অসমিয়া অনুবাদ: সংস্কার । মামণি রয়সম গোস্বামী
লেখক পরিচিতিঃঅসমিয়া সাহিত্যে দ্বিতীয় জ্ঞানপীঠ বিজয়িনী ইন্দিরা গোস্বামী ওরফে মামণি রয়সম গোস্বামী ১৯৪২ সনে অসমের গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।দিল্লি বিশ্ববিদ্যাল্যের আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগে অধ্যাপনারত এই অধ্যাপিকার রামায়ণী সাহিত্যের গবেষক হিসেবে সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।গল্প এবং উপন্যাস দুটিতেই সমান দক্ষ লেখিকা ‘মামরে ধরা তরোয়াল’উপন্যাসের জন্য ১৯৮৩ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।২০০০ সনে জ্ঞানপীঠ সম্মানে স্মমানিত লেখিকার অসংখ্য গল্প উপন্যাস ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।২০১১ সনে লেখিকার মৃত্যু হয়।
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস
বাড়ির সামনে পীতাম্বর মহাজন বসেছিল। কাদায় মাখামাখি হওয়া জুতোজোড়া সে তখনও খুলে রাখেনি। এই চামড়ার জুতো জোড়ার প্রতি তার এক ধরনের দুর্বলতা ছিল। পীতাম্বরের বয়স ষাটের কাছাকাছি। এক সময়ে সে শক্তপোক্ত পালোয়ান পুরুষ ছিল। এখন চিন্তা ভাবনা এবং এক ধরনের অসন্তুষ্টির কবলে পড়ে মানুষটার স্বাস্থ্য পড়ে এসেছিল। থুতনির নিচের মাংসপেশি নিচের দিকে ঝুলে পড়েছিল। মানুষের সঙ্গে মাথা তুলে কথা বলতে পারত না। দৃষ্টি অহরহ মাটিতে নিবিষ্ট ছিল। যেন মাটির নিচে খুঁড়ে খুঁড়ে কিছু একটা কুড়োনোর চেষ্টা করছে।
বাড়ির সামনে কিছুদিন আগে একটা কাটা সেগুন গাছের গোড়াতে বসে পীতাম্বর পথের দুপাশের খালে বড়শি বেয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের গতিবিধি দেখছিল। এই কয়েকদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ার জন্য পুরো গ্রামটাই কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছিল। কাচা রাস্তার দুপাশে জার্মান বন, কচু, ভতরা শাক,পানেরি লতা,কলমি,নল কচু ইত্যাদি গাছে পরিপূর্ণ হয়েছিল। পাতি ব্যাঙগুলি একটা খাল থেকে অন্য একটি খালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল ।
নলকচুর ঝাড়ে জট পাকানো বড়শি ধরে একটি ছেলে টানাটানি করছিল। পীতাম্বর বড়ো কৌতহলের সঙ্গে তাকে দেখছিল। হঠাৎ একটা গলগলে কণ্ঠস্বর শুনে পীতাম্বরের ধ্যানভঙ্গ হল। মাথা তুলে তাকিয়ে সে দেখল কৃষ্ণকান্ত পুরোহিত এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে।কৃষ্ণকান্ত ছড়া কেটে বলল–
কার বাড়ির কার মাণিক ,
কে তাড়ায় পানীক।
হাতের ইশারায় ডেকে এনে
চুমু খাই খানিক।
পীতাম্বর তোমার নিজের তো ছেলে মেয়ে নেই। পরের ছেলেমেয়ে নিয়েই দেখছি মশগুল হয়ে আছ? আমি এদিকে যাবার সময় তোমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখেছিলাম‐– এখন ফিরে আসার সময়ও দেখছি একইভাবে বসে আছ। তা তোমার স্ত্রী কি এখন উঠে বসে চলাফেরা করতে পারছে?’
‘ না ,কোথায় আর চলাফেরা করতে পারছে? পা ফুলে ঢোল হয়ে আছে!‘ এবার নিয়ে কুড়িবার গুয়াহাটিতে আসা যাওয়া করা হল।‘
‘ ছেলে-মেয়ে হওয়ার তো আর আশা নেই-তাই নয় কি? তোমার আর বংশ রক্ষা হল না। বড়ো দুঃখের কথা!‘
পীতাম্বর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কৃষ্ণকান্ত কিছুক্ষণ তার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। পুরোহিত হাঁটুর উপরে একটা ধুতি পরেছিল। পরনের পাঞ্জাবিটা এত পুরোনো হয়েছিল যে ওটার রং শুকোতে দেওয়া কুমড়োর গুটির মতো হয়ে পড়েছিল। কাঁধে চাদরও ছিল । কৃষ্ণকান্তের সামনের মাত্র দুটো দাঁত বাকি ছিল।ফলে গাল দুটো একেবারে চুপসে গিয়েছিল।কথা বলার সময় মুখটা এক বিচিত্র ভঙ্গি ধারণ করত।চোখ দুটিতে সব সময় একটা ধূর্ত চাহনি জ্বলজ্বল করত।মাথার চুল পাতলা হয়ে গিয়ে তালু স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তারমধ্যে মাঝখানে সিঁথি থাকার জন্য তার ধূর্ত চোখ জোড়া যেন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এবার সে পীতাম্বরের কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘পরিবারের কিছু একটা হয়ে গেলে আবার বিয়ে-সাদির কথা ভাবছ নাকি?’
পীতাম্বর কাঁধে নিয়ে থাকা চাদরটা দিয়ে মুখ মুছে কিছু একটা উত্তর দিতে চাইছিল, তখনই তার চোখ হঠাৎ দময়ন্তীর ওপর পড়ল। কিছুদিন আগে বিধবা হওয়া দময়ন্তী শম্ভু পুরোহিতের সহধর্মিণী ছিল। তার স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না। বিধবা হওয়ার পরে সে গ্রামের যুবকদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে পড়েছিল। তাকে দেখে কৃষ্ণকান্ত বলল,’ কোথা থেকে এলি দময়ন্তী?’
কোথা থেকে আসব আর? হাতে এসব এন্ডি পোকাগুলি দেখতে পাচ্ছিস না?’
‘ তাহলে সেই মারোয়ারি সদাগরদের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করেছিস।সেই যে বলে– ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা।‘
দময়ন্তী কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু মেখেলার নিচের দিকের পাড়টার ভিজে যাওয়া অংশটা হাত দিয়ে চেপে ধরল। তার ব্লাউজটা কোমর থেকে বুক পর্যন্ত টান পড়ে উঠে গেল। কচি কুমড়োর মতো রংয়ের কোমরে পীতাম্বর আর কৃষ্ণকান্তের চোখ পড়ল। পীতাম্বর তাকিয়ে রইল, কৃষ্ণকান্ত অবশ্য চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপরে দময়ন্তী মেঘলার চপ চপ আওয়াজ তুলে অতি দ্রুত হেঁটে রাস্তায় উঠে পড়ল ।
‘শুনেছি মাছ- মাংস সবই খায়।‘
পীতাম্বরের কথায় সায় দিয়ে কৃষ্ণকান্ত বলল – ‘এই সদিলানগরের বামুনদের ওর জন্য নাক কান কাটা গেছে। কিছুই মানে না। আগে দুই মেয়ের জন্য মাছ রেঁধে দিয়ে কুমোরপাড়ে গিয়ে স্নান করত। আজকাল একসঙ্গেই বসে খায়।‘
পীতাম্বর বলল ,হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ওকে রংমলা মেছুনিকে এক ঝুড়ি ধান দিয়ে দুটো ফলি মাছ রাখতে দেখেছি!’
‘হায়!হায়!বিধবা এক ঝুড়ি ধানের বিনিময়ে দুটো ফলি মাছ খায়!!
