সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ লোকসংস্কৃতি সংখ্যার সম্পাদকীয়
সংস্কৃতি প্রবহমান নদীর মতো—এর রূপান্তর আছে, মৃত্যু নেই। মানুষের জীবনচর্চা ও চর্যার বৈচিত্র্যময় সমন্বিত রূপই সংস্কৃতি। সামাজিক মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি, ধারাবাহিক ঐতিহ্য, প্রজন্ম-পরম্পরা, আচার-বিশ্বাস, ভূয়োদর্শন, শিল্পবোধের নিদর্শন, মনন-রুচি, নীতি-নৈতিকতা; এসবই সংস্কৃতির মৌল উপকরণ। সংস্কৃতির পরিধি বিশাল ও ব্যাপক। তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা সংজ্ঞা-সূত্রে এর সীমা-চৌহদ্দি এঁকে দেওয়া চলে না। দেশ-কাল-ভাষা-ধর্মভেদে সংস্কৃতিও ভিন্ন ভিন্ন রূপ পায়। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলার সংস্কৃতিকে কেউ কেউ নগর-সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিম সংস্কৃতি—এই তিন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছেন।
পল্লী প্রধান বাঙ্গালি সংস্কৃতিই সাধারণ মানুষের মুখে মুখে , তাদের চিন্তায় ও কর্মে। ঐতিহ্যনুসারে বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্টীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান, জীবন-যাপন প্রণালী, শিল্প ও বিনোদন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সংস্কৃতিকে সহজ ভাষায় লোকসংস্কৃতি বলা হয়। আদিকাল থেকেই বাঙালীরা লোক সংস্কৃতি লালন করে আসছে। এই সংস্কৃতির মধ্যে থাকে সহজিয়া সুর৷ কোনো কৃত্রিমতা থাকে না।
গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্য, জীবনবোধের প্রকাশ৷ তাঁদের পোশাক, খাবার, প্রার্থনা, পূজা-পার্বণ, ফসল, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বাসস্থান, বাহন, জীবন সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব, বিরহ এ সবই লোকসংস্কৃতিকে রূপ দেয়৷ লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে তার সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে৷ লোকগানে, কবিতায়, সাহিত্যে, উৎসবে, খেলাধুলাতেও প্রকাশ পায় লোকসংস্কৃতি৷
আছে প্রবাদ-প্রবচন, খনার বচন, লোককথা৷ আছে প্রকৃতির কথা, ঋতুর কথা, ভালো-মন্দের কথা, জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় দিকের কথা৷ এ সবের সঙ্গে আছে বিজ্ঞানের সম্পর্ক, আছে যুক্তির সম্পর্কও৷ লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্তুগত, মানসজাত, অনুষ্ঠানমূলক ও প্রদর্শনমূলক৷
গ্রামীণ জনপদের লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে, তা বস্তুগত সংস্কৃতির উপাদান৷ যেমন বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র ইত্যাদি৷
মৌখিক ধারার লোকসাহিত্য মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত৷ লোককাহিনি, লোকসংগীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্য৷
ইরাবতীর সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ আজ সেজে ওঠেছে লোকসংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে। পাঠকের ভালো লাগলে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। বাঙালি লোকসংস্কৃতির ব্যাপ্তিকে এই ক্ষুদ্র পরিসরে ধরা অসম্ভব তবু আমাদের এই প্রয়াশ কেবল ইরাবতীর পাঠকদের জন্যে। পাঠকদের প্রতি রইলো অনিঃশেষ ভালোবাসা।
অলকানন্দা রায়
২২ আগষ্ট, ২০২১