দিদার সঙ্গে হাত ধরে যাচ্ছিল তিন বছরের খুকি। রাস্তার ধারের স্কুলের মাঠের মাথায় তখন কালো মেঘের আড়ালে সূর্যের নিভে যাওয়া ছিল। মেয়ে বলল, ‘দেখ, দেখ কত্ত মেঘ!’ দিদাও বলে উঠল, ‘ভ্রমর কালো মেঘে আকাশ ঢেকেছে। আসছে…’ আমার পেছন ফিরে দেখে হয়নি আর, দেখতে ইচ্ছে করেনি, দেখব না বলেই দেখিনি আসলে…… কে আসবে, কে আসবে না, তাতে আমার কী!
কেউ আসার আগে কি সঙ্কেত পাঠায় কোন? কোন রূপক অথবা কোন গন্ধ? আসবে আসবে ভাবতেও আজকাল আর ইচ্ছে করে না। অপেক্ষার নাম ‘নেই’ হয়ে গেছে কবেই! এক জোড়া ভ্রমর কালো চোখ, এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে চেয়েছিল… কেউ দেখেছে? মেঘ করা মুখ ঘন হতে হতে কখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেছিল, কেউ জানত? এখন সঙ্কেত আর রূপকের কাছে হাত পাতলেও এক ফোঁটা জল কেউ দেবে না, একথা জেনে যাওয়াই ভাল।
বাড়ির ছাদের ওপরে টিনের শেড। রোদের তাপ থেকে বাঁচায়, বৃষ্টি আসে না ওই ছাদে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়লে তবুও এখনো অদ্ভুত মায়ার ঝমঝম বাজে। বৃষ্টি ছাদ ভেজায় না, শব্দে ভিজতে থাকে ছাদ। কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে নামে টিন ধোওয়া জল। এর নাম কি বৃষ্টি? একে কি আসা বলে?
কল খুলে রাখে যারা, অনবরত জল গড়িয়ে পড়ার শব্দে বৃষ্টির শব্দ শোনে না। বালতির জলে বৃষ্টি পড়তেই থাকে। মগের উপুড় হয়ে থাকা অনেকটাই ইচ্ছাকৃত যদিও। ভেজার ইচ্ছেগুলো নিয়ে বালতি থেকে দূরে ওর আড়ষ্ট হয়ে থাকার মধ্যে স্পষ্টতই কোন সঙ্কেত নেই।
ঢালাই রাস্তাও ভিজতে চায়। তার গা থেকে সিমেন্ট, বালি, পাথরের আস্তরণ তুলে নিলে একপ্রস্থ সাদা বালি রয়েছে। তারও নীচে অনেকখানি মাটি এখনো লুকিয়ে রেখেছে সোঁদা গন্ধ। কেউ কি পায়? বৃষ্টির গা জুড়ে এখন ভ্যাপসা সাহারা। ভেজায় তোমাকে?
আর ওই আকাশের কাছে যাওয়ার অভিলাষ থেকে মুক্তি নেই বৃষ্টিরও। ফিরে ফিরে যায় ওখানেই। ঝরে পড়ে বিলাসিবালা নাম নিয়ে। ওর গায়ে বড় আদুরে সোহাগ। কপালে গলে যাওয়া সিঁদুর, নাকের মস্ত নোলকে এক বিন্দু হিরে কুচি বৃষ্টি ঝকঝক করে সবসময়ে। আহ্লাদী খুকি ‘মেগ’ ডাকে, সোহাগী দিদার ভ্রমরকে মনে পড়ে।
ফিরে আসবে কি ও? এবারও? প্রতিবার আসে, যায়ও চখন ইচ্ছে হয় ওর। রাতের এক্সপ্রেস ট্রেন ওকে নিয়ে চলে যায়। ভোরের আড়মোড়া আর দিনের কেজো সারমর্মে ওকে কোথাও মানায় না। তবু থাকে অনাহুতের মত। ওর সঙ্গে ভাব শুধু ওই ঘুম জড়ানো রাতের, আয়েসি ছুটির দুপুরের।
ওর আসা নিয়ে আমি ভাবি না। এলেও তাকাই না সরাসরি। ওকে এইসময়ে আগুন ঝরাতে দেখি বাগানে। গাছগুলো দাউদাউ করে পুড়ে যায় আমার চোখের সামনে… একটা আস্ত দাবানল আমার পেটের ভেতরে ঢুকে যায় কেমন করে জানি না, আকাশের গায়ে লাল হলকা… পাতা পোড়া গন্ধ, শেকড় জ্বলা ঝাঁজ আমার পেট থেকে উঠে আসে মুখে। গলগল করে আগুন বমি করি। ওকে পুড়ে যেতে দেখে পৈশাচিক আনন্দ হয়।
এদিকে এক গ্লাস ওআরএস খেতে খেতে আবার জান আসে। ওই লকলকে আগুন একগ্লাস ওআরএস নিভিয়ে দিতে পারে? পালস্ বিট্ কমে গেলে দ্রুত তালে নাচতে থাকা তরঙ্গ থেকে প্রাণ পায়? পাবে কোনদিন? সাসপেন্সন-এ আর কাজ হবে না জেনেও কেন ওকে একই ওষুধ দাও বারবার, ডাক্তারবাবু? তোমারও তো বৃষ্টির জলে অ্যালার্জি হয়, নাকের ডগা ফুলে ওঠে, হাঁচি জমতে থাকে জলের গভীরে।
মোনালিসা বৃষ্টিতে ভিজতে চায়নি বলে ওর মৃদু হাসির মধ্যে ছাতা লুকিয়ে রেখেছিল। আমি দেখে ফেলেছিলাম সেদিন। তুলি আর রঙের উৎসব থেকে দূরে ওর এই সাদা কালোর দুনিয়া।
ওকে চেন? ‘মেগ’ আর মেঘে কত বেলা হয়েছে বোঝ? মোনালিসার বয়স বাড়েনি বলেই যে তুমি আধো বুলিতে এখনো আঁচড় কাটছ, লোক হাসানোর তড়িকা থেকে ফিরিয়ে আনতে চাইছ তোমার জান, সেও বুঝি। মৃদু চেয়ে থাক বরং…
শব্দ করে বৃষ্টি পড়ুক টিনের শেড-এ, ঢালাই রাস্তায়, টায়ারের গায়ে। ওটুকু পথ বরং ছাতা ছাড়াই চলে যাও। একদিন তো ভেজার জন্য মরিয়া হয়েছিলে…একদিন তো কতই ভিজেছ…একদিন এই বৃষ্টিকেই মনের কথা শুনিয়েছ…গান গেয়ে উঠেছ যখন তখন…
মল্লারের চাকু বিঁধে আছে এখনো তোমার বুকে। আগুনে সেঁকে নিয়েছে মল্লার, চাকুর ধার বেড়েছে আরও। এবারে ভিজলে আর মর্চে পড়বে না। এবারে ভিজলে আর অ্যালার্জির ভয় নেই, এবারে নাহয় গান ধর মিঞা… ভোরের ভৈরবী বেজে উঠুক ঘনঘোর বরিষায়… তীব্র উচ্চারণে ঢ় বলুক আবার কেউ, গভীর ঝর্ণায় শ্রাবণ ভরে যাক।
প্রচ্ছদ: নাওয়াজ মারজান
কবি ও কথাসাহিত্যিক