‘চুপ কর,চুপ কর পুরোহিত!বিধবা বামুনের স্ত্রী মাছ খায় একথা জানাজানি করার প্রয়োজন নেই।আজকাল অনেক জায়গাতেই একথা শোনা যাচ্ছে।দক্ষিণ পার,উত্তর পারের অনেক জায়গায় এই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে।খুব একটা খারাপ হয় নি।সেইসব নিয়ম উঠে যাওয়া উচিত।’
পীতাম্বর তাঁর পায়ে এবং হাঁটুতে বিরক্ত করতে থাকা মাছিগুলিকে কাঁধের চাদরটা দিয়ে তাড়াতে তাড়াতে কিছুক্ষণ দময়ন্তীর যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইল।তারপর বলল,আচ্ছা আজকাল তোমার যজমানদের ধ্যান-ধারণা কীরকম?’
‘পীতাম্বর মহাজন, তুমি দেখছি সবকিছু জেনেও আজ নতুন করে জিজ্ঞেস করছ।আমাদের দুই ভাইয়ের নিজেদের মধ্যে ঝগড়ার ফলস্বরূপ আজ আমার এই নিঃস্ব অবস্থা।’
‘তুমি সংস্কৃত পড়তে পার না বলে তোমার দাদা ঢোল পিটিয়েছিল।সেইজন্যই তোমার আজ এই অবস্থা।’
কৃ্ষ্ণকান্ত লাফিয়ে উঠল।‘ইস কয়টা বামুণ নরহরি ভাগবতীর মতো শুদ্ধ করে মন্ত্র পাঠ করতে পারে,পীতাম্বর মহাজন? টোলে আমরা একসঙ্গেই পড়েছিলাম।ওই কুকুরের পিঠেই বেত পড়ত।আমি বেত খাই নি।আজকাল আমাদের নিঃস্ব অবস্থার জন্য দায়ী হল আমাদের যজমানরা।দশ-কর্ম জানা বামুনদের আজ শুকিয়ে মরার মতো এই অবস্থা হওয়াটা উচিত হয় নি।মাসশেষে একটি পৈ্তা,এক জোড়া ধুতি এবং রূপোর পাঁচ টাকা যজমানের বাড়ি থেকে পাওয়া যেত।কিন্তু এখন একটাই নিয়ম হয়ে গেছে -পৈ্তাও রাখতে চায়,বিধি-নিষেধ ও মানবে না।এই সেদিনের আমাদের পুরোনো যজমান মহীকান্ত শর্মার ছেলে দুটি কামাখ্যায় গিয়ে পৈ্তা নিয়ে এল।মাইসানপুরের যজমান সূর্য শর্মা মা-বাবার শ্রাদ্ধ একসঙ্গে পেতেছে।বিয়ে-সাদিতে নয় পুরুষের শ্রাদ্ধও অনেকেই ধীরে ধীরে পতিত ফেলতে শুরু করেছে।ভাত চুয়নি,কর্ণবেধন,পুহন বিয়ে,নামকরণ,গৃহপ্রবেশ,বাসন্তী পূজা,বাড়িতে শকুন পড়ার হোম ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্ত কিছু এই অঞ্চল থেকে উঠেই যাচ্ছে।পৈ্তা খুললেই আগে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। আজ কয়টি বামুনের ছেলে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে?’
পীতাম্বর মুখে কোনো শব্দ না করে কৃষ্ণকান্তের কথা শুনছিল যদিও বার বার তার দময়ন্তীর কোমরটার কথা মনে পড়তে লাগল।মেখেলাটা আঁট করে বাঁধার সময় দময়ন্তী পরে থাকা পাতলা ব্লাউজটা অনেকটা উঠে গিয়েছিল।তার পিঠটা পাবদা মাছের মতো কোমল।আজ যেন জীবনে প্রথমবারের জন্য সে এরকম একটি পিঠ দেখতে পেয়েছে।এমন নয় পীতাম্বর মেয়েদের পিঠ কখনও স্পর্শ করেনি।প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পরে সে দ্বিতীয় বিবাহ করেছিল। সন্তানের আশায় সে প্রথম পত্নীর মৃত্যুর দুইমাস পার না হতেই দ্বিতীয় বিবাহ করেছিল।কিন্তু সেও ছিল চিররুগ্না।বাত-পিত্তের কবলে পড়ে পীতাম্বর মহাজনের দ্বিতীয় স্ত্রীও একেবারে বিছানা নিয়েছিল।গুয়াহাটির হাসপাতালে আসা যাওয়া করতে করতে পীতাম্বর মহাজনের পায়ের জুতোর তলি ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে মানুষটা কেবল অস্থি চর্মসার হয়ে উঠেছিল।বিছানায় শুয়ে শুয়ে মহাজনের গতিবিধি দেখতে দেখতে দিন কাটাত। সন্তান আশা করে করে এবং বংশনাশ হওয়ার ভয়ে মানুষটা বিকারগ্রস্ত রোগীর মতো হয়ে পড়েছিল।লোকে বলে বিছানায় পড়ে থাকা স্ত্রীর মৃত্যু পর্যন্ত সে বড়ো অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। পরবর্তীকালে সে গুয়াহাটির হাসপাতালেও আসা যাওয়া করা ছেড়ে দিয়েছিল। বয়স যতই বেড়ে চলছিল ততই সে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।এইতো এখনও তার সামনে বসে কৃষ্ণকান্ত নিজের অবস্থার কথা বলে চলেছে। পীতাম্বর অর্ধেক শুনছে,অর্ধেক শুনছে না। বিছানায় পড়ে থাকা মানুষটা চোখের ইঙ্গিতে কাজের লোকটাকে একটা মোড়া এগিয়ে দিতে বলেছিল । লোকটা সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণকান্তের কাছে মোড়াটা রেখে গেল সেটাও পীতাম্বর লক্ষ্য করল না।
এবার কৃষ্ণকান্ত বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।বলল,সত্রের লোকেরা বলাবলি করছে, তোমার নাকি মাথার গন্ডগোল হয়েছে।এই পৃথিবীতে নিঃসন্তান লোকজন কি বেঁচে নেই? তাছাড়া ভালোভাবে ভেবে দেখ তো পীতাম্বর আমাদের গুরুজনেরাই কি বলে যায়নি–’ পুত্র পরিবার সকলি অসার! মায়া প্রপঞ্চ!!’
পীতাম্বর মাথা নিচু করল। কৃষ্ণকান্ত লক্ষ্য করল তার মাথার চুলগুলি অকালেই পেকে গেছে। চোখের নিচে মাকড়সার জালের মতো কিছু রেখা প্রকট হয়ে উঠেছে। সাজ পোশাকেরও কোনো ঠিক নেই। পরনের জুতো জোড়া কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে।
মানুষটার প্রতি কৃষ্ণকান্তের করুণা হল। অথচ আগে এই মজবুত স্বাস্থ্যের মানুষটিকে বুড়োরা ‘গোরা পল্টন’, ‘গোরা পল্টন’ বলে ডাকত। টাকা পয়সা থাকা সত্ত্বেও জীবনে সুখ পেল না।ভাঁড়ারের ফসল খাবার লোক নেই। হঠাৎ কৃষ্ণকান্ত একটা অভাবনীয় কথা পীতাম্বরকে বলল। কথাটা বলার সময় সে চারপাশটা দেখে নিল। পীতাম্বরের শোবার ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা ছিল। সে পীতাম্বরের স্ত্রীর বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া কঙ্কালসদৃশ দেহটা দেখতে পাচ্ছিল। মহিলার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। কৃষ্ণকান্ত পীতাম্বরকে কী কথা বলতে চলেছে এ কথা জানার জন্য সে যেন উদগ্রীব হয়ে আছে, এত দূরের দৃষ্টিও যে এত তীক্ষ্ণ হৃদয় স্পর্শী হতে পারে এ কথা কৃষ্ণকান্ত আগে কোনোদিন বুঝতে পারেনি। তথাপি সে বলল– ফিসফিস করে বলল, আমাকে যদি কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পার আমি তোমার একটা ব্যবস্থা করতে পারি।’
‘ আর ব্যবস্থা?’
‘ এবারের ব্যবস্থা একেবারে পাকা!’
‘ মানে?’
‘এবার গর্ভবতী না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাঁশবাগানের নিচে সে’ নষ্ট ভ্রুন’ চারবার পুঁতে রেখে এসেছে!’
পীতাম্বর মহাজন আর্তনাদ করে উঠল,’ তুমি দময়ন্তীর কথা বলছ!’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দময়ন্তীর কথা বলছি। আজকাল আমাদের বামুনের মেয়েরা একেবারে ধলেশ্বর নদী পার হয়ে নমঃশূদ্রদের সঙ্গে ঘর বাঁধছে। মুক্তেশ্বর সত্রের গোঁসাইর ছেলে মুসলমানের মেয়ে আনেনি কি? গান্ধী মহারাজ নাকি এই পথ দেখিয়ে গেছে। তাই আমি এই কথাটা ভাবছি।’
পীতাম্বর মহাজন আকুল হয়ে উঠল।
‘ কী কথা?’
‘ তুমি ইচ্ছা করলে দময়ন্তীকে নিজের করে নিতে পার!’
কথাটা বলে কৃষ্ণকান্ত পুনরায় দরজার দিকে তাকাল। মহিলাটির চোখ খোলা ছিল। চোখে দু টুকরো অঙ্গার যেন জ্বলজ্বল করছে।সে কৃষ্ণকান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল।
পীতাম্বর মোড়াটা থেকে চট করে উঠে দাঁড়াল। কৃষ্ণকান্ত যেন তার মনের কথা বলতে শুরু করেছে।
পীতাম্বর দৌড়ে গিয়ে কৃষ্ণকান্তের হাত খামচে ধরতে চাইল।কৃষ্ণকান্ত কিছুটা পিছিয়ে গেল। সে স্নান করে এসেছে।অধিকারীর বাড়িতে মুরলীধরকে স্নান করাতে যেতে হবে, কারণ যিনি বিগ্ৰহকে স্নান করান সেই পূজারী মাটির মামলায় গুয়াহাটিতে আসা যাওয়া করছে। অন্যদিকে জলে ভেসে যাওয়া খড়কুটো খুঁজতে গিয়ে পীতাম্বর চোখের সামনে একটা বিচিত্র পাল তোলা নৌকা দেখতে পেল বলে মনে হল। সে কৃষ্ণকান্তের হাত ধরবে না পা ধরবে কিছুই বুঝতে পারল না।
‘ মহাজন, তাহলে তুমি এই কথা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলে?’
একটা প্রাণ খোলা হাসি পীতাম্বরের ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল।কৃষ্ণকান্ত পুনরায় একবার গলা বাড়িয়ে বিছানায় পড়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকাল। এবার সে মানুষটার চোখ দুটি বন্ধ দেখতে পেল। বোধহয় যন্ত্রণা পাচ্ছে। গলবস্ত্র হয়ে পীতাম্বর বলল তুমি এই উপকারটুকু করে দাও। সে যে রাতের বেলা প্রদীপ হাতে নিয়ে নষ্ট কিছু পুঁতে রাখতে যায় একথা সত্রের সবাই জানে। আমিও জানি। কিন্তু সে বামুনের বিধবা। আমি ওকে মাথায় করে রাখব। ‘
কৃষ্ণকান্তের ফোকলামুখে ধূর্ত হাসি ছড়িয়ে পড়ল।’ আমাকে আসা-যাওয়া করতে হবে। ওর মেয়ে দুটিকে রাজি করাতে হবে। ভোলার দোকান থেকে গজা কিনে নিয়ে যেতে হবে।’
পীতাম্বর মহাজন চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে গেল। এবার বিছানায় পড়ে থাকা মানুষটা বন্ধ চোখ দুটি খুলে তাকাল।মনে হল সে যেন আগে থেকে ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করেছিল। তার চোখে পড়ল মহাজন মোড়ার ওপর তুলে রাখা তোরঙ্গটা খুলল। কিছুক্ষণ পরে সে দেখল মহাজন পুনরায় কৃষ্ণকান্ত পুরোহিতের কাছে উপস্থিত হয়েছে ।
‘ তুমি তাহলে দ্রুত খবরটা এনে দেবে! কৃষ্ণকান্ত হাত পেতে কুড়িটা টাকা নিল। যাবার সময় বলে গেল ‘দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।’
ইতিমধ্যে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। বড়ো আগ্রহ নিয়ে পীতাম্বর মহাজন কৃষ্ণকান্ত পুরোহিতের জন্য অপেক্ষা করে রইল। এই কয়েকদিন সে যে বাড়ির সামনে দিয়ে দময়ন্তীকে যেতে দেখে নি এমন নয়। কাপাস তুলোর পৈতে বানানোর জন্য বেশ কয়েকবার সে অধিকার গোঁসাইর বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছে।পীতাম্বর মহাজন ইদানিং তারদিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে আবিষ্কার করেছে যে তার মতো সুন্দরী নারী সে আগে পিছে কখনও দেখেনি। শোনা যায়, তার মা ধনশ্রী নদীর তীরের রৌতার মানুষ। ধনশ্রী নদীর তীরের বামুনের মেয়েদের মতো সুন্দরী নারী নাকি ভূ-ভারতে নেই, পীতাম্বর মহাজনের এরকমই মনে হল। তার পিতা পূর্ণানন্দ পুরোহিত একবার একজোড়া হালের গরু হারিয়েছিল। সেই সময় তার নিজস্ব একটা হাল ছিল। মাইসানপুর, গড়গড়া ইত্যাদির দিকে তার অসংখ্য যজমান ছিল। গরুর খোঁজে সে ধনশ্রী নদীর তীর ধরে একেবারে রৌতায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। গরুর খোঁজে তাকে এতদূর কেন যেতে হয়েছিল একথা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। রৌতার ভাগবতীর মেয়ের সঙ্গে তাঁর তখনই বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আগে পরে এই খন্ডের যজমানী বামুন কয়েক ঘর এত দূরে গিয়ে বিয়ে করেনি।
জৈষ্ঠ মাস। নদী-বিলের জল উপচে পড়ছিল। আলের দুপাশের মাদুরি, জার্মান বন, ভতরা, পানেরি লতা ইত্যাদি এমনভাবে ঘিরে ধরেছিল যে পথ দিয়ে যাওয়া আসা করার সময় বন্যলতা গুলি মানুষের নাকে মুখে লাগছিল।মহাজনের বাড়ির সামনে লাল আল-পথটাও কাদায় ভরে গিয়েছিল।কিন্তু এরকম অবস্থাতেও পীতাম্বর মহাজন পুনরায় আজ দময়ন্তীকে দেখতে পেল।সে হাঁটু পর্যন্ত মেখেলা গুটিয়ে আলের পাশে কলমি শাক কুড়াচ্ছে। তার ছয় বছরের মেয়েটি একেবারে উলঙ্গ হয়ে মায়ের গায়ের সঙ্গে লেগে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
নতুন আমের চারার মতো সজীব হাত-পা।পিঠে খসে পড়া চুলগুলির রঙ কিছুটা লাল,মরচে পড়া লোহার কামানের মতো রঙ ধারণ করেছে তার চুলগুলি।
মরচে পড়া কামান?
হ্যাঁ!হ্যাঁ!একবার কুয়ো খোঁড়ার সময় সে রকম একটি লোহার কামান আবিষ্কারের কথা পীতাম্বর মহাজনের মনে ছিল।সেটা মান সেনারা ফেলে যাওয়া কামান বলে সবাই বলাবলি করত।এক সময়ে শহর থেকে আগত কিছু ছাত্র সেটা উঠিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
ঘষে-মেজে রাখায় রোদে চমকানো লোহার কামানটার মতো রঙ ধারণ করেছিল আজ এই মুহূর্তে পীতাম্বর মহাজনের দময়ন্তীর পিঠে পড়ে থাকা চুলগুলিকেও একই রঙের বলে মনে হল-সেই লাল এবং কালোর চমকানি? লোহা এবং মরচের চকমকানি।
পীতাম্বর মহাজন সাহস করে দময়ন্তীর কাছে গিয়ে বলল,’এই ধরনের কাদা-জলে ছানা-ছানি করলে অসুখ হয়!’
দময়ন্তী ফিরে তাকাল।তার চোখেমুখে বিষ্ময়ের কিছু রেখা ছড়িয়ে পড়ল।
অন্যদিনের মতো আজও সে কোনো জবাব দিল না।
মহাজন পুনরায় বলল,আমি আমার কাজের লোকটাকে দিয়ে কলমি কেন,ঢেঁকিয়া,খুতরা…’
বাক্যটা মহাজন শেষ করতে পারল না।দময়ন্তী আবার ফিরে তাকাল।মহাজন যেন দুটো জ্বলন্ত অঙ্গারের সঙ্গে মুখোমুখি হন।সে আর সেখানে অপেক্ষা করলেন না।দ্রুতঁ এগিয়ে এসে সেগুন গাছের গোড়ায় বসল।ঐ যে বিছানা থেকে স্ত্রী তাকিয়ে রয়েছে।যেন খোড়লের ভেতর ঢুকে থাকা ডানা ভাঙ্গা পেঁচা বাইরে উড়ে বেড়ানো কিছু পাখির দিকে তাকিয়েছিল।সে সকালে উঠেছিল।কিন্তু এখন সে আবার বিছানা নিয়েছে।মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে।অনেকদিন পরে সে উঠতে চেয়েছিল।তার শুকিয়ে কর্কশ হয়ে যাওয়া হাঁটু এবং হাতের গ্রন্থিগুলি থেকে একটা কটকট শব্দ বেরিয়ে আসছিল।তারপরেই মাথাটা ঘুরতে লাগল।পুনরায় সে বিছানায় পড়ে বাইরের দিকে তাকাতে লাগল।পীতাম্ব্রর মহাজন একটা বড়ো কর্কশ এবং অস্বস্তির দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল।মুখ দিয়ে সে কোনো কথা উচ্চারণ করল না।এই সময়ে তার একধরনের জলীয় ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে।মহাজনের ঔষধের কথা মনে পড়ল।সে কিন্তু উঠে গেল না।কিছুক্ষণ মহাজন মাথা নিচু করে নিজের জুতোজোড়ার দিকে তাকিয়ে রইল।এই সত্রের ভেতরে মাত্র চারজন মানুষ জুতো পরে হাঁটে।সত্রের অধিকারের ছেলে দুটি,সত্রের মহুরি বাবু,আর সে পীতাম্বর মহাজন।পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মহাজন জুতোজোড়া থেকে কাদাগুলি দূর করার চেষ্টা করতে লাগল।এবং আলপথের দিকে তাকাল।কৃ্ষ্ণকান্ত পুরোহিত আসে নি।হঠাৎ কড়কড় ঘড়ঘড় শব্দ করে একটা গরুর গাড়ি তার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল।বঙরার আধিয়াররা বোকাধান দিতে এসেছে।অন্য দিন হলে পীতাম্বর উৎসাহে উঠে গিয়ে ধানের হিসেব নিকেশ করে।আজ তাকে নিষ্ক্রিয় দেখে কাজের লোকরাই এগিয়ে গিয়ে ধরাধরি করে ধানের বস্তাগুলি নামিয়ে ভাঁড়ারে নিয়ে রাখল।
একটা সময়ে অধিয়াররা চা-পান খেয়ে হাত পা ধুয়ে এখান থেকেই বিদায় নিল। বিদায় নেবার সময় আধিয়াররা অন্যদিনের মতো আজও আক্ষেপ করে গেল’ সন্তানাদি নেই। এই তিন চারটি ভাঁড়ারের ধান কে খাবে মহাজন? দান-দক্ষিণা কর! বুড়ো হয়ে এসেছ– কথায় বলে–
‘আর যাই লুকোবার লুকোও,
ফোকলা গাল কোথায় লুকাবে?
পীতাম্বর মহাজন কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল। বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার চোখ দুটি পুনরায় খুলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে সে হয়তো জল খেতে চেয়েছিল। পেতলের একটা গ্লাসে জল তার বিছানার কাছে কেউ রেখে গেছে।
তার ঔষধ খাওয়ার সময়ও পার হয়ে গিয়েছিল।
পীতাম্বর মহাজনের এবার তার ঔষধের কথা মনে পড়ল। সে উঠল। জুতো জোড়া খুলে বারান্দার এক কোণে রাখল। তারপর স্ত্রীর খাটের দিকে যেতে গিয়ে দরজার মুখে কৃষ্ণকান্ত পুরোহিতের কন্ঠস্বর শুনতে পেল। খুলে রাখা জুতা জোড়া পুনরায় পরে নিয়ে সে দরজার মুখে দ্রুত এগিয়ে গেল।
মহাজনের স্ত্রীর বন্ধ হয়ে থাকা চোখ দুটি খুলে গেল। একেবারেই দুর্বল দৃষ্টি। এই দৃষ্টিতে আগের সেই আগুন নিভে ছাই হয়ে গেছে।
‘ মহাজন!’
‘ বল বাপু,বল।’
‘ পুর্ণিমার দিন রাতে তার ঢেঁকিশালে তুমি উপস্থিত হবে। কিন্তু শোন মহাজন’, কৃষ্ণকান্ত চারপাশটা দেখে নিল। তারপর মহাজনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি খবর নিয়ে এসেছি। ওর পেট খালি আছে। মেয়েটি ভোলার দোকানের গজা খেয়ে বলল, এবার প্রদীপ নিয়ে নাকি ভলুকাবাঁশের নিচে নষ্ট ভ্রূণ পুতে আসার এক মাসও হয়নি। ছয় বছরের মেয়েটি অনেক কিছুই বুঝতে পারে না।সে প্রদীপ হাতে মাকে পাহারা দিচ্ছিল।এবার মাকে নাকি চতরাগুরির বামুনের ছেলেটি দেওয়া খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল।এই বামুনের ছেলেটি সাইকেল মেরে চৌরাস্তার কলেজে পড়তে আসত। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিল। কিন্তু চরিত্রহীন। কলেজে যাচ্ছি বলে বইপত্র দময়ন্তীর ঘরে চালের ডুলিতে লুকিয়ে রাখে। কলেজের মাশুলের টাকা দময়ন্তীর সাজ সজ্জায় খরচ করে। এবার পুতে রেখে আসা সন্তানটা নাকি সেই ছাত্রটির! পীতাম্বর মহাজন মুখে ইশ ইশ শব্দ করতে লাগল।
কৃষ্ণকান্ত পুনরায় বলল, শোনো মহাজন আমি তোমার কথা ওকে বললাম। শুনে ও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, ‘বেটা শুদ্র মহাজনের এত সাহস!সেই ব্যাটা কি জানেনা আমি যজমানী বামুনের মেয়ে বলে?’ আমি বললাম যজমানি বামুনের মেয়ে বলে সবাই জানে। কিন্তু পাপের পথে পা রেখেছ যখন তখন আর বামুন শুদ্র বাচ বিচার কিসের?বামুনের ছেলেরা তো তোকে বিয়ে করার জন্য এগিয়ে আসেনি। আঁখের মতো রস চুষে খেয়ে নিয়ে ছিবড়ে করে ফেলে রেখে যাবে। মহাজন একেবারে পঞ্চায়েতের আশীর্বাদ নিয়ে হোম করে বিয়ে করবে। স্ত্রী মর মর অবস্থা, আজ আছে তো কাল নেই। সুখে রাখবে। একেবারে মাথায় তুলে রাখবে। শোনো পীতাম্বর মহাজন, দময়ন্তী ভেতরে গিয়ে ফুঁপিয়ে,ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ও কেন এভাবে কাঁদছে কিছুই বুঝতে পারলাম না।’
তারপরে চাদরে চোখ মুছে বলল,’ আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কারও উপরে নির্ভর করতে পারলে ভালোই হতো।’
‘ আমি বললাম শরীর কীভাবে ভালো থাকবে। শুনেছি চার পাঁচবার নষ্ট ভ্ৰূণ পেছনের বাগানে পুঁতে রেখেছিস। পঞ্চায়েতে সভা ডাকলে হাহাকার পড়ে যাবে। অসুখের সময় মুখে জল দিতে এলেও কুড়ি টাকা দন্ড দিতে হবে ।’
দময়ন্তীর চোখের জল মাটিতে পড়ল। বলল কোনো উপায় ছিল না। পেটের ক্ষুধায় ছটফট করে মরছিলাম। আগে অধিকারিনী গোঁসাই চিড়ে ভাজার জন্য ডেকে পাঠাত। আজকাল আর ডাকে না, আমার স্পর্শে নাকি চিড়ে অশুচি হয়ে যায়। আগে পৈতে কাটতে দিত, আজকাল এখানকার বামুনরা সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। যারা আধি নিয়ে জমির ফসল ফলাচ্ছে তারাও অসুরের মতো হয়ে পড়েছে। আমার মাথার ওপরে কেউ নেই এ কথা ওরা জানে। বামুনের বিধবা বলে কোনো দয়ামমতা নেই।সাতপখলির মানুষ ধান দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আমি অসুরদের সঙ্গে কীভাবে লড়াই করব? সাতপখলির দুই পুরা মাটির পাঁচ মণ ধান আজ পর্যন্ত কেউ দিতে আসেনি। সেই জমির খাজনা আজ তিন বছর ধরে দিতে পারিনি, কবে নীলাম হয়ে যাবে ঠিক নেই। এই অবস্থায় আমি মেয়ে দুটিকে নিয়ে কী করব?’
পীতাম্বর মহাজন ইতিমধ্যে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। সে চিৎকার করে বলল, ‘আমার প্রস্তাবটা ভেবেছ কি?’
‘ তোমার কথাতেই আসছি’শোন। শূদ্র মানুষ, অর্থাৎ এই চতুর্থ বর্ণের মানুষের সঙ্গে… শোনো সে এই পূর্ণিমার দিন তোমার সঙ্গে ঢেঁকিশালে দেখা করবে বলল!
পীতাম্বর মহাজন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। এই সুযোগে কৃষ্ণকান্ত পুরোহিত বলল,’ এবার পাঁচ কুড়ির মতো লাগবে। দময়ন্তীকে নাকি মশা কামড়ায়। মশারি চাই। আর মেয়ে দুটির জন্য ভোলার দোকানের গজা!’
তাড়াহুড়ো করে পীতাম্বর মহাজন ভেতরে চলে গেল। বিছানায় শুয়ে থাকা মহিলাটি চোখ মেলে তাকাল। তার ঔষধ খাওয়ার সময় পার হয়ে গিয়েছিল। স্বামীকে তোরঙ্গটার কাছে যেতে দেখে সে ভেতরের দিকে তাকাল। পীতাম্বর মহাজন ধমকে উঠল’ এভাবে বড়ো বড়ো চোখ করে কেন তাকিয়ে রয়েছিস? চোখ দুটো কোনদিন উপড়ে ফেলব!’
কৃষ্ণকান্ত পুরোহিত সব কথা শুনতে পেল, সবকিছু জানল। পাঁচ কুড়ি টাকা নিয়ে ফিরে আসার সময় মহাজনের কানের কাছে গিয়ে সে ফিসফিস করে বলল,’ বেশি প্রয়োজন হলে একটা কাজ করবে– স্ত্রীকে একটা আফিমের বড়ি খাইয়ে দেবে! বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে হয়তো সব কিছুর হিসেব করছে! এভাবে বলে কৃষ্ণকান্ত খিক খিক করে হেসে উঠল। বিছানায় শুয়ে থাকা মহিলাটি এবার চোখ দুটো বুজে নিল।
কৃষ্ণকান্ত এবার আরও এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,’ টাকা পয়সার প্রতি দময়ন্তীর বড়ো লোভ। একেবারে বাঘিনীর মতো। শোন মহাজন ঢেঁকিশালে তুমি তাকে আরও নিবিড় করে পাবে।’
মহাজন পুনরায় তাড়াহুড়ো করে ফিরে তাকাল। না না ,বিছানায় পড়ে থাকা মানুষটা শুনেনি। সেই চোখ বুজে পড়ে আছে। তার সেই শুকনো কপালটিতে ঘামের দুটো কণা দূর থেকে চকচক করছে।
আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা। পীতাম্বর মহাজন এণ্ডির পাঞ্জাবি এবং শান্তিপুরী ধুতি পরে নিল। আশি সুতোর একটা চাদর কাঁধে নিল। অনেকদিন পরে সে কাঠের ফ্রেমের আয়নাটা বাইরে এনে নিজের মুখটা পরীক্ষা করে দেখল। সকাল বেলা সে দাড়ি কেটেছিল। এখন বাইরের রোদের আলোতে সে তার মুখে অজস্র বলিরেখা দেখতে পেল। মুখের এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখা বাইরে আয়নাটা এনে এভাবে দেখার জন্যই যেন দেখতে পেল– মহাজনের এরকম একটা ভাব হল। তথাপি সে যেন নিজের মুখটা দেখে সন্তুষ্ট হল। রেখা গুলি যেন একটি জাল। আর নিজের মুখটা যেন সেই জালে আবদ্ধ একটা মাছ। জালে পড়ে থাকা মাছ।
একটা সময় সে দময়ন্তীর বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সেগুন বন পার হয়ে শিংরা নদীর সেতুর কাছে তার বাড়ি। এদিকে সত্রের চার ঘরের মতো মানুষ রয়েছে। এভাবে নির্জন জায়গায় থাকার জন্যই যেন দময়ন্তী এরকম একটি জীবন যাপন করতে পারছে– পীতাম্বর মহাজনের এরকম মনে হল।
আকাশে ছত্রাক রঙের কিছু মেঘ বিচিত্র ভঙ্গিতে পুব আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেগুলিকে একটা কামানের মতো মনে হচ্ছিল। আর সেই চন্দ্রমাকে? কেউ যেন ছাল ছাড়িয়ে রাখা একটি হরিণী। ফুটুকি কাটা চামড়াটা কেউ যেন কামান গুলিতে পেঁচিয়ে রেখেছে!ছাল ছাড়িয়ে রাখা হরিণী? থকথকে মাংসটা বড়ো চকচকে।ঝলমল করছে।আঃ! পীতাম্বর মহাজনের চোখে এই ছাল ছাড়িয়ে রাখা হরিণীটি দময়ন্তীতে রূপান্তরিত হল। একেবারে নগ্ন হয়ে থাকা দময়ন্তী।ঐ যে গাভিনী ছাগলীটার পেটের মতো তার দুটি স্তন । সুস্বাদু বিজুলী বাঁশের চারার মতো তার শরীরের রং এবং তাঁর ঠোঁট? কেটে রাখা ডাসা পেয়ারার মতো তার ঠোঁট। না না, বেশি সময় পীতাম্বর মহাজন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। আজ পুরো অঞ্চলটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে । আজ সত্রের বকুলের নিচে বার্ষিক যাত্রার দিন । সে জেনেশুনেই আজ তাকে নিমন্ত্রণ করেছে।
আরো পড়ুন: উর্দু অনুবাদ গল্প: লেপ । ইসমত চুঘতাই
… একদল শিয়াল পাশের কাটা ঝোপের থেকে হুক্কা হুয়া করে উঠল। ঘন ঘন পদক্ষেপে পীতাম্বর মহাজন দময়ন্তীর ঢেঁকিশালের দিকে এগিয়ে গেল।
একটা সময়ে জুতো খুলে মহাজন বারান্দায় বসল। কোথাও কাঠালিচাঁপা ফোটেছিল। গন্ধে সমস্ত অঞ্চলটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। চালের ডুলি এবং পাকা কাঁঠালের স্তূপের মধ্যে থাকা একটা খাটে ছোটো মেয়ে ঘুমিয়েছিল।সাত আট বছর বয়সের মেয়েটি একটা শ্লেটে ঘুমের চোখে স্বরবর্ণ সমূহ লিখছিল। ফাটা মলিন চিমনির লন্ঠন একটা তার সামনে জ্বলছিল। ঢেঁকিশালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দময়ন্তী পীতাম্বর মহাজনের হাবভাব লক্ষ্য করছিল। এবার হাতের ইঙ্গিতে দময়ন্তী মহাজনকে ঢেঁকিশালের কাছে ডাকল। সেখানে বসার জন্য একটা মোড়া পেতে রাখা ছিল। চোখের ইঙ্গিতে তাকে মোড়ায় বসতে বলল। তেল চিটচিটে একটা পিলসুজে সরষের তেলের প্রদীপ জ্বলছিল। প্রদীপের ধবধবে আলোতে দময়ন্তীর দেহের দিকে মাথা তুলে তাকাতে পীতাম্বর মহাজনের ভয় হল। কোথাও যেন কিছু শেষ হয়ে যাবে !
এটা যেন একটি মায়ার রাজ্য!
তার সামনে থাকা এই বামুনের বিধবা যেন মানুষ নয়-ঠিক এরকম মনে হল মহাজনের।
‘টাকা পয়সা কিছু এনেছিস কি?’মহাজন চমকে উঠল।প্রথম প্রশ্নটা ঠিক এই ধরনের প্রশ্ন হবে বলে সে আশা করে নি।
‘আমার যা আছে সমস্ত কিছু তোমার!’এই বলে পীতাম্বর মহাজন একটা শণসুতোর থলে দময়ন্তীর দিকে এগিয়ে দিল।সে ছোটো থলেটা ঢেঁকিশালের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা একটা খালৈর মধ্যে ভরে রাখল।তারপরে প্রদীপটা নিয়ে তার আগেই গিয়ে বারান্দায় উঠল।লন্ঠনের আলোতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বরবর্ণ লিখতে থাকা মেয়েটি বোনের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ল।চালের ডুলি রাখা একটা কোঠায় একটা ছোটো খাট পড়েছিল।দময়ন্তীর স্বামী সেটা অধিকার গোঁসাইর মৃত ভাইয়ের শ্রাদ্ধে লাভ করেছিল।
পীতাম্বর মহাজন দময়ন্তীর পেছন পেছন গিয়ে সেই খাটে বসল।একটা সময়ে দময়ন্তী তার কাছে এল।
দুটো মাস পার হয়ে গেল।একদিন মহাজন উঠে যাবার পরে নদীর তীরে স্নান করতে থাকা অবস্থায় কৃ্ষ্ণকান্ত পুরোহিত দময়ন্তীকে ঠাট্টা করে বলল-‘আগেও দুধনৈ-বঙরার বামুনের ছেলেরা আসা যাওয়া করত।ওরা চলে যাবার পরে তুই তো এভাবে এসে স্নান করতিস না,দময়ন্তী?’
দময়ন্তী কোনো উত্তর দিল না।
‘মহাজন চতুর্থ বর্ণের মানুষ বলে তুই…!’
দময়ন্তী কোনো উত্তর দিল না।কিন্তু হঠাৎ সে ভেজা কাপড়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আস্তাকুড়ের পাশে হড়হড় করে বমি করতে লাগল।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ কৃ্ষ্ণকান্ত পুরোহিত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল।তারপরে তিনি দময়ন্তীর কাছে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘এটা তাহলে পীতাম্বর মহাজনেরই সন্তান হবে?’
সে কোনো উত্তর দিল না।
‘খুব ভালো হয়েছে।খুব ভালো খবর-বেচারা পীতাম্ব্রর।পিতা হবার জন্য তার কী আকুল বাসনা।’
এবারও দময়ন্তী কোনো উত্তর দিল না।
‘আমি তাহলে পীতাম্বরকে খবর দেব।শোন,গান্ধী মহারাজ বলে গিয়েছিলেন এই জাত পাতের বিচার আমাদের মানুষগুলিকে সংস্কারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।মহাজন হোমের আয়োজন করে বিয়ে করবে।জনগণের আশীর্বাদ নিয়ে বিয়ে করবে।শোন দময়ন্তী,জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।তোর কাণ্ড-কারখানা দেখে পঞ্চায়েত বসানোর মতো অবস্থা হয়েছিল।শোন,আমি আজ তোকে খোলাখুলি ভাবে বলছি।তুই বোধহয় জানিস না তুই বিজুলিবাঁশের নিচে পুতে রেখে আসা তিন মাসের একটা সন্তানের মাংসপিণ্ড একটা শিয়াল তুলে এনে গোঁসাইকে স্নান করান যে পুরোহিত তার উঠোনে ফেলেছিল।তাকে কতবার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল তুই জানিস?’
‘ এবার তুই কোনো গন্ডগোল করবি না! সমস্ত জেনেও পীতাম্বর মহাজন তোকে গ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছে। এবার উদ্ধার না হলে তুই একেবারে নরকে পতিত হবি, আমি আমার এই যজ্ঞসূত্র স্পর্শ করে বলছি, একেবারে পতিত হবি!’
কৃষ্ণকান্ত পুরোহিতই পীতাম্বর মহাজনকে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর খবরটা দিয়ে বলল,’ দময়ন্তী যদি এই সন্তান নষ্ট না করে – জেনে রাখ মহাজন ,সে বিয়েতে বসবে!’
অন্যদিনের মতো মহাজন কেটে ফেলা হরিতকী গাছের গোড়ার মতো হয়ে পড়া গুড়িটাতে বসেছিল। কাদায় মাখামাখি হয়ে থাকা পায়ের জুতোগুলি সে খুলে রাখেনি।
কৃষ্ণকান্ত পুরোহিতের কথা শুনে সে উত্তেজিত হয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। সে পিতা হবে?সে পিতা হবে? এ কথা সত্যি? এ কথা সত্যি? একথা পুরোহিত বামুন নিজে বলেছে!!
বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। কিছুক্ষণ উঠোনে পায়চারি করতে লাগল।
কৃষ্ণকান্ত বলল,’ একেবারে পাগলা বাঁদরের মতো আসা-যাওয়া করছ দেখছি। মনের আনন্দ একেবারে উপচে পড়ছে‐– আড়াই কুড়ি বছরে পিতা হতে পারার সৌভাগ্য বড়ো সৌভাগ্য!’
হঠাৎ পীতাম্বর মহাজন কৃষ্ণকান্তের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। একেবারে বিনয় করার মতো গলবস্ত্র হয়ে সে বলল,’ বাপু আমার আশায় কুঠারাঘাত যেন না হয়! আমার বাপ ঠাকুরদা কীরকম সিংহ পুরুষ ছিল জানো তো। বংশের প্রদীপ ছাড়া হতভাগার মনস্তাপ কতটা সে কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। শুধুমাত্র তাই নয়, কুহকিনী বামুনের মেয়েটি আমার জীবনটা হাতের মুঠির মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।… আমি কী করব? আমি এখন কী করব?’
একটা হাত তুলে কৃষ্ণকান্ত আশ্বাসের সুরে বলল,’ আমি শবদেহ পাহারা দেওয়া শকুনের মতো পাহারা দিতে থাকব। তুমি ভয় করবে না। যে বুড়ি গাছের শিকড়-বাকড় দিয়ে এইসব অপকর্ম করে তাকেও সাবধান করে দেব। কিন্তু তার জন্য ও টাকা-পয়সার প্রয়োজন হবে।’
মহাজনকে আজ আর বাক্স-তোরঙ্গ খুলতে হল না। বাগানের সাতটা কাঁঠাল গাছের কাঁঠালগুলি সে একসঙ্গে আজ ওরপুতের দিকে একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছে। পাঞ্জাবির পকেটে নোটের বান্ডিলটা ভরাই আছে। গোটা বান্ডিলটা এনে মহাজন কৃষ্ণকান্ত পুরোহিতের হাতে তুলে দিল। কৃষ্ণকান্ত গদগদ হয়ে মহাজনের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করল।
এবার ফিরে এসে ঘরে প্রবেশ করতে যেতেই পীতাম্বর মহাজন বিছানায় পড়ে থাকা স্ত্রীর চোখের সঙ্গে মুখোমুখি হল। একটা মর্মভেদী দৃষ্টি কিছু সময়ের জন্য তাকে বিবশ করে রাখল কিন্তু পরমুহূর্তে সে বর্বর রূপ ধারণ করে চিৎকার করে উঠল,’ এই হতচ্ছাড়ি বাঁজি কোথাকার – এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’
একথা বলে সে চাকরদের চিৎকার করে ডেকে নির্দেশ দিল,’ এই ধর ধর, বিছানাটাকে নিয়ে ঢেঁকিশালের পাশের ঘরটাতে বিছিয়ে দে! ধর! ধর!’
যেমন কথা তেমন কাজ। চারজন চাকরের সঙ্গে পীতাম্বর বিছানাটা স্ত্রীকে সহ তুলে নিয়ে ঢেঁকিশালের পাশে দরজা-জানালা বিহীন একটা অন্ধকার ঘরে রেখে আসল। দময়ন্তীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর মহাজন স্ত্রীর চিকিৎসার কথা একপ্রকার ভুলেই গেছে। মানুষটা অস্থি-চর্ম সার হয়ে পড়েছিল। সময় মতো তার খাওয়া-দাওয়া দিতেও চাকররা অবহেলা করা শুরু করেছিল। ভাতের সঙ্গে জলের গ্রাস দিতে ভুলে যেত। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত।না মানুষটা কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কিছু উচ্চারণ করত না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও অথবা এটোঁ বাসন চোখের সামনে পড়ে থাকলেও সে চুপ করে থাকত। লোকে বলাবলি করত মানুষটা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে ছিল। এখন এই অন্ধকারে খুপরি ঘরে ফেলে রাখার সময়ও সে নিশ্চুপ হয়ে রইল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে এই অন্ধকারের মধ্যেও মানুষটার চোখ দুটি জ্বলতে থাকল। মাটির প্রদীপের ফ্যাকাশে আলোর মতো তার এই দৃষ্টির আলোতে সে যেন সমস্ত কিছুর একটা উলঙ্গ রূপ দেখতে পেল।
সন্তান লাভের আনন্দে পীতাম্বর মহাজন সুখ এবং কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করছে। দময়ন্তীর গর্ভে স্থিতি লাভ করা শিশুটি যেন জন্মলাভ না করেই শৈশব থেকে তরুণে পরিণত হয়েছে। ধনশ্রী নদীর তীরে তীরে সে পীতাম্বরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে লাগল, বংশপরম্পরার যুগ যুগান্তরের এটা সোনালী রশি সে টেনে নিয়ে গেল কোনো এক সীমাহীন দিগন্তে, যেখানে স্বর্গ এবং মর্ত্য এক হয়ে গেছে,যেখানে সমস্ত রং এক হয়ে আলোর দিকে ধাবিত হয়ে চলেছে।
পীতাম্বর এবার পুরোনো একটা বাক্স চাকরদের মাধ্যমে র্যাক থেকে নামিয়ে এনে সবার অজান্তে ভেতরের মেঝেতে খুলল। একটা গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে পিতা বলিরাম মহাজনের কয়েক টুকরো অস্থি সেখানে রাখা ছিল। আধপোড়া এই কয়েক টুকরো হাড়ের সঙ্গে পিতা সব সময় পরে থাকা সোনার মাদুলির সঙ্গে প্রবালমনিও রাখা ছিল। মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকা পিতার গলা থেকে হারটা খোলার সময় পিতা তাকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল,’ এই হার তোর ছেলে পরবে!
তারপরে তার ছেলে তারপরে…! সোনালি সিঁড়ি দিয়ে ওরা আমাদের বংশের ধ্বজা…!’ এর বেশি বলতে পারেনি। কলেরায় মৃত্যু হয়েছিল পিতার। মালাটা বের করে পীতাম্বর মহাজন পুনরায় অস্থি গুলি গামছায় বেঁধে রাখল। চাকরেরা পুরোনো বাক্সটা পুনরায় তাকে উঠিয়ে রাখল।
দিনের পরে দিন পার হয়ে যেতে লাগল। কিছু একটা খবর পাবার জন্য পীতাম্বর মহাজন অধীর হয়ে পড়ল। কে জানি বলেছিল, পাঁচ মাস পার হয়ে গেলে গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করা যায় না। সে অধীর আগ্রহে সময় অতিক্রান্ত হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। প্রতিটি দিনই তার সামনে একটি পর্বতের মতো এসে দাঁড়াল। সে কুহকিনী দময়ন্তীর পদধ্বনি যেন অহরহ শুনতে লাগল! কানের কাছে এসে গুনগুন করতে লাগলঃ
‘ হোমের যোগাড় কর!’
‘ আমি এখন আর বাইরে বেরোনোর মতো অবস্থায় নেই।হোমের জোগাড় কর।’
‘ সেই সব শূদ্র, বামুন, মুসলমান বাজে অজুহাত । আমাদের তো মানুষ চাই, কাটলে রক্ত বের হওয়া মানুষ !’
‘ হোমের জোগাড় কর মহাজন। দেখছ না ,আমার পেটটা কীভাবে বেড়েই চলেছে!’
… হ্যাঁ হ্যাঁ, দময়ন্তী যেন পায়ে নূপুর পরে থাকে! রুনু ঝুনু ,রুনু ঝুনু! হ্যাঁ কল্পনায় দেখা তার কচি বাঁশ গাছের মতো পায়ে যেন নুপুর পরে থাকে… সে আসে! সে মনের মধ্যে সব সময় যাওয়া আসা করে। বলে মহাজন তোমার সঙ্গে শোবার পরে আমি আর কুয়োর পারে স্নান করতে যাই না। এইসব হিন্দু- মুসলমান- বামুন সবই মিথ্যা অজুহাত !!’
তিন মাস পার হয়ে গেল। এখন অহরহ পীতাম্বর মহাজন ধনেশ্বরী নদীর তীরে তীরে একটি তরুন যুবকের কাঁধে হাত রেখে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে।দিনেও দেখে, রাতেও দেখে।
ভাদ্র মাস। বিকেল থেকেই তুফান আরম্ভ হয়েছিল। স্ত্রীর ঘরের দরজা লাগাতে গিয়ে সে দেখল অন্যদিনের মতো স্ত্রী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আজ তার চাহনি রাতের বেলা পায়ের সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়া একটা সাপের মতো চকচক করছে। ঝড় তুফানে ঘরের প্রদীপ নিভে গিয়েছে। চেঁচামেচি করেও কোনো চাকর বাকরকে কাছে পেল না।
কারও কণ্ঠস্বর শোনা গেল না। হুড়মুড় করে পেছনের বাগানের কিছু গাছ ভেঙ্গে পড়ল।
কী গাছ পড়ল?হায় হায় কী গাছ পড়ল?পুনরায় দূরে কোথায় যেন বজ্রপাত হল। এবারও কোনো গাছের উপর পড়ল বোধ হয়। গাছ ঝলসে ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মহাজন দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এল। বারান্দার এক কোণে সাতটা নারকেল গাছের নারকেল স্তূপ করে রাখা ছিল। চাকররা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেইসব ঢেঁকিশালে রাখার আয়োজন করছে। প্রচন্ড বাতাস কিছু নারকেলকে উঠোনে নিয়ে আছড়ে ফেলেছে। কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছেনা। ধীরে ধীরে বাতাস এবং মেঘের গর্জন কমে এল। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল।এখন কেবল একটাই শব্দ।বৃষ্টির শব্দ। কেউ মহাজনের শোবার ঘরে একটা লন্ঠন রেখে গেল। অপরিষ্কার চিমনির ফ্যাকাশে আলোতে সে বাইরের বৃষ্টিপাত দেখতে পেল। ভিজে যাওয়া মেঝেতে কেউ যেন চাটার ছাল পেতে রেখেছে বলে মনে হল। কিন্তু এরকম একটি অবস্থায় মহাজন পায়ের সেই রুনুঝুনু নুপুরের শব্দ শুনতে পেল। এক তরুণ যুবকের সঙ্গে সে ধনেশ্বরী নদীর তীরে তীরে ঘুরে বেড়ানোর ছবি দেখতে পেল।সে সেই যুবককে বুকের কাছে টেনে এনে মাথাটা শুঁকে দেখল… তার পায়ের রুনু ঝুনু নুপুরের শব্দের সঙ্গে বাইরে মুষলধারে পড়া বৃষ্টির শব্দ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। একটা বড়ো পিড়িতে বসে মহাজন বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে লাগল। পুনরায় সেই রুনু ঝুনু শব্দ তার কানের কাছে বাজতে লাগল।
হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ একজন মহাজনকে নাম ধরে ডাকতে শুনল। অহরহ উৎকর্ণ হয়ে থাকা মহাজন বৃষ্টির মধ্যেও এই শব্দ শুনতে পেল। লণ্ঠনটা নিয়ে সে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেল। বৃষ্টির মধ্যে সে কাক ভেজা ভিজে কৃষ্ণকান্ত পুরোহিতকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কেন এল পুরোহিত ? কেন? কেন এল এই বৃষ্টির মধ্যে কাক ভেজা হয়ে? ওই যে ফাটা ছাতিটা তাকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ধুতিটা তিনি হাঁটুর উপরে গুটিয়ে নিয়েছেন। একেবারে খালি গায়ে একটা চাদর ভিজে শরীরে লেপ্টে আছে । মানুষটাকে নর কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে। একটা নরকঙ্কাল তার দিকে এগিয়ে আসছে!কী খবর নিয়ে আসছে ?ইস কী খবর নিয়ে আসছে?
লন্ঠনটা তুলে ধরে মহাজন চিৎকার করে উঠল,’ বাপু এত রাত্রিতে? এই বৃষ্টিতে?’
কৃষ্ণকান্ত পুরোহিত কোনোমতে এসে বারান্দায় উঠল। কম্পিত হাতে নড়বড়ে পায়ে তিনি ছাতিটা বন্ধ করে একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে রাখলেন। গায়ের চাদরটা চিপে তিনি মুখটা মুছে নিলেন। তারপরে তিনি কুঁজো হয়ে মহাজনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে স্থলিত কন্ঠে বললেন ,’ পীতাম্বর, তোমার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর সময় পুষ্কর লেগেছিল তাই নয় কি ? তিনটি না চারটি পুষ্কর ?’
‘মনে নেই ?কিন্তু কেন?’
‘ তিনটি পুষ্কর পেলে বাড়ির উঠোনের দুব্বো ঘাসও জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায়! তোমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে তিনটি পুষ্কর লেগেছিল। সব জ্বলে পুরে শেষ হয়ে গেছে!’
‘কী হয়েছে বাপু?কী হয়েছে?’
‘ দময়ন্তী নষ্ট করে ফেলেছে। সে শূদ্রের বীজ ধারণ করবে না। সে শান্ডিল্য গোত্রের বামুন। সেজন্য নষ্ট করে ফেলেছে। তোমার সন্তান সে নষ্ট করে ফেলেছে, পীতাম্বর… পীতাম্বর…।’
(ধনেশ্বরীর তীরে ঘুরে বেড়ানো তরুণ-যুবক পীতাম্বর মহাজনের হাত ছাড়িয়ে যেন নদীর গভীর জলে ছিটকে পড়ল। কে পড়েছে ?কে পড়েছে? পীতাম্বর মহাজন পড়ল না তরুণ যুবক পড়ল?উঃকে পড়ল?)
একদিন মধ্যরাতে হঠাৎ দময়ন্তী শুনতে পেল কেউ বিজলী বাঁশের ঝোপের নিচে মাটি খুঁড়ছে।’কে?কে’ বলে সে বড়ো মেয়েটিকে জাগিয়ে দিল। এই ছয় বছরের মেয়েটি এবং মা কান খাড়া করে শুনল। হ্যাঁ হ্যাঁ, কেউ বিজলী বাঁশের নিচে মাটি খুঁড়ছে। এই সেদিন মা মেয়ে দুজন যে জায়গায় মাটি খুঁড়েছিল ঠিক সেখান থেকেই এই শব্দটা আসছে। মা মেয়ে দুজনই অন্ধকার রাতে সেদিন সাতাম পুরের বামুনের ছেলে দেওয়া খুপড়ির সাহায্যে অনেকক্ষণ ধরে মাটি খুঁড়েছিল। মেয়ে কাছাকাছি কোথাও শেয়ালের ডাক শুনে বারবার কেঁপে উঠছিল। আজ সেই জায়গায় শব্দ হচ্ছে–হরাৎ!হরাৎ!!হুটুর!হুটুর!হুটুর!!
মা মেয়ে দুজনেই একটি লন্ঠন জ্বলতে দেখতে পেল। লণ্ঠনের আলোতে দুজনেই দেখল একটা হৃষ্টপুষ্ট মানুষ সেই একই গর্ত খুঁড়ে চলেছে যে গর্তটি মাত্র দুদিন আগে দময়ন্তী খুঁড়েছিল। হ্যাঁ হ্যাঁ সেই একই গর্তটা খুঁড়ছে।
দময়ন্তীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। মানুষটা পীতাম্বর মহাজন। হ্যাঁ হ্যাঁ মহাজনই। একান্ত মনে মহাজন গর্তের মাটি সরাচ্ছে। লন্ঠনটা বিজলী বাঁশের একটি চারার উপরে বেঁধে রাখা আছে।
মহাজন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত রোগির মতো সে মাটি সরাচ্ছে।
দময়ন্তী ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। মানুষটা কী। সে কি চিৎকার করবে? তার বাড়িতে কান্ড ঘটছে, সে চেঁচাবে না?’
‘মহাজন? মহাজন?’
না ,কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
হুটর !হুটর!হুটর!!
‘ মহাজন !মহাজন! কেন গর্ত খুঁড়ছ?’
পীতাম্বর মহাজন জানালার দিকে একবার ফিরে তাকাল। কিন্তু কোনো উত্তর দিল না।
পুনরায় হুটুর!হুটুর!হুটুর!!
দময়ন্তী হাহাকার করে উঠল।
‘ আমি পুঁতে রেখেছি সত্যি কথা। কিন্তু কী পাবে সেখানে– একটা মাংসপিণ্ড পড়ে আছে!’
পীতাম্বর মহাজন মাথা তুলে দেখে বলল, আমার সন্তান ছিল– আমি মাংসপিণ্ডের টুকরাকে ছুঁয়ে দেখব। আমি আমার এই দুই হাতে আমার বংশধরকে ছুঁয়ে দেখব।’
অনুবাদক