| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথে বসবাস

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
 
 
২২ শ্রাবন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। তবে প্রিয় কবিকে মনে করার জন্য আলাদাভাবে কোন দিবসের প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তিনি তো আছেন প্রতি কাজে, প্রতি মুহূর্তে, রবীন্দ্রনাথে যেন বসবাস।
 
আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়ে আব্বার মুখে শুনে শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটা বড় কবিতা মুখস্ত করেছিলাম।
যদিও জীবনের প্রথম কোন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতে গিয়ে পড়েছিলাম অন্য একটি কবিতা। কবিতার নাম ছিল-‘স্বপন’। চোখ বড় বড় করে, হাত ঘুরিয়ে, তর্জনি উচুঁ করে বলেছিলাম-
 
দিনে হই এক মতো
রাতে হই আর!
রাতে যে স্বপন দেখি
মানে কি যে তার!
আমাকে ধরিতে যেই
এল ছোট কাকা
স্বপনে গেলাম উড়ে
মেলে দিয়ে পাখা।
….
শেষের অংশটা বলার সময় দুই হাত দুই পাশে মেলে দিয়ে ওড়ার ভঙ্গী করতাম। আমাদের গেন্ডারিয়া ডিস্ট্রিলারী রোডের বাসিন্দারা তখন সবাই মিলে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করত। এমনি পাড়ার অনুষ্ঠান। বড় কোন শিল্পী নেই। আমরা নিজেরাই শিল্পী। আমাদের প্রতিবেশী কাউয়ুম চাচার চমৎকার বাংলো ধরনের বাড়ির বিরাট বারান্দায় স্টেজ বানিয়ে সেই অনুষ্ঠান হত। পাড়ার বড় ভাইরা যেমন কামাল ভাই, হাসান ভাই, শ্যামল দা, তুহিন ভাইরা নাটক করতেন সেই অনুষ্ঠানে। আমরা হা হয়ে দেখতাম। মন ভরে যেত খুশীতে। জীবনে প্রথম কবিতা আবৃত্তি করে পাওয়া কালির দোয়াত আর চুল বাধার লাল ফিতে পুরস্কার পাবার আনন্দের কথা কোনদিন ভুলতে পারব না। রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই আমার জীবনের প্রথম অর্জন।
 
আমাদের একতলা বাড়ির বারান্দাতেও আব্বার পরিচালনায় আমরা প্রায়ই ঘরোয়া অনুষ্ঠান করতাম। সেখানে বড় কবিতাগুলি পাঠ করতাম। দুই বিঘা জমি, সোনার তরী আর নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ দিয়ে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয়। শৈশবে মস্তিস্কের উর্বর কোষে গেঁথে গিয়েছিল কবিতার লাইনগুলি, যা এখনও সমান উজ্জ্বল। আমাদের সময় কিংবা তারও আগে দেখেছি অনেকেই এই তিনটা কবিতা মুখস্ত বলতে পারতো। সম্ভবত তখন স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইয়ে এই কবিতাগুলি অন্তর্ভূক্ত ছিল। যেমন, বিএ ক্লাসে এক সময়ে পড়ানো হত- দুই পাখী কবিতাটি।
 
তৃতীয় শ্রেণীর সেই বয়স থেকে এই মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত জীবনের সবটাই যেন রবীন্দ্রনাথময়। যখনই কিছু ভাবি, কিছু প্রকাশ করতে যাই, কোন উপলব্ধি ঘটে, তখনই সেই সব প্রকাশ কিংবা অনুভবের সঙ্গে কোথায় যেন রবীন্দ্রনাথ এসে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। যখনই বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই, মনে হয়- ‘বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি।’ ইস্ট রিভারের ওপর যখন সন্ধ্যার অন্ধকার নামে তখন বলে উঠি- ‘যদিও সন্ধ্যা আসিতে মন্দ মন্থরে/ সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া…’। লম্বা কাউকে দেখলে বলে উঠি- ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’। নদী দেখলে মনে মনে ভাবি, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’
 
রবী ঠাকুরের কণিকা ছড়া যেন আমার পরিনত ভাবনার প্রতিচ্ছবি। জীবনের নানা উত্থান আর পতনে আর চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় যখন নানা ধরনের উপলব্ধি হয়, তখন বিস্মিত হয়ে ভাবি কিভাবে আমার প্রিয় কবি আমার সমস্ত অনুভবের কথা আগেই বুঝে ফেলেছেন। একজন মানুষ কিভাবে এমন অন্তর্যামী হন! যেমন একটি লেখা – কুটুম্বিতা, যেখানে আছে- ‘কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,/ ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে।/ হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা;/ কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা।’ কিংবা মাঝারির সতর্কতা- ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,/ তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে। আর মোহ কবিতাটি আমরা সবাই অহরহ বলি, এর চেয়ে সত্যি জীবনে আর থাকতে পারেনা- ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,/ ও পারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।/ নদীর ও পার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে…./ কহে, যাহা কিছু সুখ সকলই ও পারে।’
 
প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা চেতনার উন্মেষকাল থাকে। সাধারণত মানুষের ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সের সময় এটা হয়। ওই বয়সে মানুষের চিন্তা ভাবনা ধারা তৈরী হয়। পরবর্তী জীবনে মানুষ সেটাকে সমৃদ্ধ ও লালন করে। সেই সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই। ভর্তির পরের মাসে আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলনের ফর্ম কিনি। সেখানে গিয়ে পেলাম সংস্কৃতিজ্ঞ ওয়াহিদুল হককে। তিনি আমার চেতনার মর্মমূলে এমনভাবে রবীন্ত্রনাথকে প্রোথিত করলেন, যেন আমার নতুন জন্ম হল। আমি হয়ে গেলাম অন্য মানুষ। অন্য ভাবে-অন্য দৃষ্টিভঙ্গীতে চারপাশের জগতকে দেখতে লাগলাম। রবী ঠাকুরের বাণী দিয়ে উনি আমার ভাবনাকে প্রসারিত করলেন। আমি তো রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, ওয়াহিদ ভাই হয়ে গেলেন আমার রবীন্দ্রনাথ।
 
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলা উভয় বাংলা মিলে ওয়াহিদ ভাইয়ের রবীন্দ্রনাথ বিশেষজ্ঞ তাঁর জীবিতকালে আর কেউ ছিল না। দুই বাংলার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা, ওয়াহিদুল হকের মুখে একটা প্রশংসাবানী শোনার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে থাকতেন। এই অসামান্য মানুষটি কণ্ঠশীলনে আমাদের মতো অর্বাচীনদের গান শেখাতেন- ‘এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে। এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে।’; ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল’ ‘আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো, তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্ণা-ঝরানো’ ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’। টিএসসির দোতলার রুমে বসে কোরাসে গান গাইতে গাইতে বাইরে জানালা দিয়ে পাতার ওপর আলোর নাচন দেখতাম আর মোহিত হতাম। ভাবতাম, এমন অসামান্য সৌন্দর্য্যময় ছবিটি কেন আগে দেখিনি! মনে পড়ে ওয়াহিদ ভাইয়ের কন্ঠে দরদ ভরা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনা। এত শুদ্ধ ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে আমি আগে পরে কাউকে দেখিনি।
 
লিপিকা আর মালঞ্চ পড়েছিলাম ওয়াহিদ ভাইয়ের কাছে। লিপিকার সহজ ভাষায় বলা অসামান্য সেই গল্পগুলি মনে দাগ কেটেছিল প্রচন্ডভাবে। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল লেখাগুলি। খুব সাধারণ ঘটনার অসাধারণ অনুভব সব। কণ্ঠশীলনের আবর্তনে লিপিকা আর প্রয়োগে মালঞ্চ পড়াতেন ওয়াহিদ ভাই। মালঞ্চ উপন্যাসটা ছিল মানব মনের অজানা গুঢ়তত্ত নিয়ে। একদিন আচমকা বলে বসলেন, ‘একজন মানুষ একই সঙ্গে দুজন মানুষকে ভালোবাসতে পারে।’ মালঞ্চ উপন্যাসে এই কথার ছায়া ছিল। তখন আমাদের বয়স ছিল কম। বুঝতে পারিনি স্পষ্টভাবে। হয়ত এই কথার মধ্যে ছিল ওয়াহিদ ভাইয়ের জীবনেরও ছায়া। আসলে অপরিণত বয়সের উপলব্ধি তো পরিণত বয়সের মতো হয় না।
 
যেমন শেষের কবিতা স্কুলে পড়ে কিছু বুঝিনি। চরিত্রগুলি কেন এত লম্বা কথা বলে, এই জন্য বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে শেষের কবিতা পড়ে যেন নতুন জন্ম হল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যুগে থেকে কতখানি অগ্রসর সময়ের মানুষ ছিলেন সেটাই গভীরভাবে অনুভব করলাম। এখনও সময় পেলে উল্টে দেখি শেষের কবিতার কয়েক পৃষ্ঠা। শেষের কবিতার মতো নষ্টনীড়, চোখের বালি পড়ে জ্ঞান চক্ষুর উন্মীলন হল। জীবনকে দেখতে শুরু করলাম অন্যভাবে। গোরা-নৌকা ডুবি পড়ে সাহিত্য রসে সিক্ত হলাম। গোরার মতো এমন সাহসী চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বিরল মনে হল। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমন সাহিত্যও অসামান্য। এমনভাবে পৃথিবীকে দেখতে পারেন কজন। আর ছোট গল্পে তো উনি আমার বিস্ময়। আদর্শ ছোট গল্প লিখতেন তিনি। গুগলে খুঁজতে গেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকারদের তালিকায় সব সময় রবীন্দ্রনাথের নামটা শুরুতে দেখতে পাই।
 
রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য সব কিছু পড়া হত কণ্ঠশীলনে। আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতাই আবৃত্তি করতাম বেশী। ‘আমি’ ‘পৃথিবী’ ‘অসমাপ্ত’ সহ একাধিক বিশাল কবিতা কণ্ঠস্থ করলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতে শুরু করলাম। অন্য আবৃত্তি দলগুলি বলতো কণ্ঠশীলনৈর সদস্যরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে বেশী। এটা সত্যি ছিল। যে সত্যির কারণ ছিল ওয়াহিদ ভাই। উনি আমাদের মর্মমূলে গেথে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে।
 
রবীন্দ্রনাথকে যে কারণে শুধু তাঁর জন্ম জয়ন্তীতে কিংবা প্রয়ান দিবসে স্মরণ করি না। উনি থাকেন জীবন যাপনের প্রতিটি স্তরে। সুখের দিনে তাঁকে স্মরণ করি। দুঃখের দিনে তাঁর কথা ভাবি। আজো কোন কারণে মন খারাপ হলে প্রথম যে গানটা শুনি, সেটা হল- ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’। আমার প্রয়াত আব্বা-আম্মার দুজনেরই সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল- ‘তুই ফেলে এসেছিস, কারে মন মনরে আমার’।
 
উৎসবের দিনে তাঁর গান শুনি। মন উদাস হলে তাঁর গান শুনি। বৃষ্টি এলে শুনি, বসন্তের মৃদু মন্দ হাওয়া উত্তাল করলে শুনি। রবীন্দ্রনাথেই যেন করি বসবাস।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত