জীবনভর কবিতা লিখে গেছেন লুইজ গ্লিক। কবিতাকে তিনি তার জীবনের মতোই ভালবাসতেন। ছোটকাল থেকে কবিতা লেখা শুরু এবং চালিয়ে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। যদিও তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন কিন্তু তার মূল পরিচিতি ও খ্যাতি কবি হিসেবেই। তিনি ১২টির মতো কবিতার বই লিখেছেন। তার প্রথম কবিতার বই ফার্স্টবর্ন বের হয় ১৯৬৮ সালে এবং শেষ কবিতার বই উইন্টার রেসিপিজ ফ্রম দ্য কালেক্টিভ বের হয় ২০২১ সালে। এই দীর্ঘ অর্ধশতকালের কাব্যজীবনে তিনি অটল থেকেছেন তার চর্চায়, নিষ্ঠায়; উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন শিল্পমহিমায়।
তার কবিতার মধ্যে যা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো আত্মজৈবনিকতা ও বিষাদময়তা। তার কবিতা মৃদুপ্রবহ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হ্রস্বকায় ও চকিত অন্তমিলযুক্ত। তিনি কথা বলেন আপাতসরল ভাষায়, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবনের গভীর বোধ ও জটিলতা। সেখানে প্রগলভতা নেই, আছে পরিমিতিবোধ। শব্দকে তিনি ব্যবহার করেন অতি সাবধানে, অনেক চিন্তাভাবনা করে। তার কবিতার লিরিক্যাল কোয়ালিটিকে অনেকে এমিলি ডিকিনসন ও এলিজাবেথ বিশপের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার নির্মেদ-সংবেদী কবিতায় অলংকারের ঘনঘটা নেই। আছে সহজ কথোপকথন ও শুভ-অশুভের বার্তা। তার কবিতা আবেগঘন, মিথ ও প্রাকৃতিক চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ। আধুনিক জীবনের নানা অনুষঙ্গকে তিনি উপজীব্য করে তোলেন তার পঙক্তিমালায়।
গ্লিকের কবিতাকাঠামোয় বিষণ্ণতার স্বরটি বেশ স্পষ্ট। তীব্র মনস্তাত্ত্বিক অপঘাত, বিষাদ, বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব, সম্পর্কের ব্যর্থতা, মৃত্যু ইত্যাকার বিষয়ে আকীর্ণ তার কাব্যচিত্র। তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা দুঃখকষ্ট প্রতিফলিত তার কবিতায়। ছোটকালে তিনি অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা নামক এক জটিল মনোদৈহিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং বেশ কয়েক বছর চরম ভোগান্তির পর চিকিৎসায় ও মানসিক দৃঢ়তায় তার রোগমুক্তি ঘটে। এই ট্রমেটিক এক্সপেরিয়েন্স তাকে আজীবন তাড়িত করেছে। প্রুফস অ্যান্ড থিয়োরিজ নামক প্রবন্ধের বইতে তিনি তার অসুস্থতাকালীন স্মৃতিচারণ করেন: “আমি বুঝতে পারছি কোনো এক সময় আমাকে মরে যেতে হবে। কিন্তু আমি যা আরো স্পষ্টভাবে ও স্বজ্ঞাতভাবে জানি তা হলো আমি মরতে চাই না।” তার সাংসারিক জীবন সুখের হয়নি, ঘটেছিল বিবাহবিচ্ছেদ। তার সাংসারিক জীবনের ছন্দপতনের চিত্রটি বিশেষভাবে ধরা পড়ে ‘ভিটা নোভা’ কাব্যে। জীবনের নানাবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতার ছায়া পড়েছে তার লেখায়। তার জীবনের যন্ত্রণা যেন প্রকট হয় ‘দ্য এজ’ (প্রান্ত) কবিতায়: “বারবার আমি আমার হৃদয় বাঁধি খাটের মাথায় যখন কম্বলের নিচে আমার কান্নাগুলো তার হাতে শক্ত হয়ে ওঠে।”
গ্লিকের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় আত্মজীবনের ছায়া। সেখানে চিত্রিত ব্যক্তিজীবনের রূপরস যা নান্দনিক গুণে সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হয়। গ্লিক ২০২০ সালের নোবেল বক্তৃতায়ও নিজেকে “ঘনিষ্ঠ, ব্যক্তিগত কণ্ঠ” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ব্যক্তিজীবনের কথা বললেও তাকে ঠিক সিলভিয়া প্লাথ বা জন বেরিম্যানের মতো কনফেশনাল পোয়েট হিসেবে অভিহিত করা যায় না। তার ব্যক্তিত্ব মিথকথায় রূপ নেয় এবং সেখানে ব্যক্তি আর ব্যক্তি থাকে না। ‘ভিটা নোভা’ ও ‘সেভেন এজেস’ কাব্যে গ্লিক কল্পনা করেন তিনি সামাজিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করছেন এবং মানুষের আপাতসুখ প্রত্যক্ষ করছেন। ‘নেস্ট’, ‘এলসোয়ার্থ এভিনিউ’, ‘লিউট সং’, ‘ফর্মাগিও’ ইত্যাদি কবিতায় তিনি তার আত্মসত্তাকে অনুসন্ধান করেন যা ‘খাঁটি আত্মা, প্রকাশিত, / বিচ্ছিন্ন, অমর, / আত্মপ্রেমে প্রতিসরিত’ (ভিটা নোভা)।
জীবনের সুখদ বর্ণনার মধ্যেও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন বিষাদের সুর বেজে চলে। বাতির নিচেই যেন অন্ধকার। তার কবিতা বিষাদের বিশদ রেখাচিত্র। আনন্দ-নন্দনের বিপ্রতীপেই তার অবস্থান। ‘ফার্স্টবর্ন’ কাব্যে তিনি বিচ্ছেদবেদনায় বিধূর, ‘ডিসেন্ডিং ফিগার’-এ হারানোর আশঙ্কায় অস্থির। ‘দ্য ড্রাউন্ড চিলড্রেন’ কবিতায় বরফশীতল জলে শিশুদের ডুবে যাওয়ার চিত্রটি মর্মন্তুদ:
তুমি দেখতে পাচ্ছো, তাদের কোনো বিচার নেই
কাজেই এটা স্বাভাবিক তারা ডুবে মরবে,
প্রথমে বরফ তাদেরকে নিচে টেনে নেয়
তারপর পুরো শীত ধরে তাদের ওড়না
তাদের পিছনে ভাসে যখন তারা ডুবে যায়
তারপর সব সুনসান
পুকুর তার অজস্র কালো হাতে তাদেরকে টেনে তোলে।
কিন্তু মৃত্যু তো অন্যভাবে তাদের কাছে আসবেই
শুরুর খুব নিকটে
যেন সবসময় তারা অন্ধ ও ওজনহীন ছিল
কাজেই বাকিটা স্বপ্ন, বাতি,
টেবিল ঢাকা সাদা সুবস্ত্র, তাদের শরীর।
তারপরও তারা শোনে তাদের ব্যবহৃত নাম
পুকুরে পিছলে পড়ার প্ররোচনা যেন
তুমি কিসের জন্য অপেক্ষা করছো
ঘরে আসো, ফিরে আসো ঘরে,
হারিয়ে গেলে জলে, নীল, চিরতরে।
গ্লিক গ্রিক মিথকে আধুনিক অনুষঙ্গে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন তার কবিতায়। ‘দ্য ট্রায়াম্ফ অব একিলেস’ কাব্যে অভিজ্ঞতাকে তিনি মিথে রূপান্তরিত করেন। গ্রীক বীর একিলেসের বিজয়কে তিনি টেনে আনেন তার মৃত্যু আয়োজনে, ভালবাসার প্রান্তরে। ‘দ্য রিপ্রোচ’ ও ‘নাইট সং’ কবিতা দুটি ইরস ও সাইকির ভাবনাসঞ্জাত। ‘দ্য মাউন্টেন’ কবিতায় পাওয়া যায় সিসিফাসের কথা, ‘মিথিক ফ্রাগমেন্ট’ কবিতায় অ্যাপোলো ও ড্যাফনির কথা। ‘আভের্নো’তে পাই আমরা পার্সিফোনির কথা। ‘পার্সিফোনি দ্য ওয়ান্ডারার’ কবিতায় তিনি লিখেন “বাধ্যতায়, দুঃখে, ডিমেটার পৃথিবীকে ঘেরে। পার্সিফোনি কী করছে আমরা তা জানার আশা করি না। সে মৃত, মৃতেরা রহস্য।” আমরা সেখানে হেডিসের দেখাও পাই: “হেডিস যখন মেয়েটিকে ভালবাসার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে তার জন্য তৈরি করে এক পৃথিবীর প্রতিরূপ, সবকিছু একইরকম, বিস্তীর্ণ মাঠ, কেবল অতিরিক্ত একটি খাট” (এ মিথ অব ডিভোশন)।
গ্লিকের কবিতার বিশাল ক্যানভাস জুড়ে আছে প্রকৃতি। তিনি প্রকৃতির সন্নিধানে রচনা করেছেন তার ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ যেখানে বাগানের পুষ্পসমূহের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা ও আবেগের লক্ষণ প্রকাশ পায়; পুষ্পদেবী ঋতুর পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেন। তার ‘হাউস অন মার্শল্যান্ড’ কাব্যেও প্রকৃতির কারুকাজ বিদ্যমান এবং একে ইউরোপীয় রোমান্টিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে। ‘আরারাত’-এ ফুলেরা শোকের ভাষায় কথা বলে। প্রকৃতি বর্ণনায় বেজে ওঠে অপার্থিব সুর, যা পাঠকের অন্তরে জাগিয়ে তোলে প্রকৃতিপ্রেম। ‘মেডোল্যান্ডস’ ও ‘এ ভিলেজ লাইফ’ থেকেও পাঠকের প্রকৃতিপাঠ নিবৃত্ত হবে। ‘ইস্টার সিজন’ কবিতায় আমরা সাগরতটের বর্ণনা পাই:
কোনো শব্দ নেই … কেবল ঝোপঝাড়ের নড়াচড়া
সুগন্ধি উত্তাপ বেলাভূমি মাতিয়ে রেখেছে
আমি দেখছি লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে
ওয়েস্টচেস্টারে, ক্রকাসফুলে ছেয়ে যাচ্ছে সব।
আবার ‘মেরিডিয়ান’ কবিতায়:
লং আইল্যান্ড ঘুমিয়ে আছে
কোনো বাতাস নেই
নেতিয়ে পড়া আলোয়
খাড়িতে মৃদু শব্দ
হারিয়ে যেতে যেতে
দুটি রবিবারের নৌকা
অপেক্ষা করে
পক্ষাঘাত, অথবা শান্তি,
পোকামাকড়ের ভিড়ের মধ্যে
সূর্য ডুবে যায় কুয়াশায়
ঘোলাটে সাগরে মশকের ঢেউ।
বিষাদময়তায় বিপরীতে জীবনের আকাঙ্ক্ষারও ক্বচিৎ সাক্ষাৎ মেলে গ্লিকের কবিতায়। প্রেমের আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্দৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। মাঝে মাঝে ইতি ও নেতির আকাঙ্ক্ষায় ঘটে উভয়প্রাপ্তি। এর মধ্যে হয়তো খুঁজলে বিরোধাভাসও পাওয়া যাবে। ভাষায় বিক্ষিপ্ত স্ট্যাটাস, পাওয়ার, মোরালিটি ও জেন্ডার তার সাম্পর্কিক জ্ঞানকে প্রভাবিত করে। তিনি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন, নিজেকে প্রশ্ন করেন। চিন্তা ও অনুভবের মাঝপথ দিয়ে তিনি হাঁটেন। তার পা মাটিতে কিন্তু দৃষ্টি আকাশে। তিনি আবেগরসে নিত্য ও অনিত্যের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেন। তার কবিতা চলমানতা ও স্থিরতার এক আত্মিক সেতুবন্ধন। তার নিমগ্নতায় চেতন ও অবচেতনের মধ্যে পার্থক্য লুপ্ত হয়ে যায়। অপার অন্তর্মুখিনতার কারণে যদি তার কবিসত্তাকে ‘স্পিরিচুয়েল’ আখ্যা দেওয়া হয়, তাহলে ভুল হবে না।
প্রাত্যহিক জীবনের রূপকল্পে নির্মিত গ্লিকের কাব্যসৌধ। তাই তার দৃষ্টি ব্যক্তিমানুষের জীবনের দিকে, নাগরিক জীবনের আটপৌরে ঘটনাবলিতেও। ছোট ছোট দৃশ্য চোখের সামনে আসে, ভাসে, চলে যায়। তাদের গুরুত্বও কম নয়। ‘শিকাগো ট্রেন’, ‘দ্য এগ’, ‘থ্যাঙ্কসগিভিং’, ‘হেজিটেট টু কল’, ‘মাই কাজিন ইন এপ্রিল’, ‘লেবার ডে’, ইত্যাদি কবিতায় জীবনের ছোটখাটো ঘটনাবলি অপূর্ব তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। ‘রেডিয়াম’ কবিতায় তিনি সময়ের ও জীবনের সহজ চলমানতাকে তুলে ধরেন:
তারপর বসন্ত চলে যায়, বছর বিদায় নেয়
আমরা বদলে যাচ্ছি, আমরা বেড়ে উঠছি
কিন্তু এটি এমন কিছু নয় যা আমরা করতে চেয়েছি
এটি এমন কিছু যা ঘটে যায়
এমন কিছু যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
সময় চলে যাচ্ছে, সময় আমাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
দ্রুত গবেষণাগারের দরজার দিকে
তারপর দরজা পেরিয়ে খাদে, অন্ধকারে।
মা স্যুপ রান্না করছে
পেঁয়াজ দৈবক্রমে আলুর অংশ হয়ে গেছে।
গ্লিকের কবিকণ্ঠ বাচিক ও ভাষিক উজ্জ্বলতায় ভাস্বর। তার উচ্চারণ মৃদু, কিন্তু ঋজু। তার কবিতার মনোবিশ্লেষণ সম্ভব। ডায়ান বন্ডস তার কবিতাকে লাকার মনোতত্ত্বে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। মার্গারেট গর্ডন তাকে দেখিয়েছেন ইকো-ফেমিনিস্ট হিসেবে। কাব্য সমালোচক ডেনিয়েল মরিস তার বিখ্যাত ‘দ্য পোয়েট্রি অব লুইজ গ্লিক’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “গ্লিকের কবিতা বিচিত্র, প্রায়শ পরস্পরবিরোধী, সমালোচকগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করেছে। … কিন্তু এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে তার কবিতা পাঠ থেকে ভিন্ন ভিন্ন উপসংহার আসে। এটি দেখার বিষয় যে তার কাব্যতত্ত্ব কিভাবে নারীবাদ, পিতৃতন্ত্র, মাতৃত্ব, মনোবিশ্লেষণ, প্রকৃতি, এবং সর্বোপরি, ভাষার মতো মৌলিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। তার ক্ষেত্রে ভাষা আন্তরিকতা ও ছদ্মবেশের মাঝামাঝি ঘুরপাক খায়। সমালোচক ও পণ্ডিতগণ তার কাজ নিয়ে মতবিরোধ প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু এটি পরিষ্কার যে লুইজ এলিজাবেথ গ্লিক সমসাময়িক মার্কিন কবিতার এক প্রধান কণ্ঠ।”
গ্লিকের কবিতায় লিয়োনি এডামস, স্ট্যানলি কুনিৎজ, রবার্ট লাওয়েল, রাইনার মারিয়া রিলকে ও এমিলি ডিকিনসনের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তথাপি তিনি কবিসত্তায় স্বতন্ত্র ছিলেন, নিজস্ব কাব্যস্বর তৈরি করে নিয়েছিলেন। গ্লিক তার কাব্যদর্শনে ছিলেন প্রথাবিরোধী। তাকে কোনো প্রথাগত তকমার বাকশে বন্দি করা যায় না। তার লেখার ধরনটিকে শৈলী না বলে বলা উচিৎ প্রতিশৈলী। তিনি রাজনীতি ও ধর্মকে সযতনে এড়িয়ে চলেছেন। তিনি ইহুদী-আমেরিকান কবি হতে চাননি; নারীবাদী কবি হতে চাননি, কিংবা হতে চাননি অন্য কোনো ব্র্যান্ডের কবি। তিনি চেয়েছিলেন কেবল কবি হতে, নিজের মতো। এবং তিনি হয়েছেনও।