| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী ছোটগল্প: সাধু গুনিনের খুলি । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

 

মুখাগ্নি হয়ে গেল। সুনীল সাদা থান গায়ে জড়িয়ে সাত পাক ঘুরে এসে খড়ির জ্বলন্ত শিখা চেপে ধরে পরমপূজ্য পিতার মুখে। তখন আকাশ ছায়া ছায়া সন্ধে নেমে আসে নাকি মেঘ জমেছে কে জানে, সেদিকে তাকাবার ফুরসত নেই। পুরোহিতের নির্দেশ, মন্ত্রপাঠ, তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলানো অদ্ভুত আচ্ছন্ন করে রাখে সকল মনোযোগ। বোধশক্তিহীন অন্ধকার বিবর থেকে কানে এসে বড় ধাক্কা বাজে। বেজে যায় আর সে-সবের মধ্যে জেগে ওঠে বিস্বাদ উপলব্ধি। বাবাকে হয়তো বাঁচানো যেত। তখনো গমকে গমকে দীর্ঘ শোকের উচ্চারণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

‘সাধু রে…চলি গেলু রে, ও সাধু-উ-উ, সাধু রে…চলি গেলু রে…ও সাধু-উ-উ।’

মানুষের সেই শোক-সন্তাপ কৃত্রিম নয়। কেউ কেউ বাবার সমবয়সি। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আছে তাদেরও। সুনীলের এসব স্বস্তি দেয় না। অথবা সেই অনুভূতি মরে গেছে। সে ভাবলেশহীন নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। চিতার উপর ধীরে ধীরে উঠে বসে বাবা। তখন হরিশংকর বাঁশের ডগা দিয়ে দুটো বাড়ি দেয়। আবার শুয়ে পড়ে লাশ। সুনীলের বুকের মধ্যে হাতুড়ির তীব্র ঘা। সে ব্যথা-যন্ত্রণা নীরবে নিভৃতে ছড়িয়ে যায় রক্তধারায়। পশ্চিমে নদী। একসময় দলবেঁধে গঙ্গাসাগরে স্নান করত। এখন শীর্ণ খাল। শ্মশানের এই প্রান্তে কিছু খানাখন্দক আছে বলে বুক সমান পানি। এখানে আরও একবার ডুব দিতে হবে তাকে। পাড়ের একধারে কতগুলো মালতির ঝাড়। চৈত্রের ধুলো জমে জমে ম্লান। বুকে ধরে আছে পাঁচ পাপড়ির কয়েকটি সাদা ফুল। সেই ঝোপের পাশে জড়ো করে রাখা সাদা থান কাপড়। একটুকরো লাল-গেরুয়া। সেখানে ছুড়ে রেখেছে। অস্থি-ভস্ম ইত্যাদি বেঁধে নিতে হবে। তারপর বিসর্জন। থানের অন্য একটি অংশ পরনে তার। এই একটি কাপড়ে কাটিয়ে দিতে হবে তেরো দিন আর রাত। নানান হযবরল ভাবনায় অথবা অন্যকিছু তার ভালো-মন্দ উপলব্ধি করার অবস্থা নেই। দু-চোখে ভাসে পুড়ে যাওয়া মানুষটির অবহেলা।

নাম যশ সব ছিল। অনন্ত সাধু গুনিনকে চেনে না এমন মানুষ আশপাশের দশ-বারো গ্রামে নেই। ফুলবাড়ি-পার্বতীপুর-চিরিরবন্দর এমনকি শহর থেকেও মানুষজন আসে। তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে সাপের বিষ নামানো, হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পাওয়া, গরু-ছাগল উদ্ধার, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ দূর, দুষ্ট লোকের বাণ কাটানো, ভেঙে যাওয়া সংসারে সুখ ফিরিয়ে আনা কত কি সহজ কাজ। অথচ নিজের প্রতি রেখে গেল চরম অবহেলা। নয়তো কী? নিজের বিদ্যের উপর চরম বিশ্বাস। যুক্তিহীন ঋজু আস্থাও যে একসময় প্রবঞ্চনা করে সে তো সত্য হল। অবশেষে সেই চরম পরিণতি ঘটে গেছে। এমন দুঃসময়ের সামান্যতম ভাবনা ছিল না, নাকি সকল দুর্ভাবনা চারপাশে ঘিরে ফেলে তাকে? ফুলবাড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরাসরি জবাব দিয়ে বসে।

‘দেড়-দুই মাস চলি গেইছে, তারপর আইলেন…এখন কী কিছু করার আছে বা হে?’

ডাক্তার শফিজুল দাঁত কিড়মিড় করে বারান্দায় বিরক্তি ছুড়ে দেয়। দক্ষিণের দেয়াল ঘেঁষে তিনটি আমগাছ। শাখায় শাখায় মুকুল এসেছে এবার। গাঢ় সবুজ রঙের সবটুকু বুকে নিয়ে মুখ উঁচিয়ে আছে সম্ভাবনা। এখন বৃষ্টি এলে মুকুলগুলো বাঁচবে। নয়তো খরায় শুকিয়ে শেষ। এসব অকারণ ভাবনার মধ্যে কোনো এক গাছের শাখায় যে কয়েকটি শালিক নাচানাচি করে, ভয় পেয়ে দেয়ালের ওপারে রাস্তায় নেমে যায়। বিদ্যুতের তারে বসে স্বস্তি খোঁজে। সুনীলের বুক জুড়ে অস্থিরতা। অনেক দেরি করে ফেলেছে। ভয়ংকর ভুল। এ ভুলের কী যে খেসারত কে জানে। সে চমকে ডাক্তারের দিকে তাকায়। ওই দু-চোখে কি বিরক্তি…কি রাগ ঠিক দেখেছে সে। প্রত্যুত্তরে কী বলার আছে? সে বাবাকে সিমেন্টের বেঞ্চে শুইয়ে রেখেছিল। বেশি বয়স হয়নি সাধুর…অনন্ত সাধু। পঞ্চাশ কিংবা বাহান্ন। এত দ্রুত কেউ মরে যায় না। কেউ কেউ যায়, সে যাক; তার বাবা মরবে না। অনেক নাম-ডাক বাবার। সাধু গুনিন। কত জায়গা থেকে কত মানুষ আসে। তাদের কত সমস্যা। সাধু সবকিছু মিটিয়ে দেয়। মন্ত্রের এত শক্তি! সেদিন সেই শক্তিকেও বিশ্বাস হয় না সুনীলের। সে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে অনুনয় করে বসে।

‘আপনে যদু না দেখিবেন তো কাঁয় বাঁচাবি কন?’

‘অনেকদিন আগের ঘটনা। শরীরে বিষ উঠে গেছে। না না আমি রিস্ক নিতে পারব না।…এক কাজ করো, দিনাজপুর মেডিকেলে নিয়ে যাও।’

‘একটু দেখেন…কেমন অবস্থা।’

‘দেখার কী আছে? মাথা-ভরতি চুলের জট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে বিকট দু-র্গ-ন্ধ; ওয়াক্! সে যাক আজকেই নিয়ে যাও। কী করে এ লোক?’

‘কবিরাজি ঝাড়ফুঁক…গুনিন মানুষ স্যার।’

‘ও তাই তো!’

ডাক্তার বারান্দা থেকে দু-পা সামনে হেঁটে বেশ জোরে থুতু ফেলে। তারপর কোনো এক এক্সরে ছবিতে মনোযোগ। আজ সূর্যের অনেক উত্তাপ…দিঘল বিস্তারি আলো। সুনীল কী করে? বাবার পাশে এসে মৃদু জোরের সঙ্গে বলে ওঠে, –

‘এ্যালা টাউনোত যাবা হবি। সুচ না নিলি হবি না। চলেক মুই নিয়া যাছো।’

‘তেমন কিছু নহায় রে বা, আকন্দের পাত শ্যাক দিলি সব সারি যাবি।’

‘এইটা তোমহার বিষ-ব্যথা নহায়। সবখানোত কবিরাজি চলিবি না। কুকুরের কামড়। কুত্তা যদু পাগলা হয়, খবর আছে।’

‘তুই ক্যাংকা করি বুঝিবু কুত্তা পাগলা আছিলো? এ্যানা রক্ত বেইরাছে বটে, কিছু হবি নানে।’

সেই কাল হল। বড় জেদি মানুষ সাধু। কিছুতেই নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর চেষ্টা হয়েছে। ফুলবাড়ির আলোচনা চলে। সুচের বিষয় আসে। সাধু যাবে না। কবিরাজি টোটকা-জড়িবুটির উপর মহৌষধ দ্বিতীয়টি নেই। কেটে গেল অনেক দিন। সেই ঘটনা ভুলেই গিয়েছিল সকলে। সেদিন সকাল, সকাল থেকে দুপুর; দুপুর থেকে বিকেল একফোটা পানি মুখে দিল না সাধু। পানি দেখলেই হাউ হাউ চিৎকার করে ওঠে। যে মানুষ এত বড় কবিরাজ…গুনিন, তার মুখে কেউ উচ্চস্বরে ভিন্ন ধর্মের কথা শোনেনি; গুনগুন বিড়বিড় চলে, –

‘লাহু মা ফিছছামা ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্। মানযাল্লাজি ইয়াস ফায়ু ইন দাহু ইল্লা বি-ইজনিহি ইয়া লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খল ফাহুম।’

কেউ কেউ তখন ‘রাম রাম হে রাম’ করে উঠলেও মণিমালা ঘর থেকে প্রায় লাফ দিয়ে আঙিনায় নামে। গলা খাটো করে ওজর। সেই নিচুস্বরে হয়তো সবকিছুর জবাব থাকে। ব্যাখ্যাও। তান্ত্রিক মানুষ। অনেক তন্ত্রমন্ত্র জানতে হয়। মুখে বলা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কথায় কি না জাদু থাকে! সুনীলের সে-সবে স্বস্তি বা শান্তি নেই। অস্থিরতার ডালপালা বুকের মধ্যে গজিয়ে উঠতে শুরু করে তার।

‘গুনিন মানুষ নিজেই ঝাড়ফুঁক করোছে। বিষ-ব্যথা উঠিছে। মাথা বলে ক্যাংকাবা আউলাই গেইছে।’

‘ওইলা কাথা ঠিক নহায় তোমহার মা। এইটা জলতঙ্ক। জল দেখিলে ফিট লাগি যাবি। মুই সেখনই কইছিনু, অবহেলা করেন না; তো ফলনা মোর কাথা কাঁহো শোনে যদু। এ্যালায় সামলাও।’

‘তো কী করিবু এ্যালা? মানুষটা তো সেখন যাবা চাহে নাই। কয় সব চিকিসসা নাকি তার জানা আছে। ওই সমায় তো কিবা কিবা পিষি পিষি লাগাছেলও।’

‘আর ফ্যাদলা পারি না তো মা। মুই ফুলবাড়িত নিয়া যাম। দেখঁ ডাক্তার কী কছে?’

‘হায় হায় মানুষটা কাল থাকি না খাওয়া…কেমন করি বাঁচিবি।’

সাধু তখন বারান্দায় এসে ধপ করে বসে পড়ে। ঠোঁটের কম্পনে মৃদু স্তব। তার সবটুকু শোনা যায় না। পরনের কাপড় বিস্রস্ত। কোনোকিছু ঠিক নেই। মণিমালা সেদিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে কিছু ভাবে। ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। মানুষটিকে কোনোদিন কোনো কথা বলেনি। তার ইচ্ছে বা সাধের কাছে ‘না’ করেনি। অনেক জ্ঞানের অনেক উঁচুমার্গের মানুষ। কোনোদিন ঘরের কোনায় জানালার পাশে কুলঙ্গিতে আসনপাতা মা কালির দিকে তেমন দৃষ্টি দেয়নি। ধর্মের সকল কথা সকল বাণী তার মুখস্থ। এখন সে-সব কথা মুখে খইয়ের মতো ফোটে। কে বলবে মানুষটি ভয়াবহ অসুখের ভার বয়ে চলে। মণিমালা এগিয়ে কাঁধ চেপে ধরে ওঠাতে চেষ্টা নেয়। তখন সাধু নিজেই নিজেকে আলতো তুলে এনে চৌকিতে আছড়ে ফেলে। ডান-পা ফুলে উঠেছে। হাঁটা যায় না। চোখের দৃষ্টি কেমন আউলা। ঝাপসা ঝিলমিল। মুখে বিড়বিড় হাজার স্তব। মণিমালা সে-সবের কোনোকিছু বোঝে না। সবকিছু অর্থহীন।

‘অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।’

‘এইলা কী কবা নাগছেন?’

‘ধর্মের কাথা সুনীলের মা…তন্ত্রমন্ত্র নহায়। ঈশ্বর কহেন, আসমান আর যমিনের নিচে যা যা আছে, সউগের মালিক তিনি। কে কোঠে আছে তাক ছাড়া কারও কাথা কয়? চক্ষুর আগত-পাছত সবেঠে তার নজর। সউক তার জানা। ঈশ্বর ছাড়া মোকে কায় দেখিবি? ভগবান আল্লাহ যা বলি না ক্যান সব এক। সব থাকি বড় পাপাচারী সেহও জ্ঞানের নৌকাত চড়ি দুর্দশা থাকি মুক্তি পায়।’

‘তোমহার ফির কষ্ট হছে।’

‘এইলা ঈশ্বরের লীলা…কষ্ট থাকিবি না।’

‘এ্যালা চুপ করি শুতি থাকেন। কিছু খামেন? মুখোত তো কিছু দেছেন না।’

‘ভোগ নাই…ভোগ নাই রে…ভোগ নাই…কী খাম মুই?’

মণিমালা পেছন থেকে মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে মৃদু গুনগুন সুরে প্রলম্বিত কান্নার গান শুরু করে। চৈত্রের শেষ-সকালে বাতাসে ঢেউ তুলে তুলে সেই গমক দূর থেকে দূরে ভেসে যায়। আঙিনায় এসে জড়ো হয় আশপাশের বাড়ি থেকে কৌতূহলী দু-চারজন মানুষ। সুনীল বসে থাকে না। আঙিনার কোনায় জবাঝাড়ের কাছে রাখা ভ্যান নিয়ে রাস্তায় বের হয়। একটানে বেজাই মোড় চলে আসে। আনিছুরের কাছে থেকে একটি বিড়ি নিয়ে খুব জোরে টান দেয়। জোরে-জোরে নিশ্বাস। যদি মাথার রাগ-অস্থিরতা কিছু কমে। তখন একটি লোকাল বাস ফুলবাড়ি হয়ে বটতলায় থামে। নওশেরওয়া মাইক্রোফোন হাতে মসজিদের জন্য দু-চার টাকা চাঁদা আবদারে মায়াকান্না শুরু করে দেয়। চল্লিশ শতাংশ কমিশন। আশপাশের মানুষজন বলে পুণ্যকর্ম। পরকালের কাজ। পুণ্য আর পুণ্য। সুনীলের মনে হয় চিটারি ব্যবসা। ভণ্ড সব টাকা নিজে খায়। সামান্য দু-চার জমা করে মাত্র। সে একদলা থুতু ফেলে বাসের দিকে তাকায়। মন বড় অস্থির-বিক্ষিপ্ত। মাথায় অকারণ রাগ জমতে থাকে। সকলকিছু এড়িয়ে একটু স্বস্তির খোঁজে আনমনা। ধানের ক্ষেত, বটগাছ আর চেনা-অচেনা মানুষজনের দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাস্তায় তাকায়। কয়েকজন যাত্রী পেলে কিছু টাকা হাতে আসে। বাবাকে ফুলবাড়ি হেলথ কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।

তখন বাসের ভেতর থেকে হিজাব পরা তিনটি মেয়ে নামে। এইসএসসি পরীক্ষা চলছে। দুপুর বেলা। পরীক্ষা শেষ। তিনজনই যাবে পানিকাটা। মাইল দু-আড়াই রাস্তা। তিন পাঁচে পনেরো টাকা রোজগার হয়। আজ ভাগ্য খারাপ। আনিছুর এগিয়ে ভ্যানে তুলে নেয় তাদের। সুনীল সেদিকে কিছুক্ষণ করুণ দৃষ্টি ছড়িয়ে রাখে। এক-আধ ঘণ্টার মধ্যে কাজ সারতে হবে। টাকা দরকার। নুরানি হাফিজিয়া মাদরাসার দুটি ছেলে যাত্রীদের ছুড়ে দেয়া কয়েন-নোট রাস্তা থেকে তুলে নেয়। নওশেরওয়া সেগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখে। পকেটে ঢোকায়। টেবিলের একপাশে অ্যামপ্লিফায়ার। কোনো পিরমুর্শিদের ওয়াজ ক্যাসেট বাজে। ধর্মের বাণী বাতাসে ভেসে ভেসে যায়। টেবিলের সামনে পাঁচ-দশ-পঞ্চাশ আর দু-টাকার নোট আলাদা সাজিয়ে রাখা। সেগুলোর উপর টুকরো ইট-পাথর। বাতাসে যাতে উড়ে না যায়। সুনীল কিছুক্ষণ দৃষ্টি ফেলে রাখে। একঝটকা মেরে সব টাকা তুলে নেয়া কঠিন কাজ নয়। কত টাকা হবে…তিন-চারশ? মানুষের কত টাকা! তারা কত পথে খরচ করে। তার টাকা নেই। সে-সময় টাকা থাকলে বাবাকে জোর করে নিয়ে যেত দিনাজপুর মেডিকেল। কোনো আপত্তি শুনত না। সবগুলো সুচ গুনে গুনে দেয়া হতো। এখন কী হবে কে জানে! এসব ভাবনায় অস্থিরতা তীব্র করে তোলে চৈত্রের দাবদাহ।

 

দিনটি ছিল ফাল্গুনের শেষ কিংবা চৈত্রের শুরু। মানুষটির ডাক পড়ে শেষ-বিকেলে। প্রায় সন্ধে। অনেক ঘোরালো পথের গ্রাম আরজিদেবিপুর। বারাই গিয়ে ভ্যান কিংবা পায়ে হেঁটে চকযাদু বাজারের রাস্তা। সচ্ছল গৃহস্থ ঘরের কলেজে ভর্তি হওয়া মেয়ে। সাপ কামড়েছে। বিষ ঝাড়তে হবে। সুনীল ভ্যান থামিয়ে বাবার সঙ্গে সেই বাড়িতে ঢোকে। মানুষজনের ভিড়। সবকিছু এড়িয়ে সামনে এগোয়। তার বুকে ধক করে ধাক্কা লাগে। মেয়েটি বারান্দায় শোয়ানো। আধবোজা চোখ। অজ্ঞান। অদ্ভুত মায়াবী চেহারা। অপূর্ব কোনো পরি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। সুনীল বিস্ময়ে নির্বাক-হতবিহ্বল। আকস্মিক বন্দনার মুখছবি ভেসে ওঠে। কেমন আছে সে? অনেকদিন দেখা হয় না।

সাধুকে পেয়ে গুঞ্জন তখন। তাকে ঘিরে চলে জরুরি কথাবার্তা। সুনীলের তেমন মনোযোগ থাকে না। বরাবরের মতো কোনো আগ্রহ জাগে না। এবার কী হল? তার মুগ্ধ দৃষ্টি মেয়েটির উপর ছড়িয়ে থাকে। বুকের মধ্যে ধীরে ধীরে জমে ওঠে বিমর্ষ অন্ধকার। আহা এত সুন্দর নিষ্পাপ চেহারা! সে কিছুক্ষণ স্থির-বিমুঢ় দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর যেমন বাবাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে চলে যায়, যেতে পারে না; সবকিছু দেখতে ইচ্ছে হয়। মেয়েটি উঠে দাঁড়াবে। বিস্ময়ে জেগে উঠবে দু-চোখের দৃষ্টি। রূপকথার গল্পে যেমন মৃতপুরীর কোনো রাজকন্যা সোনার কাঠি স্পর্শে জেগে ওঠে, ধীরে ধীরে খুলে দেয় দু-চোখ; আহা তেমন আশ্চর্য কিছু ঘটে যাক। সুনীল কী করবে তখন? তার সঙ্গে কোনো কথা বলবে কিংবা…। সে আকস্মিক চমকে ওঠে। নিজের ভাবনায় লজ্জা-অপরাধবোধ ধেয়ে আসে। এই মেয়ে তার কে? আগে কোনোদিন দেখেনি। কোন্ অধিকারে এসব ভাবে? সে কতক্ষণ উন্মুখ দাঁড়িয়ে দেখে মনে নেই। বাবা মেয়েটির দু-চোখের পাতা টেনে পরীক্ষা করে। শিয়রে মধ্যবয়সি এক মহিলা। নির্বাক ভয়ার্ত অসহায় চোখ। বাড়ির সমস্ত শোক-সন্তাপ-আশঙ্কা সেখানে মিশে আছে। সুনীল আর কোনোদিকে তাকায় না। কী ভেবে নিশ্চুপ সেখান থেকে রাস্তায় বের হয়ে আসে। এসব আবেগের কোনো মূল্য নেই। তখন সন্ধের ছায়া প্রগাঢ় হয়ে নামতে শুরু করে। উদাসী হিম-বাতাস ধীরলয়ে বয়ে যায়। শীত যাই-যাই করে এখনো বিদায় নেয়নি। সাধু বারান্দা থেকে একপলক দৃষ্টি ফেলে নিচুস্বরে বলে, –

‘তুই চলি যা বা…মুই কাজ সারি বেহানে চলি যাম। যা দেখঁচি সমায় নিবি।’

‘আচ্ছা মুই গেনু তাইলে।’

সুনীল চলে আসে। রাস্তার দু-পাশে শত শত গাছের ভেতর অন্ধকার নেমে আসে। ভ্যানের পেছনে হ্যারিকেনে তেল নেই। তাই দ্রুত দু-পায়ে অতিরিক্ত শক্তি চাপিয়ে দেয়। চার-পাঁচ মাইল দূরের পথ। আলো থাকতে থাকতে ফিরে যেতে হবে। তখন কেন জানি বারবার মেয়েটির মুখ ভেসে ওঠে। কেন এমন হয়? সুনীল বন্দনার কথা মনে করতে চায়। সামনের বৈশাখে জীবনের মহালগ্ন। যেমন চেয়েছে, মনে হয় সেই প্রতিমা অপেক্ষায় তার। তবু সেই অপরিচিত মেয়েটির মুখছবি ঘুরে ঘুরে কত স্পষ্ট হয়। হতে থাকে। সুনীলের মন-উন্মন মায়াঘোর, আবেগ বাতাস-দোলা চোখ ছলছল; মেয়েটির আরোগ্য প্রার্থনা করে যায়।

পরদিন কাকভোরে অনন্ত সাধু ফিরে আসে। তার বিমর্ষ চেহারা বলে দেয় বিষাদ খবর। মেয়েটি বেঁচে উঠেনি। সুনীলের মন অকারণ খুব খারাপ হয়ে যায়। আকাশের কোনায় ধূসর-কালো মেঘ। মানুষের এত কষ্ট কেন? এর রেশ কাটতে না কাটতেই শোনে অন্য দুর্ঘটনার কথা। সেই গ্রামের পুকুরপাড়ে কোনো রাতজাগা কুকুর কামড়ে দিয়েছে বাবাকে। এত বড় গুনিন তখন ব্যর্থ। মন খারাপ। সারারাতের চেষ্টা সফল হয়নি। অনেক অপরাধ তার। ভোরের দিকে যখন পরাজয় মেনে নিয়ে আঙিনায় দাঁড়ায়, সকাল বড় লজ্জার; কোনোমতো বলে ফেলে সকল দায়। আকস্মিক দমকা বাতাসের মতো কান্নার ঢেউ উঁচু হয়। বাতাসে ভাসতে থাকে। তার মধ্য দিয়ে ফিরে চলে সাধু। মাথা টলমল। বুকে বিভীষিকাময় শোকগাথা। কোন্ ফাঁকে কুকুর হামলে আসে বুঝতে পারে না। পায়ের নিচে বসিয়ে দেয় গভীর কামড়। সাধু উঁচু রাস্তা থেকে ক্ষেতের মধ্যে আছড়ে পড়ে। ক্ষেতে ভুট্টার কয়েকটি কচি চারা ভেঙে গুড়িয়ে যায়। সুনীল সব শুনে অস্থির-ব্যস্ত।

‘টপ করি সদরোত চলেক, সুচ দিবা হবি। রেডি হ মুই নিয়া যাম।’

‘কিছু হবি নানে বা। একটুখানি আঁচড়াইছে খালি। গরম জলে সাবান দি ধুই তেল মাখে দিলি সব ঠিক।’

‘ওইলা কাথা তুলি থো। কুত্তার কামড়, রক্ত বেইরাইছে; অবেহলা করা যাবি না।’

‘আইচ্ছা কাইল যামো। এ্যালা তুই কামোত যা। মুই এ্যানা নিন দেও। দিবা পারিম ফির? ছইলকোনা বাঁচিলি না হায়! জাত সাপের বিষ। মন খুবে খারাপ হইছে বা।’

 

সেই অবহেলা কাল হল। এখন শেষে কী হয় কে জানে। কী আছে কপালে! সুনীলের দৃষ্টি উদ্বেগ-আশঙ্কায় ভারাক্রান্ত। ডাক্তার শফিজুল মুখের উপর বলে দেয় শেষকথা। এখানে চিকিৎসা নেই। শহরের মেডিকেলে নিয়ে যেতে হবে। অবশেষে বাবাকে আলগোছে চেপে ধরে রাস্তায় নামে সুনীল। মানুষটি হাঁটতে কষ্ট পায়। বিনোদ দোকান বন্ধ করে সঙ্গে এসেছে। সে এগিয়ে এসে অন্যপাশে ধরে। তার চেহারায় ভাবলেশহীন গাম্ভীর্য।

‘এইবেলা টাউনোত্ গেইলে ডাক্তার মিলিবি?’

‘হ্যাহ্ ওইঠে তেমুন ডাক্তার কোঠে? সব তো নয়া নয়া…কী কয় এন্টারনি, যারা পড়োছে।’

‘ওমহরাই চিকিৎসা দিবি।’

ফেরার পথে বাসে কানে ফিসফিস করে বিনোদ। পাশের সারির বাঁ-সিটে বসেছে। জানালার ধারে সাধু। দূর-দিগন্তে অদ্ভুত কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে। নবজন্ম তার। এই পৃথিবীর সবকিছুই নতুন।

‘হ্যাঁ রে সুনীল, হসপাতালোত নাকি কুত্তায় কামড়ান রোগীক মারি ফেলায়? সবায় কয় মারাত্মক জার্ম?’

‘এইটা ফির একটা কাথা হইল বে…ডাক্তার মানুষ মারি ফেলাবি?’

‘আস্তে ক…কাকা শুনিবি ফির।’

অনন্ত সাধুর কোনো খেয়াল নেই। মৃদু বিড়বিড় সুরের মধ্য দিয়ে কোনো অলৌকিক প্রার্থনায় নিজেকে ছড়িয়ে দেয় আদিগন্ত। সুনীল কী ভেবে মানুষটির দিকে তাকিয়ে উদাস-করুণ। এই মানুষ তার বাবা। পরমপূজ্য দেবতা। জীবনে কোনোদিন কারও উপকার ছাড়া অনিষ্টের চিন্তা করে নাই। আপনমনে নিজের মধ্যে এক পৃথিবী গড়ে বেঁচে আছে। কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়া-ফ্যাসাদ, গ্রামের নষ্ট-বুদ্ধি-কুটিলতা, রিলিফের গম বা কম্বল আদায় কোনোকিছুতে নেই। একগাদা পুরোনো বইপুস্তক আর নিয়মের মধ্যে সারাজীবন। আজ একেবারে অসহায়। তার জন্য কিছু করতে পারে না সুনীল। তার বুকের গভীরে নিশ্চুপ কান্না জেগে ওঠে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। সে দ্রুত বাসের ভেতরে একেবারে নিচে দু-চোখ নামিয়ে ফেলে।

সেদিন বিকেলে নিয়ে যাওয়া হল না। বিনোদ কোন্ ফাঁকে কী বুদ্ধি দিয়েছে, মণিমালা অনড়; সাধুকে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেখানে তাকে মেরে ফেলবে। শরীরের ভেতর বিষ যে পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে, কোনো ডাক্তার সুস্থ করতে পারবে না। এখন সব ভগবানের হাতেই ছেড়ে দেয়া ভালো। সাধুর জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। নিজ চেষ্টায় নানা মন্ত্র পড়ে। গুনিন মানুষ। ঠিক ভালো হয়ে উঠবে। সুনীল কিছুক্ষণ পীড়াপীড়ি করে। বাবা দু-দিন ধরে তেমনকিছু খায় না। জল তো নয়। জল দেখলে দু-চোখ উলটিয়ে শুয়ে পড়ে। এভাবে তো চলতে দেয়া যায় না। চিকিৎসা করতে হবে। ইত্যাদি যুক্তি আর তর্ক-বিতর্কে সময় চলে যায়। অবশেষে সে-সময় আকাশের নৈর্ঋত কোনে ধীরে ধীরে কালো মেঘ জমে ওঠে। বড় কোনো ঝড় এগিয়ে আসে। তাই সেদিনের মতো সবকিছুর উপসংহার টেনে নেয়। যেভাবে হোক কাল শনিবার খুব সকালে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আনিছুরের কাছে থেকে শ-পাঁচেক টাকা ধার নিয়েছে। সেই টাকা বিড়ি খেয়ে শেষ করবে না। মেডিকেল থেকে ফিরে একবার চুপচাপ বাজিতপুর ঘুরে আসার ইচ্ছে আছে। আজ প্রায় তিন-চার মাস বন্দনাকে দেখে না। কেমন আছে সে? তার কথা ভেবে কখনো মন হারিয়ে যায়। চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাকে খুব মনে পড়ে। কবে যে নিয়ে আসতে পারবে! লগ্নের দিন যে আসে না। আসবে কবে?

 

পরদিন অনন্ত সাধুকে দেখে কে বলে, এতগুলো দিন এই মানুষটি কত ভুগিয়েছে। একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক। সুনীল কাছে গিয়ে বসে। আজ বুকের মধ্যে অনেক আনন্দ। উদাস রাতের কোনো একসময় বন্দনার দেখা পেয়েছে। নীলপরির মতো আকাশ থেকে নেমে আসে। তারপর দু-জনে হাত ধরে বালিয়াড়িতে হেঁটে গেছে অনেকদূর।  কোনো নাম না জানা নদীর পাড়। নদীর কত স্বচ্ছ জল গানের সুরে ঢেউ বয়ে যায়। তার তীরে তীরে কাশবন সাদা আকাশ-দিগন্ত। অনেক দূর হেঁটেছে তারা। তখন অচিন কোনো দূর থেকে ধূপের মাতাল সুবাস ভেসে আসে। তারা এক পোড়োবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে শানবাঁধানো পদ্মদিঘি। তার বুকে চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল ফুটে আছে গোলাপি-সাদা কমল। বন্দনা সিঁড়িতে পা রেখে হাত ধরে তার। পেছন ফিরে তাকায়। তখন আশ্চর্য, বন্দনা সেই মেয়েটি হয়ে গেছে। ভুবন-ভোলানো হাসি। সুনীল ঘুমঘোরে অচেতন। তবু মনে পড়ে, এই মেয়ে তো মরে গেছে। তার স্বপ্নে কেন এল? কে সে? সে কি বন্দনা নাকি বন্দনা সেই মেয়েটি? যার বিষ ঝাড়তে গিয়েছিল বাবা। সেখানে বাবাকে পাগলা কুকুর কামড়ে দেয়। বাবা ভালো নেই, ভয়ংকর অসুস্থ; জলাতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জল দেখলে আতঙ্ক আর্তনাদ। বাবা বাঁচবে না। মরে যাবে। বাবাকে ছাড়া কেমন করে থাকবে সে? সুনীল মৃদু আর্তচিৎকার দিয়ে জেগে ওঠে। আতঙ্ক-বিমুঢ়। আশ্চর্য তখনো ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশ!

রাত কত কে জানে। আকাশ অন্ধকার। গতকাল বিকেলে মেঘে মেঘে ঘন-গম্ভীর সাজলেও কোনো বৃষ্টি হয়নি। অন্যকোথাও ঝরেছে। রাতের বাতাস হিম-শীতল। তার ঘুম হয় না। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবে। একসময় ধীরপায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাইরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দেয়। ভোর হতে তেমন দেরি নেই। আলোছায়ায় জবা ফুলের কুঁড়ি ফুটতে শুরু করে। সূর্য মুখ উঁচু করে তাকাবে এখন।

 

সুনীলের খুব ভালো লাগে। বাবা সকালে ভাত খেয়েছে। জল খেতেও সমস্যা নেই। তখন কেন জানি বারবার এ কথাই মনের মধ্যে বেজে ওঠে, আসলে অনন্ত সাধু গুনিন মানুষ; এই মানুষটি তার বাবা। পৃথিবীর সেরা বাবা। সুনীল অনেক হালকা মনে বেজাই মোড় চলে আসে। আজ তার ভাগ্য সবদিক দিয়ে ভালো। কয়েকজন দূরের যাত্রী সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যায়।

তারপর যখন দুপুরের রোদ মাথার উপর, মোড়ের বটগাছে কয়েকটি শালিক ক্লান্ত-অবসন্ন প্রগাঢ় ছায়ার ফাঁকে লুকিয়ে থাকে; বিনোদ ছুটে এসে চরম খবর দেয়। কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে অনন্ত সাধু। যাওয়ার আগে নিজের কবিরাজি ঘরে একা একা কী-সব পড়ছিল। একসময় চারিদিকে নিশ্চুপ নিথর নীরবতা নেমে আসে। মণিমালা যেয়ে দেখে মানুষটি চৌকির নিচে পড়ে আছে। মুখ-ব্যাদান। কড়িকাঠে নির্নিমেষ দৃষ্টি। সুনীল ছুটে যায়। কতটুকুইবা পথ নবগ্রামের শেষ-সীমানা! শোকের প্রলম্বিত কান্না বেজে চলে আঙিনার সকল কোনায়। আশ্চর্য তার নিজের দু-চোখ চৈত্রের মতো ভয়ংকর শুকনো! শেষবারের দেখাটুকু হল না। কত হতভাগ্য সে!

এখন বাবার প্রিয় মুখটিতে আগুন দিয়ে তার দু-চোখে অশ্রুর প্লাবন নামে। সে কতদিন বাবার দিকে তাকিয়ে তার মতো হতে চেয়েছে। বাবা সুপুরুষ। দীর্ঘ দেহ, প্রশস্ত ললাট; মুখে সবসময় স্বর্গের হাসি। অথচ এই কয়েকটি সপ্তাহে একেবারে বুড়িয়ে গেল। অযত্ন অবহেলায় ভিন্ন মানুষ। শরীরময় ময়লা গন্ধ। কৃশকায়। সেই মানুষ এখন পুড়ে গেছে। অনন্ত সাধু…তার বাবা। সুনীলের কী হল, বুকের কান্না যে থামতে চায় না। বাবা গুনিন মানুষ। তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে মানুষের উপকার করে গেছে। সুনীল কান্না বন্ধের কোনো মন্ত্র তার কাছে থেকে শিখে নিতে পারেনি। সে-সব কি মন্ত্রের দ্বারা সম্ভব? অনেকে তো তুকতাক করে বিশাল সম্পদের মালিক হয়। অজানা গুপ্তধন পেয়ে রাজা হয়ে বসে। বাবা তেমন হতে পারত। সুনীল এসব ইত্যাদি উদ্ভট ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে পুরোহিত বলে যায় অনুসরণ করে। মালতি ঝাড়ের ওখান থেকে গেরুয়া কাপড় টেনে হিম-শীতল বালুতে বিছিয়ে নেয়। তার উপর নতুন হাঁড়ি। সেটির মধ্যে ধীরে ধীরে দেহভস্ম তোলে। একফাঁকে পোড়া-আধপোড়া মাথার খুলি। এটিকে যত্ন করে রাখার নির্দেশ আছে। হরিশংকর, বিনোদ, ময়না কোনোভাবেই এখানে আঘাত করেনি। মণিমালার নির্দেশ, যে সে মানুষ নয় অনন্ত সাধু; তান্ত্রিক পুরুষ। তার মাথার দাম অনেক। সেই মাথা অন্য তান্ত্রিকেরা চুরি করতে পারে। সাধু গুনিনের আত্মাকে করায়ত্ত করে অবৈধ অনেক জাদুবিদ্যা খুব সহজ। অসাধ্য সাধন করে দেবে সাধুর আত্মা। পরলোক আর আত্মার অজানা পৃথিবী, সেই জগতের শক্তি অনন্ত অসীম; দু-হাতের মুঠোয় শক্তি এনে দেবে সাধু। মণিমালা দু-চোখে কান্নার বহমান ধারা এড়িয়ে গোপন মন্ত্রের মতো কথাগুলো বলে যায়। সুনীল অনেক মনোযোগ দিয়ে শোনে। তাই অনন্ত সাধুর মাথা গলে যায়নি। ভেঙে যায়নি। ভেতরের সবকিছু বের হয়ে পোড়া বীভৎস হলদেটে বস্তু হয়ে গেছে। সুনীল সেটি খুব সাবধানে হাঁড়িতে রেখে দেয়। অনেক দায়িত্ব তার। বাবার মাথা নিয়ে যেতে হবে ভারত। বিসর্জন দেবে গঙ্গায় কোনো তীর্থে। সেই দেশে যেতে প্রচুর খরচ। টাকা? নিশ্চয়ই জোগাড় হয়ে যাবে। সুনীল ভেবে রেখেছে, জীবনের বিনিময়ে হলেও এ কাজ করবে সে। তার হাতে তেরো দিন সময়।

 

সন্ধে শেষে রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে নেমে আসে। আজ অমাবস্যা। আকাশের দিগন্ত জুড়ে প্রগাঢ় কালো মেঘ। অদ্ভুত গুমট স্থবিরতা ধরে আছে চারদিক। ঝড় হবে। সুনীল কলস নিয়ে গঙ্গাসাগরে নেমে যায়। পুরোহিত যেভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করে, সুর ধরে সে। একসময় কলস-ভরতি করে উপরে উঠে আসে। নিজের মাথায় গড়িয়ে দেয় হিম-জল। কোনোদিকে আর তাকানো নয়। কলস পেছনে ফেলে দিয়ে বাড়ির পথ ধরে। হাতে ধরে থাকে লাল কাপড় মোড়ানো হাঁড়ি, সেটির মধ্যে অনন্ত সাধুর দেহভস্ম…খুলি।

সারাদিনের ক্লান্তি শোক-সন্তাপ। সুনীল তবু জেগে থাকে। রাত গভীর হতে হতে মনে হয়, পৃথিবী স্থির…নিশ্চুপ নিস্তব্ধ। সকল কোলাহল থেমে গেছে। দূর আকাশে শুধু বজ্রের আলো। মুহুর্মুহু গর্জনের মৃদু লেশ ভেসে আসে। সেখানে ঝড় হয়। মনের তাণ্ডব থামে না। কোন্ ফাঁকে দু-চোখ লেগে এসেছিল, সুনীল হাতে-পায়ে চমকে ওঠে; কেউ তার নাম ধরে ডাকে। ‘বাবা সুনীল, সুনীল…ও সুনীল।’ বাবার আবেগ-গম্ভীর কণ্ঠ। অনন্ত সাধুর সেই চিরচেনা ডাক। সুনীল দ্রুত সামনে তাকায়। বুকের মধ্যে অদ্ভুত উপলব্ধি, বাবা মরেনি; বেঁচে আছে। তার পাশে বসে আছে। সুনীলের চোখ থেকে ধীরে ধীরে জল গড়িয়ে নামে। বুকে চাপ চাপ গুমট কান্নাঢেউ। বেদনা বেরোতে পারে না। ডুকরে ফুঁপিয়ে ওঠে। প্রিয় মানুষ খুব অবহেলায় চলে গেল। সে ঝাপসা দৃষ্টির মধ্য দিয়ে উত্তরের দেয়ালে তাকায়। সেখানের তাকে হাঁড়িটি রেখেছিল। তার মুখ খোলা। লাল কাপড় নিচে পড়ে জড়িয়ে স্তূপ। সাদা ঝকঝকে একটি খুলি দরজার দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। সুনীলের বিভোল শ্রুতিতে দূরাগত গুঞ্জন।

 

‘বাবা সুনীল, সুনীল…ও সুনীল।’

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত