বীরএর ও শরীরে দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতো। কিছু ডাকাতের রবিনহুড ইমেজ ও ছিলো অর্থাৎ ধনী কে লুঠ করে দরিদ্রর পাসে দাঁড়ানো আবার কেউ কেউ তো ডাকাতির করে অর্থাৎ সঞ্চয় করে রাতারাতি জমিদার বনে গেছিল। হান্টার সাহেবের “Annals of Rural Bengal “নামক গ্রন্থে এই সব ডাকাত দের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়|সাধক রামপ্রসাদ থেকে মা সারদা অনেক বিখ্যাত মনীষী কেই পড়তে হয়েছে ডাকাতের খপ্পরে, সে সব গল্প হয়তো আমরা অনেকেই জানি।

বাংলা সাহিত্যেও ডাকাত দের অবাধ বিচরন,রবীন্দ্রনাথ এর মুসলমানির গল্প হোক বা বঙ্কিম চন্দ্রের দেবী চৌধুরানী কিংবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর মনোজ দের অদ্ভুত বাড়ি সবেতেই ঘটনাক্রম আবর্তীত হয়েছে ডাকাতদের কেন্দ্র করে|এছাড়া বাংলা সিনেমা গান ও নাটকেও ডাকাত দের উপস্থিতি বেশ তাৎপর্যপূর্ন।

নীল বিদ্রোহ থেকে সাধীনতা সংগ্রাম সবেতেই জড়িয়ে আছে কিছু ডাকাত দের নাম এদের অনেকেই মাতৃ ভূমি কে রক্ষা করতে সেই চরম দুর্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বসস্ত্র বিপ্লবে। অনেকেই হারিয়ে গেছে ইতিহাস থেকে তবে কেউ কেউ সাহিত্য ও সিনেমার কল্যানে আজও বেশ পরিচিত। ডাকাতির পাশাপাশি এই ডাকাত রা ছিলো বেজায় কালী ভক্ত তাই তাদের নামের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ ডাকাত কালীর মন্দির ও সেই সংক্রান্ত অনেক প্রচলিত অলৌকিক কাহিনী।
এমনি কয়েকজন কুখ্যাত ডাকাতের কথা আজ বলবো আপনাদের –

রঘু ডাকাত –

এক সময় বাসুদেবপুরের এক কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে রঘু ডাকাত। কথিত রয়েছে, সপ্তমগ্রাম বন্দরে কোনও জাহাজ এসে দাঁড়ালেই তা লুঠ করতে রঘু ডাকাতের দল। আর লুঠতরাজের সাফল্যের জন্যই বাঁশবেড়িয়ার ত্রিবেণীর কাছে রঘু ডাকাত প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর ডাকাত কালী।যেখানে প্রতিদিন ল্যাটা মাছের পোড়া মাকে অর্পণ করে ডাকাতিতে বের হত রঘু ডাকাত।শোনা যায়, চন্দননগরের অনতি দূরে হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় এক সময়ের ত্রাস ছিল রঘু ডাকাত। নীলকর সাহেবদের হত্যা করে তাদের গাছে ঝুলিয়েও অনেক সময় পালিয়ে যেত এই ডাকাতদল।

কালী ডাকাত –

একসময়ে রাতের অন্ধকারে হুগলীর জিরাটের জমিদার কালিচাঁদকে এখানে সকলে কেলে ডাকাত বলেই চিনত। সেই জমিদারের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে আজএ পুজো হয় কেলের গড়ে।জিরাটের কালীগড়ের কালী সম্পর্কেও রয়েছে ডাকাতিকে কেন্দ্র করে এক অজানা কাহিনি। বহু বছর আগে নাকি, এই এলাকার জমিদার কালী পুজোর পর বেড়িয়ে পড়তেন ডাকাতিতে। যদিও তা অস্বীকার করেন পরিবারের সদস্যরা। উল্লেখ্য, কালীগড় থেকে এই এলাকার পুজোর নাম কেলেগড়। সেই ডাকাতের নামও কেলে ডাকাত বা কালী ডাকাত হিসাবেই পরিচিত ছিল।

প্রল্হাদ ডাকাত –

বাংলার আরেক কুখ্যাত ডাকাত ছিলো প্রল্হাদ শোনা যায়, এককালে প্রহ্লাদ ডাকাত এলাকার কেতুগ্রামের রামসীতা মন্দিরের স্বর্ণালঙ্কার ডাকাতি করতে যায়। সেই সময় পথে এক মহিলাকে ডাকাতদলের একজন আক্রমণ করে। আর মহিলা-স্পর্শের অপরাধে সেই সদস্যকে ডাকাতদলের নেতা প্রহ্লাদ সর্দার এক কোপে ছিন্ন করে দেয় । এরপরই ডাকাত সর্দারের সন্দেহ হয়। ওই মহিলাকে প্রহ্লাদ জিজ্ঞাসা করে তিনি কে? জবাবে মহিলা অলৌকিকভাবে কালীমূর্তি ধারণ করেন। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠিত বামা কালীর মন্দির। পূর্ববর্ধমানের পাণ্ডুক গ্রামে রয়েছে এই বামা কালীরমন্দির।

বিশে ডাকাত –

বিশে ডাকাতের নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন সিঙ্গুরের প্রসিদ্ধ ডাকাত কালীর সাথে জড়িয়ে আছে ডাকাত বিশের নাম, নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে জন্ম হয় বিশু ডাকাতের। জানা যায়, বহু নীলকর সাহেবদের খুন করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল এই বিশু ডাকাত। আবার শোনা যায়, চালকেবাটির মোড়ল দেবীর স্বপ্ন পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় জঙ্গলের মধ্যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মায়ের পুজোকে কেন্দ্র করে ডাকাতরাও পেয়েছিল আশ্রয়। ডাকাতি করতে যাওয়া ও ফেরার পথে মায়ের পুজো দিত ডাকাতরা। এখানে নরবলি হত বলেও শোনা যায়।

ভুবন ডাকাত –

ভুবন ডাঙ্গার মাঠ নাম টা অনেকেরই অজানা আসলে এখনকার বোলপুর ছিলো এক কালের ভুবন ডাঙ্গার মাঠ আর এই অঞ্চল শাসন করতো দুর্ধর্ষ ভুবন ডাকাত যার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। পড়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অঞ্চলের ব্যাপক সংস্কার করেন ও তারও পরে কবি গুরু প্রতিষ্ঠা করেন শান্তি নিকেতন। ধীরে ধীরে প্রচারের আড়ালে চলে যায় ভুবন ডাকাতের গল্প।

রানা ডাকাত –

এখন যাকে আমরা রানা ঘাট বলে জানি সেই অঞ্চলের ত্রাস ছিলো রানা ডাকাত। এলাকায় রবিন হুড ইমেয ছিলো তার। ব্যাপক লুট পাঠ চালাতো এই রানা ডাকাত |দীর্ঘ সময় সে নিজের প্রাধান্য বজায় রেখে ছিলো তারপর ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। তবে আজও রানাঘাট এর বহু মানুষ তার কথা মনে রেখেছেন।

চিতে ডাকাত –

কলকাতাও এক কালে ছিলো এক দুর্গম অনউন্নত গ্রাম্য অঞ্চল আর সেই কলকাতা শাসন করতো একদল ডাকাত, দিনে দুপুরেও লোকে কেঁপে উঠতো তাদের নাম শুনলে|এমনই এক ডাকাত সর্দার ছিলো চিতে ডাকাত যার নামে নামকরণ হয় আজকের চিৎপুরের।

আরো অসংখ্য ডাকাত ও তাদের রোমহর্ষক গল্প ছড়িয়ে আছে বাংলার আনাচে কানাচে আর আছে তাদের স্মৃতিবিজরীত ডাকাত কালীর মন্দির গুলি। শোনা যায় মহিষাদল রাজবাড়ীর নিজস্ব মাইনে করা ডাকাত দল ছিলো|কথিত আছে এমনও বহু জমিদার ছিলেন যারা দিনে করতেন জমিদারি আর রাতে ডাকাতি |হান্টার সাহেবের বই থেকে জানা যায় বাংলার ডাকাতের সংখ্যা ছিলো কয়েক হাজার। ডাকাতির জন্য বিখ্যাত ছিলো বর্ধমান বীরভূম ও হুগলী জেলা, তবে কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় পিছিয়ে ছিলো না। বন জঙ্গলে ঢাকা অঞ্চল, মেঠো পথ, পালকির আসা যাওয়া ও নিরাপত্তা বলতে লাঠি ধারী একদল গ্রাম্য লোক এই সব মিলিয়ে সে কালের বাংলা হয়ে উঠেছিলো ডাকাতের স্বর্গ রাজ্য।

ডাকাতদের জীবন যে ব্যাপক সুখ ও সমৃদ্ধি তে ভরপুর ছিলো তা ঠিক নয়, পদে পদে ছিলো বিপদ ও প্রানের ঝুঁকি। ধরা পরে বহু ডাকাতের প্রান গেছে কারুর আবার কেটে নেয়া হয়েছে পা। কেউ মারা গেছে গোষ্ঠী দ্বন্দে কেউ কেউ আবার লড়াই করে ফিরে আসতে পেরেছিলো সমাজের মূল স্রোতে। বাংলার ডাকাত দের নিয়ে তেমন কোনো প্রামানিক তথ্য বা সংরক্ষিত ইতিহাস নেই। লেখক যোগেন্দ্র নাথ গুপ্ত এই বাংলার ডাকাত দের নিয়ে অবশ্য একটি বই লিখেছিলেন নাম বাংলার ডাকাত যা পাঠক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিলো।এছাড়া এক রকম প্রায় হারিয়েই গেছে বাংলার ইতিহাস এর এই সব বিখ্যাত বা কুখ্যাত ব্যক্তিরা।

নাটকীয়তা বা মৌলিকতার দিক থেকে বলতে হলে মারাঠা বর্গী দের তুলনায় বা চম্বল এর ঘোর সোয়ার ও বন্দুক ধারী বাগী দের থেকে বাংলার ডাকাত রা ছিলো অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে ও অনেক বেশি প্রভাবশালী যার প্রমান আমাদের শিল্প ও সাহিত্য আজও বহন করে চলছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত