| 29 মার্চ 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া

পাঠপ্রতিক্রিয়া: মোহিত কামালের জলবোমা । সালমা আক্তার

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
মানব জীবনে যুদ্ধ, প্রতিরোধ যুদ্ধ বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী যেকোনো ঘটনার প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। এসব ঘটনা চিরদিনই কালজয়ী ও মহৎ সাহিত্যের অনন্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, এমন জটিল ও সংবেদনশীল সময়েই মানুষের মহত্তর ও গভীরতর পরিচয় উন্মোচিত হয়। ‘ইলিয়াড’ অথবা ‘মহাভারত’ এর মতো মহাকাব্য তার সমস্ত অবয়বে এই যুদ্ধকে ধারণ করেছে। বিখ্যাত রুশ কথাশিল্পী লিও টলস্টয়ের মহাকাব্যোপম উপন্যাস ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এর মূল উপাদান সংগৃহীত হয়েছে দিগ্বিজয়ী ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের সময়কার রুশ দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সূত্র থেকে। ইলিয়া  এরিলবুর্গের ‘প্যারীর পতন’ এর আখ্যানভাগ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিকায় ফরাসি সমাজ ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মূল উৎসের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। স্পেনের গৃহযুদ্ধের একটি বিশেষ পটভূমিকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ফর হুম দ্যা বেল টোলস’ কিংবা বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যা পল সার্ত্রের বিখ্যাত ট্রিলজি ‘দি এজ অবরিজন’, ‘দি রিপ্রিভ’ ও ‘আয়রন ইন দ্যা সোল’ – এর বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে যুদ্ধকালীন পটভূমি। একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও বহুদিক থেকেই আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃজন প্রয়াসে এক বিশেষ প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের সাহিত্যে উদ্ভাসিত। কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল এই মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সময়কে কেন্দ্র করেই তাঁর ‘জলবোমা’ গল্পে  কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত নিরবিচ্ছিন্ন ঘটনা খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। লেখক অন্তরঙ্গভাবে মুক্তিযুদ্ধের রাজাকারদের স্বরূপসত্য উন্মোচন করেছেন গল্পটিতে। স্বাধীনতা-উত্তরকালীন বিপন্ন সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লেখক প্রতিবাদ ও জাগরণের মননসিদ্ধ শিল্প অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন তাঁর গল্পে। 
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, “ঈশ্বরের ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতি সর্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম।” সংস্কৃত শ্লোকে আছে, ‘জননী জন্মভূমিশ্চঃ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ দেশপ্রেম মানুষের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এক মহৎ গুণ। এই বিশাল পৃথিবীর যে ভূখণ্ডে যে মানুষ জন্ম নেয়, সে দেশের আলো-বাতাস- ধূলিকণায় তার নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস, যে রাষ্ট্রের ধর্ম-ভাষা- সংস্কৃতিতে তার একাত্ম হওয়ার আকুতি সেই দেশই হলো তার স্বদেশ। সে কারণে, স্বদেশের ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি এবং জীবন ও পরিবেশের সঙ্গে একজন মানুষের যেমন শেকড়ের বন্ধন গড়ে ওঠে, তেমনই মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি সৃষ্টি হয় তার চিরায়ত ভালোবাসা। ভালোবাসার এই আবেগময় প্রকাশই হলো দেশপ্রেম। ‘জলবোমা’ গল্পে তেমনই এক দেশপ্রেমিক চরিত্র রাজু চৌধুরী। 
সমকালীন জীবনে অতীতের অশরীরী পদচ্ছায়া ও রাজু চৌধুরীর আত্মসম্মান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তা সন্ধানের পূর্বতন ধারায় প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেছে। বর্তমানের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাসে এ পর্যায়ে তিনি আত্মসমিধ সংগ্রহে পরিভ্রমণ করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সঙ্ঘজীবনাবেগে। ষাটোর্ধ্ব রাজু চৌধুরী চৈত্রের তপ্ত রোদের মাটির ঢেলা কপালে ঠেকালেন, কিন্তু এ বয়সে তা স্বাভাবিক নয়। তার ভেতরের দেশপ্রেম বা তেজ যেন চৈত্রের রোদের ভেতর থেকে ছড়িয়ে যাওয়া রুপোলী রোশনিরই প্রতীক। যখন অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন ওঠে তখন সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায় মানুষ। আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ছিনিয়ে আনতে চায় মুক্তি। যুগ যুগ ধরেই মানুষ আন্দোলন করে আসছে। অতীতে সংঘটিত হওয়া আন্দোলন বর্তমান আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। রাজু চৌধুরীর অস্তিত্বে মিশে আছে সে আত্মত্যাগ ও প্রতিবাদী চেতনা। আবার মুঠি ধরে তুললেন আরেক দলা মাটি। দেশকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে যেন আবার নতুনভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ তিনি।
গল্পে রাজু চৌধুরীর চলমান জীবনরূপ আবেগময় শব্দ রূপায়ণের মধ্য দিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ময় বিন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মন্থন জীবন স্রোতের মধ্যেও তরঙ্গায়িত হয়েছে মানবীয় আশা- আকাঙ্ক্ষা অচরিতার্থ বেদনার রূপবৈচিত্র্য। তাই তো স্মৃতির নদীতে ডুবতে থাকা খরস্রোতা ইতিহাসের ভরদুপুর আর চৈত্রের কড়া রোদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে নিজের অজান্তেই। সূর্যাস্তের সময় ডুবতে থাকা সূর্য যেমন রক্তিম চোখ তুলে ঠিক তেমনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে ষাটোর্ধ্ব রাজু চৌধুরী ডুবতে থাকা সূর্যের মতন আবার নতুন করে তেজোদীপ্ত হতে থাকেন। যেন রক্ত লাল স্মৃতির ঢাকনা খুলে গেল আচমকা। মনে পড়ে গেল সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের কথা। 
রং আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি রঙই নিজের নিজের জায়গায় সুন্দর এবং তার নিদর্শন শক্তির জন্যই সুপরিচিত। রং দিয়ে সুখ, ভালবাসা এমন কী কষ্টও বোঝা যায় ৷ বিভিন্ন রং ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের প্রতীক এবং তাদের ব্যবহারও আলাদা। কাকের কালো রং অশুভর প্রতীক। কালো মানেই মৃত্যুর, বিশ্বাসঘাতকতার ও ভয়ের প্রতীক। 
শৌর্য, তেজস্বিতা, বিজয়, পরাক্রম, গৌরব ও যশের ধারক হলো লাল। হলুদ রং মহাকর্ষের, বুদ্ধি বা অনুভবের প্রতীক। যে কোনো অশুভত্বকে নাশ করে বলে সর্ববিঘ্নহন্তা গণপতির পরিচ্ছদ হলুদ বর্ণের। একই কারণে শ্রীবিষ্ণুও হলুদ পরিচ্ছদ পরেন। কমলা রং সৃজনশীলতা, বদল, শক্তি এবং ধৈর্যকে বোঝায়। সবুজ রং আসার প্রতীক, নতুন জীবনের, শক্তি, উর্বরতার এবং বৃদ্ধির প্রতীক। মানসিক শান্তি এনে দেয় সবুজ। তাই রাজু চৌধুরীর মনে হলো মাটির ঢেলা ছুড়ে মারতেই যেন সবুজ পাতা রূপী স্বদেশের মাঝ থেকে কাকরূপী রাজাকারদের কালো ছায়া পালিয়ে গেল। 
আর সঙ্গে সঙ্গেই নানা রঙের সমারোহে দেশটা যেন সৌন্দর্যের আধারে পরিণত হলো। রঙের সমারোহ যেন যুদ্ধ জয়ের ইঙ্গিত বহন করে। তাই বোধের সুন্দর ঢিলটাও মাটির ঢেলার মতো ঝাকি দেয় খরস্রোতা ইতিহাসের সমুদ্রজলে। এবার তিনি ডুবে গেলেন স্বপ্নচোখের গভীরে। 
কী কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তা ভাবতে গিয়ে নিভে গেল ঘোরলাগা স্বপ্ন চোখের আলো। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে একই সুতায় গাঁথা দেশপ্রেমের আকুলতা। স্বদেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের হৃদয়কেই কাঁদায়, রাজু চৌধুরীও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি বুঝতে পারেন, স্বাধীনতা – উত্তর বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রত্যাশিত কোনো গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়নি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডের সমাজচেতনা প্রবাহের পশ্চাদগতি রাজু চৌধুরীর প্রাগ্রসর মানসকে করেছে দ্বন্দ্বদীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত। 
হঠাৎ পুত্রবধূর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলেন। তার নাতনি ফুলকথাকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার কথা। এদিকে মায়ের উদ্বিগ্ন মন যেন আগে থেকেই সন্তানের অশুভ বার্তা পেয়ে গিয়েছিল। 
লাগাতার হরতাল অবরোধের কারণে শুক্রবারেও স্কুল কলেজ খোলা। প্রতিদিন পেপার পত্রিকায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কথা শুনে তিনি ভীষণ মর্মাহত হন। দেশ স্বাধীন করার যেন কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি ফুলকথাকে স্কুল থেকে আনার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
হঠাৎ পথে ফুলের আকৃতির ধূলোচিত্র দেখে তিনি পা সরিয়ে নেন। দেশ তো একটা ফুলই। এই ফুলকে রক্ষা করার জন্যই একাত্তরে অস্ত্র ধরেছিলেন। তাই হয়তো ফুলের আকৃতির ধূলোচিত্রকে পা দিয়ে দলে যেতে পারেননি তিনি।
পথের পাশে আম গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কচি সবুজ পাতার ফাঁকে ভরে গেছে নতুন সাজে সজ্জিত হলুদ পাতা আর সবুজের ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠেছে তুলতুলে নরম আর হালকা লালচে রঙের নতুন কচি পাতা। প্রকৃতিতে ছুটে আসছে যেন নবীনের জয়োচ্ছ্বাস। যেন কোনো বিজয় গাঁথা দেশের প্রতিচ্ছবি। নবীন পাতার নির্মলতা ছুঁয়ে দেখার আগ্রহে হাত বাড়ালেন সড়কের পাশের আম গাছের কচি পাতার দিকে। উড়ে গেল তেলতেলে ডানার কুচকুচে কালো কাক। আজও সুন্দরের মাঝে অসুন্দরের নষ্ট কালো ছায়ার ছাপ সুস্পষ্ট।
জাপানি সংস্কৃতিতে কাক নবজীবন এবং পুনর্জন্মের প্রতীক। জাপানের দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী উপজাতি আইনুদের মধ্যে কাক হলো একটি পাখি যা নিজেকে উৎসর্গ করেছিল যাতে মন্দটি সূর্যের ক্ষতি করতে না পারে এবং এর সঙ্গে পুরো পৃথিবী। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতিতে তাদের কলঙ্ক হিসাবে দেখা হয়। কাককে খারাপ, মৃত্যুর প্রতীক এবং নানা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। তাদের বেশিরভাগ কাল্পনিক উপস্থিতিতে তারা ডুবে যাওয়া ভয়ঙ্কর পাখি এবং প্রচলিতভাবে বহু পৌরাণিক কাহিনি ও সংস্কৃতিতে মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত। লেখকও গল্পে কাককে মৃত্যুর এবং দেশের কলঙ্কের প্রতীক হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। পুকুরের জলে ছায়া ফেলে শব্দহীন উড়ে যায় একটি কাক। কিন্তু তারা তো একা উড়ে না বা দুপুরে ছায়ায় বসে তৃষ্ণা মিটিয়ে নীরবে উড়ে যায় না। এ ভাবনায় আচমকা কেঁপে ওঠে শরীর, কেঁপে ওঠে মাটি। রাজু চৌধুরী ভাবেন, কাকের ছায়ার মতোই পাকিস্তানি আমলের আদর্শিক অপচ্ছায়ার ক্রমপ্রসার, রাষ্ট্র ও জনতার দূরতিক্রম্য ব্যবধান, জনকল্যাণের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় স্বার্থ সংরক্ষণ প্রয়াস, সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যবচ্ছেদে রাষ্টের হস্তক্ষেপ, প্রতিবাদের পরিণামে জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা প্রভৃতি রাজনৈতিক মত প্রকাশের পথকে স্বাভাবিকভাবেই সঙ্কুচিত করে তোলে।
ধূলোচিত্র রূপী দেশ যেন পেতে চাইল মাটিতে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ, পুরোপুরি স্বাধীনতার আস্বাদ। কিন্তু এক অজানা আশঙ্কায় তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হলেন আর সে ছাপ তার চোখেমুখে সুস্পষ্ট।
সিএনজি চালককে দেখে তার দুঃস্বপ্নের ঝাপি খুলে গেল। চোখেমুখে একধরনের আতঙ্ক খেলে গেল। সে তাকে রাজু কমান্ডার ডাকলেও তা উপলব্ধিহীন বুলির মতোই শোনাল। তাতে কোনো শ্রদ্ধা বা ভক্তির লেশমাত্র ছিল না। যেন তার কথায় লুকিয়ে আছে তাজা পেট্রলবোমা। বালক-চালক একাত্তরে শান্তিবাহিনীর প্রধান রহমত আলীর নাতি। কয়েক বছর আগে একবার সে রাজুকে প্রশ্ন করেছিল, “আপনি নাকি একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে আমার দাদাজানরে খতম করবার লাগছিলেন?” তবে সেদিন তার তেজদীপ্ত জৌলুশ দেখে পালিয়ে গিয়েছিল রহমত আলীর নাতি।
একাত্তরে রহমতের ছেলেকে দেখে মায়া হওয়ায় বেঁচে গিয়েছিল রহমত। কিন্তু আজ বুঝতে পারেন কত বড় ভুল সেদিন তিনি করেছিলেন। শত্রুর বীজ রাখা ঠিক হয়নি। স্বাধীনতা বিরোধী এবং ওদের বংশধররা আজীবন এদেশের শত্রু। কারণ তারাই আজ দেশের বিরুদ্ধে ভয়ালরূপে আবির্ভূত হয়ে খুনের নেশায় বিভিন্ন জায়গায় জ্বালাপোড়াও করছে। 
কিন্তু রাজু চৌধুরী আবার সে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন রহমতের নাতির বিগলিত কথায় তার অটোতে উঠে। ফুলকথা স্কুলপ্রাঙ্গণে একা দাঁড়িয়ে থাকবে ভেবেই তিনি উঠেছিলেন। ফুলকথা তাকে অটোতে দেখে মোটেই খুশি হয়নি। সে রিক্সায় ফিরে যেতে চাইলেও দাদার কথায় অনিচ্ছাকৃতভাবেই সেও অটোতে উঠে বসে। কোথাও কোনো গোলযোগ দেখা দিলে সে খবর মস্তিষ্কে পৌঁছায় সবার আগে। তার প্রভাব পড়ে আমাদের মননেও। ফুলকথাও হয়তো তাই বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। হঠাৎ তার মনে হলো সমস্ত সৌন্দর্যের জোয়ারের উল্টো দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। যেন শেকড়হীন শেকড়ের দিকে তাদের এ অন্তহীন যাত্রা। যেন সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে অজানা কোনো অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।
মাস্তানের অটোতে ওঠাতে ফুলকথা ভয় পাওয়ায় তিনি আধ্যাত্মিকতায় ডুবে গিয়ে বলেন, “মাস্তানদের সিএনজিতে কেউ পেট্রলবোমা মারার সাহস  পাবে না।”
আর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফুলকথা একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতনি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বদেশপ্রীতি তার হৃদয়ে ধারণ করেছে। সে তার দাদাকেও মনে করিয়ে দেয় সে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকারের নাতি এবং মাস্তানের অটোতে চড়ে কী করে! এ কথায় তার চেতনার জগতে যেন আঘাত হানলেও এই উদ্বেগদহনকে অচেনা মনে হলো।
অটো চালক তাদের সব কথা শুনে ফেলে বলে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। ফলাফল গুম করলে বা কেড়ে নিলে বরং এগুলো আরো বেড়ে যাবে। রহমত আলীর মতো রাজাকারদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষমা করে দেওয়ায় রাজু চৌধুরীর মনে আজ আক্ষেপের জন্ম হয়েছে। তিনি ভাবলেন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তির অঙ্কুরিত বীজ সুশোভিত হয়ে আরো নির্মম ও হিংস্ররূপে ছড়িয়ে আছে বর্তমানেও। তারাই আজ নানা জায়গায় বোমা ফেলে অরাজকতা করছে। তাদের বংশধররা স্বাধীন দেশে এখনো যুদ্ধের সময়ের মতো নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, যা তাকে প্রতিনিয়ত মর্মাহত ও যন্ত্রণায় দগ্ধীভূত করছে। মাস্তানের গাড়িতে পেট্রলবোমা না ফেললেও অনেক বোমার মতো জলবোমা তো আছে। তারা এ বোমার নাম নতুন শুনল। ফুলকথা যেন তার কল্পলোকে দেখতে পেল,সে জলবোমার স্রোতে ভাসতে ভাসতে কোনো অজানা দেশ মানে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
হঠাৎ তারা বুনো গন্ধ পেল। অটো জলে ফেলার আগে নিশ্চয়ই সেখানে বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল যার বুনো ঝাঝালো গন্ধ তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। দেখতে পেল অটো ঢাল বেয়ে নিচে নামছে আর অটোচালক সামনের দরজা খুলে নেমে গেছে। ফুলকথার কল্পনায় ধরা দিল কোনো পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে অটোতে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে জলবোমায় নিভে গেল কল্পিত বারুদের সে স্ফুলিঙ্গ। কিন্তু বারুদ থেকেও বেরুচ্ছে আগুন। রাজু চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সে আগুন স্পর্শ করল না চন্ডাল মাস্তানের বোধের জগৎ। আনন্দ নিয়ে একবার চিৎকার করল সে তারপর নিরিবিলি সড়ক ধরে এগিয়ে আসতে থাকা অটোরিক্সা চালকের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল যাত্রীসহ অটো ডুবে গেছে। চেতনার বারুদ নিভে গেল নব প্রযুক্তির উদ্ভাবনী কৌশলে। সবাই জানলো দুর্ঘটনায় মারা গেছে রাজু চৌধুরী আর ফুলের মতন আপনি ফুলকথা। 
মূলত রাজু চৌধুরীর আবেগের কারণে সেদিন তার দাদাকে ক্ষমা করায় আজ তার এবং ফুলকথার জীবনে এ নির্মম পরিণতি সাধিত হয়েছে। ক্ষমা মহৎগুণ হলেও রহমত আলীর মতো মানুষদের মায়া করে ক্ষমা করা যায় না। জলবোমার ঘটনা এ গল্পে ভাবনাবীজ হিসেবে কাজ করেছে মাত্র। কিন্তু লেখকের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় অস্তিত্বের লুপ্ত চেতনার পুনরুজ্জীবন। কিন্তু গল্প শেষে পাঠক হৃদয় যন্ত্রণায় দগ্ধীভূত হয়।   
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল ‘জলবোমা’ গল্পে একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মানুষের সঙ্ঘশক্তির সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। গল্পের বিষয়ভাবনার কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সঙ্গজীবনাবেগ,সংগ্রামী জীবনচেতনা এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালীন বিপন্ন সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জীবনভাষ্য। 
দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও অপরিমেয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় মানচিত্র বাঙালি জাতির এক মহত্তম প্রাপ্তি। একজন মহৎ লেখক হিসেবে মোহিত কামাল অনুভবে সেই মানচিত্র বক্র ও সরল রেখায় অঙ্কিত কিছু ঘটনা বা মুক্তিযোদ্ধাদের নামের সমষ্টি মাত্র নয়; বরং তা হয়ে ওঠে সামূহিক অস্তিত্বের বিরলদৃষ্ট সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, রক্তক্ষরণ এবং সাফল্যের চৈতন্যময় অভিব্যক্তি। পরীক্ষিত লেখকের মতো তিনি  একটা প্রলয়ঙ্করী পরিস্থিতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের রক্তোজ্জ্বল চেতনার শিল্পরূপ নির্মাণ সফল করে তুলেছেন। সমগ্র জাতিসত্তার প্রাণস্পন্দনকে তিনি শিল্পমণ্ডিত করে তুলেছেন গভীর জীবনীশক্তি ও শৈল্পিক নিরাসক্তিতে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত