কথাসাহিত্যে মা
কথাসাহিত্যে মা’কে নিয়ে লেখা বেশ কয়েকটি বই দাগ কেটেছে পাঠক মনে। যুগ যুগ ধরে পঠিত হচ্ছে এসব বই। মা কে উপহার দিতে পারেন তেমন কয়টি বই।
মা’কে নিয়ে ‘লা মাদ্রে’ নামে ইতালিয় লেখক গ্রেজিয়া দেলেদ্দার উপন্যাস লিখে ১৯২৬ সালে নোবেল পেয়েছেন।
রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির (১৮৮৬-১৯৩৬) ‘মা’ (১৯০৬) উপন্যাস অনুবাদ হয়েছে বিশ্বের বহু দেশে। ১৯০৫ সালের শ্রমিক বিদ্রোহের পটভূমিতে একজন সংগ্রামী মায়ের জীবন নিয়ে লেখা এ বই আজো অমর করে রেখেছে গোর্কিকে। বিভিন্ন দেশে এ বইটি নিয়ে সিনেমাও হয়েছে।
আর বাংলা ভাষাতেও মা’কে নিয়ে লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি কালজয়ী উপন্যাস। এরমধ্যে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের (১৯০৮ – ১৯৫৬) প্রথম উপন্যাস ‘জননী’ (১৯৩৫), শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) ‘জননী’ (১৯৫৮), মহাশ্বেতা দেবীর (১৯২৬-) ‘হাজার চুরাশীর মা’ (১৯৭৪), আনিসুল হকের (১৯৬৫) মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘মা’ (২০০৪) অন্যতম।
লা মাদ্রে: এই বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আবদুল হাফিজ। তিনি বইটি সম্পর্কে নিজেই বলেন, ‘লা মাদ্রের কাহিনী গড়ে উঠেছে এক যাজক ও তার মাকে নিয়ে। অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করে মা তার ছেলে পল’কে বড় করেছেন। বড় হয়ে পল যাজকত্ব গ্রহণ করে। এ অতি কঠিন দায়িত্ব। মায়ের মনে সদাই ভয় পল তার কর্তব্যের সীমা পেরিয়ে পাপের পথে যেন পা না বাড়ায়। কিন্তু সুন্দরী এজনিসের সঙ্গে দেখা হয় পলের। একদিকে কর্তব্য অন্যদিকে প্রেমের আকুতির মধ্য দিয়ে গল্প বেড়ে ওঠে। এবং শেষ হয় একটি করুণ মৃত্যুতে। সে মৃত্যু পলের মায়ের। গ্রেজিয়া দেলেদ্দা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অসাধারণ। গোটা কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে মা। অন্যান্য চরিত্রগুলিকে সমান সহানুভূতির সঙ্গে উপন্যাসিক নির্মাণ করেছেন। জীবনের দ্বিধা সংশয় ও আকাংক্ষাগুলিকে চমৎকারভাবে ধরতে পেরেছেন বলেই এই বই এতোখানি আদৃত।’
গোর্কির মা: রুশ সাহিত্যের তো বটেই, বিশ্ব সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি। শ্রমিক শ্রেণীর এই লেখক বইটিতে দেখিয়েছেন একজন কারখানা শ্রমিকের দরিদ্র স্ত্রী ‘পেলাগেয়া নিলভনা’ কিভাবে ধীরে ধীরে পরিনত হন বিপ্লবী নারীতে। পুরুষতন্ত্র ও শ্রেণী শোষণের তীব্র প্রতিবাদও এই বই। মা’র ছেলে সাসাও কারখানা শ্রমিক থেকে পরিনত হন বিপ্লবীতে। তারা সকলেই মরনপণ লড়াইয়ে নামেন সমাজ বদলে।
মানিকের জননী: মানিক বন্দোপাধ্যয়ের যে কয়েকটি লেখা কালজয়ী বলে সমালোচকরা দাবি করেন, তারমধ্যে তার গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জননী’ (২ মার্চ, ১৯৩৫) অন্যতম। বলা হয়ে থাকে এটি মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। ‘শ্যামা’ নামে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের বহুবিধ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই বইয়ে।
শওকত ওসমানের জননী: বাংলা ভাষার অন্যতম লেখক শওকত ওসমানের গবেষক মৌরী তানিয়া ‘জননী’ (১৯৫৯) বইটি সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি (শওকত ওসমান) রচনা করেছেন ‘জননী’-র মতো বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন প্রবাসী বাঙালী ওসমান জামাল। ‘জননী’ প্রকাশিত হয়েছে লন্ডনের একটি নামজাদা প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এই বিষয়ে শওকত ওসমান সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি শামসুর রাহমানকে তাঁর স্বভাবসুলভ চমৎকার ভঙ্গিতে বলতেন, ‘শোনো শামসুর রাহমান, আমি পাশ্চাত্যকে অন্তত একটি বাংলা শব্দ উপহার দিয়েছি – জননী।’ লন্ডনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকা ‘জননী’ বিষয়ে সপ্রশংস আলোচনা প্রকাশ করেছে।’
হাজার চুরাশীর মা: ৭০ দশকের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবের পটভূমিতে লেখা মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশীর মা’ (১৯৭৪)। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ সে সময় আছড়ে পড়েছে এপার-ওপার বাংলায়। কৃষক বিদ্রোহের আগুন, আর মাওসেতুং এর গেরিলা যুদ্ধের তত্ত্ব সে সময় উদ্বুদ্ধ করে তরুণ-তরুণীকে। হাজার হাজার তরুণ সে সময় আত্নঘাতি জনবিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দেন। অকাতরে তারা মারা পড়েন পুলিশের ‘এনকাউন্টার’ ও প্রতিপক্ষের হামলায়। এমনই এক মেধাবী বিপ্লবীর অকাতরে জীবন দেয়ার গল্প বলা হয়েছে এই বইয়ে। মর্গে তার লাশের নিবন্ধন নম্বর ছিল-১০৮৪, সেখান থেকেই উপন্যাসটির নামকরণ। গোবিন্দ নিহালিনী ১৯৯৮ সালে এটি হিন্দী ভাষায় সিনেমা করেন। সুজাতা চ্যাটার্জি নামের মা’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া বচ্চন।
আনিসুল হকের মা: মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে লেখা আনিসুল হকের উপন্যাস ‘মা’ (২০০৪)। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী যখন ঢাকা শহর অবরূদ্ধ করে রেখেছিল, সে সময় অকুতভয় গেরিলা গ্রুপ ‘অপারেশন ক্রাক প্লাটুন’ পাক-সেনাদের ওপর একের পর এক চালাতে থাকে সাহসী হামলা। তরুণ মুক্তিযো্দ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী (আজাদ) ছিলেন ক্রাক প্লাটুন গ্রুপের অন্যতম সদস্য। কিন্তু পাক সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পুরনো ঢাকার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে তাকে। আজাদের মা সাফিয়া বেগম ধর্ণাঢ্য পরিবারের স্ত্রী হয়েও স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে না পেরে ওই বাড়িতেই আজাদকে নিয়ে থাকতেন। পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর চরম নির্যাতনের মুখেও মুক্তিযোদ্ধা আজাদ কোনো তথ্য দেননি। সে সময় কারাগারে মা দেখা করেন আজাদের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা আজাদ মাকে জানিয়েছিল, পাক সেনারা তাকে মাটিতে শুতে দিয়েছে। আর তাকে ভাতও খেতে দেয়নি। এই ছিল মায়ের সঙ্গে শহীদ আজাদের শেষ সাক্ষাৎ। এর পর শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগম স্বাধীন দেশে ১৪ বছর ভাত না খেয়ে, মাটিতে শুয়ে কাটিয়েছেন। এসব সত্যি ঘটনাই উঠে এসেছে আবেগ তাড়িত ‘মা’ উপন্যাসে।