| 19 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

একটি পরকীয়া অথবা নিজকীয়ার গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

                      

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com“কী, ঠিকঠাক লাগছে?”                         

প্রশ্নটা আমাকে করলেও সুতপার চোখ এই মুহূর্তে সামনের আয়নায়। উত্তর দিই বা না দিই যেকোনও মলে ঢুকে নিজের পোশাক কেনার সময় এ প্রশ্নটা ওর করা চাই। আমার মত সব ক্ষেত্রে খুব গুরুত্ব দিয়ে ও বিচার করবে না জানি বলেই শেষ কয়েক বছরে আমার উত্তরও অনেকটা দায়সারা গোছের হয়ে গেছে। স্পষ্ট বুঝতে পারি, বিয়ের পরে পরেই ওর চোখ দুটো আয়নাতেও আমাকে দেখত বেশি। আজকাল নিজের উপর থাকে।                  

পুজোর বাজারটা আজকে সকালে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে করে রাখব তা কালকে অফিস থেকে ফিরেই জানিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে একটু ঘুমানোর প্ল্যান ছিল, যাতে কালকে অফিস বেরনোর আগে একটু রিচার্জড হয়ে ওঠা যায়।প্রাইভেট সেক্টরে ম্যানেজমেন্ট লেভেল এর চাকরি আমাদের মতো চল্লিশের দোড়গোড়ায় দাঁড়ানো মানুষগুলোকে দৈহিক আর মানসিকভাবে কতটা পেষণ করে তা জানার আগ্রহ আমার বউ সুতপার আর নেই। বেরনোর আগেও দেখছিলাম ড্রেসিং টেবিলের সামনে মেকআপ নিতে নিতে যেভাবে নিজেকে আয়নায় দেখছিল, এখনও দৃষ্টিটা ওইরকম। আত্মরতিতে মগ্ন। ট্রায়ালরুমে পোশাকটা পরে কি নিজেকে দুচোখ মেলে দেখেনি! সাড়ে বারোটা বাজে। দুপুরে এই সময় মলের পরিবেশ বেশ জমজমাট।

অন্তত এই থার্ড ফ্লোরটা। পুরো জায়গাটা জুড়েই ব্র্যান্ডেড পুরুষ ও নারী পোশাকের বিপণী। সুন্দর আর সুন্দরীদের হরবখত খোরাফেরা আর সেলফির ঝলক এদিক ওদিক। সুতপা আবার অন্য কোনও রঙের সালোয়ার নিয়ে ট্রায়ালরুমে ঢুকল। দৃষ্টি সরিয়ে জিন্সের পকেট থেকে নিজের স্মার্টফোনটা বের করে ডেটা অন করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলাম। সময় পেলেই ঢুকি। কী ম্যাসেজ এল দেখতে তো বটেই, কারোর লাস্ট সিনেও চোখ রাখতে ভাল লাগে। অফিস ডিউটি বা সংসারের অন্য কোনও ব্যাপারে ক্লান্তি আর বিরক্তি যতটা আমায় ঘিরে নেমে আসে, হোয়াটসঅ্যাপের এই নাম্বারটার লাস্ট সিন বা স্ট্যাটাস চেক করলে আমাকে ছুঁয়ে যায় তাজা অনুভূতি। সুতপা জানে না। মানে, ওকে জানতে দিই না।                

বছর খানেক আগে হঠাৎ করেই দোয়েলের নম্বরটা হাতে এসে যায়। তারপর বলতে গেলে আমার তরফেই এগিয়ে যাওয়া। হাতে টান পরতে সামনে তাকিয়ে দেখলাম হিয়া। আমার আট বছরের মেয়ে। এই শহরের অত্যন্ত নামী স্কুলে ক্লাস থ্রি এ পড়ে।        

-“একবার এদিকে এসো পাপা। তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।”          

মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে আউট লেটের বাইরে আসি। একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। অল্প হাসি দিয়ে ঢেকে রাখলাম। দোয়েল কি জানতে পারল, ওর লাস্ট সিনটা দেখার জন্য সকাল থেকে কতটা উতলা ছিলাম। এখন মনঃসংযোগটা ঘোরাতে হবে হিয়ার দিকে। বললাম, “এসে থেকেই তো অনেক কিছু দেখিয়ে ফেললি। আবার কী দেখব।”

– “ওই বার্বিটাকে একবার দেখো পাপা। কী লাভলি না?”নিজের মাথা দুলিয়ে বড় বড় চোখদুটো পুতুলের ওপর রেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠল হিয়া।

ভালো করে তাকালাম। তিনটে আউটলেট পরেই খুব সল্প স্পেস নিয়ে এককোণে এই ফ্লোরে গিফট আইটেম কর্ণারটা গড়ে উঠেছে। একটা দুটো নকল গাছ, ফ্যাশনেবল বেশ কয়েকটা রিডিং লাইটের পাশেই দাঁড় করানো আছে প্রায়হাত সাইজের পুতুল। কালোচুল, পোশাকে বিদেশি নয়, বাঙালি পুতুল লাগছিল। একমনে দেখছিলাম।                                                           

– “কিনে দেবে পাপা?”             

– “না, দরকার নেই। যথেষ্ট বড় হয়ে গেছ। ওসব নিয়ে খেলা করার বয়স তোমার আর নেই।” আমি কিছু বলার আগেই সুতপা পিছন থেকে বলে উঠল। আমি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, মেয়ে আমার দিকে। সুতপা এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, – “এবার ভেতরে এসো দয়া করে। আমারগুলো পছন্দ করে ফেলেছি। কার্ডটা দাও, পেমেন্টটা করতে হবে।”                         

কার্ডটা নিয়ে ও আবার ভেতরে ঢুকে যেতেই হিয়াকে বললাম, “মা ঠিকই বলেছে। চল, এবার কিড সেকশনে যাব। তোর ড্রেসগুলো কিনে ফেলতে হবে।”     

বোধহয় নতুন আনন্দ পেয়ে বসল হিয়াকে। একটু এগিয়ে এসে আমার একটা হাত ধরে আদুরি গলায় বলল, – “আমি কিন্তু এবারে চারটে ড্রেস নেব। আমার সমস্ত ক্লাসের ফ্রেন্ডরা এবারের পূজোয় চারটে কিনেছে।”  ওর পিঠে একটা আলতো করে চাপড় মেরে বললাম, “চ তোকে আমি পাঁচটা কিনে দেব।”       

মল থেকে যখন বেরোলাম তখন দুটো বেজে গেছে। পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করতে প্রায় আরও দশ মিনিট লেগে গেল। পিছনের সিটে জিনিসগুলো রেখে ড্রাইভিং সিটে বসে এসি অন করতে একটু স্বস্তি পেলাম। হিয়া আমার পাশে আর সুতপা ঢুকল পিছনে। গাড়ি গিয়ারে ফেলে রাস্তায় তুলে সুতপাকে বললাম, “একটা অফিসের জরুরি কাজে আজ রাতেই আমাকে একবার শিলিগুড়ি যেতে হবে। কাল রাতে বা পরশু সকালে ফেরত চলে আসব। হঠাৎ ফোন এল।”

ও ব্যস্ত ছিল নিজের মোবাইলে। স্ত্রিনে চোখ রেখেই বলল, “তাহলে তো তোমার রেষ্ট নেওয়া হল না।”                                       

“জানোই তো আমার অবস্থা। তুমিও তো একটু তাড়াতাড়ি করতে পারতে।”

“মেয়ে সামনে বসে আছে। ফালতু শুরু করো না।” হিয়ার দিকে আড় চোখে তাকালাম। মনে হল না, ওর কান আদৌ আমাদের দিকে আছে। বরং চমৎকার ঠান্ডার পরশে আশ্বিন মাসেও কাঁচের ও প্রান্তের ফুটন্ত কলকাতা দেখতে মগ্ন।                                               

স্টিয়ারিং-এ ডান হাত রেখে বাঁ হাত দিয়ে বের করে আনলাম নিজের মোবাইল। হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে চোখ রাখলাম দোয়েলের লাস্ট সিনে। আমি শপিং-এ আসা পর্যন্ত আর অনলাইন হয়নি। এই দু-তিনদিন লম্বা সময়ের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বিরতি নিচ্ছে। কী করছে এই সময় ও। নিজের হাসব্যান্ডের সঙ্গে কী পূজা শপিং-এ ব্যস্ত! কলেজে পড়তে পড়তেই আমাদের দুজনের আলাপ। তারপর দীর্ঘ তিন বছরের জন্য রিলেশনে আটকে পড়া। ছাড়া ছাড়িটা কেন হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা বোধ হয় কারোর কাছেই নেই। দীর্ঘ এত গুলো বছর পর আবার ওর ফোন নম্বর পেয়ে যাওয়া। যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি হওয়া। নিজের বুকের ভিতর মেঘ হয়ে থাকা দুঃখের কাহিনি এতদিন পর বললে দোয়েল কি আদৌ শুনবে। আজ কি আমার বেরুনো উচিত! ওর পুতুল-পুতুল এক সময়ের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

ট্যাক্সি ছেড়ে যখন এই ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে দাঁড়ালাম, সিকিউরিটি মনে হল একটু অবাক হয়েছে। বোধহয় আমার সঙ্গের ঢাউস প্যাকেটটা দেখে। নিজের ফ্ল্যাট ছাড়াও টু বিএইচ কে এই ফ্ল্যাটটা নিয়েছি মাত্র একমাস। আমার বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা সুতপা- কেউই আমার এই ফ্ল্যাটের খবর এখনও পর্যন্ত জানে না। সন্ধেবেলা আজ যখন বেরোচ্ছি সুতপা কি বুঝতে পারছিল যে আমি শিলিগুড়িতে নয়, আসলে শহরের প্রান্তে এই ফ্ল্যাটটায় আজকের রাত কাটাতে আসছি।

ফ্ল্যাটে ঢুকে আগে খুব সুন্দর করে একবার চান করলাম। বসার জায়গাটায় একসেট সোফা আনিয়েছি। সঙ্গে এনেছিলাম বড় এক বোতল ভদকা। কড়া করে এক পেগ বানিয়ে ঢক ঢক করে কিছুটা গলা দিয়ে নামাতেই অনেকদিন আগে হারিয়ে যাওয়া আমার পৌরুষ ফেরত এল।

সামনের ঢাউস প্যাকেটটা থেকে বের করে আনলাম আজকের সকালে মলে দেখা সেই পুতুলকে। আমার উল্টোদিকের সোফায় তাকে যত্ন করে বসালাম। তারপর একদৃষ্টিতে সেই পুতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে শেষ করে ফেলেছি অন্তত চার পেগ ভদকা। আমার সামনে এখন পুতুল নয়। বসে আছে দোয়েল। একটু টাইট হয়ে বসে আছি বলে দোয়েল কি আমাকে পুতুল ভাবছে! নাকি সাংসারিক চাপে আমরা দুজনেই পুতুল হয়ে গেছি। এক সময় আবিষ্কার করি আমাদের দুজনের মধ্যিখানে জমাট অন্ধকার। পুতুলের পাশে বসে এবার তার কানে ফিসফিসিয়ে আমার না বলা সব কথা বলে যেতেই থাকি। বলতেই থাকি। যতক্ষণ অন্ধকার শেষ না হয়ে ভোরের আলো ফোটে…।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত