| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: সফলতার টনিক । মাহমুদুল হক আরিফ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
 
 
তখন তিনটা ত্রিশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুরে রূপালী রোদ সিকি আধুলির মত ঝকমক করছিল— বিকেল পূর্বের প্রখর রোদ, এ সময়ের সূর্য জলের বুকে পারদের মতো গড়াতে থাকে— ঝিকমিক-ঝিকমিক দারুণ দৃষ্টিনন্দন তরঙ্গ। পুকুরের তিন পাশ ঘিরে গ্রন্থমেলার স্টল। মেলার সময় সংকুচিত করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। রোদের তাপ মিইয়ে আসার সাথে সাথে গুটিয়ে ফেলতে হয় মেলার বই। সন্ধ্যা নামার সাথে দীর্ঘশ্বাস ওঠে প্রকাশকদের। মেলা জমতে না জমতেই স্টল বন্ধ করে দিতে হবে। একটা প্রচার হ্যান্ডবিল বিলি করছিল একটি মেয়ে। হাতে দিয়ে চলে গেল। হ্যান্ডবিলের লেখাগুলো পড়ছিলাম। একজন প্রকাশক এসে হাজির। আমি তখনো চোখ বুলাচ্ছি হ্যান্ডবিলটার দিকে… লিফলেটে লেখা, আপনি কি সফল হতে ছটফট করছেন? প্রশ্ন চিহ্নের বাক্যে- কি নাকি কী হবে? বানানটা জিজ্ঞেস করলাম প্রকাশককে। তিনি উত্তরে বললেন, আরে ভাই কি-না-কী এ দিয়ে কী হবে…! উাদস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। আমিও তাকালাম, দেখি একটি চিল উড়ছে। বললেন আর কী লিখেছে? লিখেছে হতে চান উদ্যোক্তা? তাহলে পড়ুন ”সফলতার জন্য উন্মাদনা” বইটি। উনি বিজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা একদিকে হেলে দিয়ে বললেন তাহলে কিনে সংগ্রহ করে ফেলুন। এ ভীষণ এক উন্মাদনা! তিনি কথাটা শেষ করতে— না করতে-ই প্রবল বেগে একটা ধূলো ঝড় মাঠে উন্মাদনা সৃষ্টি করলো… দেখি সবাই এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। যারা সেল্ফি তুলছিল তারাও বেপরোয়া হাওয়ার কারণে চুল সামলাচ্ছিল। প্রকাশক বললেন দেখেন সেল্ফিবাজরা সব চুলফি সামলাচ্ছে…। বললাম আপনি কী এদের উপরে কোন কারণে ক্ষেপে আছেন? তিনি বললেন মেলাতে যত মানুষ আসে তার বেশি ভাগ সেল্ফি টেল্ফি তুলে চলে যায়! এর কত অংশই বা বই কেনে বলুন? তবুও তো আসে, আমি তাকে আসস্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। তিনি বললেন, বই বিক্রি আশংকাজনক কমে গেছে। বলতে পারেন চটপটি ফুসকার দোকান দিলে বইয়ের চেয়ে ঢের বেশি বিক্রি হতো। অন্তত মানুষ অনুপাতে। আমি বিক্রয় কমে যাওয়া নিয়ে দু’কথা বলার চেষ্টা করলাম। দেখুন সবাই তো পিডিএফ পেয়ে যাচ্ছে… মধ্যবিত্ত সন্তানরা এখন বাংলা মিডিয়ামে পড়েই না বলতে গেলে… আবার প্রগতিশীল রাজনীতিরও একটা শূন্যতা আছে… আরো কিছু বলতে যাবো, এর মধ্যে ঝড়ো হাওয়া যেন তেতে ওঠলো। প্রকাশক তাঁর মনোযোগ হরালেন! স্টলের কাছে দৌড়ে গেলেন ঝড়ের বেগে… একটু আগের স্বাভাবিক আবহাওয়া হঠাৎ করেই সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাচ্ছে…। এমনিতেই কাল থেকে শুরু হবে লকডাউন, তার উপর ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি! প্রকাশকদের মনের ভেতরে যেন তোলপাড় চলছে- ঠিক ঝড়ের মতই। এদিকে বাতাসের তোড় রয়ে রয়ে বাড়ছে আবার একটু থামছে। মেঘমল্লার রাগের লয়ের মতোই গমকে গমকে ডাকছে মেঘ। প্রায় তিন ঘন্টা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। এই দড়ি ছিড়ে যাচ্ছে, তো করোর সাইনবোর্ড ছিটকে পরছে। বিপর্যয়ের মুখে, মুখগুলো মলিন হয়ে ওঠেলো নিমিষে… মেলা তো নয়, যেন— মূহুর্তে শশ্মানে পরিনত হয়েছে। বাতাসের সাথে হাল্কা বৃষ্টি শুরু হল। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। প্রকাশকদের মুখগুলো যেন সেই আলোতে ঝলসে যাচ্ছে। অনেকটা সময় আমরা এভাবে পার করলাম। বৃষ্টি হওয়ায় কিছুটা থিতিয়ে এলো ঝড়। এবার ছিটপিট বৃষ্টিতেই বাড়ি ফেরার পালা। আমরা বেড়িয়ে আসছি প্রকাশককে বললাম বৃষ্টিভেজা শোধা মাটির গন্ধ পাচ্ছেন? তিনি বললেন কাগজ ভেজার গন্ধ পাচ্ছি। আহ্ কপালে তাঁর দু:শ্চিন্তার ভাজ! আমি বললাম কাল তো লকডাউন মিরপুর থেকে আসবেন কী করে। বললো দেখুন লকডাউনে মেলা কি করে চলবে… এটা একটা মশকরা হচ্ছে… কেমন? বললো ওরা যদি বন্ধ করে দেয় আর আমরা যদি ক্ষতিপূরণ দাবি করি তাই খোলা রাখলো। এ ছাড়া খোলা রাখার কারণ তো দেখি না…! 
 
আমরা দুজনেই ফিরবো মিরপুরে। বাসের অপেক্ষায় আছি… সবগুলো বাসের গেট বন্ধ! হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছি, কোন পরিবহন-ই থামছে না। সরকার নিয়ম করেছে দুই সিটে একজন। হঠাৎ মিরপুরগামী একটি বিআরটিসি বাস আসলো হুরমুর করে উঠে গেলাম সবাই। যাক এবার অন্তত পৌঁছে যাব। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট থেকে শাহবাগ যেতেই বললো ফার্মগেটের দিকে গাড়ি যাবে না। ওদিকে রাস্তা বন্ধ। কিছু লোক নেমে গেল। আমারা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। কিছু লোক ভোগান্তিতে পরলো বটে আমরা বসার জায়গা পেয়ে বেশ ভালো অনুভব করলাম। যাক এবার বসে থাকি রাত এগারোটা হলেও তো বসে বসে পৌঁছে যাব। ও মা মাত্র হাফ কিলোমিটার বাটার সিগনাল আসতেই লেগে গেল প্রায় ত্রিশ মিনিট। তারপর সাইন্সল্যাব মোড়ে আসতে আসতে এক কিলোমিটার এক ঘন্টা। প্রকাশক তারা ভাই বললেন বাকী পথের কী হবে! এখনো তো বারো কিলো পথ বাকী! আমি ভাবলাম না হয় আরো এক ঘন্টা লাগবে। হায় হায় ধানমন্ডি-শুক্রাবাদ কোথায় জ্যাম নেই! আসাদগেট পার হয়ে গাড়ি ঠায় দাড়িয়ে আছে। তারা ভাই কী মনে করে নামলেন। আবার দশ মিনিট পর ফিরে আসলেন। কিন্তু গাড়ির কোন নড়নচড়ন নাই। বললাম তারা ভাই বাইরে গিয়ে কী করলেন। বললো ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু আশেপাশে খাবার খুঁজলাম দোকান না পেয়ে শেষেমেশ একটা সিগ্রেট টেনে আসলাম। যদি গাড়ি ছেড়ে দিতো? আরে ভাই এতোক্ষণ হাঁটলে মিরপুর  পৌঁছে যেতাম। আরে না! কটা বাজে? মোবাইল ঘড়ি দেখে বললেন ১২:৪০। বলেন কী! হুম, কী করবেন? আর কি করবো, বাসার দারোয়ানকে ফোন দিয়েছি। বলেছি, আসতে দেরি হবে। আমিও বাসায় একটা ফোন দিলাম। ওপার থেকে বললো কটা বাজবে… আমি বললাম বলতে পাড়ি না! বললো সকালের আগে এসো… সকাল থেকে লকডাউন শুরু হয়ে যাবে!
 
আমরা যখন মিরপুর বারো পৌঁছালাম তখন দুটো বাজে তারা ভাই হাসতে হাসতে বললেন- তাহলে আমরা বলতে পাড়ি এপ্রিলের ৪ তারিখ রাত ৯টায় বইমেলা থেকে রওয়ানা দিয়ে ৫ তারিখ রাত ২টায় মিরপুরের বাসায় পৌঁছালাম। আমরা সফল। আমি বললাম তাহলে আজকের মতো বিদায়। তিনি কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললেন। আগামী বইমেলায় “সাফল্যের টনিক” নামে আপনার একটি বই চাই। মানে মটিভেশনাল… আমি হা হা হা করে বললাম একেই বলে সাফল্যের উন্মাদনা!
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত