পৌষ ডাক দিতে আরও দিন পনেরো। আকাশে আধাআধি ষষ্ঠী’র চাঁদ। এই চাঁদের নাম শ্রবণা। বেশ উজ্জ্বল। ঐ চাঁদটা তোর খুব প্রিয়। তাই ছাদে উঠে এসেছিস। যদিও মনের মধ্যে ভয়। আশেপাশের বাড়ির জানালা পৌষের আগে অবধি খোলা বাতাস চায়। বগলদাবা করে শীতল পাটি এনেছিস ।
তিতাস চিত হয়ে শুয়ে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম”।
ছাদের কোলে ইঁটের রেলিং ঘেরা অন্ধকার। এসময়টায় হাল্কা হিম’য়ে আকাশ ধূসর থাকলেও, রোজকার মতোই জ্বলজ্বলে শুকতারাটা চাঁদের পাশে। আবছা একটা আলো তোর কপালে লেপ্টে আছে। তিতাসের নাক, ঠোঁট, চিবুক আর বুক সাঁতরে হাবুডুবু আধো জ্যোৎস্নায়। অর্ধেক চাঁদ ঝকঝকে নয় বটে, তবু কেমন যেন ঝিমঝিম মায়া ঘেরা।
—“কখনও কখনও ঝকঝকে জ্যোৎস্না বড্ড ফ্ল্যাট মনে হয়; হ্যালোজেনের মতো। তাই-না’রে সোনাই? তার চাইতে আমার এই আধো আধো আলোটা বড় বেশী রহস্যঘন মনে হয়। তোরও কি তাই মনে হয় ? উফ্! একটু সরে শো-ও না’রে বাবা!” বাঁহাতটা তিতাসের তলপেটে আলতো করে ঠেলে দেয় অপু। আর, শীতল পাটির একফালি জায়গাটায় কোনোরকমে কাত হয়ে শুয়ে নিজের মাথাটাকে ত্রিভূজ বাহুর উপরে তুলে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে তিতাসের দীঘল চোখে।
হঠাৎ উল্কাপাতের মতো নিরীহ ইচ্ছা সবে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে তিতাসের মনের মধ্যে । ঠিক তখনই আমি ঝুঁকে পড়ে তিতাসের গন্ধ নিলাম। নাকে নাক ঘষা’টা আমাদের পুরনো খেলা। আকাশের গায়ে কুঁড়ি ফোঁড়ার মতো একটা অন্ধকারকে দেখিয়ে তিতাস বললো:
— জানিস অপু… ‘জুপিটার’ ঠিক ঐখানে ফুটবে।
— ‘জুপিটার’ ? এমন অক্ষম উজ্জ্বল ? তুই ঠিক জানিস?
— একটু একটু করে ওর অস্তিত্ব বোঝা যাবে। আকাশের তৃতীয় উজ্জ্বলতম। চাঁদ আর শুকতারার পর।
আমার হাত তখনও স্থির তিতাসের জিরেন ঘাটে। ঠোঁটের সোঁদা গন্ধে অলৌকিক ইন্দ্রজালের মতো শরীর আদিমতম উত্তরাধিকারে। হাতটা সরীসৃপ হতেই তিতাসের পাড়ে ঢেউয়ের ছলাৎ একটা শব্দ হলো। চোখ মেলে তাকালো তিতাস, অস্ফুটে বলে উঠলো
— “শুনতে পাচ্ছিস?”
— কি?
— তোর আঙ্গুলের নিচে পাড় ভাঙার শব্দ?
— বাতাস কি নদীর শব্দ শুনতে পায়? সে তো ঢেউ কে পাড়ে নিয়ে গিয়ে নিজেই ভেঙে যায় ডাঙায়। শুনতে পাচ্ছিস কি তুইও, সেই ভাঙার শব্দ?
— পাচ্ছি’তো। পাচ্ছি। হিমের রাতে তোর উষ্ণ নিশ্বাস আমার পাড় ভাঙছে। খসে পড়ছে মাটি … জমে থাকা অতীত।
একটা অদ্ভুত আলো ঘিরে রেখেছে তিতাসকে। বাকি সব অন্ধকারে। অদম্য প্রেমের নিজস্ব একটা আলো আছে। অন্ধকার আর অনধিকার জরিপ করতে থাকে সে আলো। আর তখনই উদ্দাম ভালোবাসায় একটা ছায়া এসে পড়ে। সে ছায়াটাকেই ভয় তিতাসের। যদি কেউ ….
— শ্ শ্ শ্। আকাশের গায়ে কোনো ছায়া পড়েনা সোনাই
— তাহলে গ্রহণ কি?
— এই যে, আমার হাতটা নিয়ে তুই যে এখন তোর নাভি স্পর্শ করে আছিস, এই স্পর্শটা হলো গিয়ে গ্রহণ। একটা বিদ্যুৎ খেলে যায় সুপ্ত বাসনায়। কখনো চাঁদ মাঝখানে, কখনও বা সূর্য। ছায়ার চারপাশ ঘিরে থাকে আলো। সে আলো’তে ছায়ারা অন্ধ হয়ে যায়। তোর মনে হবে যেন তোকে দেখছে কোনো আলোকিত গ্রহ … আসলে সে কিন্তু তোর আলোতেই আলোকিত, কিন্তু নিজে অন্ধ।
— তাহলে জুপিটার আমাদের দেখতে পাচ্ছে না?
— কোন জুপিটার? তোর নাভিমূল থেকেই তো ওর উড়ান শুরু !
তিতাসের তলপেট উঠছে নামছে। নিঃশ্বাসে এক সমুদ্র শব্দ। তোর গিরিখাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাক ডুবিয়ে গন্ধ নিলাম হঠাৎ ভিজে ওঠা, বহুদিনের শুখা উপত্যকায়। তাকালাম তোর রক্তিম চোখের দিকে। তোর বুকের ভিতর নীল সমুদ্র। আমার ওয়াচ টাওয়ারে লাল বিন্দু। এক একটা হৃদস্পন্দনে উথাল পাথাল ঢেউ। আমার হাতের তালু কেঁপে কেঁপে উঠছে। তুই অস্ফুটে বললি …
— অমন করে কী দেখছিস অপু? অ্যাই !!!
— জুপিটার
জুপিটার তখন একটু একটু করে কক্ষপথ স্থির করে নিতে চাইছে। একটা প্যাঁচা ঠিক তখনই নিঃশব্দে এসে বসলো ছাদের কার্নিশে। এত সন্তর্পনে ডানা বন্ধ করল, যেন ছায়া এসে দাঁড়ালো পিছনে। যেন যাচাই করতে এসেছে। একটা শীতল ঠাণ্ডা দৃষ্টি … আমাদের দিকে। তুই আমার হাতটা সরিয়ে রাখলি নাভির উপরে। কেমন অলীক শব্দে বেজে উঠেছে বুজকুড়ি।
প্যাঁচা তোর একটুও ভালো লাগে না। এমন উদ্ভট প্রাণীকে ভালো লাগার কোনো কারণ’ও নেই। সামনে দেখেও যে প্রাণী চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তারপর পর্যাপ্ত কারণ ছাড়াই হঠাৎ উড়ে যায় পাশের গাছে। আর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে ঘটনার পিছনের ঘটনাকে। বিজ্ঞের মতো নিজের অসমর্থন জানায়।
— এভাবে আর কতদিন অপু?
একটা দুরন্ত অভিমান ভেঙে চুরে আছে তোর স্বরে। চোখে চোখ রেখে আবার বললি :
— এভাবে কতদিন আর আমায় একলা ফেলে রাখবি? সেই তো কবে থেকে তোর রোদ কুড়িয়ে জমিয়ে রাখছি বুকে। বৃষ্টি কবে হবি অপু?
কাছে টেনে নিলাম তোকে। হাঁস ফাঁস আলিঙ্গনে গা ভাসালাম ঝিনুক গন্ধ মাখা তোর বুকে। নীল ভালবাসায় লুটোপুটি শীতল পাটি। শরীর মনে ঝুপসু ভেজা আমি তোর বুকে মাথা রেখে বললাম,
— আর একটু অপেক্ষা করবি সোনাই? বাবার ক্যান্সারটা দামাল বজ্রপাতের মত আমাকে পুড়িয়ে দিয়েছে। একটা সুপার ফ্লপ সিনেমার নরকে দশ লাখ টাকার দেনায় ডুবে রয়েছি । একটু সামলে না উঠলে…
আমার ঠোঁটে আঙ্গুল রাখলি। অদ্ভুত শান্ত একটা হাসি ঝুলে রয়েছে তোর ঠোঁটের কিনারে। আলতো চোখ বুজে যেন সম্মতি জানালি। তোর আশরীর স্নান আমায় ছুঁয়ে । একটা শান্তি অন্তরের কানায় কানায় বাসা বাঁধে আমার দুঃখ সুখ জুড়ে। আমার চার বছরের জীবন জুড়ে। ঘাড় ঘুড়িয়ে উল্টো দিকে তাকালি … যেদিকটায় প্যাঁচাটা তোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। প্যাঁচাটা অত্যন্ত সাবধানে ডানা দুটো তুললো … স্থির করে দাঁড় করিয়ে রাখলো ওর ডানা দুটো শরীরের সাথে সমকৌণিক অবস্থানে। চোখ দুটো কী অসম্ভব জ্বলজ্বল করছে। যেন জুপিটার থেকে আসা “এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল”।
কথা শেষ করতে দিলিনা। আমার ঠোঁটে তর্জনিটা তখনও চেপে ধরে আছিস তুই। এভাবেই এখন তোকে শুনতে হবে।
— আচ্ছা অপু … ধর এক্ষুনি তুই দশ লাখটাকা পেয়ে গেলি। রাখবি আমায় তোর খাঁচায়?
আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছিস। মণি দুটো অদ্ভুত রকমের নীল। তোর চোখে ভীষণ বেমানান … অচেনা … তবু যেন খুব চেনা। তোর দৃষ্টিতে অদ্ভুত একটা সৃষ্টি। বিদ্যুৎ, ঝড়, জল … সৃষ্টি হচ্ছে অ্যামাইনো অ্যাসিড। প্রাণ । এরা সব যেন সাঁতরাচ্ছে ছাদের অন্ধকারে। ছাদটা এখন একটা গ্যালাক্সির মতো মনে হচ্ছে।
— “অ্যাই … অ্যাই তিতাস!”
— “বললি না তো, রাখবি কি না?”
স্পষ্ট নয়, একটা গোঙানির মতো স্বর মনে হলো তোর আব্দারে।
— “এটা কোনো কথা হলো? এমন অদ্ভুত কথা বলছিস কেন?”
— “জুপিটার তোর সঙ্গে থাকবে । তোর কোনো ভয় নেই।” বলেই ঘাড় ঘুড়িয়ে নিলি তুই।
জোভিয়ানের মতো মনে হচ্ছে এখন তিতাসকে। ভয় লাগতে শুরু করলো আমার। জাপটে ধরলাম ওকে। তখনও বিড়বিড় করে যাচ্ছে তিতাস।
— একটা ভুল হয়ে গেছে অপু। তাই বলে তাকে বয়ে বেড়ানোর মানে হয় না। একটা ভুল ঢাকতে গেলে, আরও যে ভুলের সমুদ্রে ডুবতে হবে!
চুপ করে ভাবতে থাকলাম। অন্ধকারের ফাটল বরাবর একটা তীব্র আলো এসে পড়েছে তিতাসের বুকে। প্যাঁচাটা একবার ঘাড় উঁচু করে তাকালো আকাশের দিকে … না-কি তাকালো আসলে বিরাশি কোটি মাইল অপসূরে? ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরতেই … চিৎকার করে উঠলাম আমি।
— সোনাইইইই
শক্ত বাঁকানো ঠোঁট । হাত দুটো ধীরে ধীরে সাদা তুষারের মতো হয়ে উঠছে। ক্রমশ ছোটো হতে হতে তিতাস এখন পাখনা ছড়িয়ে একশো সেন্টিমিটার। তিতাস এখন নরম তুলতুলে।
আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটা লক্ষী প্যাঁচা। যেন সম্মতির অপেক্ষা। ওর ঘাড় উঁচু হল। কার্নিশে বসা ঐ প্যাঁচাটাকে আর দেখতে পাচ্ছি না। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছি গোটা ছাদ। একবার আকাশের দিকে দু’হাত ছড়িয়ে ডাকলাম …. — তিতাআআআস !
একবার নীচের ঘরে যেতে হবে। হয়তো আমার মনের ভুল। হয়তো এতক্ষন যা ঘটলো … তা স্বপ্ন … হয়তো তিতাস নীচে কোথাও আছে … উপরে আসেনি। হয়তো পুরোটাই ইল্যিউশন। মোবাইলটা নিচের ঘরেই রেখে এসেছি … তিতাসকে ফোন করতে হবে। ও হয়তো এখনও ফেরেইনি। এত রাত করেনা তো! কী ভীষণ কান্না পাচ্ছে। দলা পাকিয়ে আসছে গলা।
মোবাইলটা বিছানাতেই রাখা আছে। ফোন করতে হবে । একটা মেসেজটা ভেসে রয়েছে তখনও স্ক্রীনে … ভেসে যাচ্ছি আমি … তিতাসের নুড়ি পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে চলেছে ওর আদরের অপু।
“ভালবাসা অপেক্ষা করে ঠিকই, কিন্তু কোনো অজুহাতের জন্য নয় … ভালোবাসা অপেক্ষা করে সাহসী কমিটমেন্টের জন্য। যে কমিটমেন্ট বাঁচতে শেখায়”।
না … এই মেসেজটা তখন দেখিনি রে সোনাই। তোর নাম্বার থেকে আসা ঐ মেসেজটা পরে দেখেছিলাম।
যেটা মোবাইলের স্ক্রীনে ভেসেছিলো … সেটা ছিলো :
INR 10,000,00.00 credited to your A/c No XX9947 on 05/12/2019 through NEFT with UTR HSBCN19338627495 by #JUPITER