আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
আজ ২৮ জানুয়ারী কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
গঙ্গার পাড় ধরে, অজয়ের পাড় ধরে ছড়ানো বৈষ্ণবতীর্থ। কোন শহর ছেড়ে কোন গ্রাম ধরবে, কোন স্টেশন ছেড়ে কোন বাসগুমটি, কোন ঘাট, কোন মাঠ, যেখানেই তুমি তোমার শ্রান্ত শরীর, তোমার ক্লান্ত পা-জোড়া থামাবে- সেখানেই দেখবে কোনো না কোনো মহাত্মার আশ্রম, বাঁধানো চাতাল, আঙিনায় কদম্ব গাছ, তুলসী মঞ্চ। অথবা আখড়া বা মহাজনের জন্মভিটে- যে জন্মভিটেয় কতকাল আগে হয়তো কোনো পদকর্তা অসাধারণ কাব্যসুষমাভরা পদ লিখে গেছেন। সেসব জায়গা এখনো খোল, করতাল, খঞ্জনিমুখর তীর্থ। নবদ্বীপধাম থেকে কাটোয়া পর্যন্ত যত রেলস্টেশন- বিষ্ণুপ্রিয়া, ভান্ডারটিকুরি, পূর্বস্থলি, লক্ষ্মীপুর, পাটুলি, অগ্রদ্বীপ, সাহেবতলা, দাঁইহাট, সবশেষে কাটোয়া জংশন, ইলেকট্রিক লাইনের সর্বশেষ স্টেশন এবং তার পরেও আছে ন্যারো গেজের কাটোয়া-আহমদপুরের লাইন।
কাটোয়া ছাড়িয়ে যদি পশ্চিমে যাও অজয় নদের ওপারে প্রথম হল্ট নবগ্রাম-কাঁকুরগাছি। বাঁ-হাতে একটু দূর দিয়েই গেছে কাটোয়া-আহমদপুরের ছোটো লাইন। সে লাইনে রোগারোগা চেহারার দু’খানা, কখনো খুব বেশি হলে তিনখানা কামরার ছোট ট্রেন। ঝিকঝিক করে ধীর গতিতে চলে আহমদপুর অবধি। এই দুই লাইন যদিও পাশাপাশি কিছুটা দূর গেছে কিন্তু এই ব্রডগেজ লাইনের সঙ্গে ন্যারো গেজের লাইনের কোনো তুলনাই হয় না। ব্রডগেজ ভারতীয় উপমহাদেশের একেবারে প্রথমদিকের পত্তনি লাইন। কাটোয়া ছাড়িয়ে সে গেছে আরও পশ্চিমে, সারা উত্তর এবং উত্তর-পূবের ভারতবর্ষে যাওয়ার প্রধান রেলপথ এটাই।
ন্যারো গেজের লাইন কাটোয়া থেকে বার হলেও ব্রডগেজের সঙ্গে একত্রে সে অজয় পার হয় না। তবে সে গাড়িও তো অজয় পার হবে। তার জন্য দক্ষিণে আরও একটা রেলব্রিজ আছে। অজয় পেরোবার পর এই দুই লাইন দু’তিন কিলোমিটার একসঙ্গে চলছে। এই দুই লাইনের মাঝখানে অজয়ের পশ্চিমকূল ঘেঁষে শ্রীপাট নিহিনগর।
নিহিনগরে অজয়ের পাড়ে বড়সড় আখড়া মহান্ত দেবকী দাসের। মহান্ত দেবকী দাস আজ নিয়ে তিন দিন হলো দেহ রেখেছেন। তুলসীমালা তার স্ত্রী বল স্ত্রী, সাধনসঙ্গিনী বল সাধনসঙ্গিনী, আজ এই দিনেও কপাট আটকে মহান্তের দেহ আগলে বসে আছে।
জাতবৈষ্ণবের দেহ মাটিতে গোলাকার গর্ত করে সমাধি দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু এখন আর তেমন ক’জন করতে পারে। অজয়ের পাড় প্রতি বর্ষায় ভাঙে। শিয়াল-কুকুর পচাগলা দেহ টেনে-হিঁচড়ে গ্রামের মধ্য নিয়ে আসে। কাজেই শেষ পর্যন্ত সবাই মেনে নিয়েছে দাহ করাই ভালো। আগুনে পুড়িয়ে জল ঢেলে চিতা ধুইয়ে দেও।
কিন্তু তুলসীমালা এসব কথা শুনবে না। সে জাতবৈষ্ণবের মেয়ে। জাতবৈষ্ণবের সাধনসঙ্গিনী। জাতে তারা হিন্দু বটে কিন্তু জাতহিন্দুদের নিয়মরীতির সঙ্গে জাতবৈষ্ণবের নিয়মরীতির পার্থক্য আছে। মহাপ্রভুরা এসব শিক্ষা অনেক আগেই দিয়ে গেছেন। নদী যদি ভাঙে তবে আখড়ার নিজস্ব জমিতে প্রভুর সমাধি দাও। তাতেও যখন আপত্তি হলো, তুলসীমালা জেদ ধরে বলল, ‘তাহলে আখড়ার চাতালের নিচে রাখ প্রভুর দেহ।’
তিন দিন ধরে উঠোনে হরিনাম সংকীর্তন আর দেহতত্ত্ব হচ্ছে। মহান্তের প্রধান শিষ্যরা মাঝে-মধ্যে উঠে এসে দরজায় ঠুকঠুক করে বাইরে থেকে কথা বলছে তুলসীমালার সঙ্গে। তুলসীমালার এক কথা ‘না’।
মহান্ত মারা গেছেন ছাপান্ন বছর বয়সে, তুলসীমালার বয়স এখন মাত্র সাতাশ। এরকম দু’জন অসমবয়সী পুরুষ-স্ত্রীর মধ্যে এরকম তীব্র আসক্তি, প্রেম, এ কথা কে কোথায় শুনেছে? মহান্তের দেহ রাখার খবর শুনে অনেক লোক আসা-যাওয়া করছে আখড়ায়। তারা সবাই বিস্মিত হয়। সবই রাধারানীর লীলার প্রকাশ।
জয় রাধারানী! জয় রাধারানী! গোঁসাই ছাড়া সংসারে যার আর কোনো দরদি নাই, তার বুকেই এমন ব্যথা বাজবে। তুলসীমালার প্রেমের কথা লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল।
কথা আরো আছে। মহান্তর সংসার আশ্রমের স্ত্রীর গর্ভেও কোনো সন্তান নেই। এই মুহূর্তে খুব নিকট স্বজন বলতেও কেউ নেই। আখড়ার সম্পত্তির পরিমাণ খুব ফেলনা নয়। তেত্রিশ বিঘা জমি আছে। তাতে ধান, পাট, আনাজ, সবজি সবই ফলে। আছে দুটো পুকুর, তাতে মাছের চাষ হয়। রাঢ়ের এসব জমি এখন সোনা ফলায়, প্রায় সব জমিই সেচের জল পায়। যারা আখড়ার আঙিনায় শামিয়ানার নিচে বসে গান গাইছে, তাদের কারো কারো মগজে যে এসব বৃত্তান্ত একেবারেই ঘোরাফেরা করছে না, এমন নয়।
দ্বিতীয় দিন দুপুরের পর থেকে মহান্তের শব দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছিল। এক গোছা ধুপকাঠি জ্বালিয়ে ঘরের চারধারে, শবের চারদিকে, এখানে-ওখানে পুঁতে দুর্গন্ধ আটকাবার বন্দোবস্ত করেছিল তুলসীমালা। কেন এমন দাবি করেছিল সে? মহান্ত তাকে যে গভীরভাবে ভালোবাসত, তাতে সন্দেহ নেই তার। আচমকা এই মৃত্যুটা তাকে একেবারে শোকস্তব্ধ করে দিলেও একদিন পরেই সে বুঝতে পেরেছিল, পারলে এই মহান্তই তাকে বাঁচাতে পারবে। তার বয়স এখনো তিরিশের নিচে, দেহে যৌবন আছে এবং সবাই জানে রূপও আছে।
তৃতীয় দিন রাত দশটার পর আঙিনার চাদোয়ার নিচ থেকে নতুন এক কণ্ঠের গান ভেসে এল। সে গান হলো- ‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি’- এই গান যে গাইছিল তার গলা তুলসীমালার ক্ষণে চেনা ক্ষণে অচেনা মনে হলো। কে এই সাধু যে এমন সময় মেপে গান গায়! পাঁচ বছর আগে যার সঙ্গে তাকে নিয়ে মহান্তর একবার বিরোধ হয়েছিল, সেই রাধামোহন দাস নয়! সেই তো মনে হচ্ছে! জয় নিতাই! জয় নিতাই! তুলসীমালা সজাগ থেকে অপেক্ষা করতে শুরু করল।
মাঝরাতে দরজায় ঠুকঠুক আঘাত হতে সে উঠে বসল।
‘কে?’
‘আমি-গো, তুলসীমালা। আমি রাধামোহন দাস। একবার দরজাটি খোল।’
‘কী ব্যাপার?’ দরজা খুলল তুলসীমালা।
বাইরের থেকে রাধামোহন বলল, ‘বড় তিয়াস লেগেছে। বাইরের টিউকলটার হাতল ভেঙে গেছে। এক ঘটি জল দেবে গো?’
এক ঘটি জল দিয়ে ফের দরজা বন্ধ করল তুলসীমালা।
বাইরের থেকে রাধামোহন দাস বলল, ‘গোঁসাইয়ের দেহ থেকে তো রাস ছেড়েছে গো তুলসীমালা; কত সময় এভাবে থাকবে?’
‘গোঁসাইয়ের দেহ এই ঘরের নিচেই সমাধি হবে সাধু। শুনেছি পঞ্চায়েত বলছে, সেটা হতে দেওয়া যাবে না। যদি সেই ব্যবস্থা করতে পার, তাহলে কাল সকালে দেখা কোরো জয় নিতাই!’
‘জয় রাধারানী, মানুষ মরলে মরেই যায়। বোষ্টমের মেয়ে তুমি, এসব জান না? সবই ইহকাল তুলসীমালা, পরকাল বলে কিছু নেই। আমার ঝোলার ভেতরে এক শিশি অগুরু আছে, দরজাটা খুলে সেটা তো অন্তত না-ও গো। চামের ছাউনির নিচে মনুষ্য দেহ পাখির খাঁচা। যতক্ষণ পাখি আছে, ততক্ষণ লীলাখেলা। পাখি ফুড়ৎ, বাস, আর কিছু নেই। ও দেহ তখন পচা কুমড়োর থেকেও ত্যাজ্য । কুমড়োর খোলে তবু একতারা বানাতে পারবে, আরও আরও কত তারের বাদ্যযন্ত্র হবে। কিন্তু মনুষ্য দেহ দিয়ে মরার পর আর কিছু হয় না গো, তুলসীমালা।’
তুলসীমালা তখন দরজা খুলল। বলল, ‘দাও অগুরু। কোথায় ছিলে এতদিন, গোঁসাই?’
রাধামোহন বলল, ‘দেশে দেশে ঘুরি, গান গাই। যেথায় গান, সেথায় আমি। তবে তোমাকে যে বলেছিলাম ফের আসব, তাই তো এলাম গো।’
কেঁদে ফেলল তুলসীমালা। বলল, ‘গোঁসাই বিনে আমি বাঁচব নাগো সাধু। গোঁসাইকে যে বড় ভালোবাসতাম!’
রাধামোহন বলল, ‘গোঁসাই থাকবেন এই ঘরের নিচে। পঞ্চায়েতের নরেনবাবুর সঙ্গে আমি কথা বলে এসেছি।’
‘আর আমি থাকব কোথায়?’
‘যেখেনে আছ, সেখেনেই থাকবে!’
‘আর তুমি?’
‘থাকব পড়ে একধারে, এতবড় আখড়া।’
পরদিন সকালে সব জোগাড়যন্তর হলে রাধামোহন বলল, ‘একবার ভেবে দেখ ফের, গোঁসাইকে ঘরের মেঝেতে রাখবে, না, আঙ্গনায় তুলসী মঞ্চের নিচে রাখবে?’
চতুর্থ দিনে দেবকী দাসের শবের দুর্গন্ধ আখড়ার গাছগুলোর ডালে শকুন বসিয়েছে।
তুলসীমালা বলল, ‘আঙ্গনায় সমাধি দাও।’
শবদেহকে স্নান করিয়ে তিলক সেবা করাল তুলসীমালা। মাথায় তুলসীপাতা দিয়ে তুলসী মঞ্চের নিচে দশ-বারো হাত গর্ত খুঁড়ে একটা থাক কেটে পা-ঝুলিয়ে বসানো হলো দেবকী দাসের দেহ। এক হাতে মালা, ভিক্ষাপাত্র অন্য হাতে। মাথার ওপর দেওয়া হলো কিলো পাঁচেক লবণ, তারপর মাটি দিয়ে দিল সবাই মিলে। রাধামোহন তুলসীমালাকে বলল, ‘জাতবৈষ্ণবের জীবনে এই পৃথিবীই সত্য, ইহলোকই সব। আর সত্য কৃষ্ণপ্রেম। হরেকৃষ্ণ!’
অভিজিৎ সেনের জন্ম অবিভক্ত বঙ্গের বরিশাল জেলার কেওড়া গ্রামে। পাঁচের দশকের একেবারে গোড়ায় আসেন কলকাতায়। কলকাতা, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া হয়ে পুনরায় কলকাতা, এইভাবে ঘুরে ঘুরে স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষ করেন। কলকাতায় উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে চাকরিও করতেন। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর হন। সেই সময়কার নকশালপন্থী বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে চাকরি, ঘর ও কলকাতা ত্যাগ করেন। থাকতেন বালুরঘাটে। পরে মালদহে। এখন কলকাতায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ‘রহু চণ্ডালের হাড়’, ‘অন্ধকারের নদী’, ‘ছায়ার পাখি’, ‘আঁধার মহিষ’, ‘ঝড়’, ‘বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর’, ‘হলুদ রঙের সূর্য’, ‘রাজপাট ধর্মপাট’, ‘এই সাতখানি উপন্যাস এবং দেবাংশী’, ‘ব্রাহ্মণ্য ও অন্যান্য গল্প’, ‘অভিজিৎ সেনের গল্প’, ‘দশটি গল্প’, ‘পঞ্চাশটি গল্প’, ‘কিশোর গল্প’ ইত্যাদি। নিউ ইয়র্কের FACET BOOKS INTERNATIONAL এবং দিল্লির ABHINAV PUBLICATIONS যৌথভাবে তাঁর ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ ‘Magic Bones’ প্রকাশ করেছে। পেয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার।
Related