নোবেলজয়ী লুইস গ্লুকের কবিতা
মাত্র আঠেরো বছর বয়সে কবিতায় হাত খড়ি। ২৫ বছর বয়সে প্রথম কবিতার বই ‘ফার্স্টবর্ন’। লুইস গ্লুক। তাঁর প্রথম সন্তান, প্রথম কাব্যগ্রন্থই সাড়া ফেলে দিয়েছিল সাহিত্যের জগতে। তারপর আস্তে আস্তে বেড়েছে পরিধি। মেলভিন কানে, পুলিৎজার পুরস্কার জুটেছে আগেই। এবার তাঁর মুকুটে জুড়ল নোবেলের পালক। যে কবিতা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিল মৃত্যুর থেকে, সেই কবিতায় এবার তাঁকে পাইয়ে দিল শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান। আমেরিকার সেই আশ্চর্য কবির কিছু কবিতার অনুবাদ রইল, কয়েকজন কবির কলমে…
অনুবাদ: অমিতাভ পাল
লাল পপি
মন না থাকলেও হয়,
বড় কথা হলো- অনুভূতি থাকা;
আমার সেগুলি আছে এবং
ওরাই আমাকে চালায়।
স্বর্গে আমার প্রভুর নাম সূর্য,
আমি আমার হৃদয়ের আগুন তাকে দেখাই-
এই আগুনই আমার ভিতরে তার উপস্থিতির কথা বলে।
কিন্তু যদি হৃদয় না থাকে তাহলে?
ভাই বোনেরা- মানুষ হবার বহু আগে
আমাকে কি পছন্দ করেছিলে তোমরা?
তোমরা কি নিজেকে খোলার অনুমতি দিয়েছিলে
এবং তারপর আর কখনো খোলোনি?
এটা এজন্যই বলছি,
কারণ এখন তোমাদের মতোই আমি কথা বলি।
আমি কথা বলি কারণ আমি ছিন্নভিন্ন।
অনুবাদ: নন্দিনী সেনগুপ্ত
ইচ্ছে
(‘দ্য উইশ’ কবিতা অবলম্বনে লেখা)
মনে আছে তোমার,
সেবারে তুমি ঠিক কি কামনা করেছিলে?
আমি গুচ্ছের জিনিসের জন্য মানত করি,
মনে মনে সংকল্প করি।
সেবারে ঐ প্রজাপতির ব্যাপারে
আমি তোমাকে মিছে কথা বলেছিলাম।
আমি সবসময় আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে
তুমি ঠিক কী কারণে মানত করো!
আমি কী চেয়েছি তুমি জানো?
কী ভেবেছ?
নাহ, আসলে আমিও ঠিক জানিনা।
ভাবি ফিরে আসবো।
ভাবি শেষমেষ যেভাবেই হোক,
আমাদের মিলন হবে।
অবশ্য আমি সেটাই চেয়েছিলাম,
যেটার জন্য আমি সবসময় মানত করে থাকি।
আমি আরেকটা কবিতা চেয়েছিলাম।
অনুবাদ : খোরশেদ আলম
অনুবাদঃ অনিমিখ পাত্র
মা ও শিশু
আমরা সবাই স্বপ্নদ্রষ্টা, আমরা জানি না আমরা কারা
কোনো মেশিন আমাদের তৈরি করেছিল, এই দুনিয়ার মেশিন, বেঁধে রাখা পরিবার।
নরম চাবুকে ঘষামাজা হয়ে, তারপর দুনিয়ায় ফেরৎ যাওয়া।
আমরা স্বপ্ন দেখি; আমরা মনে রাখি না।
পরিবারের মেশিনঃ অন্ধকার লোমশ ফার, মাতৃদেহের অরণ্য
মায়ের মেশিনঃ মায়ের ভেতরে সাদা শহর।
এবং তার আগেঃ মাটি আর জল।
পাথরের মাঝে মস, পাতা আর ঘাসের টুকরো।
আরও আগেঃ বিরাট অন্ধকারের মধ্যে কোষগুচ্ছ
এবং তারও আগেঃ পর্দাঢাকা পৃথিবী।
এই কারণেই তোমার জন্মঃ আমাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য।
আমার মায়ের আর বাবার কোষ, এখন তোমার পালা
মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠার, মাস্টারপিস হয়ে ওঠার।
আমি সহসা উদ্ভূত, আমি কক্ষনও মনে রাখিনি।
এখন তোমার চালিত হওয়ার পালা;
তুমিই সে যার জানবার দাবি আছে
আমি কেন কষ্ট পাই? আমি কেন কিছু জানি না?
বিরাট অন্ধকারে স্থিত কোষগুচ্ছ। কোনো মেশিন আমাদের তৈরি করেছিল।
এবার তোমার ডাক দেবার পালা, জিজ্ঞেস করার পালা
কীসের জন্য আমি? কীসের জন্য আমি?
শীতের শেষ
স্থির এই পৃথিবীতে, কালো বৃক্ষশাখার মধ্যে
একা জেগে উঠে ডাকে পাখি।
জন্ম নিতে চেয়েছিলে তুমি, আমি তোমাকে জন্ম নিতে দেব।
তোমার খুশির পথে কখনই বা
আমার শোক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলো?
একইসঙ্গে ডুবে গিয়ে অন্ধকার আর আলোয়
সংবেদনের জন্য উন্মুখ
যেন তুমি নতুন একটা জিনিস, নিজেকে
প্রকাশ করতে চাইছ
সব চমৎকারিত্ব, সব প্রাণবন্ততা
কখনও ভাবোনি
যে তোমাকে কিছু মূল্য চোকাতে হতে পারে,
তুমি কখনও কল্পনা করোনি আমার কন্ঠস্বর
তোমার অংশ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে –
অপর জগতে তুমি তাকে শুনতে পাবে না
আর কক্ষনও পরিষ্কারভাবে পাবে না,
কোনো পাখির ডাকে বা মানুষের কান্নায়।
কোনো পরিষ্কার আওয়াজ নয়, কেবল
সমস্ত শব্দের
নাছোড় প্রতিধ্বনি
যার মানে বিদায়, বিদায় –
এক অবিচ্ছিন্ন রেখা
যা আমাদেরকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রাখে।
অনুবাদ: সুজিত মান্না
সুখ
দুজন শুয়ে আছে রাত্রির কোলে
সাদা বিছানার চাদরে শুয়ে আছে দুজন মানুষ।
ভোর খুব কাছে,
এইবার ওদের ঘুম ভাঙবে
মাথার কাছে লিলি জাগছে ফুলদানিতে
সূর্যের আলো ওদের পানপাত্রে তৈরি—
এখনই চুমুক দেবে।
পুরুষটি পাশ ফিরল, কোমল স্বরে ডাকল সঙ্গীকে
পর্দাটা দুলে উঠল, গেয়ে উঠল পাখিদল
নারীটি এবার পাশ ফিরল, আর তার সর্বাঙ্গ
তপ্ত হলো সঙ্গীর নিশ্বাসে।
চোখ খুললাম আমি…
সূর্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়
আমি তোমার মুখের দিকে তাকালাম,
আয়নায় দেখতে পেলাম আমাকেই।
আমরা স্থির; শুধু সূর্যটা আমাদের
যেতে থাকল পেরিয়ে, আলো ছড়াতে ছড়াতে।