হাইব্রিড মিষ্টিকুমড়ার ন্যায় বিশাল ভুড়িটা সামনের দিকে এলিয়ে বা-হাতের তর্জনিটা তুলে বিধু কাকার ঝাড়ি দেয়ার ভঙ্গিটা প্রায় প্রদর্শিত হয় বিধায় অনেকেরই এতে টনক নড়ে না। তিনি এই ভঙ্গিমায় দীর্ঘক্ষণ আমাকে শাসালেন। তিনি তার মেয়ের জুতা বানাতে দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘কাজটা তোর বাপকে দিয়ে করাস। খগেন দা অভিজ্ঞ মানুষ। সে ভালো পারবে । খবরদার তুই হাত দিস নে যেন।’ বাবার কি সেই বয়স আছে। খালি চোখে সুঁইয়ে সুতা ঢুকানোর বয়স কবে শেষ। বাবা জুতা তৈরি করতে গিয়ে জুতার মাপ আধা ইঞ্চি ছোট বড় হয়েছে। এখন এই নিয়ে বিধু কাকা মেজাজের তুঙ্গে আছেন। এখন তিনি বলছেন, তোকে না পই পই করে বলেছিলাম খগেন দা বুড়ো মানুষ, চোখে ভালো দেখে না । কাজটা তুই নিজে করিস। কেমন বজ্জাত ছোকরা তুই, বুড়ো বাপকে একটুও বসিয়ে রাখিস না দেখছি। এখন কি তার কামাই করার বয়স আছে? এমন ছেলেপুলেরা নরকে পুড়বে। কাল বাদে পরশু পূজো। যদি কালকের মধ্যে জুতো না পাই তবে একটা কড়িও দেব না বলে দিচ্ছি কিন্তু।
বিধু কাকার ঝাড়ির ভয়ে নয় বরং টাকা না পাওয়ার ভয়েই আমি কাজটা শুরু করি। কালকের মধ্যে না দিলে ঠিকই তিনি টাকা দেবেন না।
এমন সময় এলো স্কুলের কেরাণী সালাম কাকা। নিয়াজ, ফজলু আর কালাম মতির চায়ের দোকানে বসে আছে। আমাকে এখনই যেতে হবে। কি আর করা? কাজটা ফেলে রেখেই রওনা দিলাম। গিয়ে দেখি নিয়াজ পরোটা দিয়ে চা খাচ্ছে। একসময় চট্টগ্রামে ছিল। তখনকার অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারে নি । কালাম ইদানীং সিগারেট ধরেছে। সে সিগারেট ফুঁকাতে ফুঁকাতে বললো, কি দাদা একটু নড়েন-চড়েন। স্কুল লাইফ থেকেই সে এই কথাটা আমাকে বলে আসছে। আমি চলনে একটু ধীর প্রকৃতির। আর আমার নাম নরেন। তাই সে মিলিয়ে বলে, দাদা একটু নড়েন।
আমার জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে আলোচনা শুরু করে নিয়াজ। আলোচনার বিষয়বস্তু হলো পিন্টুর বিয়ে। আমি প্রথমে একটু ভড়কে যাই। পিন্টুর বিয়ে হতে যাচ্ছে এই কথাটা আমি এখানেই এসে প্রথম শুনলাম। ওরা সবাই দাওয়াত পেয়েছে কিন্তু আমি এখনো পাই নি। ওরা এটা ভাবতেও পারে নি। তাই আমাকে জিজ্ঞাসাও করলো না আমাকে দাওয়াত দিয়েছে কিনা। ওদের কথা থেকে যেটা বুঝতে পারলাম- আগামী শুক্রবার পিন্টুর বিয়ে। বউ নাকি ৫০% দেশি আর ৫০% বিদেশি। মানে বাবা-মা আমেরিকায় থাকে, সেখানেই তার জন্ম। বাংলা তেমন একটা বলতে পারে না। এখন ঠিক করা হবে আমরা তার বিয়েতে কি দেব। কিছুক্ষণের জন্য আমি ফিরে গেলাম স্কুলজীবনের দিনগুলোতে। আমরা পাঁচজন ছিলাম খুবই কাছের বন্ধু। স্যারেরা আমাদের বলতো ফাইভ স্টার। দুষ্টুমিতেও যেমন সেরা ছিলাম, তেমনি পড়াতেও। আমরা এক বেঞ্চে বসতাম, একসাথে চলতাম-ফিরতাম। আমাদের সখ্য দেখে অনেকে হিংসা করতো।
আমি বাপের একমাত্র ছেলে হওয়ায় আর অভাব অনটনের সংসারের কারণে অবশেষে বাপ-দাদার পেশাকেই বেছে নিতে হলো। এসএসসি’র পর আমার আর পড়া হলো না। পিন্টুরা আমাদের গ্রামের প্রভাবশালী পরিবার। টাকা-পয়সা অনেক ওদের। মেট্রিকের পর সে ভর্তি হলো ঢাকার কলেজে। তখন থেকেই সে বদলাতে শুরু করে। কলেজে পড়ার সময় একবার ওর সাথে আমার কথা হয়েছিলো। ইন্টারের পর সে ভর্তি হয়েছিল ঢাকায় একটা ভার্সিটিতে। ভার্সিটিতে পড়ার সময় সে যখন বাড়ি আসতো তখন আর দেখা হতো না। ওদের বাড়ির কাজের ছেলেটা একদিন আমার কাছে জুতা পালিশ করতে এনেছিল। সে বললো, পিন্টু ভাই পাঠাইছে। ভালো করে পালিশ করতে বলছে। তখন ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম পিন্টুর কথা। ছেলেটার অভিজ্ঞতা ছিলো তিক্ত। ‘আর বলবেন না দাদা পিন্টু ভাই আর আগের মতো নেই। মেজাজ সবসময় বিগড়ে থাকে। আজ চা দিতে দেরি হওয়ায় আমার গালে এমন একটা থাপ্পর দিলো!’ বছরখানেক পর শুনলাম পিন্টু আমেরিকা যাচ্ছে। তার চাচা সেখানে থাকে তাই কোনো ধকল পোহাতে হয় নি। শুনতাম সেখানে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমিরিকায় যাওয়ার পর নিয়াজ-ফজলুদের সাথেও তার যোগাযোগ ছিলো না। দেশে ফিরে দুই বছর থেকে ঢাকায় একটা ফার্মে চাকরি করলো। শুনছি বিয়ে করে আবার অ্যামেরিকায় যাবে।
নিয়াজ, ফজলু, কালাম অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করছে। নিয়াজ চাকরি করছে চাপারহাট ডিগ্রি কলেজে। ফজলু আর কালাম গতবার ঢুকেছে আমাদের স্কুলেই।
ঠিক করা হলো বিয়েতে আমরা পিন্টুর বউয়ের জন্য টিকলি দেবো। বর্তমান বাজার অনুযায়ী খরচ পড়বে প্রায় চার হাজার টাকা। ওরা আমাকে বললো, নরেন তুই যত পারিস দিস। আমি বলি, নারে ভাগ পড়বে সমানে সমান। আর একজনই তো বাকি। সবারই তো বিয়ে হয়ে গেলো। ফজলু বললো, তাইলে তো ভাগে একহাজার করে পড়ে। তুই পাঁচশো দিস তাতেই হবে। আমি প্রতিবাদ করি, বন্ধু তো আমারো নাকি? আমি আবার কম দেবো কেন? সমস্যা নেই। আমি দিতে পারবো। একপ্রকার জেদ নিয়েই বলি কথাটা। আমি জানি একহাজার টাকা দেয়া আমার জন্য কষ্টসাধ্য। কিন্তু আমাকে এটা করতেই হবে।
বন্ধুদের মধ্যে অবশ্য সালামও এখনো বিয়ে করে নি। তবে ওর বিয়ে করার কোনো সম্ভাবনা নেই। নারীজাতির প্রতি তার এলার্জি আছে। আমাকে সে প্রায়ই প্রশ্ন করতো, বলতো দেখি নরেন পÐিত, ‘মেয়ে মানুষের প্রেম’ কোন কারকে কোন বিভক্তি? আমি বলতাম, কর্মকারকে ষষ্ঠী। সে বলতো, না হয় নাই। ভালো করে চিন্তা করে দেখ। অবশেষে সে একদিন তার মতে সঠিক উত্তর জানালো। সেটা হলো- ক্ষতিকারকে প্রথম বিভক্তি।
দোকানে ফিরে বিধু কাকার কাজটা ধরি। কিছুতেই কাজে মন বসতে চায় না। আসলেই কি পিন্টু এমন হয়ে গেছে? আমাকে ছোট জাত ভেবে সে ঘৃণা করছে? আমি তো ওর খুব কাছের বন্ধু ছিলাম। বন্ধুত্বে কি কোনো জাত বা ধনী-গরিবের ব্যাপার আছে? এমনও তো হতে পারে ভুলে এখনো আমাকে কার্ড দেয়নি। আবার এটাও হতে পারে যে, ঠিকই কার্ড দিয়েছে কিন্তু বাড়ির লোকেরা আমাকে জানায়নি। বাড়ি ফিরেই মিনতিকে জিজ্ঞাসা করতে হবে।
বাড়িতে আসার পর নিশ্চিত হলাম যে, সত্যিই আমাকে কার্ড দেয়া হয়নি। দাওয়াত ছাড়া বিয়ের বাড়িতে যাওয়া তো আরেক ছোটলোকের কাজ হবে। ওদিকে নিয়াজেরা জানলোই না যে আমাকে কার্ড দেয়া হয়নি। আমি তো ওদের বললামও না। আর ওদের বলাটা ঠিকও হবে না। এটা শুনলে ওরা কেউ যাবে না। ওরা তো আর পিন্টুর মতো নয়। ওরা নিয়মিত আমার খবর নেয়, দোকানের সামনের বেঞ্চটাতে এসে প্রায়ই বসে। আলাপ-আলোচনা করে। আমি তো আবার একহাজার টাকাও দিতে চাইলাম। যাহোক ব্যাপরাটাকে অন্যভাবে সামাল দিতে হবে।
টিকলি বানাতে দেয়া হয়েছে। আগামী বুধবার ডেলিভারি। তাই মঙ্গলবারের মধ্যে টাকা জমা দিতে হবে। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতগুলো টাকা এখন পাবো কোথায়? ঝোঁকের বশে বলে ফেলে এখন মান-সম্মান নিয়ে প্রশ্ন। অবশেষে মাথায় বুদ্ধি এলো। মাস দুয়েক পরে আমার একমাত্র ছেলে নিপিনের অন্নপ্রাশন করার কথা। এজন্য প্রতিদিন কিছু করে টাকা জমাচ্ছিলাম। রাতের বেলা বাড়িতে ফিরে মাটির ব্যাংকটা ভাঙ্গি। প্রায় বারো শত টাকা জমেছে। কাজটা করি মিনতির অগোচরেই। কেননা ও জানলে এটা কিছুতেই করতে দিত না। পরদিন একই রঙের একটা ব্যাংক এনে ঔ জায়গায় রেখে দেই।
প্রতিদিন বাড়িতে এসে খোঁজ নেই কেউ কোনো কার্ড দিয়েছে কিনা। যদি শেষ পর্যন্ত দাওয়াতটা পেয়েই যাই। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো কার্ড এলো না। বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আর নেই। সন্ধ্যায় নিয়াজেরা আমার দোকানে এলো। এখন ঠিক করা হবে আমরা কোথায় মিলিত হবো। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো শুক্রবার জুম্মার নামাজ বাদ কালীবাড়ির বটতলায় আমরা মিলিত হবো। তারপর একসাথে বিয়ে বাড়িতে যাবো।
শুক্রবার সকালে উঠে বাজারের দিকে যাই। হাটতে হাটতে একটা বুদ্ধি বের করার চেষ্টা করি। শুক্রবার সকালে সাধারণত দোকান খুলি না। বাড়ি ফিরে বলি, আমাকে এখন কাউনিয়া যাওয়া লাগবে। কারণ দর্শাই যে, আমার এক কাছের বন্ধুর বাবা মারা গেছে । বাবাকে বলি, বিকালে দোকানটা খুলতে । আমি হয়তো আজ ফিরব না।
কাকিনা রেল স্টেশনের দিকে রওনা হই। সিদ্ধান্ত নেই আদিতমারি গিয়ে পরেশ কাকার বাড়িতে আজ রাতটা থাকবো। হাঁটতে হাঁটতে আমার অনেক কথাই মনে পড়ে। গতবার নিয়াজের কলেজের প্রোগ্রামে রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকটা দেখেছিলাম। ওখানকার একটা ডায়ালগ মনে পড়ে- মানুষ বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি। একটা দাওয়াতের জন্য আমার মন এতো খারাপ হওয়ার কারণ তো দেখি না। নিমন্ত্রণের সাফল্য মানুষ নির্ধারণ করে খাওয়া কেমন হলো এটা থেকে। আমি নিজেকে বলি, পিন্টুর বিয়েতে একবেলা খেয়ে তো তোর সারাজীবনের ক্ষুধা মিটবে না। সেখান থেকে ফিরেই তো তোকে বসতে হবে চর্ম-কর্মে। আমৃত্যু এই ক্ষুধা মেটাতে হলে তোকে আমৃত্যু কাজও করে যেতে হবে। পিন্টুর বিয়ের দাওয়াত তোর এই দারিদ্র-ক্লিষ্ট জীবনের অবসান ঘটাতে পারবে না। পিন্টুর সেই নতুন আমেরিকান বউকে দেখার-ই বা এতো সাধ কেন? তারচে বরং তুই বাড়ি গিয়ে মিনতিকে দেখ, যে তোকে ভালোবাসে অকৃত্রিম। রাতের বেলা তোর অপেক্ষায় হারিকেন জ্বালিয়ে বসে থাকে, তুই না ফিরলে খায় না। বিয়ের প্রথম দিককার কথাগুলো মনে পড়ে। প্রথম একমাস মিনতি আমরা সাথে কোনো কথা বলতো না। আমাকে নাকি তার পছন্দ হয় নি। কারণ আমার মাথায় টাক। আমি শক্তির নিত্যতার সূত্র অনুকরণ করে বলতাম, মহাবিশ্বে সর্বমোট চুলের পরিমাণ নির্দিষ্ট। যে পুরুষের মাথায় চুল কম তার বউয়ের মাথায় চুল বেশি। পক্ষান্তরে যে পুরুষের মাথায় চুল বেশি (স্টাইল হিসেবে) তার বউয়ের মাথায় চুল কম (কারণ তারও স্টাইল হিসেবে বব কাটা)। এভাবে পুরোনো কথা ভেবে নিজের মনকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করি।
ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। ট্রেন এতক্ষণে মনে হয় ভোটমারি পর্যন্ত এসেছে। স্টেশনের পাশের একটা দোকানে পরেশ কাকার বাড়ির জন্য কিছু গজা কেনার জন্য দাঁড়াই। হঠাৎ পিছন থেকে ঘাড়ে একটা হাত পরে। ‘ আরে কালাম তুই? তুই এখানে কেন?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি। ও বলে, শালা তুই একা একা পালাচ্ছিস? আমি ওর কথা বুঝতে পারলাম না। ও বললো, গতকাল রাতে আমি পিন্টুর বাসায় গিছলাম। এ কথায় ও কথায় তোর কথা উঠলো। তোর কথা উঠতেই দেখি সে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। পরে শুনলাম তোকে দাওয়াত করেনি। আমি এই দাওয়াতে যেতে পারবো না দোস্ত। আমি এ ব্যাপারে নিয়াজ আর ফজলুকে কিছু বলিনি। কেউ না গেলে কেমন দেখায়? শুধু ওদের জানিয়ে এলাম আমি জরুরি একটা কাজে রংপুর যাচ্ছি। পিন্টুটা এমন হলো কেন রে? এমন বন্ধুও ক্ষতিকারকে প্রথম বিভক্তি।’ আমি সম্ভাব্য চিরকুমার কালামের মুখের দিকে তাকাই। আমার অনেক আনন্দ লাগছে। আমার তো দুঃখিত হওয়ার কারণ নাই। এমন বন্ধু থাকতে বদলে যাওয়া দাম্ভিক এক বন্ধুর কথা ভাবার কোনো মানে হয় না। কালাম জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাবি? আমি বলি, আদিতমারি যাব এক কাকার বাড়িতে। ও প্রস্তাব দেয়, ‘আমার সাথে রংপুরে চল। কালকেই ফিরবো।’ আমি মাথা নেড়ে বন্ধুর নিমন্ত্রণে সায় দেই।
কবি ও গল্পকার