| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি সঙ্গীত

ধারাবাহিক: নানা রঙে বাংলার লোকগান (পর্ব -২) । তপশ্রী পাল

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বাংলার লোকসঙ্গীতের একটি প্রধাণ ধারা “ঝুমুর”, “ঝুমাইর” বা “ঝুমরি” গান ও নাচ। এ হলো রাঙ্গামাটির দেশের গান। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর নিয়ে যে রাঢ়বঙ্গ সেখানকার মাটি রুক্ষ, শুষ্ক ও লাল! ঢেউ খেলানো টিলা পাহাড়ের কোলে, শাল, পিয়াল, শিমূল, পলাশ, মহুয়ার ছায়ায় সেখানে ধামসা মাদলের তালে তালে কোমর দুলিয়ে নেচে গেয়ে আনন্দ করে খেটে খাওয়া মানুষগুলো । এ গান তাদের হাসি কান্নার ঝুমুর গান । তবে রাঙ্গামাটির দেশ বলতে শুধুই যে পশ্চিমবঙ্গ তা তো নয়। তার ভৌগোলিক বিস্তার সংলগ্ন ঝাড়খন্ড, ওডিশার উত্তর পূর্ব প্রান্ত এমনকি ছত্তিসগড়ের পূর্বাংশেও। সংস্কৃতির ধারা এই পুরো অঞ্চল ঘিরেই। সংস্কৃতির সহজ আদানপ্রদানের মাধ্যমে ঝুমুর গান শোনা যায় এই গোটা অঞ্চলেই। এমনকি চা বাগানের শ্রমিকদের মাধ্যমে ঝুমুরের সুর ছড়িয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গ ও আসামেও। তবে সে অন্য গল্প।

প্রথমে দেখে নেওয়া যাক কতো প্রাচীন এই ঝুমুর গান আর কী বা তার উৎস। মানিকলাল সিংহ তাঁর পশ্চিম রাঢ় তথা বাঁকুড়া সংস্কৃতি গ্রন্থে লিখছেন—“ছোটনাগপুর মালভূমির কণ্ঠলগ্ন ধলভূম, সিংভূম, শবরভূম, বরাহভূম, শিখরভূম, তুঙ্গভূমের বাহুবেষ্টনীর মধ্যে দক্ষিণ রাঢ় আর সাঁওতাল পরগনার অঙ্কশায়ী উত্তর রাঢ় সুপ্রাচীন জনপদ।“ এই অঞ্চলে বাস করেন কুড়মি-মাহাতো, কুমার, রাজওয়াড়, ঘাটওয়াল, হাঁড়ি, মুচি সম্প্রদায় এবং ভূমিজ, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা জাতীয় আদিবাসীরা। এই গানগুলি ভাষার দিক থেকে উড়িয়া, বাংলা এবং বিভিন্ন স্থানীয় উপভাষা যেমন কুড়মালি, পাঁচপরগনিয়া, নাগপুরিয়া ইত্যাদি মিশিয়ে রচিত। এই অঞ্চলগুলি একটি আরেকটির সন্নিহিত হওয়ায় সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে এবং মিশে গেছে এক থেকে অন্য অঞ্চলে।

বৈষ্ণব সাহিত্যে, পদকল্পতরুর পদে রয়েছে,“যুবতী যুথ শত গায়ত ঝুমরী” অর্থাৎ শতেক যুবতী একসঙ্গে ঝুমুরী গাইছেন। ‘ঝুমরি’ বা ‘ঝুমরী’-র উল্লেখ পাওয়া যায় মহাপ্রভুর আবির্ভাবের আগে বিদ্যাপতির পদেও, যেমন “গওই সহি লোরি ঝুমরি সঅন-আরাধনে যাঞা” অথবা গোবিন্দদাসের পদে – “মদনমোহন হরি মাতল মনসিজ যুবতী যুথ গাওত ঝুমরী”। অতএব সেই সময় থেকে বা তারও আগে থেকে ঝুমুরের প্রচলন। অন্যদিকে, আশুতোষ ভট্টাচার্য এই গানকে সাঁওতাল জাতির গান বলে উল্লেখ করেছেন।

আচার্য সুকুমার সেনের মতে, ঝুমুর আসলে ছিল নাট-গীতের একটি ধারা। নাট-গীতি পালায় মূলত কোনও গদ্য সংলাপ ব্যবহৃত হয় না, সমস্তটাই গান ব্যবহার করে অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীন মৈথিলীতেও ঝুমুর শব্দের প্রচলন ছিল বলে সুকুমার সেন জানিয়েছেন। সংস্কৃতে এই গানের নাম ছিল জম্ভালিকা।

‘ঝুমুর’ শব্দের প্রকৃত অর্থ কী? এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই মানভূম তথা পুরুলিয়ারই বিশিষ্ট কবি ও প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী সলাবত মাহাত বলেছেন,- ‘ঝুমুর কথার অর্থ ঝুরে মরা। সুর ও সঙ্গীতের অন্তরের নিবেদনই ঝুমুরের মূল তাৎপর্য।’ আবার কেউ কেউ বলেন, নাচনির ঘুঙুরের ঝুমঝুম শব্দ থেকেই নাকি ঝুমুরের উৎপত্তি।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক: নানা রঙে বাংলার লোকগান(পর্ব -১)


ঝুমুর গান মানেই কিন্তু একরকম গান নয়। বহুরকম ঝুমুর গান ও নাচ হয়।

প্রাচীনকালে কৃষিক্ষেত্রেই প্রথম ঝুমুর গান শোনা যায়। ফসল কাটতে কাটতে মেয়েরা মুখে মুখে রচনা করে চার লাইনের ঝুমুর গাইতেন। উচ্চস্বরে গাওয়া এই ঝুমুরকে বলা হতো ঝুমুর হাক্কা (হাঁকা)। আর ছেলেরা গাইতেন টাঁইড় ঝুমুর (টাঁইড় বা টাঁড় মানে ঢেউ খেলানো জমি বা মাঠ), যা মাঠেই গাওয়া হতো। এই গানের পদগুলি অনেক সময় অশ্লীল হতো বলে বাড়িতে গাওয়া হতো না।

ঝুমুর গান দ্রুত লয়ে, সহজ কথা ও সুরে গাওয়া হতো বলে সহজেই স্থানীয় মানুষের ভালো লাগতো । এতে প্রতিদিনের প্রেম, সুখ, দুঃখ এবং সেখানকার মানুষের জীবনচর্যার কথা উঠে আসতো।

এরপর মধ্যযুগে নানা উৎসব ও উপলক্ষ্যে ঝুমুর গাওয়া শুরু হলো। গ্রামের বিভিন্ন পরব, যেমন করমটুসুভাদু এমনকি বিয়ে উপলক্ষ্যে ঝুমুর গাওয়া হতো। আদিবাসীরা তাদের পরবে ঝুমুর গাইতো তাদের মতো করে। অনেক বড়ো বড়ো দলে ঝুমুর গাওয়ার প্রচলন হলো।

শ্রীচৈতন্যের সময় যখন বৈষ্ণব ধর্ম ও সংস্কৃতি গোটা বঙ্গ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো, সেই সময় রাঢ়বঙ্গের উচ্চবর্ণের মানুষও ঝুমুর গাওয়া শুরু করেন। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা, বিরহ, মিলন এবং রামায়ণের নানা ঘটনা ঝুমুরের বিষয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সভায় ঝুমুর গান স্থান পায়। ঝুমুর গানে শৃঙ্গার রস আসে এই সময়েই। রাজা জমিদারদের সভায় গাওয়া এই গানকে বলা হতো দরবারী ঝুমুর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়। রাজা জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা চলে যাওয়ায় বিখ্যাত ঝুমুর পদকর্তাদের বেঁচে থাকা ও জীবনধারণ করা দুঃসহ হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেক ঝুমুরের দল ভেঙ্গে যায় এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়।

পরবর্তী যুগে ঝুমুর গানের সঙ্গে নাচের প্রচলন হয়। নানা লোকনৃত্য, যেমন ছৌ নাচ, কাঠি নাচ, বুলবুলি নাচ, নাচনি নাচ, দাসাই নাচে ঝুমুরের প্রয়োগ হতে থাকে। নাচনি হলো এখানকার এক মহিলা সম্প্রদায়, নাচই যাদের পেশা। তারা নাচের মধ্য দিয়েই জীবনের সুখ, দুঃখ ও প্রতিদিনের কথা তুলে ধরেন। এরা অনেকেই সেই সময় রাজা জমিদারদের রক্ষিতা হয়ে থাকতেন। তারা নাচনি ঝুমুরের প্রচলন ঘটান।

ঝুমুর গান ও নাচগুলি ঋতুভিত্তিকও হয়। শ্রাবণ মাসে ধান লাগানোর সময় পুরুলিয়ায় যে ঝুমুর গাওয়া হয় তাকে বলে “ধান লাগানিয়া ঝুমুর” বা “কবি গান”। ত্রিপদী ও পয়ার ছন্দে এই গান গাওয়া হয়। ভাদ্র মাসে করমা পরবের সময় যে ঝুমুর তাকে ভাদুরিয়া ঝুমুর বলে।

এই ভাদ্র মাসেই হয় ভাদু গান ও নাচ। ভাদু বা ভদ্রেশ্বরী ছিলো বাকুড়ার লাডা গ্রামের মুখিয়ার মেয়ে। কাশীপুরের রাজা নীলমণি সিংহ খবর পেলেন ভদ্রেশ্বরী লক্ষ্মীর প্রতিমূর্তি। রাজা ভাদুকে দত্তক নিলেন। রাজকুমারীর মত তাঁর ভরণপোষণ শিক্ষা চলতে লাগলো। সে গ্রামের সবার উন্নতির জন্য কাজ করতো তাই গ্রামের লোকেরা সবাই তাকে ভালোবাসতো। ক্রমে ভিনগ্রামের কবিরাজের ছেলে অঞ্জনের সঙ্গে তার প্রেম হয়। খবর পেয়ে রাজা অঞ্জনকে বন্দী করে রাখে। ভাদু পাগলের মতো গান গেয়ে অঞ্জনকে খুঁজে বেড়ায় ও খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনা নিয়ে গ্রামের মেয়েরা এখনো ভাদ্র মাসের প্রথম দিন ভাদুর মূর্তি গড়ে সারা মাস পুজো করে এবং ভাদ্রের শেষদিন মাথায় করে নিয়ে জলে বিসর্জন দেয়। সবাই মিলে ঝুমুরের সুরে ভাদু পরবের গান করে। একে বলে ভাদু ঝুমুর

আশ্বিন মাসে হয় ডাঁইর নাচের ঝুমুর। কার্তিক মাসে হয় অহিরা ঝুমুর নাচ, একে কাঠি নাচের ঝুমুরও বলে। অগ্রহায়ণ মাসে বুলবুলি নাচ, পৌষ মাসে ধান তোলার এবং পৌষ সংক্রান্তির দিন “টুসু ঝুমুর এবং টুসু বিসর্জনের ঝুমুর”। টুসু বা টুসুমণিও ভাদুর মতোই এই অঞ্চলের মানুষের ঘরের মেয়ে, যদিও তাকে এরা দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। এই টুসুও প্রেমের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলো। তাই টুসুকে স্মরণ করে মেয়েরা কামনা করে ভালো বর এবং সুন্দর সংসার। মেয়েরা হাঁটু জলে নেমে টুসুর প্রতিমা বিসর্জন দেয় আর ছেলেরা নানা ছলে মেয়েদের গায়ে জল ছেটায়, তাদের বিরক্ত করে। জমে ওঠে গ্রাম্য পরব।

মাঘ মাসে হয় নাচনি নাচ, ফাল্গুন মাসে বাঈ নাচে ঝুমুর পরিবেশিত হয়। চৈত্র মাসে শিবপুজো ও গাজনের সময় শরীরচর্চা ও ব্যায়ামের সঙ্গে ঝুমুর গান ও নাচ পরিবেশিত হয়। তাঁকে বলে শংকরী ঝুমুর

আবার এই অঞ্চলের এক বিখ্যাত লোকনৃত্য হলো ছৌ নাচ। বিভিন্ন পৌরানিক গল্প নিয়ে, মুখোশ পরে অথবা বিভিন্ন পশুপাখীর রূপ ধরে নাচেন শিল্পীরা। ছৌ নাচে যে ঝুমুর ব্যবহৃত হয় তাকে “ছৌ ঝুমুর” বলে।

এই ধরণের দু একটি ঝুমুর গানের কথা নীচে রইলো। এগুলি পড়লেই বোঝা যায় কীভাবে ঐ অঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনের সাধারণ জীবনচর্যার মধ্য থেকে উঠে এসেছে এই ঝুমুর গানগুলি।

১। ধান লাগানিয়া ঝুমুর বা কবি গানঃ (ত্রিপদী ছন্দে)

কড়চা তরকারীর জন্য মন ধরাধরি

তরকারীর বাঁটলো মাই তোরি

ছোটবাবুই ভাত খায় নাই বড়কি খনঞ্জরি

অর্থাৎ কড়চা বা মহুয়া ফলের তরকারীর জন্য সবার মন আনচান করছে। তরকারীর জন্য সব সব্জী কেটে রেখেছেন “মাই তোরি” মানে মেজবৌ। ছোটবাবুই এখনো ভাত খায়নি, তো বড়বাবুর স্বভাব তো আরো মুখরা!

অথবা পয়ার ছন্দেঃ

বঁধুর কাছে দুঃখের কথা কতো কান্দিয়া কান্দিয়া

লোদির জলে ঝাঁপ দিবো বুকে পাষাণ বাঁধিয়া

২। বিখ্যাত ঝুমুর শিল্পী গোবিন্দলাল মাহাতোর গাওয়া একটি ভাদোরিয়া ঝুমুর

এগো হাল চালাইলি

আরে আইর কডা লাইলি

বাইসামের কিসে দেরী গ

ও বাবুর মার বেলাটা জুড়ালি

আরে তাও কি সুনালি

কাণা শাগটা পুড়ালি

তুই কেমুন উসুনে গ

ও বাবুর মার সুখটা উড়ালি

শোনা যাক শিল্পীর গলায় গানটির ছোট্ট অংশঃ


৩। এবার শোনাই একটি ভাদু ঝুমুরের টুকরো আমার স্বকন্ঠে

ভাদু পরবের হাট লাইগলো রে

ও ভাদু সোহাগীরা সোহাগীরা সোহাগীরা

কেউ পরেছে নাকে নোলক কেউ বা কানে দুল গো

আমার ভাদুর গলে ফুলমালা কে পরিয়ে দিয়েছে

সোনার আলিস সোনার বালিস সোনার করবো বিছানা

মোদের ভাদু শুতে নারে গঞ্জনায় প্রাণ বাঁচে না

(কে পরিয়ে দিয়েছে)৩

তালতলাতে গড়া ভাদু তালপাতে কি জল কাটে

মোমের ছাতা তুলে ধর সোনার অঙ্গ যায় ভেসে

(কে পরিয়ে দিয়েছে)৩

তালতলাতে গিয়ে ভাদু তালের পিঠে গড়েছ

মোদের ভাদু হতভাগী টোকা নিয়ে দৌড়েছে

(কে পরিয়ে দিয়েছে)৩



৪। একটি টুসু গানের টুকরোঃ

টুসু আমার খায় না কিছু

শুকাইন গ্যালো চাঁদবদন

রাত হইলে জান ফুইরে দিবো

পান না গ টুসু ধন

বেলায় ওঠে ঝিকিমিকি

তবুও টুসু আসে না

আসো টুসু চেতন করো

আমায় জ্বালা দিও না



৫। নাচনী নাচের গানের টুকরোঃ

অহে নুনুর মা

ই বছর ফাগুন মাসে নুনুর বিহা দিব


৬। ছৌ ঝুমুর

ও রাধের মা

রাধে যেন জল ভইরতে যায় না

এই গানগুলিতে একজন মূল গায়েন থাকেন এবং তার সাথে থাকে দল, যারা পিছনে দোহার দেয়। গানে যন্ত্রও খুব প্রয়োজনীয়, বিশেষতঃ নাচের গানে। ঢোল, খোল, আড় বাঁশী, মাদল, হারমোনিয়ম, ঝুমুর(নূপুর), শিঙ্গা এবং সানাই ব্যবহার হয় গানের সঙ্গে। সাথে থাকে নাচ।

ঝুমুর গান যেমন মিশে আছে বিভিন্ন ঋতু এবং পরবের সঙ্গে তেমনই মিশে আছে নানা উপলক্ষ্যের সাথে। এই অঞ্চলে বিয়ের সময় গাওয়া হয় এমন একটি ঝুমুরঃ

৭। গেন্দাফুলের মালা গেঁথে পরাবো গলায়

তুমার সঙ্গে দেখা হবে সাঁঝেরই বেলায় বধূ

সাঁঝেরই বেলায়

বিয়ের ঝুমুরও এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে গাওয়া যায়।

আমরা আজকে যে লোকসঙ্গীতগুলিকে ঝুমুর বলে শুনি, সেগুলি অনেকখানি আধুনিক বা শহুরে হয়ে উঠেছে। তবে তার জন্ম এই অঞ্চলেই। শ্রদ্ধেয় শ্রীঅংশুমান রায় ছিলেন এমনি বিখ্যাত ঝুমুর গানের শিল্পী। তার গাওয়া একটি লোকগান যাকে ভাদোরিয়া গানই বলা যায়।

ভাদ্র মাস পড়ে গেছে, কিন্তু গ্রামের বধূটি বাপের বাড়ি থেকে এখনো ফেরেনি। তার বিরহে, তার সোহর গাইছে- শুনুন গানটির টুকরো আমার স্বকন্ঠেঃ

৮। ভাদর আশিন মাসে

ভমর বসে কাঁচা বাঁশে

আরো কি থাকিবে বাপের ঘরে গ

মন আমার কেমন কেমন করে

ও বধূ হে, আর না থাকিও বাপের ঘরেতে

এমনি আরো কটি ঝুমুর গান যা আজ শহরাঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচারিতঃ

  • ও তু লালপাহাড়ির দেশে যা, রাঙ্গামাটির দেশে যা, হেথাক তুকে মানাইছে নাই রে
  • ঝিঙ্গেফুলি সাঁঝেতে পেয়ে পথের মাঝেতে, তু কেনে কাদা দিলি সাদা কাপড়ে
  • পিন্ধারে পলাশের বন পলাবো পলাবো মন
  • বসন্ত বহিলো সখী কুকিলা ডাকিল রে, এমন সময় প্রিয়সখা বিদেশে রহিল রে

রাঢ়বঙ্গ এমন একটি অঞ্চল যাকে আজকে বলা হয় জঙ্গলমহল। এখানে মাটি রুক্ষ। ফসল ভালো হয় না। বেশীরভাগ একফসলি জমি। জলের প্রচন্ড অভাব। গ্রীষ্মকালে মাটি হয় ফুটিফাটা। তখন গ্রামের মানুষের দিন কাটে পিঁপড়ের ডিম, মহুয়ার মদ আর বড়জোর একবেলা ফ্যানা বা পান্তা খেয়ে। কিন্তু তাও জঙ্গলের এই মানুষগুলোর কালো শরীরে আলো ঠিকরোয়। যৌবনে তাদের স্বাস্থ্য হয় দেখার মতোই। বিশেষ করে পুরুলিয়া ঝাড়খন্ড বর্ডারের মানুষজনের। ব্রিটিশ আমলের কথা। আসামে নতুন চা বাগানগুলি চালানোর জন্য প্রচুর কুলি কামিনের প্রয়োজন। কিন্তু আসামের মানুষজন কাজ করতে চায় না চা বাগানে। আসামে ধান চালের ক্ষেতে ভালো ফসল হয়। জঙ্গলে পাওয়া যায় কাঠ। এই সব নানা কাজ ছেড়ে তারা চা বাগানে যেতে চায়না। বিপদ দেখে সাহেবদের চোখ পড়ে এই রাঢ়বঙ্গের ও বিহার বর্ডারের মানুষগুলোর ওপর। সাহেবরা ওদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই, দালাল পাঠিয়ে এই হতদরিদ্র সরল মানুষগুলোকে লোভ দেখায় যে চা বাগানে কাজ করলে তাদের অনেক পয়সা হবে। লোভে পড়ে দলে দলে মানুষ চা বাগানে কাজ করতে যায়। কিন্তু তারপর তাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করে সাহেবরা। কাজ না করলে পিঠে চাবুকের ঘা আর কাজ করলে পয়সা মিলতো না ঠিকমতো। মানুষগুলো বুঝলো কী বিপদে পড়েছে নিজের দেশ ছেড়ে এসে। কীভাবে ঠকেছে তারা। তেমন ঘটনা নিয়েই এই গান বাঁধা হয়েছিলো, কিন্তু সুরটি ঝুমুরের, কারণ তারা নিজেদের দেশের গান ভুলতে পারেনি। দেখুন কীভাবে আসামের পাহাড়ি সুরের সাথে মিশে গেছে ঝুমুরের সুর। তেমনই একটি গানের টুকরোঃ

৯। চল মিনি আসাম যাবি

দেশে বড় দুখ রে

আসাম দেশে গিয়ে মিনি

চা বাগান ভরি আয়

এবার চলে যাই সেই পশ্চিমবঙ্গের গা লাগোয়া ঝাড়খন্ড, বিহার অঞ্চলে। সেখানেও সেই ঝুমুরের সুর। কিন্তু ঝুমুরের কথায় অনেক হিন্দী দেহাতি কথার মিশ্রণ। “অ্যায়সান” “ভিগ গেলাই” “পানিয়া” এ সব শব্দ আসলে হিন্দীর অপভ্রংশ, কিন্তু মিশে গেছে ঝুমুর গানে।

১০। ছাতা ধর রে দ্যাওরা

অ্যায়সান সুন্দর সাড়ি আমার ভিগ গেলই না

রিমিঝিমি পানিয়া বরস গেলাই না

অ্যায়সান সুন্দর খোঁপা আমার ভিগ গেলাই না

সবশেষে আদিবাসী সাঁওতালী গানে ঝুমুরের ব্যবহার। বাংলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তার উপজাতি ও আদিবাসীরা । মহুল মদ খেয়ে ধামসা মাদলের তালে তালে সাঁওতালি মেয়েরা যখন খোপায় জবাফুল গুঁজে ঝুমুর গান গায়, সেই গান দুলিয়ে দেয়, ঢেউ তোলে আমাদের সবার মনে । শেষ করবো এমনি একটি সাঁওতালি গান দিয়ে। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল। অত্যন্ত রুক্ষ শুষ্ক । গ্রামের ছোট লদুয়া নদী যা এমনি সময় শুকনো থাকে, যা হেলায় পেরিয়ে যায় সাঁওতাল মেয়েরা, তাতে বাণ এসে গেছে হঠাত বৃষ্টিতে! হাঁটুজলে কাপড় ভিজে গেছে মেয়েদের। তাই নিয়েই গান। বেলা পড়ে এসেছে। শাল গাছের ছায়ায় সারি দিয়ে গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরছে সাঁওতাল মেয়েরা । শুনুন আমার স্বকন্ঠে গানের একটি অংশঃ

হে লদুয়ার লদিতে বাণ পড়িল দিদি

ও দিদি লিল লো লিল লো

সাল তলে বেলা ডুবিল

সাল তলে বেলা ডুবিল দিদি লিল লো

সাল তলে বেলা ডুবিল

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত