আজ ২২ জানুয়ারী কবি,সম্পাদক ফরিদ কবিরের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
ট্রেন
মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?
নাকি, তারা যেখানে নামে?
নাকি, গন্তব্যই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!
বিহ্বল স্টেশনে নেমে আমরাও ভাবি-
এখানেই কি নামতে চেয়েছি
নাকি, ট্রেনই নামিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের
এই ঘন কুয়াশারাত্রিতে!
যেখানে নেমেছি, কিংবা যেখানে যাওয়ার কথা ছিল
কিছুই আসলে সত্য নয়
আমাদের চোখের সামনে শুধু ছবি হয়ে থাকে
ট্রেনের জানালা
আর, খুব দ্রুত ছুটে চলা যমুনা ব্রিজ…
সাপ-লুডু
সাপ-লুডু বেশ বিপজ্জনক!
খেলতে গেলেই দেখি, সাপগুলি জ্যান্ত হয়ে যায়
ছোবলের ভয়ে আমি লুডুর এ-ঘর থেকে অন্য ঘরে
ক্রমাগত ছুটতে থাকি!
ওপরে যাওয়ার জন্য মইগুলি খুঁজি
একটু আগেও পড়ে ছিলো, যত্রতত্র
কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ একজন
সিঁড়িগুলি সরিয়ে ফেলেছো
আমি যে ধরবো, নেই তেমন একটা হাতও
অথচ পাশেই ছিলে তুমি
অথবা তোমার মতো অন্য কেউ!
সাপগুলি আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছে চারপাশ থেকে
আর, আমি ছোবল খাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি…
আয়না
আমি দেখি?
নাকি আয়নাই আমাকে দেখায়?
নিজেকেই দেখছি হয়তো
যদিও সামনে যাকে দেখি- দেখতে আমারই মতো
কিন্তু আমি নই
কেননা, আমি তো মৃত
বিধ্বস্ত আমার মুখ, ভয় দুই চোখের পাতায়
আয়না রহস্যময়, ভার্চুয়াল আরেক দুনিয়া
সেখানে আমার বিম্ব বরাবর ঝকঝকে, জীবন্ত
বরং কিছুটা স্মার্ট
যেমন আজ সে বাইরে এসেই
আমাকে পাঠিয়ে দিলো আয়নার ভেতরে
আয়নার ওপাশে ভয়ানক অন্ধকার
অথচ এপাশ থেকে সব সময় উজ্জ্বল দেখায়!
গণিত
গণিত বড়ই রহস্যময়
শেখায় দুয়ে দুয়ে চার…
কিন্তু বাস্তবে এ হিসাব কখনো মেলে না
দুয়ে দুয়ে ২, ৩ এমনকি
৫ কিংবা ৭ হয়
৪ কিছুতেই নয়
কী কী বর্ণ যোগ অথবা বিয়োগ করলে
অংকটা মিলবে, জানা নাই
আমি দুয়ের সঙ্গে ২ যোগ করি, ৩ যোগ করি
লাল এমনকি নীল যোগ করি
তুমি দুই থেকে দুঃখ বিয়োগ করেও পাও ৫ অথবা ৭
আমি দুয়ের সঙ্গে তোমাকে যোগ করেও ২ অথবা ৩
বিয়োগ করলেও তোমার যোগফল মেলে
আমি যোগ করলেও বিয়োগফল
আমি দুয়ে দুয়ে পাই ২ বা ৩
তুমি ৫, ৭ কিংবা ৯
একথা তো আজ বলতেই পারো
দুয়ে দুয়ে তুমিও চারই চেয়েছিলে
৫, ৭, ৯- কিছুতেই নয়…
সূর্যকে রেখেছি
ময়ূরের কথা, পাথরের কথা
ময়ূরের কথা, পাথরের কথা ছাড়ো
বুকের শোকেসে জমা রাখো কিছু ফুল
তুমিও জানো না, আমিও জানি না ভালো
ময়ূর কীভাবে হয়ে যায় নীল ঢেউ!
বৃষ্টির রাতে স্বপ্নের কথা ভেবে
পাবে না কখনো ঝলমলে প্রিয় ভোর
নির্জন রাত তোমাকে দেবে না তুলে
ক্রন্দন ছাড়া আর কোনো চেনা সুর।
যে মাছের খোঁজে গোপনে সাজাও নদী
সাজাও বিশটি গোলাপের সঞ্চয়
জানো না তোমারই চোখের স্বচ্ছ জলে
কাটছে সাঁতার স্বপ্নের এ্যাঞ্জেল
ময়ূরের কথা, পাথরের কথা ছাড়ো
তোমার বুকেই পাথর রয়েছে জমা
সে পাথর যদি খুলে আনো এক টানে
ময়ূর তাহলে পাথর হবে না, জেনো!
সময়
কাবাবের মতো ঝুলে আছো লাল শিকে
শরীর পোড়ার গন্ধ বোঝো না তবু
অলক্ষ্যে যেন ধারালো কাঁচিতে কেউ
কাগজের মতো কেটে নেয় পোড়া ঘ্রাণ!
তবু তুমি বাঁচো, ভাসো অগ্নির জলে
সময়ের গাঢ় উত্তাপে হও নীল
জানো না তবুও ক্ষত চিহ্নের দাগে
পাপের ধূসর রঙ মেখে দেয় কেউ!
অথচ তোমার ধারালো দাঁতের ফাঁকে
চুরমার হলো দুপুরের কালো ক্রোধ
তবে কেন আর জীর্ণ দেয়াল খুঁড়ে
খোঁজ করো তুমি স্বপ্নের আস্বাদ!
কাবারের মতো ঝুলে আছো লাল শিকে
অথচ বোঝে না শরীর পোড়ার ঘ্রাণ
পাথর দিনের চুল্লিতে পুড়ে আজো
ভাঙলো না, তবু ভাঙলো না কালঘুম!
লোকটা
বিশতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছে ক্রোধ
দশতলা থেকে থুতু
নিচতলা থেকে ঘৃণা
পাঁচদিক থেকে গলগল করে ঢুকছে সাহস
নামছে দেয়াল বেয়ে রক্ত, রক্ত-ঘাম
দু’টি মেয়ে দুই যুবকের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো-
ওই যে লোকটা, পোশাকের নিচে তার
ধারালো তরবারি
এক হাতে কীট-দষ্ট ফুল
অন্য হাত ঝুলছে চেয়ারে
ওকে ফেলে এসো দূর গহীন জঙ্গলে
ওর মাংস ছিঁড়ে খাক কুকুর-শেয়াল
একটি যুবক শার্ট খুলে তুলে নিলো রৌদ্রজল
গায়ে রোদ না মেখে সে মিছিলে যাবে না
অন্যজন মিশে গেলো শ্লোগান-প্লাবনে
নিচতলা থেকে ঘৃণা
দশতলা থেকে থুতু
বিশতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছে ক্রোধ
আর,-
লোকটা দেয়ালে পিঠ দিয়ে
সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে!
বস্ত্রশিল্প
শঙ্কিত পাথরখণ্ড ভেদ করে চলে যায় মেঘ
পোশাক রোরুদ্যমান, সূত্রহীনতায়!
হে মেষপালক, শঙ্খ বেজে উঠতেই
কেন তুলে নিলে উষ্ণ কাপড়ের ঘ্রাণ!
লোভ-চক্ষু থেকে নেমে আসে মেয়ে মৌমাছির ঝাঁক
লজ্জাস্থান ঢাকে বাতিবৃক্ষ
দুয়ারে দুয়ারে মাথা তোলে শীতবস্ত্র
সোনামুদ্রা ফেলে যায় মানবপ্রজাতি।
এতোটা বিভ্রম ঠিক তাদের সাজে না
ঢেউটিন দেখে ভাবে, সমুদ্র-তরঙ্গ
তাঁতি-বংশে নিভে যায় প্রেরণার বাতি।
দু’টি মাকড়শা এসে সেই স্থান অধিকার করে।
পর্যটনমোহ
রক্তমাখা ফল পড়ে আছে
গোপনে ঢুকিয়ে দিচ্ছো তাতে বাঘনখ
সমস্ত নির্জন রাস্তা আতংকিত পায়ে
ঢুকে যাচ্ছে বিভিন্ন গলিতে
যেন কেউ সংক্রামক বিষের বল্লম
গেঁথে দিচ্ছে ফলের ফুসফুসে
বাতাসে কিসের গুঁড়ো? যেন এইমাত্র
উড়িয়ে দিয়েছে কেউ হিংসার ধুলো।
ফলের চারদিকে ধোঁয়া দেখে মনে হয়,
ডানায় যন্ত্রণাগন্ধ মেখে সেই মাছি
আজও তার পর্যটন সমাপ্ত করেনি।
ঘ্রাণ
তোমার ঘ্রাণেও আছে আলাদা সৌন্দর্য
সামান্য কথার পর সমুদ্র দূরত্বও যেন নিমিষে উধাও
আর, সেই ঘ্রাণ এসে মিশে যায় আমার শরীরে
দ্বৈত গন্ধ নিয়ে আমি উন্মাতাল
যেন এইমাত্র শেষ হল সম্পূর্ণ সঙ্গম
তোমার রঙিন ঘ্রাণ টের পায় এতো দূরে গাছের পাতাও
আজ বুঝি- রূপে নয়, ঘ্রাণে আছে সকল রহস্য
এর টানে ফুলের কাছেই
বারবার ফিরে যায় সকল মৌমাছি
নিজেকেও মৌমাছি বলেই মনে হচ্ছে আজ
ঘ্রাণ থেকে খুলে নিচ্ছি অসাধারণ মধু…
পোকা
ঝরছে সর্বত্র পোকাবৃষ্টি; অনর্গল
লাল-নীল; কেউ কেউ প্রচণ্ড সবুজ
যে কোন বৃষ্টিই মৃত্তিকায় নেমে নদী হয়ে যায়
পোকাদেরও আছে মৃদু ঢেউয়ের স্বভাব
তাদের কয়েকজন বিনা উস্কানিতে
ঢুকে পড়ছে এমনকি আমার স্বপ্নের ভেতরেও
তুমি মানছ না এই কীটের সন্ত্রাস
চাইছ নিশ্চিহ্ন হোক তাদের তরঙ্গ
অথচ জান না-
মানুষেরা কীটের সমষ্টি
মরে গেলে তারা সব জ্যান্ত হয়ে ওঠে
বলি আজ, মানুষেরা বেঁচে থাকলেই
শরীরের পোকাগুলি জাগতে পারে না।
যদি ভাবে কেউ
যদি ভাবে কেউ এই রাত্রি যাবে সকালে
এই চন্দ্র শাদা মার্বেল সেজে গড়াবে নীল চাদরে
কালো রাত্রি গিলে খাবে সেই লাল রৌদ্র
সেটা ঠিক নয়
কার নিঃশ্বাস হবে নিঃশেষ
কার দরোজায় কার নিষেধের তালা ঝুলবে
কেউ জানে কি?
এই নৌকো এই পারাপার আজ বন্ধ
এই বর্ষণ ফিরে যাবে সেই মহাশূন্যে
চিতাবাঘও তার শেষ আশ্রয় ছিঁড়ে বেরোবে
দূর নগরী পরিভ্রমণে!
(অসম্ভব বলে সত্যি কোন কথা নেই)
এতো ভুল দিন কে যে রাত-দিন বোনে মগজে
কে যে করে কার লোনা জল পান ভুল স্বপ্নে
কেউ জানে কি
কেউ জা নে না
কারও ছায়া তার ঘরে ঘুমুবে- সে ঘুরবে
নাকি ছায়া তার টো টো ঘুরবে
শুধু দেহটা ঘরে ঘুমুবে নিশ্চিন্তে!
(অসম্ভব বলে সত্যি কোন কিছু নেই)।
মন্ত্র- ২২
চোখ সকলকে দেখে, নিজেকে দেখে না
দেখে না, কারণ তার চারপাশ অন্ধকারময়
স্বয়ং চোখের এই পরিণতি দেখো- চক্ষুস্মান কিন্তু অন্ধ
মানুষ নিজেকে ঠিক ততোটুকু জানে
বেদনায় শরীর ভিজিয়ে ভাবে, বৃষ্টিতে ভিজেছে
এইভাবে চল্লিশটি আকাশ পেরিয়ে
উঠে যায় অন্য কোন আকাশের খোঁজে
নিজেকে যায় না দেখা, এই কথা সব চোখ জানে
মানুষ জানে না