Irabotee,irabotee.com,ইরাবতী,শৌনক দত্ত,sounak dutta,copy righted by irabotee.com

মধ্যাহ্নভোজ

Reading Time: 5 minutes

‘হাসান, তোমার ফিয়াঁসের খবর কী?’ রবি ফিয়াঁসের চন্দ্রবিন্দুর উপর জোরসে চাপ দিল।

‘গতকাল বিকালে রোকেয়া হলের সামনে বসে কলিজি-সিঙগারা খেতে খেতে…’ হাসান থেমে গেল। ভাবলঃ শালা, আবার খাওয়া প্রসঙ্গ…মাথা থেকে সরছেই না।

‘কী হলো, বল, কলিজি-সিঙগারা…তারপর কী হলো?’

‘না, মানে বলল, তোমার যে লাইন তাতে আমার পোষাবে না।’

‘তুমি কী বললা?’

‘বললাম, আমার লাইন তো খারাপ না। সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করা কি খারাপ? ঝিনুক বলল: খারাপ না, তবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।’

‘শহরে কিন্তু মহিষের মাংস গরুর মাংস হিসাবে দেদার বিক্রি হয়।’ বলেই রবি নিজের ভুল বুঝতে পারল। প্রথমত: আলাপ আবার খাবারের দিকে ঝুকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত: হাসান তার মস্করায় আহত বোধ করতে পারে। ঝিনুকের ব্যাপারে হাসান খুব সিরিয়াস। তবে হাসান তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

‘ঝিনুক আরও বলল: তোমার এখন যা করা উচিৎ তা হল একটা চাকরি-বাকরি খোঁজা, বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়ানো নয়। বেশিরভাগ সময় তো তোমার কাছে এমনকি নাস্তা করার টাকাই থাকে না।’

গতরাত থেকে তাদের অর্থাৎ হাসান আর রবির শুধু চা, বিস্কিট আর মুড়ি চলছে, তাও আবার তারা যে মেসে থাকে সেখানকার মোড়ের দোকান থেকে বাকিতে কেনা। তাই তারা দুপুরে একটা ভালো ভোজের উদ্দ্যেশে বের হয়েছিল। পরামর্শটা রবির। পরিচিত একজনের বাসায় হানা দিতে হবে।

তারা তখন বাংলামোটর মোড়ের কাছাকাছি। রাস্তার অপর পাশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জংধরা সাইনবোর্ড ঝুলে আছে। তাদের পাশ দিয়ে একটা সিএনজি চালিত অটোরিকশা দ্রুত চলে গেল শাহবাগের দিকে। তারপর একটা মিরপুর-টু-মতিঝিল দু’তলা। একজন মধ্যবয়সী লোক রাস্তা পার হতে গিয়ে আবার ফিরে আসল। লোকটার সামনে দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল একটা মিনিবাস। পাঁচতারা হোটেলের। কয়েকজন বিদেশী নারী-পুরুষের মুখ দেখা গেল। মিনিবাসের গায়ে লেখা হোটেলের নামটা বড্ড ঝকঝক করে উঠল। তারপর আরও একটা সিএনজি । আরোহী তরুণ-তরুণী। তাদের পাশ দিয়ে সিএনজি যাবার সময় হাসান দেখল মেয়েটা ছেলেটাকে চুমু খেল। দৃশ্যটা রবিও দেখল তারপর হাত-ঝাড়া দেবার ভঙ্গি করল। তারপর বলল: হাসান, বাদ দাও। অনেক তো ট্রাই করলা…

এইবার হাসান আহত দৃষ্টিতে রবির দিকে তাকাল। বললঃ ‘ভাই, বললেই তো হবে না। মন তো মানতে হবে।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রবি তার নিজস্ব সংকটের জগতে প্রবেশ করল:

‘মিমের ব্যাপারটাই ধরো না। আমার সাথে এফেয়ার ছিল আর সে আমার সাথে থাকতেও চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা কী খেল্ দেখালো! ব্ল্যাকমেইল। বিয়ে হয়ে গেল অন্য ছেলের সাথে।’

‘মার্কেটিং-এ মাস্টার্স শেষ করার পরপরই ব্যাটা বলল তার ফার্নিচারের ব্যবসায় লেগে যেতে।’

‘ব্যাটা! ব্যাটা কে?’ হাসান আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল। তার চোখে আহত দৃষ্টি তখন আর নেই।

‘আরে! মিমের বাবা।’

‘আপনি কি লেগে গিয়েছিলেন?’

‘আমি ফার্নিচার কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেছিলাম ঠিকই। তবে মিমের বাবার প্রতিষ্ঠানে না। অন্য একটায়। মার্কেটিং-এ মাস্টার্স দেখে নিল। সেলারির অবস্থা কাহিল। আমি ভাবলাম নতুন তো, হয়ত তাই…’

‘কিন্তু না, দুই বছর চাকরি করার পরও একটা পাই পয়লা বাড়ল না। তারপর তো ক্যাচাল ম্যানেজারের সাথে। চাকরি চলে গেল…অন দ্যা গ্রাউন্ড অব ডিসঅবিডিয়েন্স। শালায় বলে কি, তোমার শরীরে এখনও ভার্সিটির গন্ধ! এমন ভাবে বলল মনে হল ভার্সিটি একটা গাঁজার কলকি। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমিও দিলাম এক ঘাঁ। বললাম আপনি তো ঐ চেয়ারটায় বসে বদ গন্ধ ছড়াচ্ছেন, দামী সেন্টেও কাজ হচ্ছে না। পরদিন আমার চাকরি নাই।’

‘ম্যানেজারের সাথে আপনার লাগল কী নিয়ে?’

‘একটা এক নম্বরের হারামি। নারী সহকর্মীকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেই জানে না। বিভিন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তাও বলত।’

‘তারপর কী হল?’

‘তারপর আর কী? চাকরিও গেল, মিমের বাবা মিমকে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। সে আসলে মানসিক ব্লাকমেইলের শিকার।’

তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর বলল: বাড়িতে গেলাম না কয়দিন আগে? তো মা জিঞ্জেস করছিল মিমের কথা। বিয়ে হয়ে গেছে শুনে মা কি বুঝলেন কে জানে, এ ব্যাপারে আর বেশি কিছু জানতে চাইলেন না।

‘আমি তখন পুটিঁমাছ আর কাঁচামরিচ দিয়ে রান্না করা তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। মা আরেক বাটি তরকারি আনতে উঠে গেলেন। আচ্ছা, আচ্ছা, এই মেনুটার নাম কী? সিদ্দিকা কবীরস্ রেসেপিতে কি এই এন্ট্রিটা আছে?’

‘জানি না। আমার মাও রান্না করেন। দূর্দান্ত!’ হাসান বলল।

তারা ততক্ষণে মগবাজার মোড়ে। মগবাজার ওয়্যারলেসের বিপরীত পাশে জীবন ভাইয়ের বাসা তাদের টার্গেট।

জীবন ভাই দরজা খুলে দিয়ে চমৎকার করে হাসলেন। তার হাসি দেখে বোঝা গেল না তিনি তাদের দুপুরে আসার উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছেন কিনা।

সব জায়গায় পরিপাটি এপার্টমেন্ট। ঘরগুলো সব সাজানো গোছানো। ড্রয়িং রুমটা বেশ বড়। একপাশের দেয়ালে বড়সড় একটা এলসিডি টিভি ঝুলছে। অন্য দুই পাশে তিনটা বড় বুকশেলফ। বইয়ের সংগ্রহ প্রচুর। হাসান ক্ষুধা আর হাঁটার ক্লান্তিতে সোফাতে এলিয়ে বসল। তবুও তাকে জ্য পল সার্ত্রের ‘আয়রন ইন দা সোল’ উপন্যাসটা টানতে লাগল। রবি ভেতরে গেল ভাবী অর্থাৎ জীবন ভাইয়ের বউ এর সাথে দেখা করতে। রবির সাথে জীবন ভাই ও ওনার স্ত্রীর বেশ কয়েক বছরের সখ্যতা।

হাসান ভাবল ফেরার সময় সার্ত্রের বইটা ধার নিতে হবে। দিবে কিনা বুঝতে পারছে না। একে তো কেউ বই হাতছাড়া করতে চায় না, কারণ ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায়ই থাকে না। আবার জীবন ভাইয়ের সাথে হাসানের তেমন সম্পর্ক তখনও তৈরি হয়ে উঠেনি যে বই ধার চাওয়া যায়। এই কথা ভাবতেই হাসানের আবার ক্ষুধাবোধ চাগিয়ে উঠল। আর তখন তার চোখে পড়ল দুই বুকশেলফের মাঝে রাখা টেবিলে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা গৌতম বুদ্ধ। কালো পাথরের দূর্দান্ত মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

‘গতবছর তিব্বত থেকে কেনা।’

হাসান চমকে উঠল, জীবন ভাই কখন তার পেছনে এনে দাঁড়িয়েছে সে টের পায় নি।

‘হাসান, ভেতরে চল। সবাই খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে।’

বেসিন থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে হাসান দেখতে পেল স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঢাকা কাঠের-তৈরি খাবার টেবিলে ব্যাপক আয়োজন। টেবিলের একপ্রান্তের চেয়ারে রবি বসে আছে; তার পাটের ঝোলাটা চেয়ারের মাথায় ঝুলিয়ে রেখেছে। রবির পাশের চেয়ারে বসে তার সাথে গল্প করছে ভাবী। হাসানকে দেখে ভাবী হাসল।

‘হাসান, তোমরা দুইজনে চলে এলে, মিশুকে আনলে না?’

‘ভাবী, মিশু ভাই বাড়ী গেছেন কয়েক দিনের জন্য।’

‘ওর বাড়ি কোথায়?’

‘বাহিরডাঙ্গা, গাইবান্ধা।’

‘মিশুর কথা মনে হলে তার সেই কবিতার কথা মনে পড়ে যায়।’

‘কোন কবিতাটা, ভাবী?’

‘ঐ যে যেদিন প্রথম রবি তোমার আর মিশুর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল, সেদিন সে আমাদেরকে পড়ে শুনিয়েছিল তার খাতা থেকে।’

‘কবিতাটা একটু বলেন, ভাবী।’

“শুয়ে আছেন কবি হাসপাতালে, করুণ শয্যায়

মুমূর্ষু জরাজীর্ন শরীর

আগত সুহৃদ এক জানতে চাইলেন:

কেমন আছো আজ?’

মৃদু হেসে কবি জানালেনঃ

আমি ভালো আছি, তবে আমার শরীরটা ভালো নেই।”

জীবন ভাই টেলিফোন ধরতে গেছিলেন। এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। বললেন: না, না, এখন কোন কবিতা নয়। এখন আমরা সবাই ক্ষুধার্ত।

খাবার টেবিলে সবাই বসলে রবি তার পাটের ঝোলা থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’ উপন্যাস বের করে জীবন ভাইয়ের হাতে দিল।

‘একটু দেরি হয়ে গেল, জীবন ভাই। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।’

‘আরে, কী বলছ! ফেরত পাওয়া গেছে, তাতেই আমি খুশি।’

জীবন ভাই স্বভাবসুলভ ঢংয়ে বলতে শুরু করলেন:

‘তোমরা বল: সকালে রাজার মতো, দুপুরে রাজপুত্রের মতো আর রাতে ভিখিরির মতো খাও। কিন্তু আমি মনে করি দুপুরের খাবার মানে মধ্যাহ্নভোজ হতে হবে রাজার মতো। কারন দুপুরেই আমাদের শরীর খাবার গ্রহনের জন্য সবচেয়ে বেশী আগ্রহী হয়ে উঠে।’

হাসান আর রবি খাবার নিয়েই ব্যস্ত ছিল, খাবারের সময়ের গুরুত্ব নিয়ে নয়। জীবন ভাই জীবন ও জগৎ, রাজনীতি ও অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আনেক কথা বলছিলেন, কিন্তু রবি বা হাসান মন দিয়ে শুনছিল না। তাদের ক্ষুধা কমে এলে হঠাৎ তারা শুনল জীবন ভাই কালিন্দী উপন্যাসের সূত্র ধরে ইএইচ কারের ‘কাকে বলে ইতিহাস?’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন: ‘সমস্ত দেবীদের মধ্যে ইতিহাসের দেবীই সবচেয়ে বেশি নির্মম………’

বারো বছর পর

আবার হাসান দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিপরীতে। তবে একা। কেন্দ্রের জংধরা সাইনবোর্ড এখন আর নাই। নতুন সাইনবোর্ড, ডিজাইনটাও ভালো। কেন্দ্রের নতুন ভবন উঠেছে। তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো একটা ঝকমকে গাড়ি। গাড়ির পেছনের আসনের দরজাটা খুলে গেলে হেমেন্তর পড়ন্ত বিকেলটা এক লহমায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। ঝিনুক ফুটপাতে উঠে এলো। হাসানের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালো। একটা শব্দও বের হল না হাসানের মুখ থেকে। ধাবমান যানবাহনের শব্দও আর তার কানে প্রবেশ করছিল না। কিন্তু ঝিনুকের চোখে দেখা গেল দু’ফোঁটা অস্রু টলমল করছে।

হাসান একটা ঘোরের ভেতর প্রবেশ করল। আর দেখল ঝিনুক গাড়ীর দিকে হেঁটে যাচ্ছে, গাড়ীর ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারপর তার চোখের সামনে শুধু পড়ে থাকল শহরের ধাবমান রাস্তা। কিন্তু ঝিনুকের চোখের ঐ দু’ফোঁটা অস্রুই মুক্তোর মতো প্রকাশিত হয়ে সন্ত্রস্ত বিকালটাকে মনোরম করে তুলল।

 

 

One thought on “মধ্যাহ্নভোজ

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>