Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

মহাত্মাগান্ধীর অহিংস আন্দোলন ও আজকের ভারত

Reading Time: 4 minutes

পৃথিবীতে অশান্তি আছে বলেই শান্তি এত প্রশান্তির। ঠিক তেমনি আমাদের চারপাশে সহিংসতার ব্যাপকতা এত বেশি যে আমরা ‘অহিংস’ নামে কোন শব্দ আছে সেটাই ভুলতে বসেছি।

বৈশ্বিক পর্যায় থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে সমাজ,সমাজ থেকে পরিবার, পরিবার থেকে ব্যাক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে অহিংসার চর্চা, লালন-পালন নেই বললেই চলে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমরা আমাদের মন মগজ মস্তিকে সহিংসার চর্চা লালন ও অনুশীলন করছি। যার ছাপ পড়ছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে একদম ব্যাক্তি পর্যায়ে।

বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিজেদের আধিপত্য, অস্তিত্ব বজায় রাখতে পৃথিবীজুড়ে সহিংস কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। অনেক ক্ষেত্রে মারণান্ত্র বিক্রির স্বার্থেও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো দেশে দেশে কৃত্রিম সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

জাতিগত সহিংসার বিভৎস রুপ দেখেছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা কিভাবে দলে দলে এসে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করার পেছনে সেদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাখাইন জনগোষ্ঠীর স্বার্থ যেমন জড়িত তেমনি জাতিগত নিধনের পেছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যও আছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে চীনের সহায়তায় বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে চায় মিয়ানমার। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচিত হিংসাত্নক ঘটনার একটি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো গণহত্যা। যদিও বিশ্ব নেতারা একে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে মানতে নারাজ। মোটা দাগে বলতে গেলে বলতে হয় এটা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা বা আরও পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় এটা বাংলাদেশের একার সমস্যা।

করোনা মহামারীর আগে ভারতের কাশ্মীরে রাষ্ট্রীয় মদদে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়া হয়। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করে কাশ্মীরবাসীর বিশেষ সুবিধা বাতিল করা হয়।

৩৭০ অনুচ্ছেদটি রাজ্যটিকে বিশেষ ধরণের স্বায়ত্বশাসন ভোগ করার অধিকার দিতো, যা রাজ্যটিকে নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন তৈরি করার অনুমোদন দেয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বিষয়ক ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ থাকেেতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।

এর ফলস্বরুপ জম্মু ও কাশ্মীর নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইন নিজেরা তৈরি করার ক্ষমতা রাখতো।

এই অনুচ্ছেদের ফলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষরা জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কিনতে পারতেন না এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারতেন না।

অনেক কাশ্মীরী মনে করেন, কাশ্মীরের বাইরের মানুষকে সেখানকার জমি কেনার বৈধতা প্রদান করে বিজেপি আসলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের জনতাত্বিক বৈশিষ্ট্য বদলাতে চায়।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সাথে যোগ দেয়া একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য ছিল কাশ্মীর; আর সংবিধানের বিধানটি ভারতের সাথে কাশ্মীরের আশঙ্কাজনক সম্পর্কের বিষয়টিই তুলে ধরেছিলো। ৭৩ বছর পরে এসেও ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ উপলন্ধি করতে পারছে গান্ধীজীর অভিন্ন ভারত আন্দোলন কতোটা যুক্তিযুক্ত ছিলো।

ভারতীয় উপমহাদেশের সব সমস্যার উৎপত্তি ৪৭ সালের দেশভাগ। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশকে স্থায়ী সমস্যার আর্বতে ফেলে দেওয়ার জন্য ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে দেশভাগের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই তুষের আগুন আজ অবধি জ্বলছে।

চলতি বছরের শুরুতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভারত। দুটো আইন ভারতের সাংবিধানিক মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে; এর ফলে ভারতের অনেক অধিবাসীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে।  জোরপূর্বক অনেকের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে।

আসামে এনআরসির ফলস্বরূপ নাগরিকত্ব হারায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যা আসামের পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। এ উত্তাপের পেছনের কারণ শুধু মুসলিম বাঙালিদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে  নেওয়াই নয়, বরং প্রকাশিত ওই নাগরিক নিবন্ধনে বাদ পড়েন প্রচুর বাঙালি হিন্দু, যারা অবৈধ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যান। নাগরিকত্ব হারানো অনেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে ভীড় করেন।

অভ্যন্তরীণ চাপে ক্ষমতাসীন বিজিপি সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের রাজি হয় এবং এ-ও বলে, প্রকাশিত নিবন্ধনপত্রটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল।

ক্ষমতার দুই মেয়াদেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃতাধীন ভারত সরকার ধর্মীয় ইস্যু পূজিঁ করে হিংসার বিষবাম্প ছড়াতে চেয়েছে। অনেকক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। যা ভারতের মতো বহু জাতির ও বহু সংস্কৃতির দেশের জন্য লজ্জাজনক।

কাশ্মীরের মতো অতটা প্রকাশ্যে না হলেও বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি আদিবাসী গোষ্ঠীর অধিকারি খর্ব করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পরে সেখানে কার্যত অলিখিত সেনা শাসন চলছে। বাঙালি সেটেলারদের রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর মদদে পূর্ণবাসন করে আদিবাসীদের ক্রমশ সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হচ্ছে। জমি নিয়ে বিরোধে আজ পর্যন্ত কতজন আদিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

শান্তিচুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ননা হওয়ায় আদিবাসীদের বিবাদমান গ্রুপের মধ্যে সংঘাত বাড়ছে।  সেখানে পরিকল্পিতভাবে হিংসার চাষাবাদ করা হচ্ছে।

করোনা মহামারী আসার পরে মনে করা হচ্ছিল বিশ্ববাসীর মনোজগতে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। আসলে কিছুই পরিবর্তন হয়নি। হিংসা সংঘাতের চাষাবাদ জারি আছে ক্ষেত্র বিশেষে আরও প্রকট হয়েছে। করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারী মানুষকে সর্বজনীন করতে পারেনি। হিংসার অনুশীলন থামেনি।

কোন শক্তিধর দেশের রাষ্ট্র প্রধান সামরিক ব্যায় কমিয়ে স্বাস্থ্য সেবা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ঘোষণা দেননি। বরং করোনা মহামারীর মধ্যেও কয়েকটি দেশ ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। বিশ্বেও বিভিন্ন প্রান্তে অস্ত্রের ঝনঝনানি থামেনি।

কদিন আগে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের এক লাখ ৬৬ হাজার বসতি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। আর এই কারণে ১০ লাখ ফিলিস্তিনি অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছেন।

এতসব সহিংস ঘটনার পরেও কিছু কিছু অহিংস ঘটনা আমাদের মনকে আজও নাড়া দেয়। সেই অনুপ্রেরণাতেই অহিংস বিশ্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়।

১৯৩০ সালে গান্ধী ভারতীয়দের লবনের ওপর কর আরোপের প্রতিবাদে ৪০০ কিলোমিটার (২৪৮ মাইল) দীর্ঘ ডান্ডি লবণ পদযাত্রার নেতৃত্ব দেন, পরবর্তীতে যা ১৯৪২ সালে ইংরেজ শাসকদের প্রতি সরাসরি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। তিনি বেশ কয়েকবার দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে কারাবরণ করেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীজীর পদযাত্রাই ছিলো বিশ্বের প্রথম অহিংস আন্দোলন।

১৯৭১-এর মার্চে বাঙালি জাতি তার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ও  নেতৃত্বে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত এই কার্যকর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ছিল বিশ্বের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

অসহযোগ আন্দোলনে হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে শুরু করে বেসামরিক প্রশাসনে কর্মচারী, আধাসামরিক বাহিনী থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত সবাই সক্রিয় সমর্থন জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধুর  নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থেকেও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে নিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারবিহীন স্বাধীন প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। যার সমাপ্তি ঘটে ২৫ মার্র্চ কালরাত্রিতে ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ মাধ্যমে।

গত ২ রা অক্টোবরমহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে মহাসমারোহে ভারতসহ বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস’ পালিত হয়েছে। অশান্তির আগুন জ্বেলে অহিংস দিবস পালনের যে কোন মানে হয় সেটা নরেন্দ্র মোদীর উগ্রবাদী মর্তাদশের বিজেপি সরকারের বোঝা উচিত।

বহুমত বহু পথের উজ্জল দৃষ্টান্ত ছিলো ভারত। যেখানে মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, মাষ্টার দা সূর্যসেন, ক্ষুধিরামের মতো ব্যাক্তিদের জন্ম হয়েছে।সেই ভারত আজ মহাত্মা গান্ধীর আর্দশ থেকে যোজন যোজন দুরে সরে গেছে, দুরে সরে যাচ্ছে।

ভারতের চালিকা শক্তি ভারতের একশো ত্রিশ কোটি জনগণের হাতে তারাই ঠিক করবে আগামীতে ভারতের পথ নির্দেশিকা কী হবে তারা কী উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিচয় ধারণ করে বিশ্বে সুপার পাওয়ার হওয়ার দৌঁড়ে অবতীর্ণ হবে নাকি বহু মত বহু পথ বহু জাতিসত্ত্বার মিলনস্থল হিসেবে সমগ্র বিশ্বে নিজেদের মেলে ধরবে।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>