রাশেদ রউফ
শিশুসাহিত্য শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ, আর ‘ছড়াসাহিত্য’ শব্দটি প্রথম আসে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কলমে। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে (১৩০১ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মেয়েলি ছড়া’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন : ‘ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্রথা অনুসারে বয়স্ক মানবের কত নতুন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শতসহস্র বছর পূর্বে যেমন ছিল আজোও তেমনি আছে। সেই অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারংবার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে, অথচ সর্বপ্রথম দিন সে যেমন নবীন তেমন সুকুমার যেমন মূঢ় যেমন মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে।
এই নবীন চিরত্বের ধারণ এই যে, শিশু প্রকৃতির সৃজন। কিন্তু বয়স্ক মানুষ বহুল পরিমাণে মানুষের নিজকৃত রচনা। তেমনি ছড়াগুলিও শিশুসাহিত্য; তাহারা মানবমনে আপনি জন্মিয়াছে!’
এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শিশুসাহিত্য শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। অন্যদিকে এর ঠিক পাঁচ বছর পর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৬ বঙ্গাব্দ) যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমণির ছড়া’ সংকলনের ভূমিকায় ‘ছড়াসাহিত্য’ ও ‘শিশুসাহিত্য’ শব্দ দু’টি উল্লেখ করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। সেখানে তিনি বলেছেন :
‘বাঙালি শিশুর ও বাঙালি জননীর স্বাভাবিক চরিত্রে অসাধারণত্ব কিছু না থাকুক, কিন্তু সেই জননীর ও তাঁহার অন্যান্য প্রতিবেশী প্রতিবেশিনীর সামাজিক চরিত্রে বঙ্গদেশে ও বঙ্গসমাজে বাসনিবন্ধন যে অনন্যসাধারণত্ব, যে বৈশিষ্ট্য আছে, এই ছড়াসাহিত্যে তাহারও পরিচয় না পাওয়া যাইবে, এমন নহে!….
বাঙালি জাতির সমগ্র সাহিত্যটাতেই বাঙালির সেই গৃহের বিবিধ চিত্র নানা রঙে চিত্রিত হইয়াছে এবং স্বভাবের তুলিকা যেন সেই রঙ ফলাইবার জন্য, কোনো কৃত্রিম উপকরণের সাহায্য লয় নাই; স্বভাবের ভাণ্ডার হইতেই সেই রঙগুলি সংগৃহীত হইয়াছে। আমি আধুনিক যুগের কৃত্রিম শিক্ষার প্রভাবে নির্মিত সাহিত্যের কথা বলিতেছি না; বাঙালির অকৃত্রিম প্রাচীন নিজস¦ সাহিত্যের কথা বলিতেছি; এবং এই অকৃত্রিমতার হিসেবে বাঙালির গ্রাম্য-সাহিত্য, বিশেষত বাঙালির শিশুসাহিত্য বা ছড়াসাহিত্য, যাহা লোকমুখে প্রচারিত হইয়া যুগ ব্যাপিয়া আপন অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে, কখন লিপিশিল্পের যোগ্য বিষয় বলিয়া বিবেচিত হয় নাই, সেই সাহিত্য সর্বতোভাবে অতুলনীয়।’
তাই ‘শিশুসাহিত্য’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার নিয়ে যে সব অভিমত প্রচলিত আছে, সেসব অভিমত আমরা উপরে উল্লিখিত দুটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিবেচনা করতে পারি। রবীন্দ্রনাথকে এখানেও পথিকৃতের মর্যাদা দিতে হয়।
শিশুসাহিত্যের স্বরূপ ও সংজ্ঞা নিয়ে নানাজন নানা রকম অভিমত প্রদান করেছেন। তাঁদের অধিকাংশই ছোটোদের জন্য লেখা সাহিত্যকে ‘শিশুসাহিত্য’ নামে অভিহিত করেছেন। লীলা মজুমদার ‘শিশুসাহিত্য’ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন গভীরভাবে। তিনি বলেছেন :
‘ইংরেজিতে যখন বলা হয় বুকস ফর চিলড্রেন, কিংবা জুভেনাইল লিটারেচার; সকলেই বুঝে নেয়, ঐসব বই ৫ থেকে ১৬ পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ স্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়বে। কিন্তু আমাদের দেশে শিশু সাহিত্য বাদে ঐ অর্থে ব্যবহার করলে কেউ কেউ আপত্তি করেন, বলেন ৮-৯ বছরের পর কেউ শিশু থাকে না, হয়ে ওঠে কিশোর। যদিও শিশুদের জন্য আর কিশোরদের জন্য দু’রকম বই লেখা হয়, সুবিধার জন্য আমরা শিশুসাহিত্য বলতে ৫-১৬ পর্যন্ত সব পাঠকের কথাই মনে করি।’ অন্যদিকে চিত্রা দেব বলেছেন : ‘শিশুসাহিত্যের পরিধি নির্ণয় করা কঠিন। সাধারণত চার-পাঁচ বছরের শিশু থেকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরদের পাঠোপযোগী সাহিত্যকেই শিশু সাহিত্য বলা হয়। ড. মহুয়া ভট্টাচার্য গোস্বামী তাঁর ‘শিশু-কিশোর সাহিত্যের স্বরূপ-সংজ্ঞা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে শিশু ও কিশোর মনের জগৎ আলাদা। তাদের জন্য লেখা সাহিত্যের জগৎও স্বতন্ত্র। অধিকাংশ সাহিত্যিক এই স্বাতন্ত্র্য মেনেই সচেতনভাবে শিশু সাহিত্য ও কিশোর সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছেন। আবার অনেকের রচনায় সমস্ত ছোটোদের জগৎটাকেই আকর্ষণ করবার উপযুক্ত উপাদান চোখে পড়ে। তাই বলা যায়, যে সমস্ত লেখা পড়ে শিশু ও কিশোররা আনন্দ পায়, জাগতিক শিক্ষা পায় এবং মানসিক পরিপূর্ণতা লাভ করে, তা সামগ্রিকভাবে শিশু-কিশোর সাহিত্য সংজ্ঞায় নিরূপিত হতে পারে। তবে শিশুসাহিত্য কথাটি যেহেতু আমাদের সাহিত্যে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাই সাধারণভাবে গ্রহণ করতে কোনো অসুবিধা নেই।’ যদিও শিশুসাহিত্য রচনা করা হয় আমাদের সমাজের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মজা ও আনন্দদানের উদ্দেশ্যে তবু তার মধ্যে শিক্ষারও একটা সংযোগ থাকে। সে কারণে হরেন ঘটক বলেছেন, ‘শুধু তাকে আনন্দ দেওয়াই নয়, শিশু সাহিত্যের মাধ্যমে শিশুকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস এবং বিশ্ব-প্রকৃতিকে জানবার আগ্রহী করে তোলবার উদ্দেশ্যও এতে বর্তমান’। ফলে সুখলতা রাও ‘শিশুসাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা ও রুচি’ বিষয়ে লিখেছেন : ‘শিশু সাহিত্যের ভিতর দিয়ে শিশুর সরল মনে যে ছবি, যে-শিক্ষা, যে-আদর্শ পৌঁছায়, তাহা তাহার অজ্ঞাতসারে সেখানে নিজের ছাপ রাখিয়া যায় এবং ভবিষ্যতে তাহার শিক্ষা দীক্ষা, এমনকি রুচির উপরে প্রভাব বিস্তার করে। বিষয়টিকে আরো ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন প্রাবন্ধিক অজিত দত্ত। শিশুসাহিত্যের স্বরূপ নির্ণয়ের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, “আমাদের সকলেরই আজ একথা উপলব্ধি করা দরকার যে, শিশুর শিক্ষা ও শিশুর সাহিত্যকে অভিন্ন করে না তুলতে পারলে, শিক্ষাও হবে অসম্পূর্ণ এবং সাহিত্যও হবে পঙ্গু। এই শিক্ষার মানে ‘সদা সত্য কথা কহিবে’ এবং ‘চুরি করা বড় দোষ’ মাত্র নয়। এ শিক্ষার মানে শিশু মনে যতগুলো সদ্বৃত্তি অপুষ্ট আছে, তাদের ফুটিয়ে তোলা। এই সদ্বৃত্তির মধ্যে আছে ভদ্রতা, সমবেদনা ও করুণা, আছে উচ্চাকাক্সক্ষা, নির্ভীকতা ও স্বাদেশিকতা, আছে দয়া, দাক্ষিণ্য ও মমতা, আছে মানবতাবোধ, আছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের সন্ধান। তেমনি আছে রসনাভূতি কাব্যবোধ ও সাহিত্যপ্রীতি, আছে অনুসন্ধিৎসা এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো কিছুকে বিচার করবার ক্ষমতা।”
এখানে বলে রাখা দরকার যে, বাঙালি শিশুর জন্য শিশুপাঠ কেমন হওয়া উচিত-সেই পথ প্রথম দেখালেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার। ১৮৪৯ সালে ‘শিশু শিক্ষা’ গ্রন্থমালা লিখে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’ এই লাইনটি ‘শিশু শিক্ষা’ প্রথম ভাগের ‘প্রভাতবর্ণন নামে চিরকালের শিশু কবিতার অংশ। ‘লেখাপড়া করে যে/গাড়িঘোড়া চড়ে সে-এক সময়ে ছোটোদের কাছে এই আপ্তবাক্যটি আওড়ানো হতো। সময়ের পরিবর্তনে আজ এই বাক্যটি ভুলে যেতে বসলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এটি ছিল বিদ্যা গ্রহণ বিষয়ে উজ্জীবনের মূলমন্ত্র। এই বইয়ে প্রচুর নীতিশিক্ষা রয়েছে। তবে কোনো বিশেষ ধর্মীয় নীতিবোধের চেয়ে সর্বজনীন মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিশুসাহিত্য সে হিসেবে আনন্দ আর শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয়। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, ‘শিশু শিক্ষার পুস্তকে যে বস্তু বাদ পড়ে যায়- অর্থাৎ আনন্দ-সেই বস্তু জুগিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ সাহিত্যের সৃষ্টি’। বিষয়টাকে আরো খোলাসা করেছেন নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘শিশুসাহিত্য আনন্দের আশ্রয়ে চরিত্রগঠন ও শুভবুদ্ধির সঞ্চার মাতৃস্নেহ, পিতৃনিয়ন্ত্রণ এবং খেলার সাথীর সাহচর্য- এই তিনটির উপরেই নির্ভর করে’। শিশুসাহিত্য গবেষকদের নানা মতকে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে এই ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে শিশুসাহিত্য হলো ছোটোদের এক রঙিন জগৎ। তাদের মনে বিশুদ্ধ আনন্দরস সঞ্চারের জন্য যে সাহিত্য রচনা করা হয়। যে রচনা পড়ে ছোটোরা মজা পায়, আনন্দ পায়, পরিতৃপ্ত হয়। তাকে তারা সহজেই অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে নেয়। ছোটদের চঞ্চল, কল্পনাপ্রবণ ও জিজ্ঞাসু মনকে অনুষঙ্গ করে সাহিত্য রচনা করেন লেখকরা। হাসি, কৌতুক, মজা বা আনন্দ গ্রহণের অন্তরালে ছোটোরা অনায়াসে পেয়ে যায় জাগতিক জ্ঞান, বুদ্ধি-যুক্তি ও চিন্তার চমৎকার উপাদান। এই জ্ঞান বা শিক্ষা জটিল নয়, কঠিন নয়, জগৎ ও পরিবেশ বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান। শিশু সাহিত্যিকদের এসব রচনা থেকে জীবনকে দেখবে এবং অনিসন্ধিৎসু মন দিয়ে খুঁজে পাবে জীবনের বিচিত্র রূপ।
শিশুসাহিত্যের পাঠক কেবল কি ছোটোরাই?
সময়ের বিবর্তনের ধারায় ক্রমশ বদলে যায় চারপাশের জগৎ ও জীবন। পাল্টে যায় সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যের ধারা। এই বদলে যাওয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিশুসাহিত্যও ধীরে ধীরে পাল্টে ফেলছে। রচনার বিষয়-বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটছে তার গতি-প্রকৃতি। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রকরণ, সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ধারার রচনা এবং নির্মাণ হচ্ছে নতুন আঙ্গিক। এজন্য পূর্বের ধ্যান ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে। শিশুসাহিত্য একান্তভাবে ছোটোদের জন্য লেখা হলেও সব বয়সের পাঠকের কাছেই তা পরম আস্বাদ্য। বুদ্ধদেব বসু অনেক আগেই বলেছেন, ‘এমন মত পোষণ করা সম্ভব যে শিশুসাহিত্য স্বতন্ত্র কোনো পদার্থ নয়, কেননা তা সত্যিকার সাহিত্য হলে বড়রাও তাতে আনন্দ পান’। ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি শিশু সাহিত্যের ভোক্তা-বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। বুদ্ধদেব লিখেছেন : বর্তমান কালের ছোটোদের বই অনেক ক্ষেত্রে বয়স্করাও উপভোগ করে থাকেন। কথাটাকে একটু বিস্তার করা দরকার। শিশুসাহিত্যে বড় দুটো শ্রেণি পাওয়া যায়। তার একটা হলো একান্তভাবে, বিশুদ্ধরূপে নাবালক সেব্য, যেমন যোগীন্দ্রনাথের, উপেন্দ্র কিশোরের রচনাবলি, আর অন্যটা হলো সেই জাতের বই, যাতে বুদ্ধির পরিণতিক্রমে ইঙ্গিতের গভীরতা বাড়ে, যেমন ক্যারলের অ্যালিস-কাহিনী, অ্যান্ডারসনের রূপকথা, বাংলা ভাষায় ‘বুড়ো আংলা’ ‘আবোল তাবোল। যাদের মনের এখনও দাঁত ওঠেনি, একেবারে তাদেরই জন্য প্রথম শ্রেণির রচনা। তাদের ঠিক উপযোগী হলেই তা সার্থক হলো : কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির রচনা, বিশেষ অর্থে, শিশু পাঠ্য থেকেও, হয়ে ওঠে বড় অর্থে সাহিত্য, শিল্প কর্ম, অর্থাৎ লেখক ছোটোদের বই লিখতে গিয়ে নিজেরই অজান্তে সকলের বই লিখে ফেলেন। বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক শিশুসাহিত্য, যা বয়স্করাও উপভোগ করেন। তা এ দুয়ের কোনো শ্রেণিতেই পড়ে না, খুব ছোটোদের খাদ্য এটা নয় বরং বলা যায় কিশোর সাহিত্য আর বয়স্কদের যখন ভালো লাগে, তখন এই কারণেই লাগে যে লেখক তা-ই ইচ্ছে করেছিলেন, অনেক সময় বোঝা যায় যে লেখক যদিও মুখ্যত বা নামত ছোটোদের জন্য লিখেছেন, তবু সাবালক পাঠকও তাঁর লক্ষ্যের বহির্ভূত ছিল না।
আশা গঙ্গোপাধ্যায়ও ‘শিশুসাহিত্যের স্বরূপ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘যথার্থ শিশু সাহিত্য বলিতে তাহাই বুঝিব, যাহা সর্ব্ব বয়সের নরনারীর কাছেই একটি রসাস্বাদ আনিয়া দেয়, বয়সের পার্থক্য অনুসারে আস্বাদনের ব্যাপারে কিছু বিভিন্নতা ঘটিতে পারে- কিন্তু সর্বস্তরের মানুষকে আনন্দ দান করিবার মতো শিল্পগুণ তাহাতে থাকিবেই।’ অতএব, আমরা বলতে পারি, যে কোনো মহৎ সাহিত্য যেমন সরস ও সুস্বাদু হবার পাশাপাশি বৃহত্তর জগতের সন্ধান দেয়, তেমনি যথার্থ শিশুসাহিত্যে আনন্দরসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় চারপাশের জগৎ ও জীবন। এটি চিরায়ত সাহিত্য। সব শ্রেণির পাঠক এর ভোক্তা।
শিশু-কিশোরদের জন্য রচনা তথা শিশুসাহিত্যে কেমন হওয়া উচিত?
শুধু শিশুসাহিত্য নয়, যে কোনো ধরনের রচনার বড় একটি গুণ হলো সহজ ও সরল রচনারীতি। শিশুসাহিত্যে এই সারল্য প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। ইচ্ছে করলেই লেখাকে সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় না। তার জন্যও প্রয়োজন সাধনা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন :
সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে
সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।
রচনার সহজ রীতির এই বৈশিষ্ট্যটি লেখকের মানসিকতা, উপলব্ধি ও আন্তরিক প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে। সহজ ও সরল রীতি আয়ত্ত করা কঠিন একটা কাজ। এই কঠিন কাজটি নিজের কব্জায় আনার জন্য প্রয়োজন অনুশীলন। অবিরাম চর্চার মধ্য দিয়ে লেখকরা তাঁদের রচনাকে সরল, সহজ, সরস ও আকর্ষণীয় করে তোলেন।
ম্যাক্সিম গোর্কির একটা বক্তব্য এখানে স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন To successfully create fiction and educative literature for children we need to following; first, writers of talent capable of writing simply, interestingly and meaningfully; then editors of culture, with sufficient Political and literary training and finally, the technical facilities to guarantee timely publication and due quality of books for childern.
ছোটোদের জন্য গল্প উপন্যাস ও শিক্ষামূলক সাহিত্য রচনায় আমাদের সাফল্য নির্ভর করে কিসের ওপর? প্রথমে আমাদের প্রয়োজন সেইসব প্রতিভাবান লেখক, যাঁরা সহজ, সরস ও অর্থপূর্ণ রচনা তৈরির ক্ষমতা রাখেন। তারপর চাই সংস্কৃতিমান সম্পাদক, যাদের সাহিত্যও রাজনীতিতে যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকে। এবং সর্বোপরি প্রয়োজন শিশুপাঠ্য গ্রন্থাবলি যথাসময়ে এবং যথোচিত উৎকর্ষে সমৃদ্ধ করে প্রকাশের নিশ্চয়তা বিধানের কারিগরি সুযোগ-সুবিধা।
ম্যাক্সিম গোর্কি Simply, Interestingly Meaningfully- এই তিনটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন। শিশুসাহিত্য রচনার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সহজ ও আকর্ষণীয় করা। কেননা, সহজ সরল না হলে ছোটোদের বুঝতে কষ্ট হবে, আর আকর্ষণীয় না হলে পড়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ জন্মাবে না। ছোটোদের মনে কৌতূহল সঞ্চার করা এবং তাদের নরম, কোমল ও আনন্দময় মনকে উজ্জীবিত করার জন্য সহজ ও আকর্ষণীয় রচনার বিকল্প নেই। এর মধ্যেই নিহিত আছে চিরায়ত সাহিত্যগুণ। শিশুসাহিত্য এমন এক মনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় যা লেখকের জন্য শ্রমসাধ্য হলেও তার প্রকাশ সাবলীল ও প্রাণবন্ত, শ্রম, চেষ্টা ও প্রতিভার সমন্বয়ে সৃষ্টি হতে পারে এমন অভাবনীয় সাহিত্য।
আমরা যারা শিশুসাহিত্য কর্মী, আমাদের দায়বদ্ধতা কী?
শিশুর প্রতি ভালোবাসা শিশুসাহিত্য রচনার পূর্বশর্ত। শিশু যে কোনো জিনিস দেখলে ধরতে চায়, ছুঁতে চায়। ওরা খেলতে চায়। টেলিভিশন দেখতে চায়। তাদের আগ্রহ ও আনন্দের জায়গাটুকু খবর রাখতে হয় আমাদের। বলা যেতে পারে, শিশু মনস্তত্ত্ব আয়ত্ত করে নেওয়া জরুরি। শিশুসাহিত্য যেন শিশুর আনন্দসঙ্গী হয়ে ওঠে, তার জন্য আমাদের ভাবতে হবে সব সময়।
শামসুজ্জামান খান তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন : শিশু সাহিত্য শিশুর মানসিক খাদ্য। এই খাদ্য তার মনকে করে সতেজ, সবল। তার স্বপ্ন ও কল্পনাশক্তির বিকাশে উপভোগ্য শিশু সাহিত্যের কোনো বিকল্প নেই। মুক্তমন, উদার চিন্তা, স্বাধীনচিত্ততার জাগরণ, এই সবকে গড়ে তোলে অদ্ভুত, বিস্ময়কর, অসামান্য বই। একথা ঠিক শিশু সবচেয়ে বেশি শেখে তার পরিবেশ থেকে, পরিবার থেকে, তার নিজস্ব জগৎ থেকে। দয়া, মায়া, বন্ধুতা, প্রতিবেশী ও অন্য মানুষকে ভালোবাসা এই বিষয়গুলো পরিবেশ থেকে প্রকৃতি থেকেও বুঝে মানুষ শিখে নেয়। সেই শিখে নেয়ার ওপর একটি স্থায়ী প্রলেপ দিয়ে দেয় আনন্দ, আবেগ ও গভীর মনোসংযোগে পড়া প্রিয় বইটি। এভাবে মা-বাবা ছাড়াও বইয়ের কোনো কোনো চরিত্র হয়ে ওঠে শিশুর আদর্শ নায়ক, বীর বা মানসসঙ্গী। নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারাও শিশুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শিশু দেশপ্রেমিকতার শিক্ষা পায় এবং দেশকে ভালোবেসে ধীরে ধীরে ভালোবাসতে শেখে সারা পৃথিবী ও তার নানা বর্ণের, নানা গোত্রের বিচিত্র মানুষকে-তাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যকে।
তাই এমন রচনা আমরা চাই, যা শিশু-কিশোরের মানস গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। ছোটোদের রুচি গঠন ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরিতে সহায়ক এমন রচনাই আমাদের কাম্য। আমরা জানি, মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও আনন্দানুভূতির মূলে রয়েছে তার রুচি। এই রুচিকেই সবার আগে প্রাধান্য দেয়া দরকার। কামিনী রায় বলেছেন, ‘কুসাহিত্য , কু-দৃশ্য মানুষের রুচিকে বিকৃত করে। সাহিত্য যখন ভবিষ্যৎ সমাজের জীবনকে গঠন করে তখন এরূপ কুসাহিত্যিকে উৎসাহ না দেয়াই উচিত। যাহা সুন্দর, যাহা আনন্দদায়ক, যাহা জনকে ঊর্ধ্বমুখ করে, তাহাই আর্ট।’ আমাদের দরকার তেমন মানসম্মত বই, যা ছোটোদের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। কেমন হওয়া উচিত বইগুলো? সত্যজিৎ রায়ের মতে: ‘লে-আউট, ছাপা, ছবি যেমন সুন্দর হওয়া দরকার, তেমনি এর লেখাগুলোও হবে শিশু-কিশোর মনের উপযোগী।’ ছোটোদের লেখার একটি প্রধান ও প্রচলিত সংজ্ঞা হলো, এটি সববয়সী পাঠক পাঠিকাকে সমানভাবে আকর্ষণ করবে। অজিত দত্ত বলেন, ‘ছোটোদের বই এমন হতে হবে যা তাদের ভালো লাগবে আর যা পড়ে তাদের মনের ভালো বৃত্তিগুলোতে খানিকটা সাড়া জাগাবে।’ ছোটোদের মন ও মনন গঠনে শিশুসাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার প্রস্তুতিপর্বে ছোটোদের চিন্তা-চেতনায় রুচিবোধ ও জীবনবোধ প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় উপকরণ সমৃদ্ধ সাহিত্য রচনা একান্ত আবশ্যক।