| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

মর্চ্যুয়ারি ক্যুলার

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

১.

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর বারবার দরখাস্ত পাঠাচ্ছি। লাভ হচ্ছে না। প্রতিটা দরখাস্তে ঘুরে-ফিরে একই কথা লিখতে হচ্ছে। মহাত্মন, আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে গত পৌনে দুই বছর কর্মরত। বিগত প্রায় এগারো মাস হয় আমাদের একমাত্র ‘মর্চ্যুয়ারি ক্যুলার’ বা মৃতদেহ সংরক্ষণের ফ্রিজটি নষ্ট হওয়ায় মৃত দেহগুলোর যথার্থ ময়না তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আমি, মোহাম্মদ ইলিয়াস শাহ, পিতা- মৃত সেকেন্দার আলী শাহ, সাং- মণিরামপুর, যশোর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের হৃদয় দয়ার্দ্র করার জন্য দরখাস্তে বিশদ ভাবে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের একমাত্র মৃতদেহ রাখার ফ্রিজটি গত ১১ মাস ধরে নষ্ট হবার কারণে কি কি সমস্যা হচ্ছে, তার একটি যথাসম্ভব কষ্টদায়ী চিত্র প্রতি দরখাস্তেই জুড়ে দিচ্ছি। যেমন গত সপ্তাহেই কি যেন লিখেছিলাম দরখাস্তে? হ্যাঁ, মনে পড়ছে:

‘মহোদয়,
গত এগারো মাস যাবৎ ডিএমসিএইচ-এর সবেধন নীলমণি একটি মাত্র মর্চুয়্যারি ক্যুলার বিনষ্ট হওয়ায় ডিএমসিএইচ মর্গের করিডোরে নানা অপঘাত যেমন সড়ক দূর্ঘটনা, হত্যা কি আত্মহত্যায় নিহত প্রায় বিশটি মনুষ্যদেহ পড়িয়া থাকিতেছে। ইহাতে চারপাশের বাতাস উৎকট পচা গন্ধ ছড়াইতেছে এবং খুন-ধর্ষণ-সড়ক দূর্ঘটনা সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ মামলার জন্য ভিক্টিম মৃতদেহগুলোর যথার্থ সনাক্তকরণ করা সম্ভবপর হইতেছে না।’

কিন্ত- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তাটি আসলে কে? তিনি কি অসংখ্য ফাইলের স্তুপে পড়ে থাকা আমার পাঠানো একটির পর একটি দরখাস্ত কি আদৌ পড়ে বা এমনকি ছুঁয়ে-টুয়েও দ্যাখেন? দরখাস্ত পাঠাতে পাঠাতে আঙুলে আমার কড়া পরে আসে। এই বয়সে এত টাইপ করতে কি ভাল লাগে? আমি ত’ আর পেশাদার লেখক নই। তা’ সেই প্রথম তিনবার দরখাস্ত পাঠানোর পর মনে হলো আমার বাংলা যথেষ্ট ভাল নয়। মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে শুধু ডাক্তারি পরিভাষাই মুখস্থ করেছি। এক সাহিত্যিক বন্ধুকে ধরে সুন্দর বাংলায় দরখাস্ত লিখে এবং পাঠিয়ে বসে থাকলাম পনেরো দিন। কোন সাড়া-শব্দ নেই। তখন মনে হলো আসলে আমার ইংরেজি তত ভাল নয়। যতই সরকারী সব দফতরে এবং সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের কথা বলা হোক, স্মার্ট ইংরেজিতে লেখা চিঠির গুরুত্বই আলাদা। ইংরেজিতে আমি ডাক্তারি পাশ করেছি বটে, তবে যাকে বলে খুব ঝকমকে ইংরেজি আমার নয়। ইংরেজি পত্রিকায় চাকরি করা, প্রতি সপ্তাহে একটি তুখোড় ইংরেজি কলাম লিখে জনপ্রিয় আর এক বন্ধুকে ধরলাম পঞ্চম দরখাস্তের জন্য। সে তার সাধ্যমতো ইংরেজি জ্ঞান উপুড় করে পঞ্চম দরখাস্তটি আমার জন্য লিখে দিল। এতেও কাজ হলো না। প্রতিটি দরখাস্ত পাঠানোর পর পনেরো দিন থেকে এক মাস অপেক্ষা করি। এমন অপেক্ষা কৈশোরে প্রথম যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলাম, তার কাছে চিঠি পাঠিয়েও করি নি। এমন দূরূহ, ভয়ানক আর উত্তেজনাকর অপেক্ষা যে বলে বোঝানো যাবে না! পরিচিত বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন কেউ কেউ বলছে সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। কোন জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকের সাংবাদিককে ডেকে রিপোর্ট করাতে হবে। তবেই কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে। সেটা করবো কিনা ভাবছি এক মাস হলো। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করালে কর্তৃপক্ষ ঠিকই আমাকে সন্দেহ করতে পারে যে ভেতর থেকেই আমরা খবর দিয়েছি কিনা। তখন এই পোড়ার দেশে আমার বদলি, ডিমোশন, আর্থিক কেলেঙ্কারি থেকে যৌন কেলেঙ্কারি কোন একটা গসিপে ফাঁসিয়ে দেওয়া- কত কি-ই না ঘটতে পারে ভাগ্যে! এক মাস হয় তাই ‘টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন’-এ ঝুলছি। শালা শেক্সপীয়র- সত্যি বলতে, ‘হ্যামলেটে’র এই বিখ্যাত স্বগতোক্তির পরের লাইনগুলো আমি একটাও জানি না। এই একটা লাইনই যা মনে আছে!
‘এই- শুনছো?’ বউ ঘরে ঢুকলো।
‘কি ব্যপার?’
‘রাত-দিন তো হাসপাতাল নিয়েই পড়ে থাকো। ঘরে এসেও অফিসের চিঠি-পত্র টাইপ করা…এদিকে আমাদের ফ্রিজটা গত কয়েকদিন হয় নষ্ট হয়ে আছে সে খেয়াল রাখো? শসা-টমেটো-লাউ-চালকুমড়া কিছুই রাখা যাচ্ছে না। মাছ-মাংস…সব কিছু পচে যাচ্ছে। হাসছো যে?’
‘কি বলি বলো তো? আমার যেখানে কাজ- সেই মর্গের ফ্রিজটা আজ বেশ কয়েক মাস হয় নষ্ট! মানুষের লাশ পচে যাবার গন্ধ কেমন সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা আছে?’
‘না- থাক- ধারণা করতেও চাই না। উফ্- তুমি কেমন? মাত্র নাস্তা করলাম আর তুমি মর্গের পচা লাশের কথা বলছো? কয়েক মাস হয় তোমার মুখে তো এছাড়া কোন কথা নাই!’
‘ঠিক আছে- চলো, দেখি তোমার ফ্রিজ। এই ফ্রিজ তো ঠিক করা তেমন কঠিন বিষয় না। আসল সমস্যা তো-’
‘প্লিজ- রাত-দিন ঐ মর্গের ফ্রিজের আলাপ বাদ দাও। আগের বাসার ফ্রিজটা তো দ্যাখো!’
এই বলে সুরাইয়া মানে আমার স্ত্রী আমাকে ঠেলতে ঠেলতে ডাইনিং রুমে গিয়ে ফ্রিজের ডালা খুলে দেখাতে থাকে, ‘দ্যাখো- কুমড়াটা অনেক বড় আর গতকালই বাজারে এক দামে কিনে ফেললাম। ফ্রেশ লাগছিলো কিনা দেখতে! বরবটি কিনলাম আর ঝিঙা- আজ সকালে উঠে দেখি সব এর ভেতরেই কেমন পচে যাচ্ছে। ডিপ ফ্রিজ থেকে মুরগী বের করছিলাম আর মাছ- সব কেমন গন্ধ করছে! হবে না? যা গরম!’

২.
Charme profond, magique, dont nous grise
Dans le présent le passé restauré !
Ainsi l’amant sur un corps adoré
Du souvenir cueille la fleur exquise.

আমার ইন্টারের সময় বাবা ফুড ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন সেই চট্টগ্রামে। ইন্টারের পর প্রথমে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্ত বাবার ভয়ানক বাসনা যে আমাকে মেডিকেলে ভর্তি হতেই হবে। দরকারে পরের বছর আর একবার পরীক্ষা তো দিতেই পারি। ইংরেজিতে এক বছর পড়ার সময় কি মনে ফরাসী ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। এক বছরে তিন মাস করে চারটি সেমেস্টার শেষ হয়েওছিল। চতুর্থ সেমেস্টারে এক শিক্ষক একবার বালজাকের ‘লে ফ্লরস দ্যু মাল’-এর ‘পার্ফ্যুম’ বা ‘সুগন্ধী’ কবিতাটা থেকে খানিকটা পড়ে শুনিয়েছিলেন। সাথে বাংলায় তর্জমা। কবি ভালবাসেন লাশের গন্ধ। তা’ সেই বছর পার হতেই চট্টগ্রাম মেডিকেলে চান্স হলো আমার। ছেড়ে দিতে হলো ইংরেজি সাহিত্য পড়া, ফরাসী ক্লাস সব। ক’দিন হয় পুরণো সেই কবিতার ভুলে আসা ঝঙ্কার মাথায় কাজ করে। সব কিছু যখন পচে আসে…গৃহস্থ বাড়ির ফ্রিজের শসা, টমেটো থেকে সদ্য মরে যাওয়া মানুষগুলোর লাশ। আমার অবস্থা পারির বালজাকের মত হবে নাতো কোনদিন? মৃত লাশের গন্ধই কি ভাল লাগবে? দিন দিন কেমন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি সকালের চা-ব্রেকফাস্টের পরই, গায়ে খানিকটা পানি ঢেলে অফিস যাবার জন্য দৌড়তে। আমার অফিস আর কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্গের পাশেই আমার বসার রুম। গতকালই আমাদের ডোম রমেশকে বকছিলাম আমি পৌঁছানোর আগেই যেন আমার রুমে খানিকটা এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে রাখে, সেই নির্দেশ না মানার জন্য।
‘বাতাস ক্যায়সে ফ্রেশ রহেগি বাবু? ক্যায়সে?’ হাত নেড়েছিল সে আমার দিকে। দিনে-রাতে সবটা সময়ই যথেষ্ট পরিমাণে কেরু কি বাংলার প্রভাবে সে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তবে একা ওকে বলে কি হবে? আমি খাই না? আমি হয়তো খাই স্মিরোনফ। তবে, মর্গে কাজ করতে হলে কিছু না কিছু একটা খেতেই হবে। হয় কেরু নয় স্মিরোনফ কি বাংলা! এত এত লাশ! নগ্ন নারী কি পুরুষের দেহ। এই যে মেঝের উপর পরশু থেকে পড়ে আছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় ছুরিকাহত এক ব্যবসায়ীর লাশ। নগ্ন দেহ নিয়ে সে এখন নির্বিকার, অচৈতন্য ঘুমাচ্ছে মর্গের মেঝেতে। গতকালই এক নারী সাংবাদিক এসেছিল। সাতাশ-আঠাশ বছরের মেয়ে। সাদা আর বেগুনী ফুলের একটি ছাপা ছাপা কাপড়ের সালোয়ার-কামিজ আর সাদা ওড়না পরণে। মেয়েটির সাহস দেখে সত্যি বলতে বিষ্মিত হচ্ছিলাম। না, টিভি সাংবাদিক না। প্রিন্টেরই মেয়ে। হাতে কাগজ-কলম। একথা ওকথা খানিকটা বলার পর বললো, ‘স্যার- এই যে আপনাদের মৃতদেহ রাখতে পারছেন না বললেন- ফ্রিজটা নষ্ট হয়ে গেছে- একবার মর্গটা দেখতে চাই।’
‘পারবেন দেখতে? আপনি তো ঢোকার মুখে বাতাসের গন্ধেই খানিকটা বমি করলেন দেখলাম!’ আমি হাসলাম।
‘জ্বি- আসলে বাসা থেকে ব্রেকফাস্ট করে বের হওয়া উচিত হয় নি। বিশেষ করে এখানেই যখন আসব। মাত্রই খেয়ে বের হয়েছি কিনা!’
‘কত সেন্সিটিভ- তবে ডাক্তারদের এমন হলে চলে না। আমাদের কত ছাত্রী রাত জেগে ছেলেদের পাশে বসে লাশ কাটে! আচ্ছা- কেন মর্গেই এলেন রিপোর্ট করতে? কেউ জানিয়েছে যে আমাদের ফ্রিজটা নষ্ট?’
‘ঠিক তা’ নয়। আসলে জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিন পড়ার পর থেকে অনেকদিনই ভাবনা ছিল যে কখনো সাংবাদিকতা করলে মর্গে আসব। সেই কৌতুহল থেকে এসে এমন যে একটা টাটকা খবর পেয়ে যাব তা’ ভাবি নি। ’
‘আপনাকে মর্গ দেখাতে নিতে পারি তবে এখনি রিপোর্টটা প্রকাশ করেন না। বোঝেনই তো আমাদের দেশটা কেমন? অথরিটি ক্ষেপে গিয়ে আবার না আমার চাকরি খায়! ছাপবেন- তবে আগে রিপোর্টটার মাশ-মশলা সব নিয়ে লেখাটা সাজান। আমি একবার পড়ে নেব। তারপর আমি ওকে করলে ছাপবেন, বুঝলেন?’
‘জ্বি- অবশ্যই। এবার তবে মর্গের ভেতরে যেতে চাই!’
‘চলেন।’
আমার কাজের রুম থেকে মর্গের ভিতর ঢুকতেই মেয়েটি হতচকিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। মর্গের মেঝেতে শায়িত নগ্ন পুরুষটিকে দেখে কি চেঁচিয়ে উঠলো? মেয়েটি কি আনম্যারেড? নগ্ন পুরুষ দ্যাখে নি কখনো?
‘আর ইউ আনম্যারেড?’
কেমন না ভেবে চিন্তেই দুম্ করে প্রশ্নটি বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে।
‘জ্বি। কি- কিকরে বুঝলেন?’
আরে- মেয়েটি তো দেখি ভয়ে রীতিমতো কাঁদো কাঁদো। চোখে জল আর ফোঁপাচ্ছে কথা বলতে গিয়ে। এবার হাসি পেল আমার, ‘দেখুন- আপনি একে মেয়ে তাতে আজো যথেষ্ট পরিমাণে নেইভ। মানে সহজ-সরল টাইপের। আপনার বয়সী অনেক মেয়ে অনেক শক্ত-পোক্ত মনের গড়নের যে হয় না তা’ নয়। তবে, আপনি সেরকমটা না। তাহলে এত কঠিন এসাইনমেন্ট করতে আপনাকে কে বলেছে? বের হয়ে আসেন!’
শেষটায় গলা জোরে তুলে রীতিমতো দিলাম এক ধমক। সুড়সুড় করে এক ধমকে সে বের হয়ে এলো মর্গ থেকে। লজ্জায় বেচারির মুখ লাল হয়ে গেছে।
‘স্যরি স্যার- আমি হয়তো আমার পেশার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে টাফ এখনো হতে পারি নি। আমি না হয় মর্গের ভেতরে আর না-ই গেলাম! তবু, একটা দু’টা পয়েন্ট কি জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
আমার হাসি পাচ্ছে মেয়েটাকে দেখে। পুরুষ সাংবাদিকের সমান ওকে হতেই হবে। ছেলেদের সমান যোগ্যতা তাকে প্রদর্শন করতেই হবে। নইলে কিসের সমানাধিকার? কিন্ত সে যোগ্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে বেচারির ধকল যাচ্ছে ম্যালা।
‘আমার কাছে কি শুনবেন? বরং আমাদের ডোম রমেশকে ডাকি? ওকে কোট করে লেখা ছাপলে আপনার রিপোর্টের হিট বাড়বে। আরো মেয়ে হয়ে এত সাহসী কাজ করার চেষ্টা- না- আপনার সাহস কম না। তবে, আপনি খুব চতুর আর পোক্ত হতে পারেন নি এখনো আর সেটা ভাল। খারাপ না। খুব শক্ত আর খুব পোক্ত এই বয়সেই আপনাকে হতে হবে কেন? রমেশ-’
‘হাঁ- আপ মুঝকো বুলায়ে?’
‘এই সাংবাদিক আপাকে বোঝাও তো আমাদের সমস্যা।’
‘ও তু কি শ্যুনবি দিদিমণি? বুঝিস তো এই জ্যৈষ্ঠ মাসের গরম। বাহার মে মওত আদমিকো কিতনা রিলেটিভ খাড়া হোতা হ্যায়। লেকিন হাম কো ফ্রিজ তো বুরা হ্যায়।’
‘ওর কথা বুঝছেন তো আপনি ঠিকঠাক? বলছে যে আমাদের মর্চ্যুয়ারি ক্যুলার মানে মর্গের ফ্রিজটা তো নষ্ট। তাতে এই গরম যা পড়েছে! ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই দেহগুলো পচে যাচ্ছে। এখন অপঘাতে মৃত্যু যত- স্বাভাবিক মৃত্যুর লাশ তো আসে না আমাদের এখানে- আসে খুন-ধর্ষণ কি বড় সড়ক দূর্ঘটনার সব লাশ! অনেক সময় একটা মানুষ হুট করে খুন হলো বা আত্মহত্যা করলো কি কোন বউকে পিটিয়ে মারা হলো। কেউ এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলো। অনেক সময় আত্মীয়-স্বজন বা কাছের মানুষ আসার আগেই গরমে লাশ পচে বিকৃত হতে থাকে। তখন আমাদের আর উপায় থাকে না। মৃতের রিলেটিভরা আসার আগেও কত সময় লাশগুলো সব আঞ্জুমানে-মুফিদুল ইসলামের গাড়িতে দিয়ে দিতে হয়!’
‘লাশ পচে গেলে কি তদন্ত করতে সমস্যা হয়?’
‘হ্যাঁ- খুব সমস্যা হয়। ময়না তদন্ত করাই যায় না প্রায়। দেখবেন আপনি? ফ্রিজের ভেতরেও কয়েকটা লাশ আছে। সেগুলো মেয়েদের লাশ। মেয়েদের বডি দেখলে- ন্যুড বডি দেখলে তো ভয় পাবেন না? কারণ আপনি নিজেই মেয়ে!’
মেয়েটি ইত:স্তত করতে থাকে।
‘ফ্রিজের ভেতর কতগুলো লাশ স্যার?’
‘চার জন নারীর লাশ আছে। দু’টা ধর্ষণ পরবর্তী খুন যাদের একজন কুমারী, একজন গৃহবধূ আর একটি এক পতিতা নারীকে খুন করেছে তার ক্লায়েন্ট। অন্য আর নারীকে বোধ যৌতুকের জন্য গলা টিপে, শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।’
‘ফ্রিজ না নষ্ট বললেন?’
‘নষ্ট তো বটেই। এই ফ্রিজটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের দিয়েছিল সেই ১৯৯২-এ। আজ দশ বছরের উপর হয়ে গেল।
‘স্যার- কিছু মনে করবেন না। কিকরে শুরুতেই বুঝে নিলেন যে কে পতিতা, কে গৃহবধূ আর কে কুমারী?’
করিডোরে গত কাল সন্ধ্যা থেকে আসা তিনটি নতুন পুরুষ লাশের উৎকট গন্ধে মাথা ধরেছিল। একটি কড়া মার্লবরো সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ‘মুস্কিল হলো আমাদের দেশে যৌন শিক্ষা বলে কোন বিষয় নেই। কাজেই বিয়ে না করা অবধি লাখ লাখ নর-নারীর বিশেষত: মেয়েদের সেক্স এডুকেশন শিশুর স্তরে থাকে। কিন্ত সেক্ষেত্রে আপনার চিল্ড্রেন্স বিট করা উচিত- ম্যাডাম!’
‘মানে?’
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর দিই। যে মেয়েটিকে কুমারী বলছি সে সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ছাত্রী। ব্যাগে তার আইডেন্টিটি কার্ড ছিল। তবে সেটার ভিত্তিতে তাকে কুমারী বলা হয় নি। তার ভ্যাজাইনায় অস্ত্রের আঘাত ছিল আর আমরা ডাক্তাররা বুঝি কে হ্যাবিচুয়েটেড ইন ইন্টারকোর্স আর কে না? এই মেয়েটি মৃত্যুর আগে সদ্য কুমারীত্ব হারালেও সে রেগ্যুলার ইন্টারকোর্সে হ্যাবিচুয়েটেড না। আপনার- তোমার তথ্যের জন্য আরো জানানো যাক- তুমি আমার ভাগ্নির বয়সী হবে- একজন প্রস্টিট্যুট এবং একজন দীর্ঘ দিনের বিবাহিতা মহিলা বা এমনকি একজন মা- যে শব্দটা আমরা খুব সম্মান এবং ভাবাবেগ নিয়ে বলি- একজন সম্মানিত গৃহবধূর ভ্যাজাইনা পরীক্ষায় ক্লিনিক্যাল তেমন কোন ডিফারেন্স আসে না। পতিতা মেয়েটি হয়তো অনেক ক্লায়েন্টের সাথে বছরের পর বছর সম্পর্কে যায়। সম্মানিতা গৃহবধূ বছরের পর বছর হয়তো শুধু স্বামীর সাথেই সম্পর্কে যায়। তবে তাদের দু’জনের ফিজিক্যাল গড়নই একই কথা বলে- হ্যাবিচুয়েটেড ইন ইন্টারকোর্স। তাহলে আমরা কিভাবে বুঝবো কে গৃহবধূ আর কে পতিতা? সেক্ষেত্রে পুলিশ ডায়েরির কাগজ আমাদের বলে দেবে কে স্ট্রিট বেসড বা ব্রথেল বেসড সেক্স ওয়ার্কার যে ক্লায়েন্টের ছুরিতে খুন হয়েছে আর কোন্ গৃহবধূ তার পরকীয়া প্রেমিকের হাতে বা স্বামীর শত্রুর হাতে ধর্ষিতা হয়ে খুন হয়েছে? এই তুমি এখন আসো ত’! এই ম্যাচুরিটি নিয়ে মর্গে রিপোর্ট করতে এসেছো? বাইরে গিয়ে দাঁড়াও আর তোমাদের ফটোগ্রাফারকে ডাকো। সে এসে আমাদের ফ্রিজ, ফ্রিজে পচতে থাকা চারজন নারী আর ফ্রিজের বাইরে মেঝেতে আর করিডোরে পড়ে থাকা পুরুষদের লাশগুলো নিক! যত্তসব!’

বিরক্তির চোটে সাংবাদিক মেয়েটিকে ভাগিয়ে দেই। শেষমূহুর্তে ওর সাথে খুব রূঢ় আচরণ করা হয়ে যায় আমার। এত ইমম্যাচিওরড মেয়ে এত কঠিন বিট করতে এসেছে কেন? ওদের পত্রিকার ফটোগ্রাফার ঢোকে অবশ্য। কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে হাসি হাসি, রীতিমতো আদুরে মুখে ছেলেটি ফ্রিজের ভেতরের চার নগ্নিকা, মেঝেতে আর করিডোরে শোয়া নিহত পুরুষগুলোর দেহের ছবি এমনভাবে তুলতে থাকে যেন পুষ্প প্রদর্শনী বা ফ্যাশন শোয়েরই ছবি তুলতে। বাহ্, বাঘের বাচ্চা!
‘মিম আপু একটু নরম-সরম। আর বিয়া-শাদি করে নাই তো। তাই এখনো অনেক ভয়-ডর আছে। মিম আপা আপনার মেজাজ দেখে স্যার আমাকেই ডিটেইলসে নিতে বলছে। লাশগুলোর নাম? কে কিভাবে মরেছে?’
‘যন্ত্রণা- লিখুন- তিনটি ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী খুন, একটি যৌতুকের জন্য প্রহার ও শ্বাসরোধ করে বা গলা টিপে খুন, একটি সড়ক দূর্ঘটনা, একটি ক্রস ফায়ারে মৃত্যু, একটি চাঁদাবাজির আব্দার না মানায় ছুরিকাঘাতে খুন, দু’টো সড়ক দূর্ঘটনা-’
আমি নির্বিকার বলে যেতে থাকি মৃতদের ডিটেইলস। বলা-টলা শেষ হলে ফটোগ্রাফার ছেলেটি মর্গ থেকে বের হয়ে মর্গের ঘাসে দাঁড়ানো প্রতিবেদক মেয়েটির সাথে যোগ দেয়। ওদের টুকরো কথার আলাপ আমার কাণে আসে। মেয়েটি- আশ্চর্য- এখন হাসছে, ‘অনেক থ্যাঙ্কস তোতা ভাই!’
‘না- না- আপা- অনেক সাহস আপনার! তবে আমি না থাকলে পুরা রিপোর্টটা আজ করতে পারতেন না। সব ডিটেইলস নিয়া আসছি- আপনাকে অফিস গিয়া দিয়া দেব ইনশাল্লাহ্!’
পরের দিন সকালে আমার পত্রিকায় বড় বড় হরফের শিরোনামে একটি প্রতিবেদন আসে: ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একমাত্র মর্চ্যুয়ারি ক্যুলার দীর্ঘ দিন হয় বিকল। ইমন কল্যাণ।’
..মেয়েটার নাম ইমন কল্যাণ নাকি? আজকাল কত যে বাহারের নাম চারদিকে!

৩.
‘অর্ডার- অর্ডার- হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের জন্য একটি নতুন ‘মর্চুয়্যারি ক্যুলা’র কিনবার অকশন এখনি শুরু হতে যাচ্ছে!’
যাক- নতুন ক্যুলার কেনা হবে তবে? কর্তৃপক্ষকে কোনটা কিনতে বলবো? আটটি মৃতদেহ রাখতে সক্ষম না দশটা বা বারোটা মৃতদেহ রাখতে সক্ষম ক্যুলার? ওয়ান ডোর মর্চুয়্যারি ক্যুলার না ডাবল ডোর মর্চুয়্যারি ক্যুলার? ওয়ারেন কোম্পানীর ক্যুলারগুলো খুব ভাল হয় না? দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কত মর্চুয়্যারি ক্যুলারের বিজ্ঞাপন উল্টে চলেছি। জাপানে ফরেনসিক মেডিসিনে ডিগ্রি করার সময় একটি পাহাড়ের পেছনে যে বড় হাসপাতালে কাজ করতাম আর পড়তাম আমি, সেখানে মর্গে ছিল দুধ ধবধব শাদা রঙের চারটি মর্চুয়্যারি ক্যুলার। আমাদের দেশের মত গরম ছিল না সেখানে। পাশেই ছিল একটি শিন্তো মন্দির। চেরির মৌসুমে মর্গ থেকে বের হয়ে কেন্টিনে হাত ধুতে খেতে যাবার সময় কাণে আসতো শিন্তো মন্দিরের ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ। অকশনটা কোথায় হচ্ছে? না- ঢাকা মেডিকেলে তো না। এ তো জাপানেই। তবে সেখানে ঢাকা মেডিকেলের সহকর্মীরা আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদা বিরক্ত কর্মকর্তারাও আছে। কিন্ত বাঙালী লোকগুলো সব জাপানীতে কথা বলছে কেন? আর কি আশ্চর্য দ্যাখো- সবার সামনে দাঁড়িয়ে টেবিলে নিলামের হাতুড়ি টিপছে আমার জাপানী প্রফেসর তাকিহিতো। তাকিহিতো উল্টো জাপানী না বলে, ভাঙা ভাঙা বাংলায় মুচকি হেসে বলছে, ‘সম্মানিত ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ, আপনাদের সামনে আমি খুলতে যাচ্ছি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি ও ডিজাইনের এক অভিনব মর্চুয়্যারি ক্যুলার।’
এটুকু বলে তাকিহিতো তার মাথার টুপিটি খুলে অভিবাদনের ভঙ্গিতে মুচকি হেসে, আমাদের সবার সামনে খুলে ফেললো পেল্লায় আকারের, হাল্কা ছাই রঙের একটি মর্চুয়্যারি ক্যুলারের দরজা। একটার পর একটা ড্রয়ার খুলতে খুলতে, আমাদের বিষ্ফারিত এবং বিষ্ফোরিত দৃষ্টির সামনে মুচকি হেসে তাকিহিতো- কোত্থেকে ব্যাটা সাধু বাংলা শিখলো কে জানে- সে বলতে থাকে, ‘দেখিয়া লও কেমন উত্তম ফ্রিজ! প্রতিটা ডালায় সফল আত্মহত্যাকারী নারী-পুরুষগণ প্রসাধিত শুইয়া রহিয়াছে- নিষ্পন্দ ও নগ্ন যেন বা ড্রয়িং ক্লাসের মডেল। হত্যার শিকার যাহারা হইয়াছে, তাহাদের ঠোঁটেও রক্ত জমা হইয়াছে যেন সুদৃশ্য ওষ্ঠ রঞ্জনী!’
তাকিহিতো একটির পর একটি মর্গের ফ্রিজের ডালা খুলতে থাকে। আর নিষ্পন্দ, নগ্ন, শান্ত, সৌম্য ও সুন্দর- আশ্চর্য সফল এক পাল নগ্ন নর-নারী পাউডার, রুজ ও লিপস্টিক মাখা ঠোঁটে আমাদের দিকে চেয়ে মুচকি হাসতে থাকে। …তারা ছিল লাল, নীল, রূপালী ও নীরব!

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত