পাঠক মেয়ের মুখোমুখি লেখক মা (পর্ব-১)
সম্পূর্ণা মুখোপাধ্যায় এবং সোনালি মুখোপাধ্যায় ভট্টাচার্য
মা লেখে সন্তান পড়ে,অন্তরালে সমালোচনা ও হয়ত করে। কিন্তু সন্তান পাঠক হয়ে মা কে প্রশ্ন করছে,
এমন প্রায়শই দেখা যায় না। পাঠক মেয়ের মুখোমুখি লেখক মা, তাদের মধ্যে যে কথোপকথন তার চুম্বক অংশ রেকর্ড করেছে ইরাবতী টিম। লেখক সোনালী মুখোপাধ্যায় কে ভিন্নধারার অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে পাঠক মেয়ে সম্পূর্ণা মুখোপাধ্যায়ের। সেই প্রশ্নগুলোয় উঠে এসেছে লেখকের শৈশব থেকে বতর্মান। লেখার নানাদিক। আজ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য রইল সেই কথোপকথনের প্রথম কিস্তি।
মেয়েঃ কাফকা না পড়লে জাত যায়, এর’মই কিছু লোকের মন্তব্য শুনি। ( বাঙালি আঁতেল সমাজ, আমি আপনাদের দিকে তাকাচ্ছি)।
আপনি ত কাফকা না পড়েই দিব্যি আছেন। এমনটা কি করে হল? আপনি জাত রক্ষা করে টিকে আছেন কি ভাবে?
মাঃ আমি নেহাৎ বজ্জাত তাই। আর ইয়ে, কাফকা না পড়ি কীর্তন শুনে বড় হয়েছি ত।
আসলে ১৯৯৩ সালে বিয়ে হবার পর থেকে, এক রোজ ডায়েরি লেখা ছাড়া আর একটা বাংলা শব্দ ও ত লিখিনি। সাহিত্য কাকে বলে মনেও পড়ছিল না। দু জন ছোট্ট মানুষ, দু তিনটে বাড়ি পালটানো, সংসার গোছানো, সদ্য গজানো প্রাইভেট প্র্যাক্টিস , নিশ্বাস নেবার সময় ও ছিল না।
এর মধ্যে ছানাদের গান আর ছড়া শেখানো একটা আরামের জায়গা ছিল। বুদ্ধিমান এবং সুরেলা ছেলেমেয়ে পেয়েছিলাম, তারজন্য জীবনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
দুজনেই ইস্কুলে যেতে সুরু করল যখন, শব্দেরা সারি বদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে থাকল ডায়েরির পাতায়। বিয়ের সময় ত বয়স পঁচিশ।
ডায়েরির হিজিবিজিরা কখনো লোকসমক্ষে আসবে বলে ভাবিনি। কাজেই কৌলিন্যের চাহিদা শূন্য।
মেয়েঃ পঁচিশ শুনলে আমরা ভয় পেয়ে যাই। আমরা ত একুশে পা দিতে দিতেই বন্ধুদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানালে হা হুতাশ শুনি। ভাই আরো এক বছর বয়স বেড়ে গেল, কাজের কাজ কিছুই হল না।
আসলে আমার মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই সবার কৃতিত্ব দেখাতে এত ব্যস্ত, দিনের শেষে ওয়েবসাইটের পাতা খুলে মনে হয়; ধুর, আমি ত কিছুই করলাম না।
আর আছে একটা গতানুগতিক বাঙালি বাক্যি ঃ তোমাদের বয়েসে আমরা….
এই সব মিলিয়েই আমরা, মানে আজকালকার ছেলেমেয়েরা অযথা চাপ নিয়ে নিচ্ছি।
উল্টো দিকে এখন ইউরোপ এসে দেখছি ছবিটি একেবারে অন্যরকম।
তুমি বিয়ে কবে করবে প্রশ্ন পালটে হয়ে গেছে , আরে তুমি এত বাচ্চা মেয়ে বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছ কেন?
এনজয় ইয়োর টুয়েন্টিস।
এখানে ছেলে মেয়েরা ইস্কুল কলেজ শেষ হলে এক দু বছর গ্যাপ ইয়ার নিয়ে, দেশ অথবা দুনিয়া দেখে। তারপর ঠিক করে জীবন নিয়ে কি করবে।
মাঃ তোমাদের বয়েস মানে একুশে এসে আমি লাশ কাটার পাঠ চুকিয়ে জ্যান্ত রুগি দেখতে হাসপাতালের ডিউটি শুরু করেছিলাম। আর তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমি কত নগন্য একটা পরিসংখ্যানের অংশ।
পড়াশুনা, এত দূর, খুব কম মানুষই করতে পারে এ দেশে। যদি বা ছেলেরা চেষ্টা করে, মেয়েদের নিয়ে এত স্বপ্ন খুব মুস্টিমেয় কিছু পরিবার দেখে।
আর এই অনর্গল ইংরেজি বুলি, ইংরেজি গল্পের বই, আর্চিস, কর্নফ্লেক্স চিজ জ্যামের প্রাতঃরাশ আমার চাকুরে মা এবং সৌখিন বাবা মশাইয়ের দৌলতে পাওয়া সুবিধে যা মধ্য বা উচ্চবিত্ত কলকাতাই পরিবারেও বিরল।
মেয়েঃ তবে তোমার ক্ষেত্রেও বিয়ের বয়েস পার হয়ে যাবার ভয়ের জন্ম কোথা থেকে?
মাঃ সেটা এদেশে মায়েদেরই আগে গজায়।
আমার ক্ষেত্রে সমবয়েসী কলাবিভাগের ছাত্রী “তুতো “ বোনেদের আর বন্ধুদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়াটা বোধ করি ক্যাটালিস্ট হয়ে ছিল।
অবশ্য আমি অপরাহ্নের শিশু। মায়েদের প্রজন্মে যেখানে সবার একুশের মধ্যে দুটি সন্তান হয়ে যেত, সেখানে আমি একম এবং অদ্বিতীয়া জন্মেছি মায়ের চৌত্রিশ বছর বয়েসে।
হ্যাঁ, আমাদের বিয়ের পরেই হানিমুন এডভেঞ্চারে আন্দামানে গিয়ে এক অপূর্ব সুন্দরী স্প্যানিশ কন্যার সাথে আলাপ হয়েছিল। সে বাইশ। কলেজ সেরে পৃথিবীটাকে দেখতে বেরিয়েছিল। এক বছর পর ফিরে গিয়ে ইস্কুলে পরাবার প্ল্যান।
আমাদের বাবা মায়েরা এমন শুনলে মুচ্ছো যেতেন।
মেয়েঃ পতন এবং মূর্চ্ছা?
মাঃ ১০০%
পিছনে বিবেকের গান ও হয়ত, কুলাংগার সন্তানের দোষে কি সর্বনাশ হয় তার বিবরণ দিয়ে।
[ক্রমশ…]
.
