খাঁচাটা তৈরি হল, অবশেষে। বালথাজার চালা থেকে ওটা ঝুলিয়ে দিল, অভ্যাসবশত। দুপুরের খাওয়া শেষ করতে-করতে সবাই বলতে লাগল, এটা দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর খাঁচা। এত লোক দেখতে এল যে, বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেল। ফলে বালথাজারকে খাঁচাটা নামিয়ে নিয়ে দোকান বন্ধ করতে হল।
বউ উরসুলা বলল, দাড়িটা কামাও। পাগলা পাদ্রির মত লাগছে।
দুপুরে খাওয়ার পর কেউ দাড়ি কাটে না।
দু-সপ্তাহের না-কামানো দাড়ি, ছোট ছোট, শক্ত, খরখরে। যেন খচ্চরের লোম। মুখটা দেখাচ্ছে ভয় পাওয়া ছোঁড়ার মত। ভাবটা মোটেই ঠিক নয়। ফেব্রুয়ারীতে ওর তিরিশ বছর পূর্ণ হল। চার বছর বিয়ে না করে, বাচ্চা পয়দা না করে উরসুলার সঙ্গে থেকেছে। জীবন ওকে সতর্ক থাকতে শিখিয়েছে বটে, সঙ্গে এটাও শিখিয়েছে যে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই খাঁচাটা, ও জানেই না যে, কিছু লোকের কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর খাঁচা। ছোটবেলা থেকে খাঁচা বানিয়ে-বানিয়ে এমনি সড়গড় হয়ে গেছে যে, এটা বানানো খুব শক্ত মনে হয়নি।
বউ বলল, তাহলে একটু ঘুমোও। তবে ওই দাড়ি নিয়ে লোকসমাজে বেরোতে পারবে না।
বিশ্রাম করতে-করতেও বারবার হ্যামক থেকে নেমে প্রতিবেশীদের খাঁচা দেখাতে হচ্ছিল। উরসুলা এতদিন এদিকে নজর দেয়নি। কারণ বালথাজার খাঁচা তৈরিতে এত মগ্ন ছিল যে, নিজের ছুতোরের কাজটায় একদম মন ছিল না। এটাতে উরসুলার খুব রাগ হত, বিরক্তি লাগত। দু-হপ্তা ভাল করে ঘুমোয়নি লোকটা। রাতে বিড়বিড় করত। সমানে এপাশ-ওপাশ করত। দাড়ি কামায়নি, বলা ভাল দাড়ি কাটার কথা ভাবেইনি। এখন তৈরি খাঁচাটা দেখে ওর রাগ গলে জল।
দিবানিদ্রা সেরে বালথাজার যখন উঠল ততক্ষণে ওর জামা-প্যান্ট ইসিত্মরি করে ফেলেছে উরসুলা। সেগুলো চেয়ারের ওপর রেখে খাঁচাটা টেবিলে তুলে চুপচাপ মন দিয়ে দেখতে লাগল।
এটার দাম কত নেবে?
জানি না। বালথাজারের জবাব। তিরিশ পেসো বলব ভেবেছি। যদি কুড়ি দেয়।
পঞ্চাশ পেসো চাও। গত দু-সপ্তাহে তুমি প্রচুর ঘুম নষ্ট করেছ। তার ওপর এটা বেশ বড়। জীবনে আমি যত খাঁচা দেখেছি এটা সেগুলোর চেয়েও অনেক বড়।
বালথাজার দাড়ি কামাতে শুরু করল।
তোমার কি মনে হয় ওরা আমাকে পঞ্চাশ পেসো দেবে?
হোসে মন্তিয়েলের কাছে এটা কোনো ব্যাপার নয়। আর খাঁচাটার দাম তাই হওয়া উচিত। উরসুলা বলল। তোমার ষাট পেসো চাওয়া উচিত।
বাড়িটা পড়েছিল দম বন্ধ করা ছায়ার মধ্যে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। গরম সাংঘাতিক। আর অহর্নিশ একঘেয়ে ঝিঁঝির ডাক। অসহ্য। জামাকাপড় পরে বালথাজার বারান্দার দিকের দরজা খুলল, যাতে হাওয়া আসে। ঘরটা ঠান্ডা হয়। দরজা খোলা পেয়ে একদল বাচ্চা ঘরে ঢুকে পড়ল।
খবর ছড়ায়। বুড়ো ডাক্তার অক্টাভিও জিরান্দো – জীবনে সুখী, পেশায় ক্লান্ত। জিরান্দো পঙ্গু স্ত্রীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে বসে বালথাজারের খাঁচার কথা ভাবছিলেন। ভেতরের বারান্দায় গরমের দিনে খাবার টেবিল পাতা হয়। সেখানে প্রচুর ফুলের টব আর দুটো ক্যানারি পাখির খাঁচা। ডাক্তারের বউ পাখি ভালবাসেন। এবং এতটাই ভালবাসেন যে, বেড়াল একদম দেখতে পারেন না। কারণ, বেড়াল পাখি খায়। বউয়ের কথা ভাবতে-ভাবতে ডাক্তার জিরান্দো রোগী দেখতে গেলেন। ফেরার পথে বালথাজারের বাড়ি, খাঁচাটা খুঁটিয়ে দেখতে।
বালথাজারের ঘরে প্রচুর লোক। খাঁচাটা খাবার টেবিলের ওপর। বিরাট খাঁচা। তারের গম্বুজ। তিনটে তলা। আসা-যাওয়ার রাসত্মা। খাওয়া আর ঘুমোনোর জন্য আলাদা-আলাদা ঘেরাটোপ। দোলনা। বিশাল বরফকলের মডেল যেন খাঁচাটা।
ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে খাঁচাটা দেখলেন। খাঁচাটার নাম যা ছড়িয়েছে তার থেকেও শতগুণে উৎকৃষ্ট আসল বস্ত্তটি। বউয়ের জন্য যে খাঁচার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না ডাক্তারবাবু, এটি তার চেয়েও অনেক, অনেক গুণে সুন্দর।
অপূর্ব! কী বানিয়েছে, অ্যাঁ! কল্পনার একেবারে চরম উৎকর্ষ! ডাক্তার মুগ্ধ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওকে খুঁজে পেলেন। মায়ের মত স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ, তারপর বললেন, তুমি একজন অসামান্য স্থপতি হতে পারতে।
ধন্যবাদ, লজ্জায় লাল হয়ে বলল বালথাজার।
অবশ্যই। বললেন ডাক্তার। ডাক্তারটি বেশ নাদুসনুদুস, মসৃণ ত্বক, যৌবন পার করা সুন্দরীদের মত। কণ্ঠস্বর লাতিন আওড়ানো পাদ্রির মত।
এমনকি এই খাঁচায় কোনো পাখি রাখারও দরকার নেই। নিলামে তোলার কায়দায় দর্শকদের দিকে খাঁচাটা ঘুরিয়ে বললেন ডাক্তার। গাছে ঝুলিয়ে দিলে এটা নিজেই গান গাইবে। টেবিলে আবার বসালেন খাঁচাটা, কিছু ভাবলেন, তারপর বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। আমিই এটা নেব।
এটা তো বিক্রি হয়ে গেছে। উরসুলার ভাষ্য।
বালথাজার জানাল, এটা মন্তিয়েলের ছেলের জন্য বানানো। ও অর্ডার দিয়েছিল।
ডাক্তার গম্ভীর, খাঁচার নকশা কি ও দিয়েছে?
না। বলল, একজোড়া ট্রুপিয়েল পাখির জন্য একটা বড় খাঁচা দরকার। যেমন এইটে।
কিন্তু এটা তো ট্রুপিয়েলের জন্য নয়।
অবিশ্যি এটা ট্রুপিয়েলের জন্য, ডাক্তারবাবু। টেবিলের দিকে এগোতে-এগোতে বালথাজার বলল। বাচ্চারা ওকে ঘিরে রয়েছে। মাপগুলো খুব যত্ন করে নিয়েছি। খাঁচার কামরাগুলোর দিকে দেখাল। আঙুলের গাঁট দিয়ে গম্বুজে আঘাত করে সুরেলা ঝনঝন আওয়াজ তুলল।
এর থেকে শক্ত তার আপনি পাবেন না। বাইরে-ভেতরে দুদিকেই ঝালাই করা।
খাঁচাটায় কাকাতুয়াও রাখা যাবে আরামসে, একটা বাচ্চা বলল।
ঠিক বলেছিস।
বেশ। কিন্তু মন্তিয়েল তোমাকে নকশা তো দেয়নি। এমনকি খুব খুঁটিয়ে বলেও দেয়নি ঠিক কী চাই। শুধু বলেছে ট্রুপিয়েল পাখির জন্য একটা খাঁচা চাই। ঠিক কিনা?
ঠিক।
তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। ট্রুপিয়েল পাখির জন্য যথেষ্ট বড় খাঁচা এক জিনিস আর এই খাঁচাটা অন্য জিনিস। কোনো প্রমাণ নেই যে, ওর অর্ডার দেওয়া খাঁচা এটাই।
না, এটাই সেটা। বালথাজার একটু হকচকিয়ে গেল। সেই জন্যই তো আমি এটা বানিয়েছি।
ডাক্তার অধৈর্যে মাথা ঝাঁকালেন।
উরসুলা স্বামীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি তো আর একটা বানাতে পার। ডাক্তারকে বলল, আর আপনারও কোনো তাড়া নেই।
আমি যে গিন্নিকে কথা দিয়েছি আজ বিকেলেই খাঁচা নিয়ে বাড়ি ফিরব।
ডাক্তারবাবু, আমার খুব খারাপ লাগছে, খুব দুঃখিত আমি। কিন্তু যে-জিনিস বিক্রি হয়েই গেছে তা আবার আমি বিক্রি করতে পারব না।
ডাক্তার, অগত্যা, কী আর করা যাবে, ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন। রুমাল দিয়ে ঘাড়-গলা মুছলেন। তারপর বন্দর ছেড়ে যাওয়া জাহাজের দিকে লোকে যেমন করুণ চোখে চেয়ে থাকে, সেই চোখে খাঁচাটাকে অনেকক্ষণ চেয়ে-চেয়ে দেখলেন।
ওরা কত দিল এটার জন্য?
বালথাজার উরসুলার চোখদুটো খুঁজল।
ষাট পেসো, উরসুলার জবাব।
ডাক্তার নির্নিমেষ খাঁচাটাকে দেখতে-দেখতে বললেন, খুব সুন্দর, খুব সুন্দর। সত্যিই অসাধারণ। দরজার দিকে যেতে-যেতে রুমালটা জোরে-জোরে নেড়ে হাওয়া খেতে-খেতে হাসলেন। বললেন, মন্তিয়েল বিরাট বড়লোক।
আসলে, সত্যি বলতে, হোসে মন্তিয়েলকে যতটা মনে হয়, ততটা ধনী সে নয়। তবে পয়সার জন্য ও সবকিছু করতে পারে। এই বাড়ির দু-তিনটে গলির পরেই ওর বাড়ি। বাড়িটা জিনিসপত্রে ঠাসা। এমন কোনো গন্ধও নেই সে-বাড়িতে, যা বেচা যাবে না। খাঁচার খবরটা শুনেও মন্তিয়েল নির্বিকার। তার বউ সারাদিন মৃত্যুচিন্তায় জর্জরিত। দুপুরে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘণ্টাদুয়েক ছায়ার দিকে চেয়ে শুয়ে রইল। হোসে মন্তিয়েল তখন দিবানিদ্রায় মগ্ন। অনেক কলরবে মন্তিয়েল অবাক হয়ে বসার ঘরের দরজা খুলল। বাড়ির সামনে রীতিমত ভিড়। মধ্যিখানে বালথাজার, খাঁচা হাতে। পরনে সাদা পোশাক, সদ্য কামানো দাড়ি – ঠিক যেমনটি সেজেগুজে গরিবরা বড়লোকের বাড়ি যায়।
ওঃ কী দারুণ! আবেগে মন্তিয়েল গিন্নি চেঁচিয়ে উঠল। এসো এসো ভেতরে এসো। আন্তরিকতার সঙ্গে বালথাজারকে নিয়ে গেল ভেতরে। আমি জীবনে এরকম অসাধারণ কিছু দেখিনি। দরজার কাছে জমা ভিড়টা দেখে বিরক্ত হয়ে যোগ করল, ওটা নিয়ে একদম ভেতরে চলে এস। বসার ঘরটা বাজার হয়ে গেল দেখছি।
বালথাজার হোসে মন্তিয়েলের বাড়িতে নতুন নয়। নানা উপলক্ষে, দক্ষতা আর অকপট স্বভাবের জন্য ছোটখাটো ছুতোরের কাজে সময়-সময় ওর ডাক পড়েছে। কিন্তু ও বড়লোকদের মধ্যে স্বচ্ছন্দবোধ করে না। প্রায়ই ও বড়লোকদের কথা ভাবে। তাদের কুৎসিত ঝগড়াটে বউদের কথা, ওদের ভয়ঙ্কর সব অস্ত্রোপচারের কথা – ওদের জন্য করুণা হয়। যখন কোনো বড়লোক বাড়িতে ঢোকে, তখন ওর হাঁটাটা আস্তে হয়ে যায়, পা টেনে-টেনে হাঁটে, নয়ত চলতে পারে না।
বালথাজার জিজ্ঞেস করল, পেপে বাড়ি আছে, খাঁচাটা টেবিলে রাখল।
মন্তিয়েল গিন্নি বলল, ও ইস্কুলে গেছে। তবে দেরি হবে না। আর কত্তা চান করছেন।
আসলে মন্তিয়েলের স্নান করার সময় নেই। বদলে দ্রুত শরীরে অ্যালকোহল ঘষছে। যাতে ব্যাপারটা কী ঘটছে তা দেখতে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরোতে পারে। এই গরমেও দুপুরে ফ্যান না চালিয়ে ঘুমোয়, যাতে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়েও বাড়ির নানা আওয়াজ, কোলাহল ইত্যাদির ওপর নজর রাখতে পারে।
ভেতর থেকে মন্তিয়েল চেঁচাল, আদিলেইদ, বলি হচ্ছেটা কী?
শিগগির এসে দ্যাখ কী চমৎকার জিনিস!
মোটা লোমশ হোসে মন্তিয়েল, কাঁধে তোয়ালে, শোয়ার ঘরের জানালা থেকে বলল, ওটা কী?
বালথাজার বলল, পেপের খাঁচা।
মন্তিয়েলের বউ চমকে গেল, কার?
পেপের। পেপে বানাতে দিয়েছিল।
সেই মুহূর্তে অবিশ্যি কিছুই হল না। শুধু বালথাজারের মনে হল কেউ বাথরুমের দরজাটা ওর মুখের ওপর খুলে দিল। কেবল অন্তর্বাসটুকু পরেই মন্তিয়েল শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
পেপে!! মন্তিয়েল গর্জন ছাড়ল।
ও ফেরেনি। ফিসফিস করে বলল পেপের মা।
তখনই পেপে ঢুকল। বারো বছরের কিশোর। মায়ের মত বাঁকানো ভুরু আর বিষণ্ণ চোখ।
এদিকে আয়। তুই এটা অর্ডার দিয়েছিস?
বাচ্চাটা মাথা নিচু করে রইল। চুলের মুঠি ধরে মাথাটা পেছনে বাঁকিয়ে চোখে চোখ রেখে মন্তিয়েল আবার হুঙ্কার ছাড়ল, জবাব দে।
জবাব না দিয়ে বাচ্চাটা ঠোঁট কামড়াতে লাগল।
মন্তিয়েল!!! ওর বউ ডুকরে উঠল। মন্তিয়েল ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। রাগী মুখে বালথাজারের দিকে ঘুরে বলল, আমি দুঃখিত। এটা বানানোর আগে আমার সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। একটা বাচ্চা ছেলের কথায় কাজ ধরে বসলি, এমনটা তোর পক্ষেই সম্ভব। বলতে-বলতে শান্ত হচ্ছিল, বাইরের হাসিখুশি ভাবটা ফিরে আসছিল।
খাঁচাটা টেবিল থেকে তুলে, সেটার দিকে দৃকপাতও না করে, বালথাজারকে দিয়ে দিল।
এক্ষুনি ওটা নিয়ে চলে যা। যাকে হোক বিক্রি করগে যা। দ্যাখ হাতজোড় করছি তক্কো করবি না, তক্কো করবি না। বালথাজারের পিঠে হালকা চাপড় মেরে বলল, ডাক্তার আমাকে রাগতে বারণ করেছে।
ছেলেটা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, নড়েনি। চোখের পাতাও পড়েনি। অপ্রস্ত্তত বালথাজার যেই-না খাঁচাটা হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়েছে, তখনি ওর গলা থেকে একটা ভয়ঙ্কর জান্তব আওয়াজ নির্গত হল, অনেকটা কুকুরের গর্জনের মত। পরক্ষণেই মাটিতে আছড়ে পড়ে চিৎকার করতে শুরু করল ছেলেটা।
ছেলের চিৎকারে পাত্তাই দিল না মন্তিয়েল। ওর মা শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। মন্তিয়েল বলল, অ্যাই ওকে একদম তুলবে না। মেঝেতে ঠুকে ঠুকে মাথাটা ফাটাক, তারপর সেখানে ভাল করে
নুন-লেবু ঘষে দাও, যাতে আরো চেঁচায়, আরো লাফায়। কত রাগ ওর শরীরে আছে দেখি। ছেলেটা সমানে চেঁচাচ্ছিল, ফোঁপাচ্ছিল। হাত দুটো ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে মা।
ছেড়ে দাও। ওকে ছেড়ে দাও। হোসে মন্তিয়েল ধমক লাগাল।
ছেলেটার আছাড়ি-পিছাড়ি দেখে বালথাজারের মনে হচ্ছিল যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় তীব্র কষ্ট পাওয়া জলাতঙ্ক আক্রান্ত কোনো পশু। প্রায় চারটে বাজে। এই সময়ে তার বাড়িতে, পেঁয়াজ কাটতে-কাটতে উরসুলা খুব পুরনো একটা গান গাইছে।
বালথাজার ডাকল, পেপে। জলভরা চোখে পেপে তাকাল, ফোঁপাতে-ফোঁপাতে। হাসিমুখে বালথাজার খাঁচাটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল। প্রথমে দ্বিধায়, অবিশ্বাসে, তারপর লাফিয়ে উঠে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরল খাঁচাটা। সেটা সাইজে প্রায় ওর মতই বড়। বুকের মধ্যে খাঁচাটা জাপটে তারের ফাঁকগুলোর মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে বালথাজারের দিকে তাকিয়ে রইল পেপে। এখন আর ওর চোখে জল নেই।
মন্তিয়েল নরম সুরেই বলল, বালথাজার, তোকে বললাম না খাঁচাটা নিয়ে যা! পেপের মাও বলল, ওটা নিয়ে যাও।
না, থাক। পেপেকে বলল, তুমি ওটা রেখে দাও। মন্তিয়েলকে বলল, এটা তো ওর জন্যই বানানো।
বোকার মত কথা বলিস না বালথাজার, খিঁচিয়ে উঠল মন্তিয়েল, তোর এই ফালতু মালের পেছনে খরচা করার পয়সা আমার নেই।
ঠিক আছে। ওটা কোনো ব্যাপারই না। পেপেকে উপহার দেওয়ার জন্যই এটা বানিয়েছি। এর জন্য পয়সা চাইছি না, আশাও করছি না।
বাড়ির সামনের কৌতূহলী ভিড়টার মধ্য দিয়ে বালথাজার যখন চলে যাচ্ছে তখনো মন্তিয়েল চেঁচিয়ে যাচ্ছে, চোখদুটো লাল, মুখ ফ্যাকাশে, বিবর্ণ।
অ্যাই মাথামোটা, ছাগল। তোর ওই গয়না এক্ষুনি নিয়ে যা। আমার বাড়িতে আমার কথার ওপর কথা? কভি নেহি। কুত্তার বাচ্চা কোথাকার!
পুকুরপাড়ের আড্ডাঘরে বালথাজার ঢুকতেই হাততালি দিয়ে অভিনন্দনের ঝড় বইল। এতক্ষণ ও ভাবছিল যে, একটা ভাল খাঁচা বানিয়েছে, যেটা আগের চেয়ে অনেক ভাল। যেটা মন্তিয়েলের ছেলের কান্না থামানোর জন্য দিয়ে দিয়েছে। যাকগে, যা হয়েছে ভালই হয়েছে। মোটের ওপর ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখানে এসে দেখল অনেকের কাছেই ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এবার একটু উত্তেজনা অনুভব করল।
তাহলে তোকে ওরা পঞ্চাশ পেসো দিলো।
ষাট।
ওঃ, কি দাঁও মেরেছিস ভাই। তুই-ই পারলি একমাত্র চিপ্পুস মন্তিয়েলের থেকে পয়সা বের করতে। এটা তো সেলিব্রেট করতেই হচ্ছে। বিয়ার আন, বিয়ার আন।
বালথাজারের জন্য বিয়ার এল। বদলে ও সববাইকে এক পাত্তর করে খাওয়াল। আর জীবনে প্রথম মদ খেতে গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই পুরো আউট। তখন নেশার ঘোরে বিরাট-বিরাট স্বপ্ন। কী? না, এক হাজার খাঁচা বানিয়ে ষাট পেসো করে একেকটা বিক্রি করবে। বাড়তে-বাড়তে সেটা হল লাখ-লাখ খাঁচা। বেচে ওর রোজগার হবে ষাট লাখ, ষাট কোটি। জড়ানো গলায় বলল, বড়লোকের বাচ্চাগুলো মরার আগে ওদেরকে অনেক-অনেক খাঁচা বেচতে হবে। সবকটা শালা রোগে পড়েছে, ধুঁকছে। মরবে, সবকটা মরবে। এমনই প্যাঁচে ওরা পড়েছে বাওয়া যে আর ভাল করে রাগ কত্তেও পারবে না।
জুকবাক্সে ঘণ্টাদুয়েক গান বাজল টানা, খরচা বালথাজারের। বালথাজারের স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, সৌভাগ্য আর বড়লোকদের মৃত্যু কামনা করে সববাই বেশ কয়েক পাত্তর টানল। তারপর যে-যার মত একে-একে কেটে পড়ল। আড্ডাঘরে পড়ে রইল একা বালথাজার।
ভাজা মাংসে পেঁয়াজ কুঁচো ছড়িয়ে উরসুলা একটা পদ রান্না করল। সন্ধ্যাবেলা কেউ একজন বলে গেল, ওর বর পুকুরপাড়ের আড্ডাঘরে, আনন্দে পাগল। সববাইকে মাল খাওয়াচ্ছে। উরসুলা বিশ্বাস করেনি। বালথাজার তো মদ খায় না। আটটা বেজে গেলে উরসুলার চিন্তা শুরু হল। অপেক্ষা করে-করে ক্লান্ত উরসুলা যখন মাঝরাতে ঘুমিয়ে পড়ল, বালথাজার তখন একটা আলোকিত ঘরে – যেখানে কয়েকটা টেবিল। প্রতিটি টেবিল ঘিরে চারটে চেয়ার। একটা নাচঘর। সেখানে তিতির পাখিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক বিছানায় দুটো মেয়ে নিয়ে বালথাজার, ওর মুখ রুজে রাঙানো। আসলে নেশায় চুরচুর, এক-পাও ফেলতে পারছে না। মদে এত খরচা করেছে যে, ঘড়িটাও বন্ধক রাখতে হয়েছে।
টলতে-টলতে বাড়ি ফেরার চেষ্টায় রাসত্মায় বেরোতেই হুড়মুড় করে উলটে পড়ল। পড়েই রইল হাত-পা ছড়িয়ে। উঠতে ইচ্ছা করল না। একসময় বুঝতে পারল যে, কেউ ওর জুতাটা খুলে নিচ্ছে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে সুখী, সুন্দর স্বপ্নটা ভাঙতে চাইছিল না বালথাজার। তাই ও কিছুই বলল না, নড়লও না।
ভোর পাঁচটার প্রার্থনায় যোগ দিতে যাওয়া মহিলারা ওর দিকে ফিরেও তাকাল না। ভাবল মরে গেছে।