lokosangit-irabotee-gitaranga-special

লোকসংস্কৃতির পাঠ ও অনুশীলন । ইন্দ্রজিৎ ঘোষ

Reading Time: 15 minutes

লোকসংস্কৃতির পাঠ ও অনুশীলনঃ—একটি জরুরি অনুসন্ধান 

 

“মনের মানুষ পাইবার আশে
ঘুইরা ফিরি দেশ-বিদেশে
কত মানুষ আইলো গেল
মনের মানুষ না মিলে ৷”
ভাটিয়ালির এই বিরহ ব্যথাতুর মন যেন লোকবিবেক কে সামনে আনে৷ এই লোকবিবেক যেন ঘুমিয়ে থাকে লোকমানসের পরম সৃষ্টি লোকসংস্কৃতির অন্তর মহলে৷

পৃথিবীর নানা দেশে লোাকসংস্কৃতি আজ শিক্ষানুশীন ও জ্ঞানচর্চার এক বিশিষ্ট বিষয়৷ স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে এর গ্রহণযোগ্যতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ মানববিদ্যার অন্তর্গত সত্য এই শাস্ত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখি৷ একটি শাস্ত্র পাঠের ক্ষেত্রে যে ধরণের বৈজ্ঞানিক নিয়মনিষ্ঠতা দরকার , যে ধরণের পাঠশৃঙ্খলা দরকার, লোকসংস্কৃতির পাঠ বা অনুশীলনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই-ই প্রয়োজন৷ এবং তা পৃথিবীর যে কোনো দেশের, যে কো’ন প্রান্তের লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ সভ্যতা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত যে কো’ন ধরণের চর্চা, লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও পরিণত জ্ঞান ছাড়া গড়ে উঠতে পারে না৷ ইতিহাস, সমাজ, দর্শন, এ সব কিছু সম্পর্কে সাধারণ ধারনাটুকু গড়ে তুলতে গেলেও কিন্তু লোকসংস্কৃতি সংক্রান্ত প্রাথমিক জ্ঞানের প্রয়োজন৷

লোকসংস্কৃতি আসলে সংস্কৃতিরই বিশিষ্ট রূপ৷ তাই সংস্কৃতিকে না বুঝে, না জেনে, লোকসংস্কৃতির চৌকাঠে পা রাখা যাবে না৷ এবং সংস্কৃতি-র বহুমাত্রিক অর্থ মাহাত্ম্য সম্পর্কে সচেতন না হ’য়ে, সে সম্পর্কে সহনশীল না হ’য়ে, নিতান্ত কো’ন রোম্যান্টিক আকর্ষণ থেকে লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে কথা বলা মানে, তালকালা লোককে সংগীত সমঝদার বানিয়ে দেওয়া ৷ সব কিছুর আগে তাই সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গ’ড়ে তোলা প্রয়োজন৷

সংস্কৃতি ও সভ্যতা, এই দুয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, ঘনিষ্ঠ এবং পরিপূরক৷ বেশীর ভাগ সময় আমরা এই দুটি শব্দকে একসঙ্গে এবং একার্থে প্রয়োগ করে থাকি৷ Anglo-French চিন্তাধারার দিকে তাকালে দেখ’ব , সেখানে সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে অভিন্ন রূপেই দেখার ও বোঝার বিশেষ প্রবণতা রয়েছে৷ আবার জার্মান চিন্তাধারায় সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে স্বতন্ত্র পাঠ ও অনুশীলন হিসাবে দেখা হয়ে থাকে৷ টায়নবি তাঁর “A study of History” গ্রন্থে সভ্যতার যে প্রকরণের কথা বলেছেন , সেখানে তিনি সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে পরস্পর নিবিড় এক বিষয় হিসাবেই দেখেছেন৷ সমাজতত্ত্ব অনুশীলন ও চর্চায় Alfred Weber সভ্যতা এবং সংস্কৃতির মধ্যে সর্বপ্রথম একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করেন৷ পরবর্তী কালে ম্যাকাইভার এবং পেজ আরও সূক্ষ্ম-গভীর ও বিস্তারিত ভাবে এই পার্থক্যকে একটা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট রূপ দিয়েছেন ৷ এক্ষেত্রে তাঁরা সরাসরি বোঝাতে চেয়েছেন যে, সভ্যতা মানুষের বাস্তব প্রয়োজন এবং চাহিদা পূরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক যুক্ত৷ মানুষ প্রতি মুহূর্তে চাহিদা অনুযায়ী জীবনযাপনকে আরও সুবিধাজনক , আরও আনন্দময় ও শান্তিপূর্ন ক’রে তুলতে চায় , আর এই বাস্তব প্রয়োজন মেটাতে মানুষকে নির্মাণ বা আবিষ্কার করতে হয় নানান বস্তুগত সামগ্রী ; গভীর অর্থে সভ্যতা এই সামগ্রীর-ই মিলিত রূপ৷ মানুষের নানা খাদ্যপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে , তার পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রসমূহ , এসবই সভ্যতার এক ও অভিন্ন , অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ চাহিদা বা প্রয়োজন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়৷ এ কারণে সভ্যতার গতি অত্যন্ত দ্রুত প্রবহমান এবং প্রসারণশীল ৷ সভ্যতা এমন এক মূর্ত ও চাহিদা সম্পন্ন শক্তি যা মানুষকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে৷ মানুষ তার জীবনযাপনের স্বাভাবিক প্রয়োজনেই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে৷

আমরা খুব সাধারণ বুদ্ধিতেই বলতে পারি, গরুর গাড়ির তুলনায় ঘোড়ায় টানা গাড়ি অনেক বেশী দ্রাতগামী এবং সাধারণ ট্রেনের থেকে বুলেট ট্রেন অনেক অনেক গতিশীল ৷ এগুলি সবই সভ্যতার দৃষ্টান্ত এবং এই সব দৃষ্টান্তের ব্যবহারিক চরিত্রই বুঝিয়ে দিচ্ছে, সভ্যতাকে স্পষ্টভাবে পরিমাপ করা সম্ভব ৷ এবং এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই ৷ কিন্তু এখন যদি বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ কবি হিসাবে কালিদাসের তুলনায় কম রোম্যান্টিক , কিংবা শেক্সপিয়রের থেকেও ব্রেখট্ অনেক বড় নাট্যকার , তাহলে সন্দেহ এবং বিতর্কের অবকাশ কিন্তু থেকেই যাবে৷ বিতর্ক বাড়বে , তবু কমবে না৷ এর কারণ সভ্যতার ম’ত সংস্কৃতি পরিমাপ যোগ্য নয় , কো’ন বস্তুনিষ্ঠ মানদন্ডের দ্বারাই সংস্কৃতিকে পরিমাপ করা সম্ভব নয়৷ সংস্কৃতিকে পরিমাপ করার ম’ত কো’ন মানদন্ডই নেই এবং তা থাকার কথাও নয় , থাকা সম্ভবও নয়৷

আমরা প্রতিদিন খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছি , প্রযুক্তির চেহারা , চরিত্র ও আচার,কী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বদলে যাচ্ছে ৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের হাতের মোবাইল ফোনটি কী সাংঘাতিক দ্রুততায় প্রযুক্তিগত ভাবে বদলে যাচ্ছে তা আমরা টের পাচ্ছি ৷ এ থেকে অমরা বুঝতে পারছি সভ্যতা সর্বদাই প্রগতিশীল ৷ নিজের যে পূর্ব চিহ্নকে সভ্যতা অতীত হিসাবে ফেলে এসেছে তার দিকে ফিরে তাকাবার ইচ্ছা, প্রয়োজন বা রুচি কোনটাই বর্তমান সভ্যতার নেই ৷ নিজেকে আরও বদলের মধ্যে দিয়ে আরও উন্নতশীল স্তরে পৌঁছে যাওয়াই তার লক্ষ্য ৷ তাই পিছন ফিরে তাকাবার সময় তার নেই ! সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু একথা কো’ন ভাবেই বলতে পারি না ৷ একথা বলা খুব কঠিন যে , রামপ্রসাদী সংগীতের প্রয়োজন আজ ফুরিয়েছে , কিংবা বলতে পারি না , কবীর সুমন নিধুবাবার থেকেও বড় মাপের শিল্পী ৷ বলতে পারি না যে , মঙ্গলকাব্যগুলির সাহিত্যিক আবেদন আজ আর অত গ্রহণযোগ্য নয় ৷ এ সব বলতে পারি না এ জন্যই যে , সভ্যতার ম’ত সংস্কৃতি উন্নতি বা অবনতির পরিমাপ্যতায় বিচার্য নয় ৷ আবার সভ্যতা হস্তান্তরিত হয় অতি সহজেই , কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা হয় না ৷ তাই জাপানে তৈরি টি.ভি পৃথিবীর যে কো’ন দেশেই কার্যকরী হ’য়ে যায় কিন্তু তাই ব’লে শেক্সপিয়রের “কিং লিয়র” বা “ওথেলো”কে হুবহু টেক্সট থেকে তুলে বঙ্গরঙ্গ মঞ্চে মঞ্চস্থ করা সম্ভব হয় না৷ এক্ষেত্রে দেশ-কালের মাত্রাগত পরিপ্রেক্ষিত কে মাথায় রেখে রূপান্তর বা বিনির্মাণের পথে হাঁটতে হয়৷ তাই বলা যায় , সভ্যতা পরিবর্তন ছাড়া গ্রহণ যোগ্য হলেও সংস্কৃতির চরিত্র কিন্তু মোটেই তা নয় ৷ এক দেশের সাংস্কৃতিক নির্মাণকে তাই অন্যদেশে বিনির্মাণ বা অবিনির্মাণের হাত ধরে গ্রহণযোগ্য হ’য়ে উঠতে হয় ৷

L . H . Morgan তাঁর “Ancient Society” গ্রন্থে মানবসভ্যতা এবং সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ধারাকে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কয়েকটি স্তরবিন্যাসের কল্পনা করেছেন৷ এই সব স্তরের বেশ কিছু উপস্তরের কথাও তিনি বলেছেন ৷ আদিম বন্যজীবন দিয়ে সভ্যতার যে স্তর শুরু হয়েছিলো তা ক্রমান্বয়ে অন্যস্তরের দিকে যাত্রা করেছে ৷ বন্য অবস্থাতে মানুষ যেমন তার নিত্য প্রয়োজনের জন্য শিকারের অস্ত্র বানিয়েছে , তেমনিই অবার ভৌতিক আধিভৌতিক নানা ধারণারও জন্ম দিয়েছে ৷ জাদু , দেবতা কিংবা আত্মার ধারণাতে মানুষ পৌঁছেছে এক বাস্তব ও মানসিক অভিব্যক্তির সূত্রেই ৷ আদিম বন্য জীবনেরই এক অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তরে মানুষ পশুচারণের পাশাপাশি কৃষি সভ্যতার জন্ম দিল ৷ সেই সঙ্গে স্থায়ী বসবাসের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করল ৷ অতএব, মানব সভ্যতা আদিম স্তর থেকে আদিবাসী স্তরে উন্নীত হ’ল ৷ বস্তুসংস্কৃতির বিবর্তন ঘটতে থাকল নিজস্ব নিয়মে ৷ এরপর ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব মানুষের সামাজিক জীবনকে নানা স্তরান্তরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল ৷ শ্রেণিবিভাজনের পাশাপাশি ভূমিব্যবস্থা এবং সম্পত্তির অধিকার সমাজ চরিত্রে যে বিন্যাসগত বদল আনল তার প্রভাব কিন্তু সমাজের নির্দিষ্ট কো’ন অংশে সীমাবদ্ধ রইল না , তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল সমাজের নানা দিকে ৷ আদিম সংস্কৃতির স্তর থেকে গ্রামীণ সংস্কৃতির স্তর এবং সেখান থেকে নাগরিক সংস্কৃতির স্তরে উন্নীত হওয়ার যে দীর্ঘ যাত্রা পথ তা আসলে এক দ্বান্দ্বিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ৷ এ কারণে একদিকে আদিম সংস্কৃতি এবং অন্যদিকে নাগরিক উচ্চসংস্কৃতি , এরই মাঝখানে অবস্থান করছে আদিবাসী সংস্কৃতি ৷ আদিম সংস্কৃতির নানাপ্রকার উপাদান নিয়েই গড়ে উঠেছে আদিবাসী সংস্কৃতি ৷ পাশাপাশি নিজস্ব চলনের সূত্রে আদিবাসী সংস্কৃতি নিজের ম’ত করে পরিচয়ও তৈরি করে নিতে পেরেছে ৷ মনে রাখতে হবে , সমাজ বাস্তবতার নানান দিক রয়েছে , সেই সমস্ত দিকের নিত্য-নতুন যে সব চেহারা ও চরিত্র নির্মিত হয়ে উঠছে সেই সমস্ত কিছুরই বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতির যে বিচিত্র রূপ গড়ে উঠেছে তা মূলত তিনটি ধারায় প্রকটিত হয়েছে ব’লে মনে করা হয়ে থাকে ৷ এই তিনটি দিক হল—“আদিম সংস্কৃতি ” , “লোকসংস্কৃতি” এবং “উচ্চ সংস্কৃতি” ৷ এই লোকসংস্কৃতি অবশ্যই একটি প্রবহমান ধারা ৷ গ্রামীণ কৌম সমাজ ব্যবস্থার গর্ভে যে লোক সংস্কৃতির জন্ম , সেই লোকসংস্কৃতির বিকাশ ও বিবৃদ্ধি কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ পরিবেশে৷ এমন নয় যে , এর গতি গ্রামীণ বাস্তবতার মধ্যে থেমে রয়েছে ৷ বরং বলা যায় , পুঁজিবাদী সভ্যতার আগ্রাসী বাড়বাড়ন্তের মধ্যেও কিন্তু লোকসংস্কৃতি সময়ের নিজস্ব নিয়মকে আত্মস্থ করে নিজের ছন্দে , নিজের ম’ত করে বিবর্তিত হ’য়ে চলেছে ৷ পল্লব সেনগুপ্ত তাই তাঁর “লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ”-এ বলেছেন— ” এটা মানতেই হবে যে লোকসংস্কৃতি কৃষি- বিবর্তনের পথে কোন টার্মিনাস নয় , বরং তাকে জংশন-স্টেশন বলেই গণ্য করা শ্রেয় ৷ “

Edward Tylor ১৮৬৫ সাল নাগাদ সর্বপ্রথম Culture শব্দটি ব্যবহার করেন৷ পাশাপাশি সংস্কৃতির বিজ্ঞান সম্মত আলোচনারও সূত্রপাত করেন ৷ সংস্কৃতি বিষয়টি যে সত্যিই গভীর কোন অভিনিবেশের দাবী করে তা Tylor-এর আলোচনা থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে ৷ এবং এটাও বোঝা যায় যে , সভ্যতা আসলে সংস্কৃতির অংশ বিশেষ ৷ Culture শব্দটি ইংরেজি শব্দ ৷ আসলে এর আগমন ঘটেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Cultura” থেকে ৷ অক্সফোর্ড ইংলিস্ ডিসসিনারি তে Culture শব্দের অর্থ হ’ল—” The trining and refinement of mind , tastes and manners ; the intellectual side of civilization.” অর্থাৎ ‘কালচার’ হ’ল ,সভ্যতার বিদ্যাবুদ্ধির এমন এক প্রকাশ যেখানে নিহিত ও অন্তর্গত হয়ে আছে পরিশীলিত মন , মার্জিত রুচি ও ব্যবহার ৷ Tylor তাঁর ‘Primitive Culture’ গ্রন্থে সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এই ভাবে—” Culture is that complex whole which includes knowledge , belief , art , morals , law , custom and any other capabilities and habits acquired by man as a member of society .”এখানে স্পষ্ট ভাবেই সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে ৷ অতএব সংস্কৃতি হচ্ছে এমন এক জটিল সমষ্টি , যা মানুষ অর্জন করছে
তার প্রতিদিনের যাপনের ভেতর থেকে, যেখানে রয়েছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিক বিধান, শিল্পকলা,প্রথা, আইন, এমনকি অন্যান্য নানান গুণ ও অভ্যাস ৷ মার্কিন শিক্ষাবিদ্ জন ডিউই সঙ্কীর্ণ অর্থে সংস্কৃতি বলতে মানুষের আচার- আচরণ ও ব্যবহারের বিশেষ মার্জিত ও পরিশীলিত অবস্থাকেই বুঝিয়েছেন ৷ এখান থেকে অনেকটা ধাপ এগিয়ে Ralph Linton সংস্কৃতিকে দেখেছেন,”the total lifeway of people”-এর সামগ্রিকতার প্রেক্ষিতে ৷
তাঁর মতে মানুষ একান্ত ভাবেই একজন সংস্কৃতি সৃজনকারী প্রাণী এবং এ কারণেই মানুষ কখনও সংস্কৃতির বাইরে থাকতে পারেনা৷ মানুষ তাই মানসিক, মানবিক, সামাজিক, নৈতিক এবং আত্মিক সব দিক থেকেই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত৷ তাই প্রতিটি মানুষেরই একটা সাংস্কৃতিক পরিচয় আছে৷ সংস্কৃতি তাই কারও একার অধিগত নয় ; কারও একার সম্পত্তিও নয় ৷ তাই ম্যাকাইভার বলছেন, “Culture is what we are” অর্থাৎ আমরা যা তাই হচ্ছে সংস্কৃতি৷

কালমার্কস সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে সংস্কৃতির ধারণা ব্যক্ত করেছেন ৷ তিনি সংস্কৃতিকে সমাজের উপরিকাঠামো অর্থাৎ Super structure-এর অংশ বলেছেন ৷ তাঁর মতে উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মিলিত সমবায়ে সমাজের Basic structure অর্থাৎ মৌল কাঠামো নির্ধারিত হয়ে থাকে ৷ উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র ও প্রকৃতির ওপর উপরি কাঠামোর সামগ্রিক রূপ নির্ভর ক’রে , তাই সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ৷ মানুষের চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে তার শিল্প-সাহিত্য তথা তার সমগ্র দর্শনকে উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করে থাকে ৷ এই অনুষঙ্গে তাই Koenig-এর সংস্কৃতি সংক্রান্ত চিন্তা সূত্রের অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায় ৷ কোয়েনিগের মতে সংস্কৃতি অবশ্যই প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্মিত হয়ে থাকে ৷ সে ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মানুষের এমন এক সার্বিক প্রচেষ্টার ফল , যা তাকে বর্তমান এবং পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে৷ তাই সংস্কৃতি হ’ল এমন এক অর্জিত আচরণ পদ্ধতি,যা অনুসরণ এবং নির্দেশনার মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়ে চলে৷ তাই তা গভীর ও সূক্ষ্ম অর্থে সংস্কৃতি মানুষের মনোজগতেরও অংশ বিশেষ৷ এক দিকে বস্তুগত প্রবহমানতা এবং অন্যদিকে মনোজগতের প্রবহমানতা, এই দুই দিকের অনিবার্য উপস্থিতিকে লক্ষ্য করে সমাজতাত্ত্বিক অগবার্ণ তাই সংস্কৃতির শ্রেণিকরণ করতে গিয়ে দুটিভাগের সন্ধান দিয়েছেন৷ বস্তুগত সংস্কৃতি এবং অবস্তুগত সংস্কৃতি, এক্ষেত্রে বস্তুগত সংস্কৃতি পুরোপারি মানুষের নিত্যনতুন প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ আর অন্য দিকে অবস্তুগত সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে মানুষের মননশীলতা ও মানসিকতার সঙ্গে গভীরভাবে অন্বিত ৷ এ কারণেই প্রযুক্তি মননশীল সংস্কৃতির তুলনায় হাজার গুণ বেশী গতিশীল ৷ মননঋদ্ধ সংস্কৃতির গতি সেই তুলনায় অনেক ধীর স্বভাব সম্পন্ন ৷এ কারণে অগবার্ণের “theory of cultural lag ” অর্থাৎ “সাংস্কৃতিক বিলম্বন” তত্ত্বে আমরা পাই, সাংস্কৃতিক ব্যবধান বা তার বিলম্বনের ধারণা ৷ কো’ন সংস্কৃতির ভেতরে অসম গতিতে প্রবহমান দুটি অংশের মধ্যে যে চাপ বিদ্যমান থাকে বা অনুভূত হয় , তাকেই বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতির ব্যবধান বা বিলম্বন ৷ সংস্কৃতির যে দিকটি স্বনির্ভর স্বাভাবিক ভাবেই তার অভিমুখ যেভাবে এগিয়ে চলে সেই তুলনায় সংস্কৃতির নির্ভরশীল দিকটি অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে৷ এক্ষেত্রে নির্ভরশীল দিকটি টিকে থাকার স্বাভাবিক প্রবণতায় সঙ্গতি বিধানের জন্য তৎপর হ’য়ে ওঠে৷ এর ফলেই গড়ে নানা প্রকরণের সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ৷ আমরা তাই হামেশাই দেখি,হাতে ধরা রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রসভ্যতার গর্ভজাত উদ্ধত এ কে ফরটি সিক্স কিংবা বেপরোয়া কালাশনিকভ , আর মগজের কোষে কোষে সঞ্চারিত মধ্যযুগীয় বর্বরতার তুমুল জেহাদি আস্ফালন ! সংস্কৃতি তাই গভীর ভাবে মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশের অংশ৷

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি Culture-এর প্রতিশব্দ রূপে কৃষ্টি শব্দটি ব্যবহারের পক্ষপাতি ছিলেন৷ সুনীতি কুমার চট্ট্যোপাধ্যায় তাঁর “ইতিহাস ও সংস্কৃতি” প্রবন্ধে বলেছেন—“ইংরেজি Culture শব্দের ধাতুগত ব্যুৎপত্তি ধরিয়া , অনর্থক সংস্কৃত ধাতুগত শব্দ ‘কৃষ্টি’ শব্দ, আমরা Culture-এর প্রতিশব্দরূপে বাঙ্গালায় ব্যবহার ব্যবহার করিতেছিলাম, কিন্তু এই ‘কৃষ্টি’ শব্দ রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় নাই—বেদে ‘কৃষ্টি’ মানে Tribe বা People অর্থাৎ জাতি বা জন বা জনগণ , এই জন্য তাঁর আপত্তি ছিল৷ কিন্তু আমার ভূতপূর্ব ছাত্র…দূর্গাচরণ চট্ট্যোপাধ্যায় দেখাইয়াছেন যে, অর্বাচীন সংস্কৃতে—’সভ্যতা’ বা ‘সংস্কৃতি’ অর্থে ‘কৃষ্টি’ শব্দের প্রয়োগ ছিল এবং ইহার সমধাতুক শব্দ ‘উৎকর্ষ’ উন্নতি অর্থে সংস্কৃতে বাংলা ভাষায় সুপ্রচলিত৷ সভ্যতার অন্তরঙ্গ দিক বুঝাইবার জন্য বাঙ্গালা ভাষায় ‘সংস্কৃতি’ শব্দ কত পূর্বে এবং কোথায় প্রথম ব্যরহৃত ইইয়াছে জানি নাই ৷ আমি এই শব্দ ১৯২২ সালে প্রথম মারাঠীতে প্রযুক্ত ইইতে দেখি , এবং তখন হইতে আমি রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন লাভ করিয়া বাঙ্গালাতে ব্যবহার করিতেছি ; নিজ দ্যোতনা শক্তি বলে , এবং রবীন্দ্রনাথের অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে , এই সুন্দর শব্দটি সহজেই বাঙ্গালা ভাষায় সর্বজন-গৃহীত হইয়া গিয়াছে ৷” ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিচারে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি (সম-কৃ + তি) যা সম্যক রূপে গড়ে তোলে , এই অর্থকে প্রতিষ্ঠিত করছে ৷ এই গড়ে তোলা অর্থে সুচারু ভাবে গ’ড়ে তোলাকেই বোঝানো হচ্ছে ৷ সুতরাং শব্দটির অর্থ ব্যঞ্জনায় মানুষের কৃতি বা সৃষ্টিমূলক সক্রিয় প্রচেষ্টার দিকটি নিহিত আছে ৷ তবে মানুষের জীবিকা প্রচেষ্টা এবং তার পাশাপাশি শ্রমশক্তির সঙ্গেও সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠতা নিবিড় ও অচ্ছেদ্য ৷ তাই আর্থিক উদ্যোগের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কের দিকটি পৃথক মনোযোগ দাবি করে ৷ সংস্কৃতি বলতে আমরা তাই মানুষের জীবন সংগ্রামের সার্বিক প্রচেষ্টাকেই বুঝব ৷ তাই শুধুমাত্র সমাজ দেহের চাকচিক্যটাই সংস্কৃতি নয় , বরং সমাজের পরিপূর্ণ পরিচয়ই হ’ল তার সংস্কৃতির পরিচয় ৷ সেই সঙ্গে মনের বিকেন্দ্রিকরণের মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতি যেমন নিত্য-নতুন উদ্ভাবনের দ্বারা নিজের মৌল ধর্ম টিকিয়ে রাখে ,তেমনি প্রসারণের ভেতর দিয়ে সে তার প্রাণশক্তিকেও টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় ৷ একরণেই “সংস্কৃতির গোড়ার কথা”-য় গোপাল হালদার বলেছেন—”…মানুষ প্রকৃতির সহিত সংগ্রামে একটু একটু করিয়া জয়ী হইতেছে—আর সংস্কৃতি তাহার সেই যুদ্ধের অস্ত্র ,আবার সেই যুদ্ধেরই বিজয় নিদর্শন ৷ মানুষের সেই জীবন-যুদ্ধ যেমন নূতন নূতন রূপে অগ্রসর হইতেছে, তাহার সংস্কৃতিও তেমনি রূপান্তরিত হইতেছে ৷” একারণে লোকসংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন বা আলাদা কো’নবিষয় নয় , তা আসলে সংস্কৃতিরই বিশিষ্ট অঙ্গ ৷ কিন্তু জাগ্রত মনে একটা খটকা থেকেই যায় , তাহ’ল এই যে , লোকসংস্কৃতি শব্দে সংস্কৃতির আগে থাকা লোক শব্দটি নিয়ে ৷ এই শব্দটির ক্ষমতা নেহাত কম নয় ৷ শব্দটির অর্থ ওসমাজ ইতিহাসগত ওজন যথেষ্ট ৷ একারণে সংস্কৃতির আলোয় এই লোকসংস্কৃতি শব্দটির স্বতন্ত্র মূল্য নিরূপনে প্রয়াসী হওয়া প্রয়োজন ৷ তার আগে ‘লোক’ কথাটির স্বতন্ত্র পরিচয় নেওয়া দরকার ৷

এই লোক হ’ল গোষ্ঠীবদ্ধ পল্লীর লোক সাধারণ ৷ কৃষিজীবী জনতা ৷ প্রান্তজীবী জনগোষ্ঠী৷ লোকসংস্কৃতির ধারণা আজ বহু দূর প্রসারিত ৷ তাই ‘লোক’ নামক ধারণাটি আজ আর শুধু পুরাতন তথা প্রাচীন রীতিনীতি বদ্ধ কৌম জনগোষ্ঠী অন্তর্গত ছকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ চলমান ধারণানুযায়ী নগরবাসী ঠেলাওয়ালা , রিক্সাওয়ালা, কলকারখানার মজুর , মুটে , মেথর , সব্জিওয়ালা, ঠিকা শ্রমিক, বস্তিবাসী সহ এই ব্যাপক অংশের মানুষও অনেক ক্ষেত্রে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্থ৷ একই রকম ধর্মীয় আচার-আচরণের পাশাপাশি রীতিনীতি , বিশ্বাস ও সংস্কারেরও অংশীদার তারা ৷ এক্ষেত্রে তাদের লোকপরিচয় একই পঙক্তি ভুক্ত৷ আবার আধুনিক লোকসংস্কৃতি ধারার এক শ্রেণির গবেষকরা ‘লোক’ ধারণাটির বিশেষ এক ক্ষেত্রসীমা নির্দেশ করেছেন ৷ এই সীমারেখা অনুযায়ী লোকসমাজ এক মধ্যবর্তী স্তর হিসাবে চিহ্নিত ৷ এই মধ্যবর্তী স্তরের লোকসমাজ হ’ল এমন এক জনগোষ্ঠী যারা কোনো ভাবেই আদিবাসী সমাজ অন্তর্ভুক্ত নয় ৷ আবার অন্যদিকে তারা আধুনিক প্রগতিশীল সমাজেরও অংশ নয়৷ লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রথাগত আলোচনায় ডঃ মানস মজুমদার বলেছেন—”লোকসংস্কৃতির আলোচনায় ‘লোক’ বলতে কোন একজন মানুষকে বোঝায় না৷ বোঝায় এমন একদল মানুষকে যারা সংহত একটি সমাজের বাসিন্দা৷…জন্ম থেকে মৃত্যু এবং বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকলে একই ধরণের বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি ,উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে৷”

তবে আদিবাসী বলে যাদের লোকসমাজের বাইরে রাখার একটা ঝোঁক কোনো কোনো আলোচনা ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় , সেটা বোধ হয় এই মুহূর্তে আর সঙ্গত নয়, কেননা, সমাজ বিবর্তনের পথ ধরে এই আদিবাসী জনসমাসও আজ লোকসমাজের বৈশিষ্ট্য ধারণ ও বহন করছে৷ আদিমতার প্রকট চিহ্নগুলি আজ তাদের ভেতরে অনেকটাই প্রচ্ছন্ন , বা বলা যায় , বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তা লুপ্তও৷ আবার এটাও লক্ষণীয় বিষয় যে , লোকসমাজের এমন অনেক আচার-অনুষ্ঠান আছে , যেগুলোর মধ্যে অরণ্য সংলগ্ন আদিম জনগোষ্ঠীর বহু আচার-আচরণ বর্তমান৷ সাঁওতালদের ভুয়াং নাচের ভেতর যেমন হিন্দু পুরাণ আশ্রিত মিথের অনুষঙ্গ বিদ্যমান , তেমনই আবার করম অনুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় ,সাঁওতাল এবং ভূমিজ দেশোয়ালি মাহাতো উভয় গোষ্ঠীর মধ্যেই ৷ তাই বলা যায় , লোকসংস্কৃতির উপজীব্য ‘লোক’ সাধরণ এমন এক জনগোষ্ঠী যারা কোনো ভাবেই এবং কো’ন অর্থেই অভিজাত উচ্চকোটির নাগরিক সভ্যতার অংশ নয়৷ এমনকি শিক্ষা, পরিমার্জিত সংস্কৃতি এবং বিবিধ যন্ত্র ও প্রযুক্তি কৌশল থেকেও তারা অনেক দূরবর্তী৷ নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী চিন্তা করলে বোঝা যাবে , কৃষিসভ্যতার গোড়াপত্তন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও গোষ্ঠীচেতনার উদ্ভবের সময়কাল থেকেই লোক সমাজের অস্তিত্ব একটু একটু করে গড়ে উঠেছে৷ অতএব সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে অনুন্নত এবং ক্রমোন্নত, এই দুটি স্তরের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা লোকসমাজের অস্তিত্বকে অনুধাবন করতে পারি ৷ এ ক্ষেত্রে তাই বর্তমান বা সমসাময়িক সময়কাল এবং অনাগত ভবিষ্যতের দিকেও লোকসমাজের সচল অস্তিত্ব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে৷

‘Folklore’ শব্দটির প্রতিরূপ হিসাবে আমরা বাংলায় ‘লোকসংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি ৷ ১৮৪৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এথেনিয়াম পত্রিকায় Folklore শব্দটি প্রথম ব্যহার করেন Tomas . পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এই শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় ৷ বাংলা ভাষায় Folklore শব্দটি বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের হাতে ভিন্ন ভিন্ন পারিভাষিক রূপ লাভ করেছে ৷ যেমন— “লোকযান” (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়), “লোকচর্চা” (সুকুমার সেন) , “জনকৃষ্টি”(প্রফুল্ল দত্ত গোস্বামী) , “লোকযর” (মযহারুল ইসলাম) , “লোকবার্তা”(বাসুদেবশরণ আগরওয়ালা), “লোকসংস্কৃতি”(কৃষ্ণদেব উপাধ্যায়) , “লোকচারণা”(নির্মলেন্দু ভৌমিক) , “লোকঐতিহ্য” (আনোয়ারুল করীম), “লোকায়ান” (অরুণ রায়) , “গ্রামসাহিত্য” (রামনরেশ ত্রিপাঠী), “লোকবিজ্ঞান”(মুহম্মদ শহীদুল্লাহ),”লোকশ্রুতি”(আশুতোষ ভট্টাচার্য) , “লোককৃতি” (তুষার চট্টোপাধ্যায়) প্রভৃতি ৷

ইংরাজী ‘Folk’ শব্দটি একই সঙ্গে সমাজের ক্ষুদ্র , পিছিয়ে পড়া তথা অনগ্রসর , অতিসাধারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়ে থাকে ৷আর ‘Lar’ এটিও ইরাজী শব্দ ৷ ব্যুৎপত্তিগত বিচারে এই শব্দটির অর্থ শিক্ষা , নীতি বা জ্ঞান ৷ কিন্তু লোকসংস্কৃতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা চর্চায় শব্দটির অর্থগত মাহাত্ম্য যথেষ্ট ব্যাপ্তি লাভ করেছে ৷ এখানে ‘লোর’ শব্দটি লোক সমাজের আচার-আচরণ , ঐতিহ্যাশ্রিত প্রথা , বিশ্বাস-সংস্কার , রীতি-নীতি , নাট্য, গীত , বাদ্য , নৃত্য ,উৎসব-অনুষ্ঠান এই সবকিছুই কো’ন না কো’ন ভাবে এই শব্দটির অর্থগত ব্যাপ্তির সঙ্গে জড়িত ৷ ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতি তাই লোকায়ত মানবজীবনের এমন এক অভিজ্ঞান যেখানে মানবসভ্যতার আবহমান ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিধৃত হয়ে আছে৷ পাশাপাশি এ হ’ল , লোকায়ত মানব গোষ্ঠীর এমন এক অস্তিত্বের চলমান সংগ্রহশালা যেখানে অতীত ইতিহাসের সঙ্গে প্রবহমান জীবন ও জীবনলব্ধ বাস্তবচেতনার অন্তর্সম্পর্ক বর্তমান ৷

লোকসংস্কৃতি হ’ল সংস্কৃতির এমন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে কৌম তথা গোষ্ঠী জীবনের সামগ্রিক আবেগ অনুভূতি ও চিন্তা-চৈতন্যের পাশাপাশি জীবন ও মানসচর্চার এবং জীবনচর্যার প্রতিফলন ঘটে ৷ লোকসংস্কৃতির সামগ্রিক স্বরূপ ও চরিত্র সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য নিম্নলিখিত দিক গুলি তুলে ধরলামঃ—

(১) সমষ্টিবদ্ধ জীবন চেতনার আলোয় সংহত লোকায়ত পটভূমি বিধৃত লোকজীবন এই সংস্কৃতিতে
প্রতিফলিত হয় ৷

(২) দীর্ঘদিন একই সমাজ আয়তনে
বসবাসের কারণে এক ও অভিন্ন গোষ্ঠী চেতনা লোকসমাজকে প্রাণিত করে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধশীল হতে ৷

(৩) এখানে আমরা যে সংহত সমাজের সন্ধান পাই , সে সমাজ মূলত পারস্পরিক নির্ভরতামূলক কৃষিভিত্তিক পল্লীসমাজ ৷ সকলে অভিন্ন আর্থ সামাজিক স্বার্থবোধে বিজড়িত ৷

(৪) লোকসংস্কৃতি সর্বদাই ঐক্যবদ্ধ লোকসমাজের মুখাপেক্ষী ৷

(৫) লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তি প্রতিভার স্ফূরণ লোকায়ত সমষ্টিগত চেতনার বোধে উন্নীত হয় ৷

(৬) ঐতিহ্য লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রাণসম্পদ ৷ ঐতিহ্যের প্রাণরসে লোকসংস্কৃতির বিকাশ , বিবৃদ্ধি ও রূপান্তর ঘটে ৷

(৭) লোকসংস্কৃতি বিশেষ কালের দ্বন্দ্বমূলক বাস্তব প্রতিবেশের ভেতরে নিজের সাবলীলতা বজায় রেখেই কালোত্তীর্ণ গুণ অর্জন করে ৷ তাই আঞ্চলিক পরিচিতি সত্তার ভেতরও বিশ্বমানবিক চেহারা নিহিত থাকে ৷

(৮) সহজ সারল্য লোকসংস্কৃতির অনন্য বিশিষ্টতা ৷

(৯) লোকসংস্কৃতিতে শ্রমনির্ভর উৎপাদনশীলতা প্রাধান্য পায় ৷

(১০) আঞ্চলিক ভাষাই লোক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় পরিচিতি ৷

(১১) লোকসংস্কৃতির গর্ভে যেমন অতীতের অনুরণন রণিত হয় , তেমনি সমকালও সেখানে প্রভাব ফেলে ৷সেই সঙ্গে লোকসংস্কৃতির ভেতর ভবিষ্যকালও প্রতিবিম্বিত হয় ৷

লোকসংস্কৃতির সীমানা নির্দেশ করতে গিয়ে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে লোকগবেষকরা লোক সংস্কৃতির বিষয় সমূহকে মোটামুটি পাঁচটি ধারায় বিন্যস্ত করেছেন৷ যেমন— দৈহিক ক্রিয়াধর্মী লোকসংস্কৃতি, শিল্পধর্মী লোকস্কৃতি , বাকধর্মী লোকসংস্কৃতি , প্রয়োগধর্মী লোকসংস্কৃতি , বিশ্বাস অনুষ্ঠানধর্মী লোকসংস্কৃতি৷ মনে রাখা প্রয়োজন যে , এই পাঁচটি বিভাগ স্পষ্টত পরস্পরের পরিপূরক৷ এই পাঁচটি বিভাগকে বস্তাগত এবং অবস্তুগত, এই দিক থেকেও দেখা যেতে পারে৷ খাদ্যদ্রব্য , পোশাক-পরিচ্ছদ,বাসস্থান, আসবাব,পথঘাট , যানবাহন, ঔষধপত্র , যন্ত্রসমূহ আরও অন্যান্য , এ সবই বস্তুগত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত৷ অন্যদিকে সাহিত্য তথা ছড়া , লোককথা , লোক নাট্য , লোক নৃত্য , প্রবাদ-প্রবচন , ধাঁধা ,রূপকথা, গীতিকা,চিত্রশিল্প , সংগীত , নৃত্য , ব্রত ,অভিনয় , ধর্ম , বিশ্বাস , কারীগরী , স্থাপত্য , ভাস্কর্য , সংস্কার ইত্যাদি ৷

এ কথা মানতেই হবে বিদ্যায়তনিক শাস্ত্র রূপে লোকসংস্কৃতি আজ আধুনিক বিশ্বে স্বতন্ত্র গুরুত্ব অর্জন করেছে৷ অনেকের কাছে আজও লোকসংস্কৃতি কেললমাত্র মৌখিক তথা অলিখিত লোকসাহিত্যেরপরিচয়ে সীমাবদ্ধ৷ কিন্তু পৃথিবীর নানাদেশে আজ লোকসংস্কৃতি নিয়ে যে সব উচ্চ গবেষণা মূলক কাজ হচ্ছে তাতে লোকসংস্কৃতি কেবল লোকসাহিত্যের মধ্যে দিয়ে পরিচিত নয়, সে সব ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির সীমা বস্তু এবং অবস্তু দুটি ক্ষেত্রের প্রতিটি বিভাগ ও উপবিভাগ নিয়েও অণুপুঙ্খ পাঠ , চর্চা তথা অনুশীলন ও গবেষণা চলছে৷ এ জন্য লোকসংস্কৃতি পাঠ ও অনুশীলনের জন্য বিষয়পরিধি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ও গভীর জ্ঞান থাকা একান্তই জারুরী৷ পাশাপাশি দরকার ভূগোল , নৃবিজ্ঞান , ইতিহাস , সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে যথাযথ ধারণা ও সচেতন আগ্রহ৷ সেই সঙ্গে দরকার মূলভাষার অন্তর্গত বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি ও জ্ঞান৷ এ ক্ষেত্রে মানববিদ্যার প্রতিটি শাখা সম্পর্কেই অবগত হওয়া প্রয়োজন৷

লোকসংস্কৃতি চর্চার দিগন্ত আজ বিজ্ঞাননিষ্ঠ নৈর্ব্যক্তিকতার হাত ধরে আমাদের বোধ-বুদ্ধির জগতকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ ক’রে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে ৷ এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বোধ হয় লোকসংস্কৃতি চর্চায় ‘ফোকলোর’-এর পাশাপাশি ‘ফোকলোরিস্টিকস’-এর সুস্পষ্ট ভূমিকায় ৷ যখন লোকসংস্কৃতির বিষয় ও উপাদান-ই কেবলমাত্র লোকসংস্কৃতি চর্চার উপজীব্য বিষয় হয়ে ওঠে তখনই শুধুমাত্র ‘ফোকলোর’ শব্দটির প্রয়োগ ঘটে ৷ একটা সময় ছিল যখন লোকসংস্কৃতির বিষয় এবং পঠন-পাঠন , এই দুই বিষয়ই নির্দেশিত হ’ত ‘ফোকলোর’ বা ‘লোকসংস্কৃতি’ শব্দের দ্বারা ৷ আজ আর তা কার্যকরী নয় ৷ তাই এখন লোকসংস্কৃতি চর্চায় ‘ফোকলোর’ শব্দটি নির্দেশিত হয় উপাদান ও বিষয়সমূহকে বোঝাতে ৷
অন্যদিকে দিকে লোকসংস্কৃতির অনুশীলনে ‘ফোকলোরিস্টিকস’ এই শব্দটির প্রয়োগ ঘটে লোকসংস্কৃতির অর্থাৎ ‘ফোকলোরের’ বিষয়সমূহের তত্ত্ব এবং সেই সঙ্গে পদ্ধতিবিদ্যাগত ধারণা ও অনুশীলনকে নির্দেশ করতে৷ সুতরাং‘ফোকলোরিস্টিকস’ শব্দটি তাই লোক গবেষণার মঞ্চে ‘লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞান’ হিসাবে স্বীকৃত ৷

যে কো’ন কিছুর আলোচনা, বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে ৷ সঠিক ও সময় উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কো’ন কিছুর মূল্যাঙ্কন নিরূপন করা কঠিন কাজ ৷ আধুনিক লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞানীগণ যথেষ্ট উদার ও মুক্তবুদ্ধির দ্বারা চালিত ৷ তাই তাঁরা লোকসংস্কৃতি বলতে কৃষিসভ্যতা জাত পল্লীজীবনের নিরক্ষর মানুষের হাতে গ’ড়ে ওঠা সংস্কৃতি , যা গড়পড়তা মানুষ বুঝে থাকে , সেই অর্থে বোঝেন না ৷ তাঁদের কাছে লোকসংস্কৃতি অনেক ব্যাপক ও প্রবহমান এক বিষয় ৷ তাঁরা মনে করেন , কৃষিভিত্তিক সংহত গ্রাম সমাজ লোকসংস্কৃতির উদ্ভব এবং বিকাশের ঊর্বর ভূমি হলেও নাগরিক সমাজেও লোকসংস্কৃতি বিশিষ্ট অর্থে বিকশিত হ’তে পারে ৷ ধীর গতিসম্পন্ন হলেও লোকসংস্কৃতির মধ্যে এমন এক চলমানতা আছে যার জন্য সক্রিয় ভাবে লোকসংস্কৃতি যে কো’ন রকমের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে দাঁড়িয়েও নিজের চেহারা ও চরিত্রের মৌল স্বরূপ অটুট রেখেও রূপান্তরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলতে পারে স্বচ্ছন্দে ৷এ কারণে শিল্পভিত্তিক নাগরিক জীবনের ভিড়েও লোকসংস্কৃতি অনায়াসে নিজের সত্তাকে বাঁচিয়ে ডালপালা মেলে ধরতে পারে ৷ তাই , লোকসংস্কৃতি শুধুমাত্র নিভৃত পল্লীর শ্রমক্লান্ত গোষ্ঠীবদ্ধ কৃষকের হাতে সৃষ্টি নয় , তা নগরেরর অনালোকিত অংশে যূথবদ্ধ জীবনসংগ্রামের বৃত্তে বসবাসকারী ঘর্মক্লান্ত শ্রমজীবীরও আত্মপ্রকাশের বিশিষ্ট মাধ্যম ৷সমষ্টিগত সংহতি চেতনা যে শুধুমাত্র কৃষিজীবন কে কেন্দ্র করেই গ’ড়ে ওঠে তা কিন্তু নয় ; আধুনিক নগর সভ্যতার শ্রমিক বস্তি কিংবা আরও নানা প্রকার খেটে খাওয়া মানুষের ভিড়েও সংহতি চেতনা দানা বাঁধতে পারে ৷ এমন নয় যে তারা পুরোপুরি নিরক্ষর ৷ কৃষি থেকে শিল্প , গ্রাম থেকে নগর , সর্বত্রই এই সংহতি বোধ এবং সেই বোধ সম্মিলনের ক্ষেত্রভূমি থেকেও লোকসংস্কৃতি সৃষ্টি বা নির্মিত হয়ে উঠতে পারে ব’লে লোকসংস্কৃতিরবিজ্ঞানীগণ মনে করেন৷

সুদীর্ঘ এক বিবর্তনের হাত ধরে লোকসংস্কৃতি আজ বিদ্যায়তনিক পঠন-পাঠনের বিষয় হ’য়ে উঠেছে ৷ ঠিক এ কারণেই যথাযথ উপায়ে লোকসংস্কৃতি অনুশীলনের পাশাপাশি লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনুশীলন ও অত্যন্ত জরুরি আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে ৷ এই দুটি বিষয় পরস্পর সাপেক্ষ ৷ বস্তুনিষ্ঠ নির্মোহতার সঙ্গে যে কো’ন ইতিহাস অনুধাবন বা অনুসন্ধান, কিংবা পর্যালোচনা করতে গেলে যেটা সবচেয়ে বেশী জরুরি ব’লে মনে হয় সেটা হ’ল ,ঐতিহাসিক যুগবিভাগ ৷ এই যুগবিভাগ ছাড়া বিবর্তনের বাস্তব চেহারাটা ইতিহাস সম্মত ভাবে প্রামাণ্য হ’য়ে ওঠে না ৷ বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার যে ইতিহাস গ’ড়ে উঠেছে ,যাঁদের হাত ধরে ঐতিহাসিক যুগবিভাগের এক রূপরেখা তৈরি হ’য়ে উঠেছে তাঁরা হলেন— ড: আশুতোষ ভট্টাচার্য্য, ড:মযহারুল ইসলাম , ড: আশরাফ সিদ্দিকী, শ্রীশঙ্কর সেনগুপ্ত এবং ড: তুষার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ৷

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সামান্য পর থেকে বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসের সূত্রপাত বলা যেতে পারে ৷ প্রাথমিক পর্বটি মোটামুটি ব্যক্তিগত উদ্যোগের দ্বারাই সীমাবদ্ধ ছি’ল বলা যায় ৷ এইসময় পর্বের চর্চা তেমন কো’ন সুসংহত রূপ লাভ করতে পারেনি ৷ বলা যায়,ঊণবিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চা এক অর্থে প্রাথমিক সংহতি লাভ করেছে ৷ এর পরের পর্বটি জাতীয় উদ্যোগের পর্ব ৷ উণিশ শতকের প্রায় শেষদিকে এ হেন উদ্যোগ সংঘটিত হয় ৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে সুসংহত ভাবে বাংলা লোকসংস্কৃৃতির চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেতে শুরু করে ৷ প্রতিষ্ঠান নির্ভরতার সঙ্গে শৃঙ্খলার প্রসঙ্গটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ৷ তাই শিক্ষাগত সুশৃঙ্খলা ছাড়া কো’ন বিদ্যায়তনিক চর্চাই আদর্শ প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা লাভ করতে পারে না ৷ বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে এই আদর্শ চেহারাটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে একটু একটু ক’রে গড়ে উঠেছে ৷

একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে , বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে পশ্চিমী চিন্তা-চেতনা এবং উদ্যোগের ভূমিকা ব্যাপক ৷ এই ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়েই বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চায় জাতীয় উদ্যোগের উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয় ৷ ১৭৭২-এর ২৬-শে মার্চ নাগাদ ওয়ারেন হেস্টিংসের লেখা একটি পত্রের সূত্র ধরেই নাকি বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রাথমিক উপকরণ সংগ্রহ এবং সেই সব সংগৃহীত উপকরণ সংক্রান্ত আলোচনা বিষয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠে ৷ এই ঘটনা অত্যন্ত সচেতন ভাবেই আমাদের লোকসংস্কৃতি চর্চায় প্রেরণা সঞ্চার করে ৷ এই সময় পর্বে বিভিন্ন বিদেশী পর্যটক , মিশনারী সম্প্রদায় এবং প্রসাসক কর্তৃক বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চার একটা সাধারণ রূপ গড়ে ওঠে , যা পরবর্তীকালে এ জাতীয় চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত হতে সাহায্য করে ৷ ১৭৮৪ সাল লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করে এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র “The journal of the Asiatic Society of Bengal”-এর আত্নপ্রকাশ ৷ যে সমস্ত পত্রপত্রিকা এ বিষয়ে উল্লখযোগ্য ভূমিকা নেয় তার কয়েকটি হ’ল—’বেঙ্গল গেজেট’ , ‘ক্যালকাটা গেজেট’,’ইন্ডিয়ান রিফরমার,’ ‘দিগদর্শন’, ‘সমাচার দর্পণ’ ইত্যাদি ৷ এছাড়া , উইলিয়ম কেরী-র ‘হিতোপদেশ’ , ‘ইতিহাসমালা’ , রামরাম বসুর ‘লিপিমালা’ ,চন্ডীচরণ মুন্সির ‘তোতা ইতিহাস’ নীলরত্ন হালদারের ‘কবিতা রত্নাকর’ ইত্যাদি ৷

এশিয়াটিক সোসাইটি লোকসংস্কৃতির নানাপ্রকার সংগ্রহ ও প্রকাশনার ওপর বিশেষ প্রচেষ্টা গ্রহণ করে ৷ ১৮৬৫ সালে কলকাতায় জাতিতত্ব প্রদর্শনীর আয়োজন এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ , কেননা এই সময় থেকেই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সরকারী এবং বেসরকারী দুদিক থেকে লোকসংস্কৃতির চর্চা অনুশীলনে নানান উদ্যোগ গৃহীত হয় ৷ ‘আর্যদর্শন’, ‘ফোকলোর রেকর্ড’, ‘রংপুর দিকপ্রকাশ’, ত্রিপুরা ‘জ্ঞানপ্রসারিণী’ ‘বঙ্গবাসী’ ইত্যাদি পত্রপত্রিকার ভূমিকাও ছি’ল যথেষ্ট ইতিবাচক ৷ পাশাপাশি গোপাললাল মিত্রের ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ”বেতাল পঞ্চবিংশতি’ , ‘কথামালা’ ,অক্ষয়কুমার দত্তের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ , ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমণির ছড়া, নফরচন্দ্র দত্তের ‘বাউল সঙ্গীত’, কানাইলাল ঘোষালের ‘প্রবাদ সংগ্রহ’ ইত্যাদি গ্রন্থের কথাও এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় ৷

স্বদেশী আন্দোলনের পটপ্রেক্ষায় জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশে জাতীয় ঐতিহ্য অনুসন্ধান ছিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ৷ ঐতিহ্যের অনুশীলন ব্যতীত ঐতিহ্যের অনুসন্ধান কার্যকরী হতে পারে না ৷ আর এই অনুশীলনের সূত্রেই লোকসংস্কৃতি চর্চায় জাতীয় উদ্যোগের পথ উন্মুক্ত ও প্রশস্থ হওয়ার সুযোগ পায় ৷ ১৮১৪ সালে “বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ” প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে জাতির আত্মআবিষ্কারের যে প্রচেষ্টা শুরু হয় তা লোকসংস্কৃতির চর্চা ও অনুশীলনকে অনেকটাই জাতীয় উদ্যোগমুখি ক’রে তোলে ৷ এই সময় জর্জ আব্রাহাম গ্রীয়ারসন, ম্যাক্সমুলার, দীনেশচন্দ্র সেন , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর , ক্ষিতিমোহন সেন, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী,জসীমুদ্দীন, প্রমুখের চেষ্টা লোকসংস্কৃতির চর্চা ও অনীলনকে বিশেষ মাত্রা দান করে৷

১৯৪৭ পরবর্তী সময় পর্বে যথাযথ পথে লোকসংস্কৃতির চর্চা ও অনুশীলন বিদ্যায়তনিক গুরুত্ব লাভ করতে থাকে ৷ শিক্ষাগত শৃঙ্খলা জনিত সক্রিয়তা এই সময় নানান সম্ভাবনার দিক খুলে দেয় ৷ ড: আশুতোষ ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের এম.এ পাঠ্যক্রমে বিশেষ পত্রসমূহের মধ্যে লোকসাহিত্যও অন্তর্ভুক্ত হয় ৷ এই অন্তর্ভুক্তির দ্বারা প্রাণিত হয়ে পঃবঃ-এর আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসাহিত্য পাঠক্রমে জায়গা পেয়ে যায় ৷ এই সময় থেকে নানান জেলায় লোকসংস্কৃতি চর্চা ও অনুসন্ধানের জন্য নানান সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ৷ জেলা বিবরণী, জনগণনা বিভাগের একাধিক প্রকাশনা পুরাকীর্তি গ্রন্থমালা , সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, লোকশ্রুতি ইত্যাদি নানান উদ্যোগ ও পত্রপত্রিকার দ্বারা লোকগবেষনায় এক সুসংহত উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটে ৷ যা সত্যিই বাংলা লোকসংস্কৃতির অনুশীলন কর্মকে ব্যাপক ভাবে উজ্জীবিত ক’রে তোলে ৷ স্বাধীন বাংলা দেশেও এই অনুশীলন নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে৷ এদেশে বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব রেখেছেন ,মনসুর উদ্দীন, আবু তালিব, মোদকার রিজাউল হক প্রমুখ ৷

‘ সোলার মিথোলজি’, ‘ইন্ডিয়ানিস্ট থিয়োরি’, ‘বায়োরিং অব টেলস্ ‘,’ উইশ ফুলফিলমেন্ট তত্ত্ব এবং ‘মোটিফ’ ও ‘টাইপ ইনডেক্স’-এর উদ্ভব এর যথাযথ ব্যবহার লোকসংস্কৃতির অনুশীলনকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে৷ লোকসংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব বহুমাত্রিক৷ এই চর্চা ছাড়া দেশের ঐতিহ্য ও জনজাতির জীবন ধারার পূর্ণ স্বরূপ অনুসন্ধান করা অসম্ভব৷

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>