| 29 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

কালো মাটির কালো পুতুল

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

বাঙলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক শঙ্খ ঘোষ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র পনেরো দিনের মাথায় লিখেছিলেন এই লেখাটি। বাংলাদেশের সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের তাৎপর্য ও অনিবার্যতাকে যে সংবেদনশীলতা এবং গভীরতার সঙ্গে তিনি অবলোকন করেছেন তা রীতিমত অসামান্য। গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাটি তখনই প্রকাশিত হয়েছিলো হুমায়ুন কবীর সম্পাদিত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায়। অতিসম্প্রতি লেখাটি শঙ্খ ঘোষের ‘অল্পস্বল্প কথা’ (জানুয়ারি ২০১৬) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি শঙ্খ ঘোষের শুভ জন্মতিথিতে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


জসীমউদ্দীন থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান পর্যন্ত কবিরা এখন কোথায়, এই মুুহূর্তে? ইয়াহিয়ার সৈন্যেরা না কি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইত্তেফাকের অফিস, ধ্বংস করেছে তার সাংবাদিক কর্মীদের। তাহলে আল মাহমুদ? কোথায় এখন তিনি? বোমায় বিধ্বস্ত রংপুর। কায়সুল হক? ঢাকার জসীমউদ্দীন রোডেও কি ঢুকেছিল ইয়াহিয়ার ট্যাঙ্ক? বাংলা দেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ পনেরো দিনের পুরোনো হলো, এর মধ্যে আমরা জেনেছি কীভাবে সামরিক অত্যাচার প্রথমেই ছুটে যাচ্ছে যে -কোনো বুদ্ধিজীবীর দিকে। ইয়াহিয়ার দল ঠিকই বুঝতে পারে যে এইখান থেকেই জেগে উঠেছে অবিশ্বাস্য এই মুক্তিবাসনার প্রথম আগুন। তাই কেবলই আজ জানতে ইচ্ছে করে বাংলা দেশের কবিরা এখন কে কোথায় আছে। তাঁরা কি সময়মতো পশ্চাৎপটে সরে এসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন করছেন কোনো? গ্রাম-গ্রামান্তরকে উদ্বোধিত করবার জন্য লিখছেন কোনো নতুন ধরনের কবিতা? প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে স্পেনের গৃহযুদ্ধে যেমন লিখেছিলেন রাফায়েল আলবের্তি আর তাঁর বন্ধুরা? আলবের্তির মতো এঁরাও কি এখন দেখতে পাচ্ছেন বা দেখতে চাইছেন সারি সারি গ্রামীণ যোদ্ধাদের স্তুপাকার মুখ, যে-মুখে অনেক জানার চিহ্ন নেই, যে-মুখে আছে কেবল বেঁচে থাকবার জন্যই মরবার প্রতিজ্ঞা?

না কি তাঁরা সকলেই এখন এক-একজন তরুণ লোর্কা? ফ্রাঙ্কোর দলবল কেন যে মেরেছিল লোর্কাকে, অনেকেরই কাছে তা স্পষ্ট নয়। এমন নয় যে তাঁর কবিতায় ছিল কোনো বিদ্রোহী রাজনৈতিক ঘোষণা, তাঁকে রাজনীতিক কবি বলার মানে নেই কোনো। তবে কি তাঁকে প্রাণ দিতে হলো শুধু এই জন্যে যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি পুরোপুরি স্পেনীয়, স্পেন দেশের বাইরে বাঁচবার কথা ভাবতে পারি না আমি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে চোখবাঁধা সংকীর্ণ কোনো জাতীয়তায় আমি ডুবে যেতে চাই।’ এই জন্যে? কিন্তু মানুষের পক্ষে এ তো এক স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে তার পরিবেশের সঙ্গে আমূল লিপ্ত রেখে পরিবেশের ঊর্ধ্বে তুলে নেওয়া নিজেকে, মাটির ভিতর দিকে শিকড় ছড়িয়ে দিয়ে ডালপালা মেলে দেওয়া হাওয়ায়, একই সঙ্গে এই দুই আপাতবিরোধী সত্যকে অর্জন করে নেওয়াই তো মানুষের চরিত্র। তাই বিশ্বতোমুখী হবার জন্যই লোর্কাকে খুঁজতে হয় স্পেন, আবহমান স্পেনের মানুষ, অতীতে-বর্তমানে জড়ানো এক স্পন্দমান জীবন। এ কোনো রাজনীতি নয়, এ হলো আত্ম-আবিষ্কারের সর্বকালীন মানবনীতি।

কিন্তু ফ্রাঙ্কো অথবা হিটলার অথবা ইয়াহিয়ার সামনে বড়ো প্রতিবন্ধকই হয়ে দাঁড়ায় এই মানবনীতি। তাই আজ ভয় হয় বাংলাদেশের সেই কবিদের জন্য, যাঁরা এতদিন অল্পে অল্পে খুলে দিতে চেয়েছিলেন মুক্তবুদ্ধির পথ। ভয় হয়, কেননা বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থানের মূলও হলো এই আইডেন্টিটির প্রশ্নে, দীর্ঘ পঁচিশ বছর যে-প্রশ্নকে সামনে রেখেছিলেন সে-দেশের কবিরা অথবা বুদ্ধিজীবিরা। এটা হয়তো ঠিক যে কৃষকসংকুল দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এখনও সম্পূর্ণ করে জাগোনো হয়নি এই বোধ, বাঙালি হিসেবে তাদের আত্মপরিচয়। কিন্তু এর সম্ভাবনা এতই বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ জুড়ে, যাকে মূল থেকে ধ্বংস করতে না পারলে ইয়াহিয়ার উপায় নেই কোনো। সৈন্যদের প্রথম লক্ষ্য তাই সেইসব মাথা, যে-মাথা থেকে আসা এই বিদ্রোহী ভাবনা ‘যাঁরা সতেরো বছর আগে ভেবেছিলেন ইসলাম আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বনিয়ন্তা হবে, তাঁদের স্বপ্ন আজ তাঁদের চোখের সামনেই ধুলিসাৎ হয়েছে’ (আবদুল গণি হাজারী, ১৩৭১) অথবা সরাসরি এই জিজ্ঞাসা: ‘আমাদের সংজ্ঞা কী? আমরা কারা? কাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার?’ এবং তার পর, প্রায় লোর্কার ধরনেই যেন, ‘আমরা পাকিস্তানী, আমরা পূর্ব পাকিস্তানী, আমরা মুসলমান, সবার উপরে আধুনিক মানুষ এবং সামগ্রিক অর্থে আমরা আধুনিক বিশ্বের বাসিন্দা’ (আবুল, ফজল, ১৩৭১) অথবা নিতান্তই সরল এই ঘোষণা, ‘এ দেশে বাঙালি সমাজ নামে একটা সমাজ সত্যি সত্যি আছে বহুকাল যাবৎ’ (আবদুল হক, ১৩৭৩)। বাংলাদেশের কবি আশরাফ সিদ্দিকী যখন এ সমাজকে এ দেশকে দেখেন এইভাবে–‘কলাহীন শিল্পহীন সাহিত্য সংগীতহীন যে জাতি, তাদের জীবনমৃত্যুর মতো–বিধাতার তারা এক মূর্ত অভিশাপ। আজ এই শরতের সোনাঝরা আলোকের মাঝখানে বসে ফুটন্ত পদ্মের মতো নীল আকাশের নীচে যেদিকে তাকাই মনে হয় গান আর কলা আর শিল্প আর সুরের এ দেশ!’
তখন তাঁর কাছে নিজের আর একটা বড়ো আধুনিক পরিচয় জেগে ওঠে। সেই পরিচয় থেকেই অল্পদিন আগে সাহস করে বলতে পেরেছিলেন তরুণ আল মাহমুদ, ‘কে জানে ধর্ম উঠে গিয়ে কবিতাই তার স্থান দখল করে কি না!’

না, শুধু ভয় নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই উদ্বেগময় মুহূর্তে বসে ওই কবিদের জন্য আজ গর্ববোধ হয়। কবিতার জন্য গর্ব। মনে হয় যেন দীর্ঘ পঁচিশ বছর জুড়ে গোটা দেশের সত্তাকেন্দ্রটিকে খুঁজে নেবার শপথ নিয়ে এইভাবে এগিয়েছিলেন ওঁরা। তাই সত্যি সত্যি অনেক সময়ে কবিতাই কি হয়ে ওঠে ওদেশের ধর্ম? তা যদি না হতো তবে কী ভাবে ওদেশের জনকর্মীরা এমন করে দেখতে পেলেন বাংলার মুখ? আমাদের এই রজনৈতিক ভ্রষ্টতার পরিবেশে কি কল্পনা করা যায় যে সমূহ এক জনউত্থানের সামনেও স্লোগান হয়ে উঠতে পারে জীবনানন্দের কবিতা? ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ এই লাইনের মায়ামমতা যে আমাদেরও কখনো স্পর্শ করেনি তা নয়, কিন্তু আমরা যেন ধরেই নিয়েছি এ হলো বানিয়ে তোলা এক জগৎ, কবিতার জগৎ, এর প্রভাব শুধু ছোটো এক পাঠকসম্প্রাদায়ের ওপর, এর সঙ্গে কখনোই যোগ হতে পারে না রাজনৈতিক জাগরণের। কবিতা যে আমাদেরও এখানে মিছিলে-নির্বাচনে কাজে লাগেনি কখনো তা নয়, সুকান্তের কোনো কোনো লাইন আজ দেয়াললিপির কল্যাণে অনেকেরই জানা। কিন্তু সে হলো বিশেষভাবেই বিদ্রোহের ঘোষণা, রাজনৈতিক উত্তেজনারই কাব্যরূপ। এ নিয়ে আমাদের কোনো বিস্ময় বা প্রশ্ন নেই। আমাদের বিস্ময় শুধু এই যে, ধ্বংসময় আক্রমণের মুহূর্তেও তবে ভালোবাসারই কথা উচ্চারণ করতে পারি আমরা? জানাতে পারি নিবিড় মায়াময়তা? অন্তত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা সেই সাহস ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাদের, নতুন করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে অল্প কথাই অনেক বড়ো কথা, নিচু গলাই অনেক জোরালো গলা, ভালোবাসতে পারাটাই সবচেয়ে বড়ো বিপ্লব।

এ নয় যে এই ভালোবাসা তাদের অস্ত্রধারণে বাধা দিয়েছে কোনো। এর দ্বারা তারা নির্বীর্য কোনো আত্মক্ষয়ে ডুবে গেছে এমন নয়। এরা শুধু আমাদের সামনে তুলে দিয়েছে সেই সাহস, যে-সাহসে বলা যায় যে লক্ষ্যকে কখনো আমি ভুলি না, তাকে সঙ্গে রাখি পাশে পাশে। আমাদের দেশের রাজনীতি তার নিজের লক্ষ্য থেকে কখন যে উচাটন হয়ে সরে যায় তা তার মনেও থাকে না, কখনোই তার মনে থাকে না বাংলার মুখ, হয়তো সে ভাবে যে একবার রাজনৈতিক অভীষ্ট সিদ্ধ হবার পর তখন দেখে নেওয়া যাবে সেই মুখখানি। সে জানতেও পারে না যে গোপনে গোপনে দিনে দিনে কেমন করে সে মুখ ক্ষইয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের রক্ত থেকে, দুস্তর বিচ্ছেদ ঘটে গেছে কবিতায় আর রাজনীতিতে।

রাজনীতি-মনস্কেরা অবশ্যই বলবেন যে এই বিচ্ছেদের দায়িত্ব হলো কবির। কবিরই অপরাধ, তিনিই সরে গেছেন তাঁর নিভৃত আপন গোত্রে, ঠিকভাবে তিনি গড়ে তোলেননি দেশের কবিতা। কিন্তু কাকে বলে দেশের কবিতা? কাকে বলে বিপ্লবের কবিতা? সে কি কেবল লড়াইয়ের উশকানি-জাগানো ফুসফুসের শক্তি পরীক্ষা? সে কি কেবল রাজনৈতিক ইশতেহারকে পদ্যে বাঁধার কৌশল? তা যদি হতো তাহলে কমিউনের ছেলেদের কাছে অল্প হেসে বলতে হতো না লেনিনকে, ‘মায়াকভস্কি? কিন্তু আমার মনে হয়ে পুশকিন আরো ভালো’। ক্রুপস্কায়া যে জানিয়েছেন সাইবেরিয়ার দিনগুলিতে লেনিন কবিতা পড়তে ভালোবাসতেন লের্মন্তফের, হাইনের–সেইসব ঠান্ডা, ভালোবাসার, ভালো লাগার কবিতা–এতে আমরা অবাক হই না। কেননা চারপাশ এই সুন্দর মুখশ্রীকে দেখতে পাবার জন্যই তো বিপ্লবের আয়োজন। তাই বিপ্লবের পথেও আমি ভুলতে পারি না সেই মুখশ্রীকে। না, এ কোনো নারীর মুখশ্রীর কথা নয়। কিন্তু নারীরও বটে। দেশের কবিতা লিখব ভেবে এই ভুলটাই আমাদের ঘটে যায় বারবার। আমরা একটা ধরাবাঁধা নকশার মধ্যে ঠেসে নিয়েছি দেশাত্মবোধের চেহারা। বলেই দেওয়া যায় যে এ কবিতায় বলা হবে, অত্যাচারী, ঢেরে হয়েছে, তোমার সীমাহীন লাঞ্ছনার অবসান হবে একদিন, সামনে আছে ভোর। কবিতায় লাল এই পূর্বদিগন্তের ছবি দেখতে পেলেই আমার মনে পড়ে যায় কী বলেছিলেন একবার এরেনবুর্গ। ভারি বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি, রুশদেশে কি তাহলে মেঘ করে না কখনো? বিপ্লবোত্তর যে-কোনো উপন্যাস খুললেই কেন তবে দেখতে পাই কেবলই টাটকা ঝকঝকে দিন, আকাশে ঝলমলে সূর্য? আর, উলটোভাবে চমকে গিয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভিয়েতনামি গেরিলাযোদ্ধার হাতে কবিতার বই দেখে ধারণা হয়েছিল তাঁর, কতই-না জ্বালাময় আগুন থাকবে ওর মধ্যে। তার বদলে মলাটে ছিল স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক ছবি, কবিতায় ছিল সহজ ভালোবাসার আবেগ!

সেই ভালোবাসারই কথা এতিদন ধরে বলেছেন বাংলাদেশে কবিরা। আমাদের চলতি অর্থে দেশপ্রেমের কবিতা যে তাঁরা লেখেননি তা নয়, কিন্তু সেইখানে এর সামর্থ্য নয়। এর সমস্ত মহিমা হলো দিনে দিনে গড়ে তোলা এক আত্মসন্ধানের ব্রতে। আজ এই মুহূর্তে বসে আমরা জানি না বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ আরো কত জটিল পথ বেয়ে তবে তার কাঙ্ক্ষিত পরিণামে পৌঁছবে, আরো কত মূল্য দিতে হবে তার মানুষকে, কিন্তু বিপ্লবের এই যে নিঃসন্ধিগ্ধ প্রথম মূর্তি জেগে উঠেছে দেশ ভরে, তার মস্ত প্রেরণাই ছিল এক আত্ম-আবিস্কারে, গোটা জাতির আইডেন্টিটির প্রশ্নে। আমাদের গর্ব, এ আত্মপরিচয়ের পথ তৈরি করছিল বাংলাদেশের কবিতা।

সীমান্তের প্রহরা ডিঙিয়ে যতটুকু বইকাগজ আমাদের হাতে পৌঁছয়, তার মধ্যে সবাই আমরা লক্ষ করেছি এইসব সন্ধান। আর তুলনা করে ভাবি, পদ্মার এপারে বসে সেই সন্ধানকে কতই অবজ্ঞা করেছি আমরা। একথা অবশ্য সত্যি যে ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক কারণে ওদের পক্ষে যত অনিবার্য ছিল এই প্রশ্নে ঝাঁপ দিয়ে পড়া, যত সরাসরি দেখা হয়েছিল ওদের শোষিত চেহারা, আমাদের পক্ষে ততটা নয়। মধ্যখানে হা-হা করা ব্যবধান নিয়ে ধর্মে ভর করে জেগে উঠল যে নতুন রাষ্ট্র, তার অধিবাসীদের পরিচয় কী? এ দেশ যদি নতুন, তবে নতুন দেশবাসীর সত্তা কী রকম? কী তার ঐতিহ্য, কী তার ভবিষ্যৎ? ঠিক, এই বুঝে নেবার চেষ্টা থেকে ওদেশে যত স্বাভাবিক ছিল অল্পে অল্পে রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্র করে ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র করে অবশেষে ভাষার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো, আমাদের পক্ষে তত নয়। কেননা আমাদের এই চিবিয়ে-ইংরেজি-বলা বুকনি-সর্বস্ব অঞ্চলে আমরা ভেবে নিয়েছিলাম যে স্বাধীনতার পর আমাদের জানা হয়ে গেছে ভারতীয়তা, যেন আর আত্ম-আবিস্কারের কোনো দায় নেই, যেন গত শতাব্দীতেই আমরা চুকিয়ে নিয়েছি সে সব বোঝাপড়া, যেন ‘ভারতীয়’ কথাটির সত্যি সত্যি কোনো তাৎপর্য আমাদের কাছে আছে। এমনও অনেকে আছেন যাঁরা মনে করেন ভারতীয় কোনো বাধ নিজের মধ্যে অনুভব করা মানেই এক সংকীর্ণ হীনতায় ডুবে যাওয়া, বিশ্বমানবতার পরিপন্থী এক আয়োজন। এই মুহূর্তে এঁদের কথা আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি কেবল তাঁদের কথা যাঁরা ধরে নিয়েছেন যে এ বোধ আমরা জন্মসূত্রেই পেয়ে আছি, জন্মসূত্রেই আমার মুখে আছে আমার ভাষা, যেন এ নিয়ে কোনো ভয় নেই আমার।

তাই ভাষাকে আমাদের নতুন করে ভালোবাসতে হয়নি কখনো। আর এইখানেই আছে সর্বনাশের বীজ। আমাদের কবিতাও বড়ো নির্লজ্জভাবে ধরে রেখেছে ভাষার প্রতি আমাদের এই সর্বনাশা ঔদাসীন্যের ছবি। যেমন এক দেশহীন দেশে আমাদের বসবাস, তেমনি এক নির্ভাষ ভাষায় আমাদের বাচালতা। যেমন আমাদের কাজেকর্মে পথচলতি জীবনের হাজার কোণে, তেমনি আমাদের শিল্পরচনায়–আমরা যেন ভুলে গেছি যে ভাষা হলো আমার সত্তার নিঃশ্বাস। তাই সহজেই আমাদের গলায় অথবা কলমে কেবলই চলে আসে অনুপলব্ধ মিথ্যা উচ্চারণ। ভাষাকে আমরা ভেবেছি কাজ চালাবার একটা উপায়মাত্র, মনে রাখিনি যে এই হলো এক সমগ্র আত্মপ্রকাশের বাহন। আমাদের আত্মার সঙ্গে আমাদের ভাষা আনন্দের তাপে যুক্ত হয় না আর!

অন্যদিকে, এই যোগেই আছে বাংলাদেশের কবিতার শক্তি। যুদ্ধজনিত আমাদের এই মথিত আসক্তির মুহূর্তেও আমি ভুলে যাচ্ছি না যে ভুল, দুর্বল, নিস্ফল কবিতাও অজস্র লেখা হয়েছে পদ্মার ওপারে, ভুলে যাচ্ছি না যে শিল্পবিচারের মহিমময় রচনা অল্পই আমরা পড়তে পেরেছি এই পঁচিশ বছরে। কিন্তু তবু, এই যে এক সরল সত্যের ওপর ভর করে দাঁড়াতে পেরেছেন ওদেশের কবিরা, এ থেকে বোঝা যায় যে তাঁরা পেয়ে গেছেন সূচনা। এই সূচনার আনন্দে প্রায় কিশোরের সারল্যে আল মাহমুদের মতো কবিদের বুক নড়ে উঠছে ‘জিয়ল মাছের ভরা বিশাল ভাণ্ডের মতো’, অথবা দেশপ্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে তাঁদের প্রিয়মুখ, স্তবের মতন বলে উঠছেন তাঁরা, ‘কালো মাটির কালো পুতুল তুমি আমার’! কালো মাটির এই কালো পুতুলেই তাঁরা আজ দেখেছেন তাঁদের বাংলার মুখ, এইখানে তাঁদের জয়!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত