| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে প্রবন্ধ সাহিত্য

এইদিনে: মল্লিকা সেনগুপ্ত : সমাজসচেতন কবির নাম

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
আজ ২৭ মার্চ অধ্যাপক, কবি ও কথাসাহিত্যিক মল্লিকা সেনগুপ্তের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তপন বাগচী

মাত্র একান্ন বছর বয়সে চলে গেলে কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি কখনো। তাঁর স্বামী কবি সুবোধ সরকারের সঙ্গে পরিচয় ছিল। কিন্তু স্বামীর পরিচয়ে তিনি পরিচিত ছিলেন না কখনো। নিজের পরিচয় আছে তাঁর। আশির দশকের একজন কবি হিসেবে তিনি যথেষ্ট স্বীকৃত। উপন্যাস লিখেও খ্যাতি পেয়েছিলেন। ‘স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ’ নামে তাঁর একটি অসাধারণ গ্রন্থ রয়েছে। মহারানী কাশিশ্বরী কলেজের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। নারীবাদী আন্দোলনে সঙ্গেও তাঁর স্মৃক্তি ছিল। সকল পরিচয় ছাড়িয়ে তিনি কবি। ১৪টি কবিতার বই রয়েছে তাঁর।
মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতায় নারীর প্রতিবাদ আছে, কিন্তু তথাকথিত পুরুষবিদ্বেষ নেই। ‘স্বামীর কালো হাত’ নামে তাঁর একটি কবিতা পড়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। দাম্পত্য সম্পর্কের খুটিনাটি খুনসুটি নিয়ে লেখা ওই কবিতায় মশারী গুঁজে দেওয়ার নৈমিত্তিক ঘটনার বিবরণ চমৎকার ভাষা পেয়েছে। কবিতাটি একটু পড়ে নেওয়া যাক–

মশারি গুঁজে দিয়ে যেই সে শোয় তার
স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল
দেহের সাপব্যাঙ, লাগছে ছাড় দেখি
ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে দিল বুক
বলল, শোনো শ্বেতা, ঢলানি করবে না
কখনও যদি ওই আকাশে ধ্রুবতারা
তোমাকে ইশারায় ডাকছে দেখি আমি
ভীষণ গাড্ডায় তুমিও পড়ে যাবে,
শ্বেতার শ্বেত উরু শূন্যে দুলে ওঠে
আঁকড়ে ধরে পিঠ, স্বামীর কালো পিঠ ।

মল্লিকার কবিতা-র বিষয় হিসেবে এসেছে নানান প্রসঙ্গ। ‘তেভাগার ডায়েরি’ নামের এক কবিতায় শ্রমজীবী নারীর প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে নতুন এক ভাষায়। শ্রমের বিনিময়ে যে নারী পায় কেবল পোকা আলু আর আতপ চাল, সে যে তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য পায় না, তা বলা-ই বাহুল্য। তবু সেই শ্রমজীবী নারী তাঁর খোঁপায় লালফিতে জড়িয়ে নেয়। এই লালফিতা শুধু আর রূপসজ্জার অংশ হয়ে থাকে না, হয়ে উঠে বিপ্লাকাক্সক্ষার প্রতীক। এমনকি কাস্তের ফলকও হয়ে ওঠে তাঁর অলঙ্কার। যে তেভাগায় দুই ভাগ শ্রমিকের আর একভাগ মালিকের কথা বলা হয়েছে, মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতার নারী দেকতে পান, সেখানে দুইভাগ নিয়ে যাচ্ছে ‘গৃহমুষিক’। কিন্তু এটি নারী মেনে নেয় না, সে ‘উনুনের চার পাশে বসে হাত গরম করে’। আর তখনই তাঁর ঘোষণা পল্লবিত হয়-

দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও
আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব
[তেভাগার ডায়েরি]

এই শালপাতাকে বার্তাবহ করা, ঘরে আলো আনার জন্য হেরিকেনের কেরোসিনকে দরকার হলে আগুন জ্বালানো অর্থাৎ চরম প্রতিবাদের উপকরণ তৈরি করার মধ্য দিয়ে কবি যে বিপ্লববার্তা ঘোষণা করলেন, তা যে কতটা শিল্পসম্মত তা লিখে বোঝানো যায় না। সাদামাটা উপকরণে যে কত উপাদেয় কবিতা-অস্ত্র তৈরি করা যায়, মল্লিকা তা নিজ হাতে করে দেখালেন।
মল্লিকা সেনগুপ্ত খুবই সহজ ভাষায় তুমুল প্রতিবাদী কবিতা লিখতে পারেন। দৈনন্দিন জীবনের যে সকল অসঙ্গতি তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন কিংবা যে সকল অসামাজিক কর্মকা- সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তার সূত্র ধরে তিনি প্রচ- ক্ষোভের কবিতা লিখে গেছেন। ২০০১ সালে বালিকাকে যৌনহয়রানির দায়ে বাসের ড্রইভার হেলপারের গ্রেফতার হওয়া নিয়ে তিনি লিখেছেন মর্মস্পর্শী কবিতা। বাচ্চামেয়েটির প্রশ্ন যে কোনো পাঠককেই বিচলিত করে–
দুষ্টু কাকু দুষ্টু চাচা
থাকুক না তার ঘরে
বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে কেন
অসভ্যতা করে !
[বালিকা ও দুষ্টু লোক]

যে মেয়ে সবুজ মাঠে পক্ষীরাজের ঘোড়া ছুটিয়ে আনন্দ খুঁজতে চায়, তাকে কেন বাস থেকে নামিয়ে বাসেরই চালক আর তার সহযোগী যৌনহয়রানি করবে, এই প্রশ্নের জবাব কারো জানা নেই। কবিতাটি মর্মস্পর্শী হলেও মল্লিকার অন্য কবিতার চেয়ে গভীরতা কম। হয়তো শিশুদের কথা মাথায় রেখেই তিনি হালকা চালে লিকতে চেয়েছেন। আর তাই ছন্দ ও অন্ত্যমিলের প্রতিও নজর দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কিছুটা ছন্দশিথিলতা ঢুকে পড়েছে। এই কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের নামের সঙ্গে কেমন যেন বেমানান!

অনাবাসী বা আমরা যাকে প্রবাসী বলি, তাদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে একটি নিটোল কবিতা আছে মল্লিকার। বিদেশে সবাই যায় টাকা কামাতে। সেখানে বাড়ি হয়, গাড়ি হয়, নারী হয়; কিন্তু তারপরেও সুখপাঠিা যেন অধরাই থেকে যায়। অনাবাসীর সেই মর্মবেদনাকে কবি ধারণ করেছেন ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তের প্রবহমান দোলায়–
মন খারাপের বিকেলবেলায়
একটি মেয়েকে মনে পড়ে যায়
দেশে ফেলে আসা সেই সুখস্মৃতি
ভোলা তো গেল না প্রথম পিরিতি
এ দেশে আরাম এ দেশে ডলার
ছেলে মেয়ে বৌ ফিরবে না আর
এখন এখানে নামছে শেকড়
জমিও কিনেছি দু-এক একর

এখানে সুখের ঘর বানিয়েছি
তবু মনে হয় কি যেন হল না
বুক খাঁ খাঁ করে, বলো না বলো না
সুখপাখিটিকে হারিয়ে ফেলেছি ।
[অনাবাসির চিঠি]

মল্লিকা সেনগুপ্তের একটা অনিন্দ্যসুন্দর কবিতার নাম ‘রেডলাইট নাচ’। নাচের মঞ্চে যে কত নারী আসেন, তাঁদের প্রতিটি দেহভঙ্গিমায় যে কত ব্যথা লুকিয়ে আছে, তারা যে সমাজের নিগ্রহ পেরিয়ে এখন মনোরঞ্জনে মত্ত, সেই বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতায়।
বীণা সর্দার খালি গলায় এমন গান গেয়ে উঠল যে
মধুসূদন মঞ্চের বাতাস করুন হয়ে এল
তেজী হরিণীর মতো সারা মঞ্চে নেচে বেড়াচ্ছে সে
কে বলবে, তিনবার ওকে বিক্রি করে দিয়েছিল ওর বাবা !
নেপাল বর্ডার থেকে পুলিশ উদ্ধার করে এখানে এনেছে
পুরনো কথার ঘায়ে মাঝে মাঝেই ওর মাথা খারাপ হচ্ছে ।
[রেডলাইট নাচ]

কিন্তু শেষতক কবির বিশ্বাস ‘ঊর্বশীর মেয়েগুলি আমাদের পৃথিবীতে বাঁচতে চাইছে ’। বাংলা ভাষা নিয়েও তাঁর একটি বক্তব্যধর্মী কবিতা রয়েছে। কথাগুলো সোজাসাপটা বলেই তিনি ছড়ার আঙ্গিকটাকে গ্রহণ করেছেন। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহারে তিনি বাংলাভাষার প্রশস্তি করেছেন। কিন্তু সেই ভাষা যখন আগ্রাসনের শিকার, তখন তিনি সতর্ক করে দিতে চান–
আজ যদি সেই ভাষা
পথে পথে ভিখারি
যদি তাকে তাড়া করে
নিষ্ঠুর শিকারি
তবু ঘুম ভাঙবে না
পশ্চিমবঙ্গী !
একবার জেগে ওঠো
যুদ্ধের সঙ্গী।
এভাবেই মল্লিকা সেনগুপ্ত হয়ে ওঠেন সমাজসচেতন এক কবির নাম। নারীর জড়তা ঝেড়ে তিনি হয়ে ওঠেন কেবলি কবি। ব্যাক্তিগত পরিচয় না থাকলেও তিনি হয়ে ওঠেন সকল পাঠকের প্রিয় কবি।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত