| 28 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

মনোনীতা চক্রবর্তীর গুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
আজ ১৭ নভেম্বর কবি, সম্পাদক মনোনীতা চক্রবর্তীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


রেওয়াজ
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে দেয় চিল… ‘ তারপরও থেকে থেকে যায় চোখ, নাক-মুখ, ঠোঁটখোলা গলে গলে পড়া জীবন বা তারই মতো কিছু! মায়া-মায়া-মায়া… ঘনমায়ায় মুছেই গেলো। চির অভিমানী ‘মায়া’ -স্বয়ং! তাতে কী! তাতে বুনন আর বিনুনি।
পানকৌড়ি, তুমি বেলেমাটির গাছ বানিয়েছিলে, মনে পড়ে!? টংঘর, শালবন, তোমার গানের খাতার মভ কালারের ঠোঁট আঁকা পৃষ্ঠা, ঈষৎ গোলাপি তাতে… আসলে, উলটো পোশাকেরও একটা চমৎকার সোজা-সাপটা গান থাকে।
একটা গন্ধরাজ,লেবুফুল বিকেল থাকে… বিকেল, বিকল আংটি-বদলে। শ্রীখোলের সমবেত বাজনা জানিয়ে দেয়, অবিচ্ছেদ্য জন্মগল্প। আগুনের ধ্যানস্থ অক্ষিগোলক… ‘ব্যবহারে তুই কেমন দেখি… ‘ কাকাতুয়া গেয়ে যায় শ্রীহরি -আজান প্রহরে… ‘ তখন গল্পের তরে..’? কী??? শূন্যস্থান পূরণ করতে দিয়ে পানকৌড়ি গালটিপে ‘গিলিগিলি গে’!
সিনিয়র -জুনিয়র সমস্ত সরকার, জায়গিরদার, সামন্তপ্রভুদল ‘ আয় হরিনাম নিবি কে রে আয়, আয় আয়… ‘ গাইতে থাকে অর্ফিয়ুস বাঁশিতে অনবরত ফুঁ-দিয়ে সুর মেলাতে চাইছে আপ্রাণ… বুনোঝোঁপ, অসংখ্য লাউডগা সাপ ক্রমাগত ঘিরে ফেলছে অর্ফিয়ুসকে, ছন্দ কেটে হঠাৎ ‘ডেসডিমনা’ আই-কার্ড নিয়ে, একটা-একটা করে মৃত্যু দাঁতে-কেটে অরফিউসকে একটা আস্ত বাতাসের পৃথিবী দিচ্ছে!
অর্ফিয়ুসের শূন্যে ‘ফুঁ’, কিংবা সবটুকু বাতাস আসলে ডেসডিমনার ফুসফুসের জন্যই জমা করেছে… কে-জানে! ডেসফিমনারা আকৃতিহীন, শর্তহীন সাদা সুর চেনে কিনা জানি না, তীব্র স্বার্থহীন
‘আকুতি চেনে, আপ্রাণ চেষ্টা চেনে… ‘
‘ মায়াবৃক্ষের প্রেমের ডালে, শুক-সারি কথা বলে, কথা যে-বুঝেছে সে-ই তো বাউল রে… ‘
সা রে গা মা পা
সা
কাল যখন তুমি খরস্রোতা হয়ে উঠলে
পাখিগুলো বাসাবদল করলো অজান্তে…বেণী থেকে খুলে আসছিল  বিকেল। পাশের বাড়ি তখন ফর্দ লিখছে।
বরবাদ লিখছে তোমার দু’চোখ
একদিন, আমার চোখের নিবিড় পাঠ নিতে নিতে
কখন যে মোরগ ডেকে উঠেছিল!
বুঝেছিলাম ভোর হল।
আজ চোখ বদলেছে, দৃষ্টিও…
সবকিছুর ওপরে থাকতে থাকতে, সবকিছুর তলানিতে যাওয়ার টেম্পোটাই আলাদা! যারা বোঝে, তারা বোঝে
টকটক-ঝালঝাল।পুরো নমকিন!
অভাবে প্রেম পালায়
অভাব উড়লে স্বভাব পালায়-সময় পালায়!
কাল যখন তুমি খরস্রোতা হয়ে উঠলে
আমি হাসতে হাসতে অভিনন্দিত করলাম
বাসাবদলের মুখর পাখিদের
মেজোপিসিমার নাতি তখন দরবারিতে সবে সা-লাগিয়েছে!

রে

চরিত্রগুলো কাঁপছে সুবর্ণা…
কিছু অন্ধকার আরও একবার দাও..
তিরতির করে গান ছুটছে।
সামনে কিছু বন্য গোলাপ… কথা সারছে খুব গোপনে!  আসলে বন আর বন্য খুব বুকে-বুকে হলেও,একফালি চোখের মত আড়াআড়ি ব্যবধান। যে-ব্যবধান ফিরিয়ে দেয় অবধারিত কিছু অঘটন অথবা অনটন…
সুবর্ণা, আরও কিছু পাপ ঝুমকফুলের মতো দুলতে দুলতে আমার অনামিকা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শেড ব্রাউন কফিনের দিকে … বুক থেকে সাদা ওড়না ঝমঝম উড়ছে … এখনও কিছু নেশা নুপুর খুলে পা -টিপে ক্রমশ পাঁচতলা জানলা থেকে ছোঁড়া ল্যাভেন্ডার রঙের সুতো ধরে ওপর থেকে আরও ওপরে… বন আর বন্য, মাঝে শুধু গোলাপের সমবেত গান…
চরিত্রগুলো ভীষণ কাঁপছে
সুবর্ণা হাতটা … এই যে … আরও আরও চেপে ধরে… হাত-পা-পুরো শরীরটাকে মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে ফেলো…
সফেদ বকের ডানার মত ওড়নায় সেই অনন্ত কাল থেকেই আমি উড়ছি…  তীব্র সুখে …
সুবর্ণা… সময় খুন হয়েছে … বহুকাল… আর দেরি নয়…দেরি নয়…

 গা
যে দু-চারটে পাতা অনায়াস হয়ে উড়ছিল আর টপ্পা গাইছিল, সেসব পাতাদের  বকুল-হার  পরাবো বলে, আমার রাতগুলো সব  বেল্টের ঘাট হল!
ত্রিকোণ বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসছিল   ভেতরের খুঁটিনাটি
পুতুল বৌদির যন্ত্রণা সুখ হয়ে যাচ্ছিল, ফিসফাস সাঁতরে আসছিল
নোটেশন ডিজাইনের আধুনিক গ্রিল থেকে
ততক্ষণে বেকড যাবতীয়
মাইক্রোওয়েভ থেকে থিকিথিকি উত্তাপ শাওয়ারের নীচে। ধারাস্নান আয়না দেখে।
অবশেষে  ঘাট খুললো। রাতের গড়ন  বকুল হল।
টপ্পা মিশ্র-খাম্বাজে মূর্তি হল। এরপর আর  সেই পাতাদের গান কখনও শোনা যায়নি
অনির্দেশে যাওয়া কিছু পাখির  দল একই জায়গায় এসে থেমে গেল
শুনেছিলাম একটা স্বাক্ষর এরা প্রত্যেকেইই করেছিল
গম-বাগানের পুবালি হাওয়া নিরুত্তর লেখে
সমস্ত, সমস্ত সরল ও বক্রপথ ধরে মাইলের পর মাইল —
ফলকের পর ফলক পেরিয়েছি, কিন্তু খুঁজে পাইনি আর সেসব অনায়াস আর গান…
গাছগুলোতে ঝুলছে  ছায়া আর ইশতিহার—–শতাব্দী পেরোনো ‘সন্ধান চাই’
নাহ, গান ফেরেনি আর
আজ হঠাৎ  সহস্র পাখোয়াজ বাজতেই চমকে উঠি
ত্রিকোণ বারান্দায় পুতুল বৌদির সাথে লক্ষাধিক আমি বেরিয়ে আসতেই দেখি পৃথিবীটা আস্ত বকুল বাগানে ভরে আছে…
ফুলগুলোর মুখের গড়ন হুবহু গানের মতো…
পুতুল বৌদি খোলা চুলের  ঝাপটায় বকুল বাগানে কী – একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে
বাঁকা-হাসি নিয়ে একছুটে ভেতরে গেল
উত্তরের পেছনে পেছনে একঝাঁক প্রশ্নও ছুটছিল
পুতুলবৌদির গলা উড়ে যাচ্ছে গান হয়ে
বাকিটুকু শুধুই সুখ…
 মা
তোমাকেই দেখছিলাম তখন
যেভাবে আকাশ মাটিকে দেখে
অথবা
মাটি আকাশ কে দেখে!
যেভাবে অন্ধকার আলো কে দেখে
অনাহার যেভাবে আহার কে দেখে!
সেভাবেই, সেভাবেই আমি
তোমাকেই দেখছিলাম
তোমাকেই দেখি
তোমাকেই দেখবো…
ভীষণ আলো অথবা  তুমুল অন্ধকারেও
পা
সাতশ’ছাপ্পন্নো বার তোমার ছবির পাতা উলটাতে গিয়ে দেখি
সব ছবি কেমন  ঘাস হয়ে হতে হতে কখনও ফড়িং, কখনও আবির হয়ে যাচ্ছে!
আটশ’বাইশবার  মেয়ের ডায়েরিটার অনবদ্য কুচি-প্লিট করতে গিয়ে দেখি… সাবাই-আতর শুধু, কোথাও কোনো শাড়ি নেই, সুতো নেই!
ন’শো তেতাল্লিশ পাক খেতে খেতে মুখ থেকে নেমে আসছে সাজ ও সুজন! সুবর্ণা হলুদ গম-শীষে  কান রেখে শুনতে চাইছে না-বলা নিষিদ্ধ,মানুষ তাড়ানোর গোপন ফিসফাস।
অনিঃশেষ শ্রাবণের মত ঢল নিয়ে কেবলই নেমে আসছে সাজ!
হাজার তেইশবার , তিনশ’তেত্রিশটি হাওয়াকল ছুঁয়ে এসে
আসলে ঘাম আর শ্বাসের সাপ-গল্প ছাড়া আদৌ কিছু থাকে না!  আসলে, সুবর্ণা উড়োসুখ-ইথার গান চাইলেও শেষে বুঝেছিল এসবই ঝুটো। পুঁজরক্ত পড়া হতাশ  লাল রাতের মতো…   গুণ বুঝলে গুনীতক… নইলে বৃথা আস্ফালন।
পঞ্চমে এসে অবশেষে দাঁড়িয়েছে সুর…  দাঁড়ানোই বড়ো… দাঁড়িয়ে থাকাটাও…
ছেলেকে বললাম যে ওর ইরেজারটা আনতে “বাঁশি সঙ্গীত হারা”…  ‘ এবার এটা মুছে দাও মহারাজ… ‘

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত