| 25 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ ফিচার্ড পোস্ট

বাংলার সম্ভাবনাময় লোকজ শিল্প হাতপাখা আজ অবলুপ্তির পথে

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

ড: সুবীর মণ্ডল

 

“নিদাঘ দুপুরে সখী পরিবেষ্টিত সখা/স্তব্ধ কানন সখীরা হাতে নিয়ে সব পাখা/সখা করে গান তাকায়ে আকাশ পানে/বারি সিঞ্চন হোক সখীদের ও গানে গানে”  প্রাচীন কোন ও  অজানা কবির কবিতাই নয়, দেশে-বিদেশে যে নামেই পরিচিতি হোক না কেন আসল পরিচয়, তার হাতপাখা। গোলাপের মতোই তার বাহারি নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বৈচিত্র্যময় হাত পাখা। আদি-অন্ত কাল ধরে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষের এক সময়ের নিত্যসঙ্গী। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০অব্দে মিশরেও পাখার চল ছিল। ক্রীতদাসেরা পাখির পালককে এক সঙ্গে বেঁধে রাজাদের বাতাস করত। সম্ভবত পাখি থেকে অর্থাৎ পাখির পালক থেকে তৈরি বস্তুটিই প্রচলিত পাখা শব্দটার উৎস। এক সময় গ্রীষ্মের দিনে বিকল্প বাতাস পেতে হাতে উঠত গাছের পাতা। আর সেদিন থেকেই হাত পাখার যাত্রা শুরু বলা যায়। তারপর দিনে- দিনে সভ্য জগতে পা দিয়ে অঞ্চল ভেদে বদলে যেতে থাকে হাত পাখার গঠন বৈচিত্র্য। ধীরে ধীরে রঙ-রূপে, মেধায়, হয়ে উঠল বর্ণময় লোকজ শিল্পের বর্ণময় বস্তু। শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা নয়, দেশ জুড়ে পূর্বে আসাম থেকে পশ্চিমে গুজরাট, উত্তরে কাশ্মির থেকে দক্ষিণে কেরল- সব রাজ্যে হাতপাখার দেখা মেলে। অলংকরণের দিক থেকে রাজস্হান ও গুজরাটের পাখা ভীষণ সুন্দর। বিহারের মধুবনীতে তৈরি পাখা শিল্পে চোখে পড়ে পরম্পরাগত শৈলীর প্রভাব। ওড়িশা ও কেরলার পাখায় দেখা যায় আ্যপ্লিক কাজের অলংকরণ। অঞ্চলভেদে আমাদের দেশে ও বিদেশে পাখার বৈচিত্র্য যেমন দেখা যায়, তেমন ই পরিচয়ের দিক থেকে আছে তাদের আঞ্চলিক নাম। অন্ধ্রপ্রদেশে বিসন্নকান্না, আসামে বিসোনী, গুজরাটের চৌউসি, হরিয়ানার বিজানা, জম্মু -কাশ্মিরে ওভেজ, ওড়িশায় বিচানা প্রভৃতি। আমাদের জেলা, রাজ্য ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের দিকে তাকালেও  দেখা মেলে হাতপাখা। পাকিস্তানের হাত পাখায় জরির চমৎকারিত্ব অসাধারণ। শ্রীলঙ্কার হাত পাখার গঠন শৈলী পান পাতার মতো। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’ শৈশবকে নাড়া দেওয়া এমন কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দু’বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে তাল গাছ গভীরভাবে আজও সম্পৃক্ত। 
     

নদী মাতৃক সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় দেখা যায় তালপাতার  হাত পাখা সহ শোলার হাত পাখা। বাংলাদেশের একটি নান্দনিক সৌন্দর্যের লোকজ শিল্প হলো তালপাতার হাত পাখা। বিশেষ করে  বাংলাদেশের যশোর, বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, পাবনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকা জেলার   সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয়  জিনিস হলো  তালপাতার হাত পাখা। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলার, উপজেলা গুলি এই লোকজ শিল্পের  আঁতুড়ঘর। বহু মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস স্হল হলো হাতপাখা। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি গ্রামীণ এলাকায় সাধারণ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এখানকার  বহু গ্রামীণ হাটে আজ ও পাখা বিক্রি হতে দেখা যায়। এই লোকজ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নানান প্রকল্প ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। ঋণের ব্যবস্থা করে উৎসাহিত করে এই লোকজ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  
     

বাংলাদেশের সর্বত্র তালগাছের আধিপত্য  লক্ষ্যকরা যায়। বিশেষ করে সুন্দরবন  ঘেঁষা এলাকাগুলি এই শিল্পের ভাণ্ডার। ঢাকা হলো  সবচেয়ে বড় বিপণন কেন্দ্র। শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুরের ও ময়মনসিংহের তালপাতার হাত পাখা বিখ্যাত, এখানকার লোক শিল্পীরা অত্যন্ত দক্ষ। তাছাড়া নাটোর উপজেলার হাঁপানিয়া হলো বাংলাদেশের প্রধান হাতপাখা  তৈরির  প্রধান  কেন্দ্র। নাটোর উপজেলা শহর থেকে হাঁপানিয়ার দূরত্ব ৪৫কি,মি। রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, ও সিরাজগঞ্জের তালপাখার চাহিদা মেটায়  নাটোরের হাঁপানিয়া গ্রাম। বাংলাদেশের পাখার গ্রাম নামে খ্যাত হাঁপানিয়া। এছাড়াও পাথরঘাটা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হাতপাখা তৈরির অসংখ্য গ্রাম আছে। যশোরের অভয়নগর,  কেশবপুর, ঝিকরগাছা, শার্শা, সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ, দেবহাটা, শ্যামনগর, তালা, করোতোয়া, খুলনা জেলার  সবকটি উপজেলা- পাইকগাছা, রূপসা, দাকোপ, কয়রা, ডুমুরিয়া, দিঘলিয়া ইত্যাদি এলাকায় সাধারণ মানুষ তালপাতার হাত পাখা তৈরির সঙ্গে  যুক্ত। এই শিল্পের সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িত। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে চলে গেছে কারণ এই পেশায় রোজগার কমে যাচ্ছে। এবছর বাংলাদেশ জুড়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বহুমানুষ। বাজারের অনেক পাখা বিক্রি হয়নি মহামারীর জন্য। ফলে হাজার হাজার মানুষের রোজগার বন্ধ হয়েছে। চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। এব্যাপারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা দরকার, নাহলে বাংলাদেশের এই লোকজ শিল্পের অবলুপ্তি ঘটতে পারে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। 
     

প্রখর তপন তাপে তালপাতার পাখা শুধু বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলি (গোঘাট, আরামবাগ, হাওড়া (উদয়নারায়নপুর, উলুবেড়িয়া) নদীয়া  (রানাঘাট, চাকদহ, শান্তিপুর, মেদিনীপুর (কোলাঘাট, ঘাটাল, বর্ধমান (কাটোয়া, পূর্বস্হলি) দুই চব্বিশ পরগনা (বনগাঁ, বসিরহাট, দেগঙ্গা, ভাঙ্গর, হাড়োয়া, ক্যানিং, জয়নগর, সোনার পুর, টাকি, কাকদ্বীপ, নামখানা, সুন্দববন), নয়, সমগ্র বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে কয়েক দশক ধরে। সে ইলেকট্রিক পাখা থাক বা না থাক। একটা সময় প্রান্তিক মানুষের নিত্য জীবনে গরমকালে, কয়লার এবং ঘুটের উনুন ধরানোর একমাত্র আশা ও ভরসা ছিল তালপাতার পাখা। ক্রমশ সারা রাজ্যে হাত পাখা  কৌলিন্য লাভ করল। আজও  বিদ্যুৎ ব্যবস্হা ও বিজ্ঞান নির্ভর প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হলেও  হাত পাখার গুরুত্ব ও উপযোগিতা অস্বীকার  করা যায় না। একটা সময়ে সর্ব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবনে পাখার একটা উল্লেখ যোগ্য স্হান ছিল। বিয়ে উপলক্ষে, ষষ্টীপুজোয়, জামাই ষষ্টীতে ও মুসলিম সমাজের শোভাযাত্রা, তাজিয়ায় পাখার বহুমাত্রিক ব্যবহার ছিল। আয়ুর্বেদিক মতে তালপাতার পাখার বাতাস স্বাস্হ্যকর, ও আরামদায়ক। তুলনায় এসি বা এয়ারকুলারের  হাওয়া স্বাস্হ্যকর নয়।  বাঁকুড়ার তালপাতার পাখা হাতে তুলে হাওয়া খাওয়ার সময় কখনও কি আমাদের মনে হয়েছে এটা, এক সময়ে বাঁকুড়া জেলার সম্ভাবনাময়  লোকশিল্প ছিল? মূলত এই জেলার প্রান্তিক মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই দশকের পর, দশক ধরে বাঁচিয়ে রেখেছেন এই লোকায়ত পরিবেশ বান্ধব গ্রামীন লোকশিল্পকে। এখানকার লোকশিল্পীরা সৃজনশীল মন ও শৈল্পিক মেধা দিয়ে অসাধারণ পাখা নির্মাণ করে চলেছেন আজও। শীতের মাঝামাঝি সময়েই গোটা জেলা জুড়ে  তালপাতার পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। তালগাছের পাতা কাটা, তাঁকে জলে ডুবিয়ে রেখে  জাঁক দিয়ে পাতাকে সোজা করা হয়। তারপর সেই পাতাকে সাইজ করে কাটা, সরু লম্বা কাঠি দিয়ে বাঁধা, রং করা ইত্যাদি নানা পর্বের মধ্যদিয়ে পাখা রেডি হলে তারপর বিপণনের ব্যবস্হা করা হয়। 

বাড়ির মহিলারা এই কাজে সহযোগিতা করেন। একটা তালপাতার থেকে একটা বা দুটো পাখা তৈরি হয়। অতীতে বহু দশক ধরে বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন  মহকুমার গ্রামে গ্রামে  হাতপাখা তৈরি কাজ ব্যাপক ভাবে হত। সেই ধারা আজকে ও বহে চলেছে। যদিও তার ব্যাপকতা কিছুটা  কমেছে। একটা  সময়  বিশেষ করে সোনামুখীর নবাসন, ছান্দার, কোতলপুরের গেলিয়া, মির্জাপুর, জয়পুর, জয়রামবাটি, মেজিয়া, বড়জোড়া, ইন্দাস, রাধানগর, বেলিয়াতোড়, সিমলাপালের পুখুরিয়া, লক্ষীসাগর, ইন্দপুরের বাউরিশোল, বাংলা, সারেঙ্গার কাটাপাহাড়ি, খাতড়ার বনতিল্লা, দহলা, বৈদ্যনাথপুর ছিরুডি, কেচন্দা,  তালডাংরার হাড়মাসড়া, লদ্দা ব্রাক্ষনডিহি, ভীমাড়া। হীড়বাঁধের মলিয়ান, দেউলাগোড়া, রাইপুরের ফুলকুসমা, মটগোদা, ইত্যাদি জায়গাগুলিতে হাজার হাজার তালগাছ দেখা যেত এবং সমস্ত এলাকায়় এই শিল্পের  ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। যদিও আজ তালগাছের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। পাখা শিল্পের  খানিকটা ভাটা পড়েছে। তবু আজও  এই শিল্প একেবারে  হারিয়ে যায়নি। কিছু পাতা আসে পুরুলিয়াও ঝাড়খণ্ড থেকে। তালপাতার পাখা বিক্রির বড় জায়গা জেলার গাজনের মেলা, গ্রামীন হাট ও ব্লক শহরের বাজার। বিপণনের দায়িত্ব পুরুষদের । ফাল্গুন থেকে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত বিভিন্ন মেলায় তালপাতার পাখা বিক্রি হয় । এখন ১৩ থেকে ১৪ টাকায় একটি পাখা  বিক্রি হতে দেখা যায়।  শতকরা ৭০০/৮০০টাকা দরে তালপাতা কেনে শিল্পীরা। বাংলাদেশের গাজীপুরে ও নাটোরের হাপানিয়াতে শিল্পীরা দক্ষতার সঙ্গে ৩/৫ জন মিলে অতি সহজেই একদিনে ৩০০খানা পাখা বানাতে সক্ষম। দেশের বাইরে ভালো বাজার আছে বাংলাদেশের। অতীতে বাঁকুড়ার অনেক জায়গায় হাতপাখা তৈরি হতো। ক্ষেত্র সমীক্ষা করে বেশ কয়েকটি জায়গার সন্ধান মেলে। সোনামুখির নবাসন, ছান্দার, খাতড়া থানার ছিরুডি, দহলা, বৈদ্যনাথপুর, গোড়াবাড়ি, মেটেলা, সিমলা সালের  লক্ষীসাগর, পুখুরিয়া, পারশোলা এবং তালডাংরা থানার, ভীমাড়া, হাড়মাসড়া, লদ্দা, ব্রাক্ষনডিহিকে এক সময় পাখার গ্রাম বলা হতো। এখনও এই অঞ্চল গুলো এই শিল্পের ধারক ও বাহক। এই সব গ্রামের কারিগররা আজ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও কাজ করে চলেছে। এই সব অঞ্চলের ৩০০টা পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বংশ পরম্পরায় তালপাতার  পাখা  শিল্পের  সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তালপাতার বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেই সংসার চালান। পৌষ মাস আসতেই  ঘরে ঘরে তালপাতার পাখা তৈরির ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। বাড়ির পুরুষ থেকে মহিলারাও সবাই সামিল হন।  

ফাল্গুন-চৈত্র থেকে শ্রাবন মাস পর্যন্ত এলাকার বিভিন্ন বাজারে পাখা বিক্রি করেন। তবে এবার লকডাউনের জন্য বন্ধ হতে চলেছে তাঁদের রোজগার। লদ্দার  জামাল শেখ, ছিরুডির ভানু কালিন্দি, দহলার রাম বাউরী,  পুখুরিয়়ার সনাতন সহিস বলেন, ‘সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে পাখা তৈরি করে বাড়িতে মজুত রাখি। চৈত্র মাস থেকে  শ্রাবন  পর্যন্ত  বাজারে বিক্রি করি। এবার লকডাউনে  সব শেষ হয়ে গেল। বাজার বন্ধ থাকায় বিক্রি করা যায়নি। ঘরে প্রচুর পরিমানে পাখা মজুত আছে। সংসার চালাতে অসুবিধা হবে। আর বলেন,জামাই ষষ্টীতে একটা বড় বাজার থাকে’। এ বছরে মরশুম শুরু হতেই লকডাউন হয়়ে যাওয়ায় জেলার হাত পাখা শিল্পীদের  সমস্যায় পড়তে  হয়েছে। 
     

বৈদ্যুতিক  পাখা ও ঘরে ঘরে এসি মেশিনের চাহিদা  বাড়লেও গ্রামাঞ্চলে তালপাতার পাখার চাহিদা রয়েছে। যাদের বৈদ্যুতিক পাখার সুবিধা নেই , তাদের কাছে তালপাতার পাখা আজ ও পরম আদরনীয়। তালপাতার সব ধরণের  পাখা বানান  লদ্দার  আব্দুল শেখ। সংসারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন  তারা দুজন। ৩৫বছর ধরেএই শিল্পে যুক্ত আছেন। পরে এলাকাবাসীর অনেকেই এই পেশা বেছে নিয়়েছে। স্ত্রী  মোমেনা বেগম চাহিদা অনুযায়ী কাপড়ের পাখা ও তৈরি করেন। একটি পাখা বানাতে খরচ ৬/৭টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ১২ টাকা প্রতি  পিস। একদিনে ৪০/৬০টি পাখা তৈরি করেন আব্দুল সেখ‌। পাখার নানা ধরন আছে গোটা  জেলায়। সাধারণ পাখা ছাড়া আছে রিভলভিং পাখা  যা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া  খেতে হয়। এই পাখার হ্যাণ্ডেলটা একটা সরু নলের মধ্যে থাকে, যাাতে হাত ঘোরালেই পাখা  ঘুরতে থাকে। এছাড়াও আছে ফোল্ডিং পাখা, নকশি পাখা, সুতোরপাখা। হাত পাখায় শিল্পকাজের মিশেল দিয়ে তৈরি হয় নকশি পাখা। তালপাতা ছাড়া সুতো, বেত, খেজুরপাতাা, শোলা, শন, গমেরকাঠি ও ময়ূরের পালক দিয়ে নকশি পাখা তৈরি হয়। সেই নকশি পাখার  অনুসারে   পাখার বিচিত্র নামকরণ করা হয়। যেমন পালংপোষ, কাঞ্চনমালা, মনবিলাসী, ছিটাফুল, যুগলহাঁস, গম্বুজ তোলা, শঙ্খলতা, ষোলবুড়ির ঘর।
   

 এই নকশা আগে থেকেই ভেবেচিন্তে  করা হয়় না। বুনতে বুনতে জ্যামিতিক নকশা তৈরি হয়ে যায়। নকশি পাখার কদর সেই বেদ, পুরাণের আমল থেকে।  চাহিদার  অভাবে এই নকশি পাখা শিল্প আজ অনেক খানি বিলুপ্তির পথে।  তবে সাধারণ পাখার চাহিদা আজ ও ব্যাপক। এই ভূখণ্ডের  অনুকূল  পরিবেশ,  সুলভে পাওয়া তালপাতার  সাহায্যে নানা শিল্পকলা সংগঠিত হচ্ছে। তালপাতার শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাতপাখা। বর্তমানে চার ধরণের পাখা তৈরি হচ্ছে  (১)সাধারণ (২)রিভলমিং/ফোলডিং ৩)হাতপাখা (৪) নকশি পাখা। দক্ষিণ বাঁকুড়ার কুঁড়েবাঁড়কা, অম্বিকানগর, বনতিল্লা, দহলা, বৈদ্যনাথপুর, গোড়াবাড়ি, ধারগা লক্ষীসাগর, পুখুরিয়া, ছিরুডি, লদ্দা অঞ্চলের বহু মানুষ এই  লোকশিল্পের  সাথে  জড়িত। ব্যবহারিক ও নান্দনিক দিক এই শিল্পে অঙ্গীভূত। এই শিল্প ধারাটি  টিকিয়ে রেখেছে কম -বেশি ২২টি থানার  ও ব্লকের তপশিলী জাতি-উপজাতিও মুসলিম সমাজের অসংখ্য পুরুষ ও মহিলারা। শুধু সংসার চালানোর জন্য নয়, ভালোবাসার টানে এই শিল্পটিকে ধরে রাখতে চান অনেকেই। পাখা তৈরি করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেকেই সুন্দর সংসার সাজিয়েছেন। এই শিল্পটিতে কঠোরভাবে পরিশ্রম করতে হয় না। অনেক বয়সে এই কাজ করতে পারেন শিল্পীরা। ঘরে বসেই কাজ। এই কারণেই অনেকেই এই শিল্পটিকে ধরে রাখতে চান আজ ও। পাখা বিক্রি করে অনেকের সংসার ভালো চলছে। গোড়াবাড়ি, লদ্দা, পুখুরিয়া, দহলাও ছিরুডির দক্ষ শিল্পিরা হলেন জিতু, বরেন, মাখন, বাসুদেব, নারায়ণ, মনু, পেলু কালিন্দী, হেলা, দুখু, বাদল সহিস, সম্পদ, রবি, সনাতন, অশোক, প্রান বাউরি, আসমান শেখ, জবর শেখ, নুরআলি, নব মাহালী, বুলু ও কালু শবর। এটাই এই শিল্পের আলোর দিক। 
     

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তালপাতার পাখা চলতে পারছে না। একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা খেতে বসেছেন। কাঁসার থালায় ভাত, সাথে নানা ব্যঞ্জন। পরিবারের কেউ তাঁকে তালপাখার পাখা দিয়ে হাওয়া করছেন, এই দৃশ্য এখন আর নেই। প্লাস্টিকের ও ফাইবারের হাতপাখার দাপটে দু’দেশের গ্রামবাংলার তালপাতার পাখা শিল্প আজ অস্তিত্বের সংকটে। এমনিতেই ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। প্রতিবাড়িতে ইলেকট্রিক পাখা, এমনকি এসি রয়েছে। ফলে হাতপাখার প্রয়োজনীয়তা কমে গিয়েছে। প্রয়োজন হলে বাজার থেকে সস্তায় প্লাস্টিকের পাখা কিনছেন। তালগাছের সংখ্যা ও কমছে। ফলে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকেই ঝুঁকছেন শিল্পীরা। আধুনিকতার ছৌঁয়ায় এখন তালপাতার পাখার চাহিদা অনেকটা কমে গিয়েছে। কালের বিবর্তনে এই শিল্পটি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কাঁচাপাতার অপ্রতুলতা, উপকরণ সামগ্রীর (বেত, সুতো, রং,বাঁশ, মূলধন) মূল্যবৃদ্ধিও ভালো বিপণন কেন্দ্রের অভাব, এই শিল্পের পিছিয়ে পড়ার কারণ বলে মনে হয়েছে। সরকারি সহযোগিতায় এই শিল্প নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেতে পারে। আশার আলো হল, পুজোরপ্যাণ্ডেল তৈরিতে, উৎসবে, অনুষ্ঠানে, বিয়়ের মণ্ডপ তৈরির কাজে এবং নানান সৃজনশীল কাজে তালপাখার ব্যবহার কিছুটা হলেও বেড়েছে। সীমিত হলেও এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা শুরু হয়েছে জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েতের উদ্যোগে। তবেই প্রাণ পাবে ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন পাখা শিল্প আর পাখা শিল্পের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ। হাত পাখা, এটি একটি সম্ভাবনাময় লোকশিল্প। একে বাাঁচানো প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত