| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি সঙ্গীত

ধারাবাহিক: নানা রঙে বাংলার লোকগান (পর্ব-৪)। তপশ্রী পাল

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

ষাটের দশকের কথা। রাঙামাটির দেশ বর্ধমান জেলার শিল্প শহর আসানসোল এর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিলো ছোট্ট মেয়েটির বাস। সে এমন এক সময় যখন পাড়ায় বাঁদর কিংবা ভালুক নিয়ে খেলা দেখাতে আসতো মাদারীরাঝুড়িতে সাপ নিয়ে বীণ বাজিয়ে খেলা দেখাতে আসতো সাপুড়েকখনো শিব দুর্গা সেজে আসতো বহুরূপী আর ছোট্ট মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে দেখতে ভালোবাসতো এই সব খেলা। খেলা শেষ হলে ঠাকুমা দুটি পয়সা কিংবা চাল দিলে দৌড়ে দিয়ে আসতো সেই সব মানুষদেরতারা খুশী হয়ে চলে যেতো। এমনি একদিন দুর্গাপুজোর ঠিক আগেঠাকুমা বললেন “যাওদেখো উঠোনে কে এসেছে!”। দৌড়ে গেলো মেয়েটি। ও মাএমন পোশাক তো সে কোনদিন দেখেনিমানুষটির পরণে গেরুয়া আলখাল্লাএক পায়ে ঝুমুর বাঁধামাথায় বিরাট বড় গেরুয়া পাগড়িমুখে লম্বা দাড়িগোঁফ আর হাতে একতারা। পিঠের ঝোলা নামিয়ে রেখেছে পাশে। তার হাত ধরে আছে একটি মেয়ে। উঁচু করে খোঁপা করাকপালে চন্দন তিলক নাকের ওপর অবধিপরণে লালপেড়ে সাদা শাড়ি। মানুষটি অদ্ভুতভাবে একটু আগুপিছু হয়ে নেচে নেচে গান ধরলো

ও মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা

ও তুই বেছে বেছে করলি জামাইও তুই বেছে বেছে করলি জামাই

চিরকালের ল্যাংটা লো ল্যাংটা!

ও মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা!

বলেই একপাক ঘুরে নিয়ে ঝুমুর আর একতারায় সুর তুললো। সঙ্গের মেয়েটি খমক বাজাচ্ছেকোথায় তারসপ্তকে অনায়াসে উঠে যাচ্ছে গলাপ্রায় মিনিট পনেরো চললো সেই গান। ছোট্ট মেয়েটির মনে হলো এমন গান তো সে কোনদিন শোনেনি। এর মধ্যে কী অদ্ভুত মাদকতাগান শেষ হলে ঠাকুমা বেশ খানিকক্ষণ তাঁদের সঙ্গে গল্প করলেন। তাঁদের চালআলুপয়সা দিলেন। তাঁরা অনেক আশীর্বাদ করে চলে গেলো।

মেয়েটির কানে কিন্তু প্রতিনিয়ত বাজতে লাগলো সেই সুর “ও মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা!” শয়নে স্বপনে কানে বাজছে “ও মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা“ অবশেষে সে ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করলো কারা এই মানুষগুলোকোথা থেকে এসেছেনএই গানের মানে কীএইসব। ঠাকুমা বললেন এঁরা বাউলবীরভূমের বোলপুর থেকে এসেছেন। গান গেয়ে ভিক্ষে করেই এদের পেট চলে। এই গানটি হলো বিখ্যাত বাউলসম্রাট পূর্ণদাস বাউলের লেখা গানশিবদুর্গা ও দুর্গার মা মেনকার গল্পও বললেন ঠাকুমা। সেই গানের অভিঘাতসেই পূর্ণদাস বাউলের নাম আজও কানে ও মনে লেগে আছে মেয়েটির। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটিই আজকের আমি। আজকের নানারঙে বাংলার লোকগানের এই পর্ব বাউল গান নিয়ে।

বাউল কথাটির উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। পনেরোশো শতাব্দী থেকেই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যযেমন চৈতন্য ভাগবত ও চৈতন্য চরিতামৃতে বাউল শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেকে বলেন বাউল কথাটি ‘বাতুল’ মানে খেপা বা পাগল অথবা ‘ব্যাকুল’ মানে পরমেশ্বরকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের বোঝাত এবং সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে এসেছে। বর্তমান বাংলাদেশআসামের বরাক উপত্যকাপশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার ও ঝাড়খন্ডের একটি অংশ জুড়ে বাউলদের বসবাস। বাউলদের নানা গোষ্ঠী আছে। তার মধ্যে প্রধাণ হলো বৈষ্ণব সহজিয়া গোষ্ঠী এবং সুফীমুসলিম গোষ্ঠী। বাংলাদেশে ও বরাক উপত্যকায় প্রধাণত দ্বিতীয় গোষ্ঠীর বাউল দেখা যায়যাঁদের মধ্যে বিখ্যাততম হলেন লালন ফকিরশাহ আবদুল করিমভবা পাগলা ইত্যাদি। প্রথম গোষ্ঠীর বাউল দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের নদীয়াবর্ধমানবীরভূমবাঁকুড়া ও ছোটনাগপুর অঞ্চলে।

বাউলদের জীবনযাপন অনুযায়ী এদের প্রধাণতঃ দুভাগে ভাগ করা যায়। “তপস্বী” যারা সাধনার জন্য বাড়িঘর ও পরিবার পরিত্যাগ করেছেন । এঁরা শ্বেত বস্ত্র পরিধান করেন। এদের স্ত্রী পুত্র পরিবার থাকে নাকিন্তু সাধনার জন্য এক বা একাধিক সেবাদাসী রাখতে পারেন এঁরা। মূলতঃ ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে এঁরা জীবন নির্বাহ করেন।

অন্য দল মনে করেন গৃহী হয়েও বাউল সাধনা সম্ভব। এঁরা স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে থাকেন ও মূলতঃ গেরুয়া পরিধান করেন। এঁদের গান গেয়ে বা অন্যভাবে রোজগার করতে কোন বাধা নেই।

বাউল সাধনা বা তত্ত্বের মূল কথা হলো সাধনার দ্বারা পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলন এবং পরমেশ্বর প্রাপ্তি। পরমেশ্বর বাউলের মনের মানুষ। বাউলসাধনার একটি প্রধাণ অঙ্গ হলো দেহসাধনা। বাউলরা মনে করেন মানুষের দেহের মধ্যেই ঈশ্বর লুকিয়ে আছেন। দেহকে বুঝতে ও রিপুকে জয় করতে পারলেই পরমেশ্বর প্রাপ্তি।

বাউলরা মনে করেন পরমেশ্বরের কাছে পৌছনোর একমাত্র বাহন হলো গান। তাঁরা প্রধানতঃ মৌখিক ও তাৎক্ষণিক ভাবে গান রচনা করেন। গানগুলি কোথাও লেখা থাকে না। গুরু শিষ্যপরম্পরায় তা ছড়িয়ে পড়ে। শোনা যায় লালন ফকির তাঁর সব গানই এভাবে রচনা করেছিলেন যা তাঁর মৃত্যুর পরেই লিপিবদ্ধ হয়। বাউলগানে একদিকে যেমন বিভিন্ন দেবদেবীর কথা থাকেতেমনি থাকে গ্রাম্য জীবনের নানা ঘটনাপ্রেমঐতিহাসিক ঘটনাদেহতত্ত্ব বা নিজের দেহকে চেনা ও দেহের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা। বাউল গানের সঙ্গে একতারাদোতারাখমকঘুঙ্গুর ও বাঁশী ব্যবহার হয়। অনেক সময় এমন কিছু শব্দ ব্যবহার হয় যা আসলে ধাঁধার মতো বা সাংকেতিক। একমাত্র গুরুরাই পারেন এর অর্থ উদ্ধার করতে।

আমরা বলি বাউল গান বা বাউলাঙ্গ গান । কিন্তু সত্যি কি বাউল গান বলে কিছু হয়বাউল তো আসলে একধরণের সাধনা। বাউলরা গুহ্য বা গোপন সাধনা ও গানের মধ্য দিয়ে পরমেশ্বরকে খোঁজে । বাউল গানের ধরণ ও সুর প্রসঙ্গে তাই বলতে হয়আসলে বাউল গান যে অঞ্চলেরসে অঞ্চলের বাউল সেই সুরে গান গায় । তাই বাংলাদেশের বাউল ধরে ভাটিয়ালি সুরবীরভূমের বাউলের গানে ঝুমুরের সুর আবার নদীয়ার বাউলের গলায় কীর্তনের সুর।

বাউল গান বা বাউল সাধনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় লালন ফকির বা লালন সাঁঈয়ের বা লালন শাহ এর কথা। এ গানের এক আদি পুরুষ বাউল সাধক লালন ফকির বা লালন সাঈ । যদিও তিনি নিজের জীবন সম্বন্ধে কিছু বলে বা লিখে যাননিতবু কথিত আছে যে ১৭৭৪ সালে অবিভক্ত বাংলার হরিশপুরে তার জন্ম হয়। তার পিতার নাম কাজী দরীবুল্লাহ্ দেওয়ান ও মাতা আমিনা খাতুন। নদীয়া ও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কুষ্টিয়ায় ছিল তার আখড়া । তিনি শুধু সাধক ছিলেন নাছিলেন দার্শনিকসমাজ সংস্কারককবি ও সঙ্গীত রচয়িতা । ঈশ্বর ছিলেন লালনের মনের মানুষ । লালনের চিন্তা মিলে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর চিন্তার সঙ্গে । বিশ্বকবি শিলাইদহে থাকাকালীন দেখা করেছিলেন লালনের সঙ্গে । অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন তার দর্শন ও গানে । এখন শুনুন লালনের এমন একটি গানের কয়েকটি লাইন যেটি অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে”।

লালন কখনো নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান কোন জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেননি। লালন জাতি ধর্মের কোন ভেদাভেদ মানতেন না । তার শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোকই ছিলো। তৎকালীন সমাজে লালনের এই দৃষ্টি

ভঙ্গীর ফলে তাকে সমাজে একঘরে করা হয়েছিলো। কিন্তু তাতে লালন পিছু হটেননি। স্বপ্ন দেখতেন এক ভেদাভেদহীণ সমাজের । তাই তো সেই বিখ্যাত গান “লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে”।

লালন ফকিরের এই দর্শন ও আধ্যাত্মবাদের আকর্ষণে বহুদূর থেকে তার আখড়ায় ছুটে আসতেন মানুষজন। তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন। লালন ফকিরের গানের প্রভাব পড়ে দুই বঙ্গেই। ক্রমে একদিকে নদীয়ামুর্শিদাবাদ হয়ে দক্ষিণ বঙ্গের আউল বাউলের কন্ঠেঅন্যদিকে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ারাজশাহী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে লালনের গান। কথিত আছে রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিলো লালনের মনের মানুষ অর্থাৎ ঈশ্বর সন্ধান। তাই লালনের একটি গানে যদি থাকে সেই চিরন্তন প্রশ্নঅর্থাৎ কোথায় গেলে কীভাবে পাওয়া যায় মনের মানুষকেতবে রবীন্দ্রনাথ যেন তার একটি গানে তার উত্তর দিয়ে গেছেন।

লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি অচিন পাখি বলেছেনতার বাস। সেই অচিন পাখির সন্ধান মেলে পার্থিব দেহ সাধনার ভেতর দিয়ে দেহোত্তর জগতে পৌঁছানোর মাধ্যমে। আর এটাই বাউলতত্ত্বে নির্বাণ‘ বা মোক্ষ‘ বা মহামুক্তি‘ লাভ। লালনমানব আত্মাকে বিবেচনা করেছেন রহস্যময়অজানা এবং অস্পৃশ্য এক সত্তা রূপে। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি গানে তিনি মনের অভ্যন্তরের সত্তাকে তুলনা করেছেন এমন এক পাখির সাথেযা সহজেই খাঁচারূপী দেহের মাঝে আসা যাওয়া করে কিন্তু তবুও একে বন্দি করে রাখা যায় না। 

লালন ফকিরের জন্ম মুসলমান পরিবারে হলেও তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোন ধর্মই পালন করতেন না। সকল ধর্মের লোকের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিলো। কখনো তাকে বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে শোনা গেছেকখনো আবার সুফি সাধনার কথা উঠে এসেছে তাঁর গানে। লালন রচিত একটি বিখ্যাত সুফি গান “দিলদরিয়ার মাঝে রে ভাইআছে আজব কারখানা”

১৮৯০ সালে ১১৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর একমাত্র স্কেচটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর রচিত ২২৫ টি গানেই লালনের পরিচয় লুকিয়ে আছে। তিনি যেন গানে গানে বলে গেছেন “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। লালনের গানগুলির সুর কিন্তু বেশীরভাগই ভাটিয়ালি সুরকারণ বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলেই লালনের বসবাস ও আখড়া ছিলো।

লালনের পরেই বাউল গানের প্রসঙ্গে বলতে হয় শাহ আবদুল করিমের কথা। শাহ আবদুল করিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলা দেশের বিখ্যাত বাউল সাধকসঙ্গীত রচয়িতাসুরকারগায়ক ও সঙ্গীত শিক্ষক। ১৯১৬ থেকে ২০০৯ সাল ছিলো বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের জীবতকাল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রায় পাঁচশোটি বাউল গান রচনা করে গেছেন। সেই গানগুলির মধ্যে সমস্ত ধরণের বাউল ও সুফী সাধনার তত্ত্ব উঠে এসেছে। সেখানে আছে মানুষ ও সমাজের কথাঈশ্বর সাধনার কথাদেহতত্ত্বের গানসহজিয়া গান এবং সুফিয়ানা।

তাঁর একটি বিখ্যাত গানযাতে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির কথা উঠে এসেছে –

তাঁরই রচিত একটি মজার সহজিয়া গান –

সহজিয়া গান কীসহজিয়া গান হলো আমাদের প্রতিদিনের জীবন থেকে উঠে আসা গানযে গানে আমরা আমাদের দৈনন্দিন সুখদুঃখকোন ঘটনা অতি সহজ ভাষায় প্রকাশ করতে পারি। বাউল সাধনার একটি মূল কথা হলো এইভাবে সহজ করে অনেক চিরন্তন সুখ দুঃখের কথা তুলে আনাযা মানুষের মনে সহজেই নাড়া দেয় এবং সবাই বুঝতে পারে।

শাহ আবদুল করিমের জীবৎকালে তাঁর গান যত না বিখ্যাত হয়তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে বেশ কয়েকজন শিল্পী তাঁর গানগুলি নতুন ভাবে গেয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। গানগুলিকে যেন নতুন ভাবে চিনতে পারে মানুষ। সেই গানগুলি থেকে প্রাপ্ত অর্থ শেষ বয়সে তাঁর চিকিৎসার জন্য তাঁর হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছিলোযদিও গোটা জীবন তাকে দারিদ্রের মধ্যেই অতিবাহিত করতে হয়। শাহ আবদুল করিমের এই বিখ্যাত গানগুলি আমরা আজও মুখে মুখে শুনতে পাই। শ্রদ্ধেয় কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য শাহ আবদুল করিমের বিশেষ ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর অনেকগুলি গান তাঁর দল দোহারের সঙ্গে গাইতেন।

আসুন শুনে নেওয়া যাক তেমনই দু একটি বাউল গান –

শাহ আবদুল করিম গানগুলির সুরও কিন্তু মূলতঃ ভাটি অঞ্চলের অর্থাৎ ভাটিয়ালি। কখনো কখনোবিশেষতঃ তাঁর সুফি গানগুলিতে আরবী বা ইসলামী প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে দুই বঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই গান।

বাউল সাধনা ও বাউল গানের কথা বলতে গিয়ে এই সুফিয়ানার কথা বারবার আসবে। তাই সেই সম্পর্কে দু একটি কথাও না বললেই নয়। হিন্দুদের মধ্যে যেমন বাউল সাধনামুসলমানদের মধ্যে সুফি সাধনা বা সুফিয়ানা। দুটির তত্ত্বই কিন্তু এক। পরমেশ্বরকে লাভ। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। সুফীরা দাবি করে যেআত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করাএবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়ালাভ করা যায়। তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী আল্লাহপ্রাপ্তির সাধনাকে তরিকত‘ বলা হয়। বলা হয়তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন। সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। সুফিগণের মতে, মুহাম্মাদ স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। আসুন শুনে নিই বাউল সাধক হাসন রাজার একটি সুফি গান।

এবার পুর্ববঙ্গ থেকে চলে আসে এই বঙ্গে। এখানে মূলতঃ আউলবাউল দেখা যায় বীরভূমের লালমাটির দেশে এবং নদীয়ায়।

প্রথমে আসি নদীয়ার কথায়। শ্রীচৈতন্যদেবের সময় থেকে নদীয়ায় ছড়িয়ে পড়ে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব। গড়ে ওঠে অনেক আখড়া। সেখানে নাম সংকীর্তনভাব সংকীর্তন এবং শ্রীকৃষ্ণদেবের লীলা কীর্তন হতে থাকে ঘরে ঘরে। ঘরছাড়া বাউলেরাও প্রভাবিত হয় এই সঙ্গীতে। ক্রমে মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ার বাউলেরা গান গাইতে থাকেন কীর্তনের সুরে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় দ্বিজভূষণ রচিত এই বিশ্ববিখ্যাত গানটির কথা –

  • তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না

তোমায় হৃদয় মাঝে রাখবো ছেড়ে দেবো না

ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাবো না

না না নাছেড়ে দেবো না



সবশেষে চলে যাই বীরভূমের বাউল গানে। বাঁকুড়াবর্ধমানবীরভূমের একটি বড়ো অঞ্চল জুড়ে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে বাউল সাধনার আখড়া। এই অঞ্চল জুড়ে গৃহী ও ঘরছাড়া বাউলদের দেখা পাওয়া যায় পথে ঘাটে। তারা গান আহরণ করেছেন নানা জায়গা থেকে। তাই তাঁদের মুখে শাহ আবদুল করিমের দেহতত্ত্বের গান ‘চাঁদের গাঁয়ে চাঁদ লেগেছে’ ও যেমন শোনা যায়তেমনই শোনা যায় লালনের গান ‘ও মিলন হবে কতো দিনেআমার মনের মানুষের সনে” অথবা “কী মাছ ধরিবো বড়শি দিয়া ও গুরুজী”।

বাউলদের পরণে গেরুয়া বা সাদা আলখাল্লা অথবা বিভিন্ন চৌকো কাপড়ের প্যাঁচ বসানো জ্যাকেটমাথায় গেরুয়া পাগড়ী অথবা চুল চুড়ো করে বাঁধা। হাতে তাঁদের সেই চিরন্তন একতারা বা দোতারা। সামান্য কাত হয়ে নেচে নেচে গাইছেন জগতবিস্মৃত হয়ে। সঙ্গে বাউলানী খমক বাজাচ্ছেন। আজও পৌষমেলার সময় শান্তিনিকেতনে সারা রাত্রিব্যাপী বাউলগানের আসর বসে। সেখানে দূরদূরান্তর থেকে আসেন বাউলের দল।

বাউল সাধনা ও গানের কথা বলতে গিয়ে যেমন ঈশ্বর সাধনার কথামানুষ ও সমাজের কথাসহজিয়া গানসুফি গানের প্রসঙ্গ এসেছেতেমনই দেহতত্ত্ব ও দেহসাধনার কথা না বললে বাউল চর্চা সম্পূর্ণ হয় না। দেহসাধনা বাউল সাধনার এক বিশেষ অঙ্গ । দেহতাত্ত্বিক বাউল বলে আমাদের এই দেহ পঞ্চতত্ত্ব দিয়ে তৈরি । তারা বিশ্বাস করে এই দেহের মধ্যেই ঈশ্বর লুকিয়ে আছেনদেহকে জয় করতে পারলেই নির্বাণ । বাউলের মনে প্রশ্ন জাগে – আমাদের দেহের মধ্যে যে বাস করে সেই মন কি একজন না আসলে কয়েকজনকারণ আমাদের সবার যেমন একটা ভালো মন আছে –ভালবাসাদয়া মায়ায় ভরাতেমনি আবার একটা কুটিল মন আছে – যে হিংসা করেক্রোধ করেধ্বংস করে । আমরা কি জানি আমাদের মনের ঘরের খবরআমরা কি আয়ত্বে আনতে পারি আমাদের এই কয়েক রকম মনকেএই জটিল তত্ত্বকে কত সরল ভাষায় ধরেছে এই গান –

রাঢ় অঞ্চলের (বীরভূমবাঁকুড়াবর্ধমানবাউল গানের প্রসঙ্গে সবশেষে বলবো বিখ্যাত বাউল গায়ক ও শিল্পী পূর্ণদাস বাউল সম্পর্কে কিছু কথা ও শুনবো এই অঞ্চলের নিজের ঝুমুরের সুরে শিল্পীর কয়েকটি বিখ্যাত বাউল গান।

তখন কলকাতায় সবে রঙিন টেলিভিশন এসেছে এবং রঙিন সম্প্রচার চালু হবে কলকাতা দূরদর্শনের। সেই উপলক্ষ্যে বেশ বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন কলকাতা দূরদর্শন। অনেক বিখ্যাত গায়ক গায়িকাকবিলেখকশিল্পী এসেছেন স্টুডিওতে। আবার কোন কোন শিল্পীর বাড়িতে গিয়ে রেকর্ডিং করে আনা হয়েছে। এমনি একজন ছিলেন পূর্ণদাস বাউল। তাঁর তখন বয়স হয়েছে। নিজের বাড়িতে বসেই কথা বলেছিলেন এবং গান শুনিয়েছিলেন তিনি। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা খোলা চুলকপালে রসকলী কাটাচোখ দুটি যেন কোন খুশীর সন্ধান পেয়ে মদিরমুখে মিষ্টি হাসি লেগে আছে। কিছুদিন আগেই ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে গান শুনিয়ে এসেছেন তিনি। সেই গল্প করলেন। তারপর ধরলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান সুউচ্চ কন্ঠে “ও ভাই পিরিতি কাঁঠালের আঠা ——“ অদ্ভুত দমপ্রায় মিনিট দুয়েক আটকে রইলো গলা সেই উচ্চগ্রামে তারপর গাইলেন “ও ভাই পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে নাগোলেমালে গোলেমালে পীরিত কইরো না!” এবার উঠে দাঁড়িয়ে ভারী শরীরেই একটু নীচু হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলেন আর অদ্ভুত সুন্দর বোল তুললো তাঁর দোতরা ও খমকতিনি গাইছেন –

ওরে এক ব্রাহ্মণের ছেলে
ও সে তো এমনি খিটকেলে
অরে পীরিত করে ধোপার মেয়ের পা ধুয়ে খেলে
ও ভাই পা ধুয়ে খেলে

কী অদ্ভুত গানের কথাগুলিএর মধ্যে মিশে আছে বাংলার লোকায়ত নানা গল্প। যেমন এই কথাগুলি বলা হয়েছে বরু চন্ডিদাস ও রজকিনীর পরকীয়া প্রেম নিয়ে।

১৯৩৩ সালের ১৮ই মার্চবীরভূমের রামপুরহাটের কাছে একচাক্কা গ্রামে এক বৈষ্ণব সহজিয়া বাউল পরিবারে পূর্ণদাস বাউলের জন্ম হয়। পিতার নাম নবনীদাস বাউল। তিনিও বিখ্যাত বাউল সাধক ও গায়ক ছিলেন। সেই সময়ে শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলায়বড় বড় অনুষ্ঠানেএমনকি রেডিওতেও গান গেয়েছেন নবনীদাস। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় গায়ক ছিলেন। তাঁদের পরিবার ছিলো সাত পুরুষের বাউল সাধক পরিবার। মাত্র চার বছর বয়সে পূর্ণদাস বাউলতখন তাঁর নাম ছিলো পূর্ণচন্দ্র দাসএকটি যাত্রাপালায় গান ও অভিনয়ের ডাক পান। বিভিন্ন গ্রামে পালাগান করে বেড়ানোর সময় বিখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয় এবং তাঁদের সেই বন্ধুত্ব থেকেই তারাশঙ্কর তাঁর রাইকমল গল্পের উপকরণ পান।

১৯৪২ সালে তিনি আকাশবাণীতে গান গাওয়া শুরু করেন এবং কোন অডিশন ছাড়াই এ গ্রেড শিল্পী হিসাবে স্টেশন ডিরেকটরের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পান। তাঁর স্ত্রী মঞ্জুদাস বাউলও এক বাউল পরিবার থেকে আসেন এবং তিনিও বাউল ও লোকসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৬০ সাল থেকে প্রায় ২০০ টি রেডিও কনফারেন্সে গোটা দেশ ঘুরে গান করেন পূর্ণদাস বাউল। ভারত সরকারের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মিশনের অংশ হিসাবে ভারতীয় লোকগান ও বাউলগানের ধারাকে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য পূর্ণদাস বাউল মোট ১৪০ টি দেশে ঘুরে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

বিদেশে ভ্রমণকালে ইংলিশ ব্যান্ড রোলিং স্টোনের প্রধাণ গায়ক মিক জ্যাগারেরপূর্ণদাস বাউলের গান এতো ভালো লাগে যে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান। আমেরিকার বিখ্যাত রচয়িতা ও গায়ক বব ডিলান পূর্ণদাসের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেন যে তিনি নিজে আমেরিকার বাউল হতে চান এবং তাঁর এক ছাত্রীর সহযোগিতায় বাউল তত্ত্বের ও সাধনার ওপর ইংরাজীতে প্রথম গ্রন্থটি লেখেন। ১৯৬৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ পূর্ণদাস বাউলকে বাউলসম্রাট উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পান কে আর নারায়ণনের কাছ থেকে।

আসুন এ লেখা শেষ করা যাক ঝুমুরের সুরে পূর্ণদাস বাউলের গাওয়া সেই বিখ্যাত বাউল গান দিয়েযেটি দিয়ে এ লেখার সূচনা করেছিলাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত