| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

আমাদের দেশে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত শব্দ ‘মৌলবাদে’র স্থলে আমি ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ’ শব্দটিকে অধিক যৌক্তিক মনে করি। কেননা কোনো ‘আদর্শ’ বা ‘ধর্ম’ যদি উদারপন্থী, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমতা, বিবেকবোধকে তার প্রধান মূল্যবোধ ও মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে, তবে সে মৌলবাদ ক্ষতিকর নয়, বরং প্রাগ্রসর। অপরদিকে, যখন কোনো আদর্শ বা ধর্ম কুসংস্কার, কূপমন্ডুকতা, পাশবিকতাকে তার মূলনীতিতে স্বীকৃতি দেয়, তবে সে মৌলবাদ মানবতাবিরোধী ও অবশ্য পরিত্যাজ্য। আমরা জানি, এ বিশ্বের সমস্ত প্রধান ধর্মেরই মূলভিত্তি হচ্ছে মানবিকতা, সাম্য, মৈত্রী, ভাতৃত্ব ও স্বাধীনতা। তাহলে ধর্ম কখন এবং কেন ফ্যাসিবাদী হয়? এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করার জন্য এ বিশ্বের প্রধান দুটি ধর্মের প্রারম্ভিক ইতিহাস ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত তার নব্য রূপটি বিশ্লেষণ করলেই ধর্মের প্রকৃত দর্শন ও অর্থনৈতিক সাম্ররাজ্যের স্বার্থে ব্যবহৃত এর বিকৃত চরিত্রটি উদঘাটিত হবে বলে আমি মনে করি।

প্রথমে আমি খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসঙ্গে রোমান সম্রাট অগাস্টাস সীজার যখন সাম্রাজ্যবাদী একনায়কতন্ত্রী রোমের ভিত্তি স্থাপন করছিলেন, ঠিক সেই সময়ে তার সাম্রাজ্যে এক যুগান্তকারী মহানায়ক যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাব ঘটে। তিনি রোমের মানবতাবিরোধী দাসতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে তার প্রচারিত খ্রীষ্টধর্ম সারা রোমান সাম্রাজ্যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। গ্রেকো-রোমান যুগের মুদ্রাভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতির উপযুক্ত ভাবাদর্শ সৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, দাসতন্ত্রের উপস্থিতির ফলে তা কখনো বাস্তবায়িত হতে পারেনি। সমাজের তিন-চতুর্থাংশ মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে, তাদের পশুর মতো জীবন-যাপনে বাধ্য করে দাস প্রথা যে সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল- রোমান সাম্রাজ্য সে সঙ্কট থেকে আর পরিত্রাণ পায়নি। সুতরাং, সে সময়কালে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে যে বিশ্বজনীন দর্শনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছিল খ্রীষ্টধর্ম সে চাহিদা মেটাতে সক্ষম ছিল।

কালক্রমেই যীশুর মানবতার বাণী ক্রীতদাস, নিঃস্ব মজুর, কৃষক ও দরিদ্রদের তাঁর ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের মানবতা এবং বিশ্ব প্রেমের আদর্শ দাসতান্ত্রিক রোমান সাম্রাজ্যে কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। যীশু একটি পাল্টা সাম্র্রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন- এই অভিযোগে জেরুজালেমের রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেট তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। যীশু ধন-বৈষম্য লোপ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কার সাধনের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক আন্দোলন। খ্রীষ্টধর্মের বিশ্বভাতৃত্ব, মানুষের প্রতি বিশ্বাস পিতার ভালোবাসা, তাদের দুর্গতি মোচনের জন্য ঈশ্বর কর্তৃক তার সন্তানকে প্রেরণ এবং এ জীবনের দুঃখ ও কষ্টের সমাপ্তিতে পরকালে চিরস্থায়ী সুখ ও আনন্দলাভের আশ্বাস ইত্যাদি সে যুগের নির্যাতিত, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে সকল দুঃখ-বেদনা সহ্য করার অপরিসীম প্রেরণা যোগায়। অপরদিকে, নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠী যোমন, নিরো, ডমিথিয়ান, মার্কাস অরেলিয়াস প্রমুখ রোম সম্রাটরা ব্যক্তিগতভাবে খ্রীষ্টান বিদ্বেষী হওয়ায় তাদের সময় খ্রীষ্টানরা সর্বাধিক নির্যাতন ভোগ করে। কিন্তু অচিরেই খ্রীষ্টধর্মের ব্যাপক জনপ্রিয়তায় এর অনুসারীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। শাসকগোষ্ঠী উপলব্ধি করে, খ্রীষ্টধর্ম বিদ্বেষী হয়ে আর শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ৩১১ খ্রীঃ সম্রাট গ্যালেরিয়াস খৃষ্টানদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করার আদেশ দেন। পরবর্তীতে সম্রাট কনস্টাইনটাইন নিজে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং ৩৯৫ খ্রী. সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রীষ্টধর্মকে রোমান সাম্ররাজ্যের একমাত্র স্বীকৃত ধর্ম বলে ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে খ্রীষ্টধর্ম তার প্রাথমিক সরল ও আড়ম্বরহীন চরিত্র হারিয়ে ধর্মানুষ্ঠান, উপাসনা, বিভিন্ন ধর্মীয় ক্রিয়া-কলাপের সাথে যুক্ত হয়ে জটিল ও আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে উঠলো। যাত্রা শুরু হলো খ্রীষ্টধর্মের নব্য ও বিকৃত রূপের।বিপুলায়তন রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রমূল রোম হয়ে ওঠে চার্চ ভিত্তিক পোপতন্ত্রের সৃতিকাগার। একসময় রোমের পোপ নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি করে। যে খ্রীষ্টধর্ম দাসভিত্তিক সমাজের প্রতিদ্বদ্বী ভাবাদর্শরূপে আবিভূত হয়, তা-ই কালক্রমে আবার মধ্যযুগের শ্রেণী বিভক্ত সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজকে টিকিয়ে রাখতে একটি উৎকৃষ্ট হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মধ্যযুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক আর তার দার্শনিক ও ভাবাদর্শের রাখা পরিস্ফুট হয়েছে চার্চের মধ্য দিয়ে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি ছোট বড় চার্চই ছিল এক একটি সামন্তপ্রভু। বহুজমি ছিল চার্চের অধীনে। সমগ্র ক্যাথলিক জগতের এক-তৃতীয়াংশ জমির মালিক ছিল চার্চ। খ্রীষ্টধর্ম প্রাথমিকভাবে দরিদ্রের ধর্মরূপে আর্বিভূত হলেও পর ধনবানদের ধন রক্ষাই এর প্রধান কাজে পরিণত হয়। পোপতন্ত্রের উৎপত্তি, চার্চ সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি, এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও প্রসার প্রভৃতি শেষ পর্যন্ত খ্রীষ্টধর্মকে ধনীর ধন রক্ষার হাতিয়ারেই পরিণত করে। দরিদ্রকে শোষণ ও সেই সঙ্গে শ্রেণী বিভক্ত সমাজকে টিকিয়ে রাখার অপরিসীম প্রয়াসে তাকে লিপ্ত হতে দেখা যায়।

একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীব্যাপী সমগ্র ইউরোপে এক প্রচন্ড ধর্মোন্মাদনার সূত্রপাত হয় যার পরিণামে ইউরোপের খৃষ্টান ও প্রাচ্যের মুসলিমদের মধ্যে কয়েকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। ক্রুসেডকে পোপের বৈদেশিক নীতির বাস্তবায়নরূপে আখ্যা দেয়া হয়। ধর্মোন্মাদ ক্রুসেডররা ভেনিসের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বদ্বী মিশরের জারা শহর ও সমৃদ্ধশালী কনস্টান্টিনোপলকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। এই ক্রুসেড সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করে ইতালির জেনোয়া, ভেনিস ও পীথা নগরগুলোকে। বিধ্বস্ত বাইজেন্টাইন সাম্রারাজ্যের বাণিজ্য পথগুলি ইতালির নাবিকদের হস্তগত হওয়ার ফলে ভূমধ্যসাগরের বাণিজ্যে এদের পুরোপুরি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনের বন্দরগুলি ইতালির নাবিকদের দখলে আসে এবং কৃষ্ণসাগরের উপকূলে তারা নিজস্ব বাণিজ্য ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। প্রচুর দ্রব্যসামগ্রী আমদানির ফলে ইউরোপের অর্থনৈতিক জীবনেও স্বচ্ছলতার আভাস দেখা দেয়। এর ফলে ইউরোপের রাজন্যবর্গ ও সামন্ত প্রভুদের জীবনে বিলাসিতার প্রচলন ঘটে।

ধর্মকে ধর্ম হিসেবে ব্যবহার করে ইউরোপীয়রা যে বিপুলায়তন অর্থনৈতিক সাম্ররাজ্য গড়ে তোলে, তার বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়টিও কম ভয়াবহ ছিল না। প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম ও অন্যান্য অষ্টাদশ শতাব্দীর চিন্তাবিদরা বর্ণনা করেছিলেন, এসময়ে ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রধানত দু’ধরনের বিকৃতি দেখা দিয়েছিল। এক ধরনের বিকৃতি ঘটে কুসংস্কার, রোমান গীর্জা থেকে পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ, প্রটেস্ট্যান্টদের প্রচারিত অজ্ঞাত শক্তি থেকে আগত অজ্ঞাত অশুভ সম্পর্কে ভয়, আতঙ্ক, অজ্ঞাত শক্তি উদ্দেশ্যে আচার-অনুষ্ঠান, কৃচ্ছ্র সাধনা, বলি দেয়ার প্রচলনের মধ্য দিয়ে। আরেক ধরনের বিকৃতি দেখা দেয় টেরটুলিয়ান, প্যাসকাল, সেন্টপলের অন্ধবিশ্বাস নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে যাতে বিশ্বাসের অধীনে বুদ্ধিকে বিসর্জন দেয়া হয়েছিল। একারণেই হিউম তার Dialogues Concerning Natural Religion গ্রন্থে খ্রীস্টধর্মের অবলুপ্তিকে তাঁর জীবনের একমাত্র অভিপ্রায় বলে মন্তব্য করেন। অপরদিকে, তাঁর History of England গ্রন্থে তিনি ধর্মীয় উম্মাদনা ও কুসংস্কারের ফলে সৃষ্ট দুর্গতি তুলে ধরেন। তিনি ইংল্যান্ডের সমগ্র ইতিহাসকেই খ্রীস্টধর্মের উম্মাদনার ইতিহাস বলে অভিহিত করে। বিশ্ব বরেণ্য অপর ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলও তাঁর Why I am not a Christian গ্রন্থে খ্রীস্টধর্মের নামে চার্চের নানা প্রতারণা, মিথ্যাচার, ছলচাতুরি ও অশ্লীলতার তীব্র সমালোচনা করেন। এজন্য শাসকগোষ্ঠীও রাসেলকে বহুবার জেল-জরিমানা, পুলিশি নির্যাতন, চাকুরিচ্যুতি, আইনগত হয়রানির শিকার করা হয়।

এবার ইসলাম ধর্মের প্রসঙ্গে আসা যাক। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল সামন্ত যুগে। এ সামন্ততন্ত্র ছিল শ্রেণীবিভক্ত, বৈষম্য ও শোষণমূলক এবং দাসভিত্তিক। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আবির্ভাব ঘটে একজন মুক্তিদাতা ও ত্রাতা হিসেবে। তিনি সর্ব প্রকার অর্থনৈতিক, লিঙ্গীয় ও শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। দাস ও নারীদের সমঅধিকারের জন্য লড়াই করেন। সাম্য, মৈত্রী ও ভাতৃত্বের বাণীর মাধ্যমে তিনি গোত্রতান্ত্রিক আরব সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। যদিও প্রাথমিক যুগে তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা ব্যাপকভাবে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। এবং জন্মভূমি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করবে বাধ্য হন। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাসটি ছিল বিজয়ের ও মুক্তির। বৈষম্য ও অসমতা দূর করে তিনি এমন একটি নৈতিক সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ধনী-নিধন নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তৎকালীন আরব সমাজে কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করা হতো। সেই পশ্চাৎপদ সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা নবী (সাঃ) দুহিতা ফাতিমা (রা.) এবং প্রথম হাসপাতালের প্রবক্তা রুফাইদা (রাঃ) নাম্নী একজন চিকিৎসক মহিলা সাহাবী। নবী করিম (সাঃ) এর পত্নী খাদিজা (রাঃ) ছিলেন সেসময়কার একজন প্রেমিক ব্যবসায়ী। তাঁর অপর স্ত্রী আইশা (রাঃ) ছিলেন একজন বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যক্তি যিনি ‘Scholar of the scholars’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন দেশ ঘুরে জ্ঞানসমৃদ্ধ বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন, যুদ্ধ বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং যুদ্ধে নেতৃত্বও প্রদান করেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নেতৃত্বে মক্কায় শ্রেণীবিভক্ত সামন্ত সমাজের অবসান ঘটলে নারীদের শিক্ষা ও সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসুল (স.) এর ভাষায়: ‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর বিদ্যা শিক্ষা করা ফরয’। শিক্ষাক্ষেত্রে এ সমতার নীতি পরবর্তীকালেও বহাল ছিল। তাই ইসলামের ইতিহাসে চার প্রসিদ্ধ ঈমাম (আবু হানিফা (রহ.), আহ্মাদ ইবনে হাম্বল (রহ.), শাফেয়ী (রহ.) প্রত্যেকেরই শিক্ষাগুরু ছিলেন একজন নারী)। শুধু নারী অধিকারের ক্ষেত্রেই নয়, দরিদ্র ও দাসদের জন্যও ইসলাম নিয়ে আসে সাম্যের বাণী। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মুয়াজ্জিন বিলাল (রাঃ) ছিলেন একজন ক্রীতদাস। রাসুল (সা.) দাসদের মুক্ত করার জন্য লড়াই করেন এবং দ্বিতীয় খলিফা উমার (রা.) দাসপ্রথা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি শিশু ও বৃদ্ধ ভাতার প্রচলন করে ইতিহাসে প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এছাড়াও তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার (বায়তুল মাল) থেকে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তার খিলাফতকালে অনাথ ও এতিম শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্বও রাষ্ট্রগ্রহণ করে। চতুর্থ খলিফা আলী (রাঃ) এর খিলাফতকাল পর্যন্ত এ জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা অক্ষুণ থাকে। কিন্তু আলী (রাঃ) এর মৃত্যুর পরে ইসলামের মূল মানবকল্যাণমুখী চরিত্রটি ক্ষুণ হয়ে পরিবারতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের বিকাশ ঘটে। নবী পৌত্র হুসাইন (রাঃ) এ পরিবারতন্ত্র ও সামাজিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কারবালায় শহীদ হন। সেই থেকে মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ঘটে এতে সংক্রমণ ঘটে নানা অঞ্চলের প্রাচীন সংস্কৃতির চর্চা। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ সুকৌশলে এ বিকৃতির কাজটি করেছে তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে।

মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদকে ঘিরে যে বিপুলায়তন অর্থনীতি তার দখলদারিত্ব নিশ্চিত করতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজতান্ত্রিক ও শাসনব্যবস্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে যারা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। এই রাজতান্ত্রিক ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয় এক বিকৃত মোল্লাতন্ত্র যারা রাজতন্ত্রকে যুক্তিসিদ্ধ এবং মূল ইসলামের গণতান্ত্রিক চেতনাকে মূলোৎপাটন ঘটায়। এ নিপীড়নমূলক রাজতন্ত্র জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ করে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বপ্রভুদের রক্ষকে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আরব স্বার্থ ক্ষুণ করে ফরাসী ব্রিটিশ সাম্ররাজ্যের স্বার্থে আরব মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে আবার যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী ভূরাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার পরিকল্পনা করে। এসময় থেকেই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেয়া হয়। এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়, আইজেনহাওয়ার ডকট্রিনে। এ ডকট্রিনে মধ্যপ্রাচ্যকে মার্কিন জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ নীতির প্রভাবে ১৯৪০ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের তেল মজুদগুলোর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ১০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করে। এর দখলদারিত্বের পেছনে অবদান রেখেছে তথাকথিত ইসলামপন্থী আরব রাজতান্ত্রিক শক্তিগুলো ও জায়োনিজম বা ইহুদী উগ্রবাদ।

এ ইহুদী উগ্রবাদের পথিকৃৎ ইসরায়েল রাষ্ট্র ১৯৮২ সালে যে ইনান পরিকল্পনা করে যার ভিত্তি ছিল দুটি। প্রথমত, ইসরায়েলকে টিকে থাকতে হলে দেশটিকে অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুরো অঞ্চলকে নৃতাত্ত্বিক ও সম্প্রদায়গত পার্থক্যের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। আর এসব দেশের মধ্যে এমনভাবে বিরোধ সংঘাত লাগিয়ে রাখতে হবে যাতে এক পর্যায়ে এসব দেশের সরকার তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে কার্যত ইসরায়েলের আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেইসাথে তাদের অবস্থা এমন হয় যাতে তারা কোনোভাবেই ইসরায়েলের জন্য চ্যালেঞ্জ না হয়ে দাঁড়ায়। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের বড় অংশ বৃহত্তর ইসরায়েলের ধারণায় বিশ্বাসী। ইহুদিবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডর হার্জেল তাঁর গ্রন্থে মিসর থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত ইসরায়েলের সীমানা হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন। ইহুদী তাত্ত্বিক রাব্বি ফিশ্কম্যান তাঁর গ্রন্থে সিরিয়া ও লেবাননের একটি অংশকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাই ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতি, ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ ও সাম্প্রতিক শিয়া-সুন্নী সংঘাত, ২০১১ সালের লিবিয় যুদ্ধ, সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি, মিসরের শাসন পরিবর্তন, নীলনদের ইজানে ইথিওপিয়ায় বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ- এসব কিছুতে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষণ দেখা যায়। এই বৃহত্তর ইহুদী রাষ্ট্রের মডেল অনুসরণে পরবর্তীতে প্রণীত হয়েছে ইসলামিক স্টেটের ধারণা। আর এস এস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সভা) আবার হিন্দু স্টেটের ধারণা গঠন করেছে ঐ একই মডেল অনুসরণ করে। সম্প্রতি বৌদ্ধ উগ্রবাদের নামে রোহিঙ্গা নিধনের সূত্র ধরে পরবর্তীকালে গঠিত হতে পারে বৌদ্ধ স্টেটের ধারণা। তবে যেকোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলেই এই উগ্র ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ গড়ে তোলা হয়। এ কারণে জ্বালানী সমৃদ্ধ অঞ্চলে সংঘাত সৃষ্টি করা হয়। এর পেছনে কাজ করে সাম্ররাজ্যবাদী বিশ্ব প্রভুদের পৃথিবীর তিন মৌল-কৌশলিক সম্পদের (পানি সম্পদ, তেল-গ্যাস-জ্বালানী-খনিজ সম্পদ, আকাশ-মহাকাশ সম্পদ) ওপর তাদের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, বিগত শতাব্দীগুলোতে অর্থনীতি ছিল ইউরোপকেন্দ্রিক। আর ইউরোপের প্রধান ধর্ম যেহেতু খ্রীস্টধর্ম, তাই সেসময়ে খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বীদের উগ্র ও চরমপন্থী গোষ্ঠী সৃষ্টি করা অপরিহার্য ছিল। এজন্য গোটা ইউরোপ জুড়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রটেস্ট্যান্ট-ক্যাথলিকদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত বিদ্যমান ছিল। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীজুড়েও নানাবিধ উগ্র খ্রীষ্ট জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী তৈরি করে বিক্ষিপ্ত নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। বর্তমান শতাব্দীতে অর্থনীতি হয়ে উঠেছে এশিয়াকেন্দ্রিক। আর এশিয়ায় যেহেতু ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় বেশি, তাই এব ধর্মের উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৈরি ব্যতীত এশিয়ার পানি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের দখলদারিত্ব সম্ভব নয়। তার ওপর রয়েছে সম্পদের দখলদারিত্বকে কেন্দ্র করে প্রধান পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নব্য বিকশিত শক্তি চীনের প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় সম্প্রতি চীন অগ্রগামী। তাই হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধারে মার্কিন সাম্ররাজ্যবাদ মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সিআইএ ও পেন্টাগনের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে বিভিন্ন দেশে উগ্র জঙ্গিবাদী সংগঠন গড়ে তোলা হচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতির এ বাস্তবতাই আজকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের জন্ম দিচ্ছে।

 

 

 

 

সহায়ক গ্রন্থাবলি:
নূরুন নাহার বেগম, মানুষের ইতিহাস, মধ্যযুগ প্রথম অংশ, ঢাকা: লেখা প্রকাশনী, ১৯৮৩।
J. C. A. Gaskin, ‘Hume on Religion’ in The Cambridge Companion to Hume, Ed. by David Norton, David Fate, Cambridge: Cambridge University Press, 1998.
David Harvey, New Imperialism, Oxford: Oxford University Press, Paperback Edition

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত