সকালে যে খেতে দিতে আসে, তার মাথায় পাগড়ি। নীল রঙের। আকাশি নীল। দুপুরের লোকটা সাদা টুপি পরে। কিন্তু রাতে যে আসে, তাকে আমি দেখিনি। কোনওদিনই দেখিনি। শব্দ শুনতে পাই। টের পাই সে এসেছে। খাবার রাখল। চলে গেল। কিন্তু তখন আমার চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুম পায়। আমি আর তাকাই না।
আমার পাশে কে যেন কাঁদে। আশেপাশে অনেকেই। এইদিকে আমার পিঠ ঘেঁষে একটা বুড়ি। কেঁদেই চলে। একঘেয়ে। ঘ্যানঘেনে। আমি কান সরিয়ে নিই। ঘুঘুপাখির ডাক শুনতে ইচ্ছে করে। ডোবার পাশে সাত ভাই পাখির ঝগড়া। বাড়ির পাঁচিলের ওপর লাল্টুদের আমগাছের ডাল। একরাশ আমের মুকুল। চারদিকে মিষ্টি গন্ধ। ঝিম ধরে যায়। আমি ঝিমোই।
একটু আগে কে এসে ডাকল। কাকে ডাকল জানিনা। বোধহয় রাতুল ডাকল। ওর চিবুকটা একদম রাতুলের মতো। কিন্তু, ও রাতুল নয়। রাতুল তো এখানে থাকে না। ও অনেক দূরে একটা অনেক বড় বাড়িতে থাকে। সেই বাড়ির ছাদে বরফ পড়ে। রাতুল যে কে, ঠিক মনে পড়ছে না। রাতুল জানালার ধারে বসে দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করত। এখন সে বড়সড় কেউ। যে এসেছে, তাকেই জিগ্যেস করব? ওকে দেখে তো আমার রাতুলের কথাই মনে পড়ল। আর মনে পড়ল, রাতুল বলেছিল, আমি আর ওই দেশে ফিরব না। কোন দেশ বলেনি। নাকি বলেছিল?
এই ঘরের দেওয়াল ময়লা। স্যাঁতসেঁতে। আমার পিছনে বসে বুড়িটা কাশে। সারারাত কাশে। কাশে আর কাঁদে। আমার দিকে তাকিয়ে কীসব বলে। বিড়বিড় করে। আমি ওর কথা শুনি না। আমি মন দিয়ে কাঠ চেরার আওয়াজ শুনি। পাশের খোলা জমিতে রোদে বসে ইসমাইল কাঠ জড়ো করছে। খাটের অর্ডার আছে বলছিল। ওরা এখনও ডিজাইন দেখাল না। এই ঘরে কোনও খাট নেই। মেঝেতেই শুই। আমাকে বললে একটা খাট অন্তত বানিয়ে দিতে পারতাম। এখনও পারি।
কাঠের গুঁড়ো আর স্পিরিটের গন্ধ নাকে আসে। খুব জোরে নাক টানলে আরও গন্ধ। অন্য গন্ধ। সেগুলো বিশ্রি। ঝাঁঝালো। বমি পায়। আমি খুব আস্তে আস্তে নাক টানি। ধীরে ধীরে। কাঠের গোলায় কাঠ চেরার ঘসঘস। আর বার্নিশের গন্ধ। আমার চেনা গন্ধটা চেপে ধরে রাখি। আর কানের মধ্যে ভালবাসার ঘুঘুপাখির ডাক। এই দেওয়ালে আঁকাবাঁকা ফাটল। পিঁপড়ে দল বেঁধে এগোয়। দাদু বলেছিল, জেলের দেওয়ালে নখ দিয়ে লেখা যায়। কাঠকয়লার টুকরো, ভাঙা পেনসিল। আমার নখ নেই। পেন-পেনসিল কিছু না। এটা জেলখানা নয়। আমার বুড়ো আঙুলে কালির দাগ বসে গেছে। বাঁ হাত। ডান হাত। দুই হাতেই। কালির ছোপ লেগে যায়। রোজ গাদা গাদা কাগজে। ওরা কাগজ দেয়। আমি ছাপ দিই। এখানে ওখানে। বুড়িটা গজগজ করে। কেন? দাওয়ায় বিছোনো মায়ের সাধের শীতলপাটিতে কি দাগ দিয়েছি কখনও? ওর আঁচলেও তো হলুদের ছোপ। ওকেই বা খামোখা রোজ রোজ টিপছাপ দেব কেন?
দূরে ছাদের আলসেতে কে কাপড় মেলছে? খুব হাওয়া। ওর ভেজা এলোচুল ছুঁয়ে যায় কাঁঠাল গাছের ভারী পাতা। আমার নিঃশ্বাসে এখনও গুলের ধোঁয়ার গন্ধ। মাটির তোলা উনুন। মোমের মতো সাদা ধোঁয়া। নারকেলপাতার ঢিমে আঁচে ভাতের ফ্যান উথলে পড়ে।
কারা যেন রোজ জিগ্যেস করে। আমার বাবা, আমার মা, আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার দেশ, আমার ঠিকানা। কবে থেকে। কোথা থেকে। কখন থেকে। জানি না। ভুলে গেছি। তারপর বলে, কাগজ কই? আমার হাতদুটোতে একরাশ কাঠের গুঁড়ো মাখানো। এখনও কোনও কাগজ বানাইনি স্যার। শুনেছি কাঠ থেকেই কাগজ হয়। আমি বানাতে পারিনি। বিশ্বাস করুন। আমার হাতের তর্জনীর দুটো কড় আছে। ঠিক দুটো। কাঠ চেরাইয়ের যন্ত্রটা রয়েছে না? আমি অস্থির হাতে রোজ করাতের ধার পরখ করি। গত কয়েকদিন ধরে একটা বাঁকানো ইস্পাতের আংটা আমি পিছন দিকে টানতে চাইছি। প্রাণপণ চেষ্টা করছি রোজ। ওই আংটাটাকে একবার পিছন দিকে জোরে টানলেই কেল্লা ফতে।
অন্ধকার ঘর। চারদিক আঁকাবাঁকা। এবড়খেবড়ো। ভাঙাচোরা। একটা লোহার মাছি। কেবল সরে সরে যায়। তবু ওটাকেই নজর করি রোজ। একমনে। বুড়িটা ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদে। এক ঝটকায় থামাই। অনেক লোক পরপর। নীল পাগড়ি। সাদা টুপি। আর যে লোকগুলো ধূসর আলখাল্লাতে সব ঢেকে পা টিপে টিপে এসে আঙুলে কালি মাখিয়ে দিয়ে যায়। সেই লোকটাও। ওরা দল বেঁধে দাঁড়ায়। ওদের সবার দিকে তাকাই। লোহার মাছিটাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। আর ওই বাঁকানো ইস্পাতের আংটা। মাছিটার দিকে চোখ রেখে ওটা এক ঝটকায় একবার পিছন দিকে টানব। ব্যস। খেলা শেষ।
ওরা আর কেউ কোনও কাগজ দেখতে চাইবে না। সব হাপিস। কাগজ কালি সব।

জন্ম ’৭১, কলকাতা
বর্তমানে আজকাল প্রকাশনা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যাণ্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত।
১৯৯৮ সাল থেকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের এফ এম রেইনবো (১০৭ মেগাহার্তজ) ও এফ এম গোল্ড প্রচারতরঙ্গে বাংলা অনুষ্ঠান উপস্থাপক।
কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের ক্যাজুয়াল ভয়েস ওভার আর্টিস্ট।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কমিউনিটি রেডিওতে (JU ৯০.৮ মেগাহার্তজ) ‘এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক সাপ্তাহিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের নিয়মিত গবেষক ও উপস্থাপক।
২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ‘সানন্দা’ ও ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় ফ্রিলান্সার অ্যাডভার্টোরিয়াল কনটেন্ট লেখার নিয়মিত দায়িত্ব।
কর্মসূত্রে ‘আজকাল’, ‘আবার যুগান্তর’, ‘খবর ৩৬৫’ ও অন্যান্য বহু পত্র-পত্রিকায় ১৯৯৬ সাল থেকে ফিচার এবং কভারস্টোরি লেখার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা।
‘একদিন’ পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে ‘নারী-শিশু-বিনোদন-স্বাস্থ্য’ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজের সুযোগ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং ‘ফ্রেশ ওয়াটার ইকোলজি’ বিষয়ে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রি।
একমাত্র প্যাশন গল্প লেখা।
‘গাংচিল প্রকাশনা’ থেকে প্রথম গল্প সংকলন ‘অসমাপ্ত চিত্রনাট্য’; সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, এই সময়, একদিন, উনিশ-কুড়ি, প্রাত্যহিক খবর, তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায় প্রকাশিত।
পরবর্তী গল্পসংকলন
“প্রেমের বারোটা” রা প্রকাশন
“ব্রেক আপ চোদ্দ” রা প্রকাশন
প্রকাশিত উপন্যাস—“জলের দাগ” (রা প্রকাশন), “সুখপাখি”, “এবং ইশতেহার” (সংবিদ পাবলিকেশন)
কিশোর গল্প সংকলন – ‘পড়ার সময় নেই’ (সৃ প্রকাশন)
কিশোর উপন্যাস – ‘বিষচক্র’ (কারুবাসা প্রকাশনী) এবং ‘এক যে ছিল রু’ (কেতাবি প্রকাশন)
এছাড়াও গবেষণাঋদ্ধ বই ‘শান্তিনিকেতন’। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।
আরও একটি ফিচার-সংকলন ‘মলাটে দৈনিক’। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।