| 28 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

মহাশ্বেতা ‘নারী’-কে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী থেকে মুক্তি দিয়েছেন জনতার মিছিলে

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়

মহাশ্বেতা দেবী—এই নামকরণেই আমরা তাঁকে চিনি এবং জানি। মহিলা লেখিকাকে ‘দেবী’ নামে সম্বোধন প্রথম থেকেই, নারী ঔপন্যাসিক বা সৃষ্টিশীল লেখায় মেয়েরা যখন নিজেদের স্বতন্ত্র মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছিল। ‘স্বর্ণকুমারী দেবী’, ঠাকুরবাড়ি থেকেই সম্মাননীয়া নারীদের নামের শেষে ‘দেবী’ শব্দ বসতে শুরু করেছিল। রাসসুন্দরী দাসী যখন আত্মকথা লেখেন, তখন দেবী ও দাসী-র মধ্যে প্রভেদ সূচিত হয়েছিল। নারী কখনও দেবী কখনও দাসী, মর্যাদায় দেবী, আত্মত্যাগে দাসী। মহাশ্বেতা ঘটক ভট্টাচার্য ‘দেবী’ মহিমার শেষতম সংস্করণ। যদিও মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য যখন লিখছেন কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন, সুচিত্রা ভট্টাচার্যরা এসে গেছেন বাংলা সাহিত্যের সৃজন মঞ্চে।

মহাশ্বেতা প্রথম ‘নারী’-র বিশ্বরূপ-কে প্রত্যক্ষ করালেন। ‘মেয়েদের লেখা’ বলে একপেশে একঘর থেকে লেখাকে মেয়েদের জগতে কেউ মুক্ত যদি করতে পারে তো তিনি হলেন মহাশ্বেতা। বিংশ শতাব্দী-র প্রথমেই জন্মগ্রহণ করে নারী সাহিত্যিকের আসনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আশাপূর্ণা দেবী। সেই আশাপূর্ণা দেবী-র জগৎ ছিল ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে বিশ্ব দর্শন। গৃহস্থের হাঁড়ি-হেঁশেলের গল্প বলে আশাপূর্ণাকে যারা একটি গোষ্ঠীতে বদ্ধ করতে চেয়েছিল, যাদের প্রতি নবনীতা-র অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ পেত সে সময়, সেটাও একটা যুদ্ধ। নবনীতা বারবার প্রতিবাদ করেছেন তার পিসিমা আশাপূর্ণার প্রতি বিদ্বজ্জনের এই অত্যন্ত সজাগ অবহেলা। আশাপূর্ণাকে আকাদেমি, জ্ঞানপিঠ, ডি.লিট পুরস্কার দিয়েও শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরের লেখিকা হিসেবেই বিবেচ্য করে রেখে দেওয়ার যন্ত্রণার সঙ্গে নবনীতা কখনও আপোষ করেননি, বরং প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস রচনা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা পুরুষ-লেখক পণ্ডিতদেরই একচেটিয়া অধিকার। সেই অধিকারে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস একটি না রাখলে নয় ‘অধ্যায়’ থাকবেই, সেটি হলো ‘বাংলা সাহিত্যে নারী ঔপন্যাসিক’ বা ‘সাম্প্রতিক স্ত্রী ঔপন্যাসিক’ জাতীয় পর্যায়।

এখনও যখন সাম্প্রতিক স্ত্রী ঔপন্যাসিক জাতীয় শব্দ পড়ি, তখন বুঝি নারীদের ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠাটা এখনও সাম্প্রতিকতম ঘটনা। আশাপূর্ণা নিজের বয়ানে লিখেছেন, যখন প্রথম আশাপূর্ণার নামে উপন্যাস প্রকাশ হতে থাকে, বিদগ্ধ সমাজ এমন সন্দেহ পোষণ করেছিলেন, এ কোনও পুরুষ ঔপন্যাসিক ‘নারী’-র ছদ্মনামে লিখছেন। বলাবাহুল্য পূর্বেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘অনিলা দেবী’ ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেছিলেন। সুতরাং মেয়েরা যে লিখতে পারেন, এটা প্রমাণ করতে হয়েছিল আশাপূর্ণা ‘দেবী’-কেই। সম্মাননীয়া নারীর সেই ‘দেবী’-তে রূপান্তর। নবনীতা-র মা-ও ছিলেন রাধারাণি দেবী, অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে তিনি লিখতেন, মহিলা কবি-র ছদ্মনাম ব্যবহার বিষয়টিও নতুন এবং অন্য ইতিহাস সৃষ্টির নজির।

আশাপূর্ণা-র থেকে মহাশ্বেতা প্রায় সতেরো বছরের ছোটো। কিন্তু মাত্র সতেরো বছরেই দুই লেখিকার শ্রেণিগত ব্যবধান পার্থক্য এতটাই দুস্তর এবং দুরূহ যে, শুধুমাত্র আশাপূর্ণা থেকে মহাশ্বেতা পর্যন্ত নারী ঔপন্যাসিকের লেখা ও ব্যক্তিজীবন আলোচনা করলে, আমরা খুঁজে পাব এই বঙ্গভূমে নারী স্বাধীনতা নারী সোচ্চারের আয়োজনের দ্রুতগতি। এই ব্যবধান এবং গতির মাঝে দেশভাগ অবশ্যই একটি অনুঘটক। আশাপূর্ণা-র পদবি ‘গুপ্ত’—এই পদবিটি শুনলে অনেকেই বলবেন এটি ওপার বাংলার পদবি, ওপার বাংলা তখন অপার বাংলা। দেশ বিভাজনের আঁচ আশাপূর্ণায় তেমনভাবে লাগেনি। আশাপূর্ণা বালিকা বধূ বা নাবালিকা বধূ যেভাবেই হোক তাঁর স্বামীর ঘরে চলে আসার পর থেকেই ‘ঘরে-বাইরে’-র বিমলা। স্বামী কালিদাস গুপ্ত তাঁকে পড়াশোনায় উৎসাহ জোগান। আশাপূর্ণা স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে বসেই আশাপূর্ণাকে নারী বিশ্ব উপলব্ধি করতে হয়। কলকাতার অন্তঃপুরের সংস্কৃতি আশাপূর্ণার কলমে।

মহাশ্বেতার জন্ম অবিভক্ত বাংলায়। স্বাধীনতার পর ওপার থেকে এপারে চলে আসতে হয় মহাশ্বেতাকে। মহাশ্বেতা-র মধ্যে কোথাও যেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ঘটনাক্রমে নীতা-র সৃষ্টিকর্তাও মহাশ্বেতা-র পরিবারের মানুষ। নীতা-র সঙ্গে মহাশ্বেতার যোজন পার্থক্য—নীতা হেরে গেছে হারতে বাধ্য হয়েছে, মহাশ্বেতা জিতে গেছেন, বা নীতাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে জীবনকে বাজি রেখে জিততে হয়, সে কৌশল শিখে গেছেন।

আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করা যায়, ১৯৬০ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি উপন্যাস লিখেছেন, যে উপন্যাসটির নাম ‘মহাশ্বেতা’। এই মহাশ্বেতা উপন্যাসটি একটি অসাধারণ মেয়ের ব্যক্তিত্ব এবং তার হয়ে ওঠার কাহিনি। মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য-র তখন চল্লিশের কোঠায় বয়স। মহাশ্বেতা তখন প্রতিষ্ঠিত। ঘাত-প্রতিঘাতে মহাশ্বেতা তারাশঙ্করের অনুপ্রেরণা কিনা বোঝা যায় না, তবে ‘মহাশ্বেতা’ পড়তে পড়তে গার্হস্থ্য জীবন থেকে বিশ্বজীবনে নারী যে মুক্তির পথ খুঁজছে সেটা বোঝা যায়।

আশাপূর্ণা-র উপন্যাসে নারী-রা ক্ষোভে দেওয়ালে মাথা ঠুকেছে, আত্মহত্যা করেছে, এক হাতে সংসার সেবা অন্য হাতে বই নিয়ে, ঘরে বসেই বিশ্ব সংবাদ অনুভব করে অনুভূতি-তে প্রমাণ করতে চেয়েছে ‘সংসার সুন্দর হয় রমণীর গুণে’—মহাশ্বেতা কিন্তু ‘পুরুষ’ শব্দটির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘরের বাইরে চলে এসেছেন। প্রতিটি লেখকের লেখা শুরু হয় রোমান্টিক কাহিনি দিয়েই, সেটা লেখকের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ, বয়সের বৈশিষ্ট্য। ধীরে ধীরে সে-ই লেখকই প্রেম থেকে দাম্পত্য, দাম্পত্য থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন। মহাশ্বেতা কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর সে সময়ের ছাত্রী তিনি, সে সময় স্বপ্নেও কল্পনা করা যেত না, বিশ্বভারতী থেকে ‘নোবেল’-টি একদিন চুরি যাবে। বিপ্লবের আত্মীয়তা যে সততার সাথে, সেটি বোঝা যায়, মহাশ্বেতার জীবন চর্চা-য়। তাঁর লেখা ঘামের সঙ্গে রক্ত মিশিয়ে নির্জনে শান্তি চয়নে দই পাতা-র মতো তাঁর লেখার পরিবেশ নয়, তিনি অন্তজ দলিত অবহেলিত মানুষদের সঙ্গে মাঠে ময়দানে যে আত্মীয়তার রক্ত সম্বন্ধে লড়াই করেছেন, পাশে থেকেছেন, তেমনই তাদের গল্প যখন তিনি কালি-কলমে লিখেছেন তখন চলচ্চিত্রের মতোই অনায়াস সাবলীল। মহাশ্বেতা তাঁর সংগ্রামী জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন নারীকে আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার কোনও বিধাতা বা পুরুষের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকে না। নারী যেহেতু পুরুষের মতোই সম-মানের এবং সমমূল্যের মানুষ, তাই নারীকেই নারীর আপন ভাগ্য জয় করবার জন্য সচেষ্ট হতে হয়, কর্মী হতে হয়, বীর হতে হয়, আর ঠিক এই কারণেই মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য-র প্রথম উল্লেখযোগ্য লেখাটি যখন নির্বিরোধে বিবেচিত হয়, সেট হয়—’ঝাঁসীর রাণী’। ঝাঁসির রাণী যিনি পুরুষের পোশাকে পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধে নামে, অসম যুদ্ধ, তবু প্রাণ দেওয়ার পৌরুষ যে শুধুমাত্র পুরুষের নয়, নারীরও সে পৌরুষ আছে তার অবশ্য সম্ভাবী প্রতীকার্থ ধরা পড়ে লক্ষ্মীবাঈয়ের ইতিহাস-এ। আর এই ইতিহাসকেই সাহিত্যে নতুন দর্শন দেন মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য। দ্রৌপদী-কেও তিনি আধুনিক মাত্রা দেন। নারী-র নিরাভরণকে পুরুষ স্রষ্টা শৈল্পিক চাতুরতায় মদিরা পানের বিবষতায় যেভাবে ব্যবহার করেন, মহাশ্বেতা সেই ব্যভিচার পুরুষের পিঠেই চৈতন্যের চাবুকের কশাঘাত। এ কারণেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে মহাশ্বেতা-র সাহিত্য অনুবাদে অনূদিত হয়ে, বাংলা-বিহার-অসম-ওড়িশা হয়ে গোটা ভারতে এবং ভারতেরও বাইরে।

মহাশ্বেতা-র আর একটি পরিচয় তিনি হাজার চুরাশির মা, তিনি যেমন শবরদের মা, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ভূমিহীন মানুষের মা, সত্তরের দশকে তিনি হাজার চুরাশির মা। মহাশ্বেতার মাতৃত্বটিও বেশ মাতৃতান্ত্রিক—এখানে মাতৃতান্ত্রিক শব্দটি পিতৃতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধী। ‘মাতৃত্ব’ শব্দটির মধ্যে লালিত-র লালিত্যটুকুই ধরা পড়ে, পিতৃতান্ত্রিকতার শ্রম-নির্ভরতার সংজ্ঞাটি যখন মাতৃতান্ত্রিকতার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে যায়, মাতা তখন শুধু স্তন্যদায়িনী নন, তিনি অন্যদায়িনীও বটে, ‘বসুমতি কেন তুমি এতই কৃপণা/কত খোঁড়াখুঁড়ি করে পাই শস্য কণা’—বসুমতি যে সহজে অন্ন মুখে তুলে দেন না, বরং জীবজগতে পুরুষ প্রজাতি ‘মাতা’ নামক নরম তুলতুলে রমণীয় নারী-র থেকেই জীবনে আহার্য সংগ্রহের কঠিনতম পাঠটুকু নেয়, সে-ই পাঠ মহাশ্বেতা ঘটক-ভট্টাচার্য আমাদের প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ‘নারী’-র লেখায় নারী জগৎ নয়, সম্পূর্ণ মানুষের পূর্ণ পৃথিবীর জগৎ যে প্রতিফলিত হতে পারে, মহাশ্বেতা ক্রমশই তাঁর লেখায় সেটা প্রমাণ করেছেন। মহাশ্বেতা-র উপন্যাসে ‘মেয়েমানুষ’ করে রেখে দেওয়ার সমাজের ছল-ছুতো সুন্দর উপসর্গে উঠে এসেছে, রুদালি কান্নাওয়ালিদের পেশা আমাদের সেই সত্যের সঙ্গে পরিচয় করায়, যেখানে মেয়েদের রুজি-রোজগার সমাজে ‘মেয়েমানুষ’-কে মেয়ে-মানুষ করে রাখার অভব্য প্রবণতায়। মহাশ্বেতা তাই আশাপূর্ণার জগৎ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছেন ইতিহাসের দায়বদ্ধতায়। আশাপূর্ণা নারীকে তার সংস্কারের আসনে আবদ্ধ থেকেই বিশ্বজগৎ দেখানোর যে প্রয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন সে পথেই নারীকে ক্রমবর্ধমান উন্নতির ধারাবাহিকতায় মুক্তি দিলেন মহাশ্বেতা। আশাপূর্ণা দেবী থেকে মহাশ্বেতা দেবী একটি বৃত্ত পরিপূর্ণ। যে বৃত্তে আশাপূর্ণা প্রথম দরজা খুলেছিলেন, মহাশ্বেতা সাধারণ নারীকে খোলা জানলা দিয়ে আকাশ দেখা ছেড়ে আকাশে ওড়ার প্রেরণা জোগালেন, নারীকে আকাশে ওড়ালেন। এই কিছুদিন আগে যখন লাঙল যার, জমি তারই বলে প্রমাণ হলো শীর্ষ আদালতের সিঙ্গুর মামলার রায় দানে, সেদিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘সিঙ্গুরের লড়াইকে যাঁরা সমর্থন করেছিলেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। আর যাঁরা সমর্থন না করে ধর্মতলায় আমার ২৬ দিনের অনশন এবং সিঙ্গুরে ১৪ দিনের অবস্থানের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদেরও বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। আমার মনে পড়ছে মহাশ্বেতাদি কবীর সুমনের সঙ্গে এসেছিলেন। ওঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। মহাশ্বেতাদি বেঁচে নেই। উনি আজ বেঁচে থাকলে দারুণ খুশি হতেন।…’ মহাশ্বেতা নারীর যে বিশ্বরূপকে পাখির চোখ করেছিলেন, নারীর সেই বিশ্বরূপের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নারী-র কেমন হওয়া উচিত, নারীর যথার্থ সংজ্ঞা ঠিক কেমনটি তার গন্তব্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা তাই পুরোনো সম্প্রচারে দূরদর্শনের ফাইল-মুভি-তে দেখি মহাশ্বেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছেন। সিঙ্গুর জয়ের মতো নারীর সেই জয়ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সার্থক করবেন। লেখকেরা ত্রিকালদর্শী হন, লেখকেরা সত্য দ্রষ্টা হন। মহাশ্বেতা দেবী-র অতীন্দ্রিয় দর্শন ভবিষ্যতে প্রমাণ করবে নারী পুরুষের চেয়েও অনেক বেশি শক্তির তৃতীয় নয়নের অধিকারী, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা এবং মানুষের সকল মহাগুণ নারীর মধ্যে বিদ্যমান, নারী মহিয়সী গরিয়সী নয় শুধু, মহাপুরুষের মতো মহামানবের মতো মহামানবীও বটে।

লেখক শুধু লিখেই ক্ষান্ত হন না, জড়িয়ে পড়েন মানব মুক্তির বিভিন্ন আন্দোলনে। রবীন্দ্রনাথেও আমরা প্রত্যক্ষ করি, দেশাত্মবোধক গান যেমন রচনা করছেন, রচনা করছেন স্বদেশবোধ জাগানোর মতো সাহিত্য, তেমনই বঙ্গভঙ্গ-এ প্রতিবাদ করছেন, রাখীবন্ধন উৎসবকে অন্যমাত্রায় ব্যবহার করছেন। মহাশ্বেতা স্বাধীন ভারতে বসাই টুডু-দের পাশে দাঁড়ালেন। মৃত্যুর পর মহাশ্বেতার চিতাভস্ম সারা ভারতের পুণ্যভূমিতে যেমন ছড়িয়ে পড়ল, তেমনই পুরুলিয়ার শবররা, তাঁদের মা-মহাশ্বেতাকে চিরকালের জন্য অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে ঊষর মৃত্তিকায় প্রতিষ্ঠা করল। মহাশ্বেতার কর্কশ-কণ্টক জীবন সংগ্রামকে অন্য মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করল। ‘মন্দির’ শব্দটি শুধু বর্ণহিন্দুত্বের রক্ষণশীল অধিকারের আধার মাত্র নয়, মাতৃ মন্দির কতভাবে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর মানুষগুলোর মহাজীবনে মহানাগরিকের সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধে, জন্ম-জন্মান্তরের, মূক মুখে প্রতিবাদের ভাষা সঞ্চার করে, আন্দোলনকে পৌঁছে দেয় আধ্যাত্মিকতার মৌনী মাত্রায়, সেটাই পুরুলিয়ার শবর-খেড়িয়াদের আশ্রমকে চিহ্নিত করে। ‘লোধা’ মানেই চোর এই নিষ্ঠুর প্রবাদের ‘ডাইনি’ অপবাদ থেকে সভ্য সমাজের ষড়যন্ত্র মহাশ্বেতা বিড়ির টানের ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন।

মহাশ্বেতা ‘নারী’-কে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী থেকে মুক্তি দিয়েছেন জনতার মিছিলে। এই মুক্তির জন্য মহাশ্বেতার প্রথম পাঠ সাহিত্য রচনা। সাহিত্য যে জীবনের বাইরে নয়, জীবন-হীন কোনও ইউটোপিয়া নয়, বরং জীবনই সাহিত্যর চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চিত বর্ণময় সুপাঠ্য। জীবন-সাহিত্য-সাহিত্য-জীবন—মহাশ্বেতা পুরুষ-লেখক নারী-লেখক-কে এক করে দিয়েছেন, লিঙ্গবৈষম্য ঘুচিয়ে দিয়েছেন।

 

 

 

সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৬ পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত