| 24 এপ্রিল 2024
Categories
নারী লোকসংস্কৃতি

বাংলার লোকসাহিত্যে নারী-পুরুষ বৈষম্য

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

মাধব দীপ

এই প্রবাদ–প্রবচনে নারী ও পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্য প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। যা’র বেশিরভাগ আবার বহাল তবিয়তে আজও রাজত্ব করছে। অন্যভাবে বলা যায়ণ্ড নারীকে পুরুষের অধ:স্তন অস্তিত্ব ধরেই এসব মৌখিক সাহিত্য বা কথ্যগাঁথা প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত সমানভাবে সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের প্রবাদের মাধ্যমে সৃষ্ট নারী–পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্য শক্তিশালী–বাস্তবতা হিসেবে এখনো জিইয়ে আছে।

বাঙলা প্রবাদ–প্রবচনকে বাদ দিলে বাঙালি সমাজকে পুরোটা কখনোই ধরা যাবে না। প্রবাদের আয়নাতেই একসময় ধরা পড়তো গ্রামবাংলার সামাজিক জীবন–যাপন। এর মধ্যেই সমাজকে দেখা যেতো। আজও সেকালের সমাজ কেমন ছিলো তা প্রবাদ ছাড়া বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। সমাজগঠনের কাল থেকেই মানবজীবনের অম্ল–মধুর সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে এই প্রবাদে। সাহিত্যরত্ন পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘ধর্মানুষ্ঠানের প্রধানতম ক্ষেত্রের নাম সমাজ। যেইখানে কতকগুলো নরনারী পরস্পরের মুখাপেক্ষী হইয়া বসবাস করেন সেইখানেই সমাজ গঠিত হয়।…সমাজের কতকগুলি অবশ্য প্রতিপাল্য অনুশাসন থাকে। লিখিত ও অলিখিতণ্ড এই অনুশাসনের দ্বিবিধ রূপ। লিখিত রূপ শাস্ত্রীয় বিধি–নিষেধ, আর পরস্পরের সম্মতিক্রমে অধিকাংশ মানুষের সুবিধার জন্য, মঙ্গলের জন্য যে প্রথা গড়িয়া উঠিয়াছে, অথচ যাহার লিখিত কোন দলিল নাই, তাহাই ইহার অলিখিত রূপ।’ সমাজের এই যে অলিখিত প্রথা বা অনুশাসনের কথা বলেছেন তিনিণ্ড প্রবাদ–প্রবচনের মতো লোকজ সাহিত্য–সংস্কৃতির মধ্যেই তা অনেকটা ধরা আছে।

কিন্তু কথা হচ্ছেণ্ড এই প্রবাদ–প্রবচনে নারী ও পুরুষের লৈঙ্গিক বৈষম্য প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। যা’র বেশিরভাগ আবার বহাল তবিয়তে আজও রাজত্ব করছে। অন্যভাবে বলা যায়ণ্ড নারীকে পুরষের অধ:স্তন অস্তিত্ব ধরেই এসব মৌখিক সাহিত্য বা কথ্যগাঁথা প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত সমানভাবে সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের প্রবাদের মাধ্যমে সৃষ্ট নারী–পুরষের লৈঙ্গিক বৈষম্য শক্তিশালী–বাস্তবতা হিসেবে এখনো জিইয়ে আছে। আবার আশ্চর্যজনক হলেও এটি সত্য যেণ্ড পুরুষতান্ত্রিক এই বাস্তবতা থেকে জগৎকে এভাবে দেখার ব্যাপরাটি সারা পৃথিবীতেই ব্যাপকভাবে জারি রয়েছে। এমনকি নারী নিজেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করেছে কোনোরকমের প্রশ্ন ছাড়াই। যেকারণেণ্ড নারীর নিজস্ব স্বর নির্মিত হতে হলে তাকে অনেক বেশি সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবারই এবং এখনো হচ্ছে।

পুত্র কামনায় সমাজের প্রাচীন মানসিকতার এমনই কিছু প্রমাণ পাই নিচের প্রবাদগুলোতে তথা লোকগাঁথাগুলোতে। যেসবে বলা হয়েছেণ্ড ‘সাত জন্মে পাপ করলি/ মেয়ে জন্মে তবে এলি’; ‘পুত্র সব সম্পদ/ কন্যা সব আপদ’; ‘ছেলেরা হীরের আংটি/ মেয়েরা মাটির কলসী’; ‘ছেলে বিয়োলে স্বর্গবাস/ মেয়ে বিয়োলে নরকবাস’; ‘মেয়ে হলে মুখ ঘোরায়/ ছেলে হলে শাঁখ বাজায়’; ‘পুরুষ করবে যা খুশি তাই/ বিধবার তাতে নাক গলাতে নাই’; ‘পুরুষের রাগে বাদশা/ নারীর রাগে বেইশ্যা’; ‘গাইয়ের বিটি, বউয়ের বেটা/ তবে জানবে কপাল গোটা’ ইত্যাদি। পুরুষের আধিপত্য বোঝাতে কিংবা মেয়ে সন্তান জন্ম হলে সেকালের সমাজ মায়ের প্রতি বিরূপ আচরণেরই নিদর্শন এসব প্রবাদে। খুব দুঃখ হয় যখন জানতে পারিণ্ড সহমরণ প্রথার সমর্থনে একসময় বলা হতোণ্ড ‘পতির মরণে সতীর মরণ’ বাক্যটি।

এমনকি নারীর পড়াশোনাকেও হেয় হিসেবে দেখে একে অর্থহীন ও অদরকারি হিসেবে ভাবা হয়েছে এই লোকগাঁথায়। যেমন বলা হচ্ছেণ্ড ‘ছেলে শিখবে লেখাপড়া/ মেয়ে শিখুক রান্নাবাড়া’; ‘মেয়ে যত পাশ দেবে/ মাথায় চড়ে তত বসবে’; ‘মেয়েরা যতই লেখাপড়া শিখুক/ খুন্তি তো নাড়তেই হবে’; ‘সময় কোথায়, মেয়ে শিখবে লেখাপড়া/ সারবে কে সংসারের কাজ আগাগোড়া’; ‘লেখাপড়া যে মেয়ে করে/ তাকে নিয়ে দুর্ভোগ সংসারে’; ‘স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী/ শিখলে লেখাপড়া হবে বাড়াবাড়ি’; ‘লেখাপড়া শিখলে/ বিধবা হবে অকালে’। তবে কোনো কোনো সমাজে নারীশিক্ষা নিয়ে ইতিবাচক কিছু প্রবাদও খেয়াল করার মতো। সমাজ পরিবর্তনে তথা নারীশিক্ষাকে এগিয়ে নিতে এসব বুলি বেশ ভূমিকা রেখেছেণ্ড এতে কোনো সন্দেই নেই। তেমনই কিছু প্রবাদের মধ্যে রয়েছেণ্ড ‘নারী শিক্ষা না এলে/ সমাজ পিছোয় পলে পলে’; ‘শিক্ষাই চোখ ফোটায়/ মেয়ে বলে কেন থাকবে পিছিয়ে তায়’।

তবে সমাজকে, সমাজের তাবৎ শক্তিকে পুরুষমুখী করতে আরও কিছু ভয়ঙ্কর বাস্তবতার প্রমাণ মেলে কিছু প্রবাদে। ‘পুত্র সুখের চিত্ত/ কন্যা দুঃখের চিত্র’; ‘পুত্র বলে বংশবাড়ে/ কন্যা যাবে পরের ঘরে’; ‘ছেলে হলো হীরের টুকরো/ মেয়ে হলো খুদকুঁড়ো’; ‘পুতের মুতে কড়ি/ মেয়ের গলায় দড়ি’; ‘খটমটিয়ে হাঁটে নারী, কটমটিয়ে চায়/ মাসেক খানেক ভিতর তার সিঁথির সিঁদুর যায়; ‘কথার দোষে কার্য নষ্ট, ভিক্ষায় নষ্ট মান/ গিন্নির দোষে গৃহ নষ্ট, লক্ষ্মী ছেড়ে যান’; ‘কলির বউ ঘরভাঙানি’; ‘পুরুষের বল টাকা/ নারীর বল শাঁখা’; ‘শাঁখা, শাড়ি, কেশণ্ড/ তিনে নারীর বেশ’; ‘গরুর মত বৌকে না মারলে/ হয় না সিধে কোন কালে’ ণ্ডএসব প্রবাদ এরই উদাহরণ।

প্রকৃতপক্ষে ণ্ড পৃথিবীতে পুরুষের প্রবল আবশ্যকতা সর্বাগ্রে বিবেচনা করার জন্য কিংবা কেবল ছেলেসন্তানের জন্ম ও তার পড়াশোনাকে সবার আগে স্বাগতম জানানোর নারী–পুরুষের মনের জমিনকে তৈরি করা হয়েছেণ্ড যেখানে স্পষ্টতই যথেষ্ট পরিমাণে মুক্তচিন্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা আর আজকের এই যুগেণ্ড এধরনের কথা কেবল ভুলই নয় বরং এধরনের মানসিকতা লালন করা মানে সমাজকে বহুকাল পিছিয়ে দেওয়ারই নামান্তর। সমাজে কন্যাসন্তানের প্রয়োজন যে কতোটা ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র সেকথা সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন। ‘সমাজে নারীর অস্তিত্ব না থাকলে আমরা তার যথার্থ মূল্য অনুধাবন করতে পারতাম।’ বহু আগেই এই মন্তব্য করে গেছেন তিনি।

বস্তুত: ‘শুধু রূপকথা নয়, পুরুষতান্ত্রিক– ক্ষমতা–ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে, আমাদের মৌখিক–কথকতার অন্যান্য ক্যাটাগরির লোককাহিনীগুলোর নারী–নির্মাণও আধিপত্যশীল–সমাজ–মূল্যবোধের নিরীখে ঘটেছে’ –লেখিকা–শিক্ষক সুস্মিতা চক্রবর্তীর এই কথায় সুর মিলিয়েই তাই বলতে চাইণ্ড সামাজিক অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, কুসংস্কার প্রভৃতি এই বাঙালি সমাজে যে কতোটা প্রবল ছিলো এই প্রবাদগুলো তারই উদাহরণ। এর মাধ্যমে নারী–পুরুষের ঐক্যের বদলে সামাজিক ও ব্যক্তিগত বিভেদই অনিবার্য করা হয়েছে সমাজে। কিন্তু এখনো কি সেই বৈষম্য আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছি? বুঝতে পারলেও মেনে চলছি কি?

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত