অসমিয়া অনুবাদ গল্প: স্বপ্ন ভাঙ্গার পরে । মন্দিরা কলিতা
লেখক পরিচিতি– গুয়াহাটি নিবাসী মন্দিরা কলিতা স্কুল জীবন থেকেই ছোট গল্প লিখতে শুরু করেছিল। ১৯৯৫ সাল থেকে পূবালী, প্রিয়সখী, মুকুতা, নতুন পৃথিবী ইত্যাদি ম্যাগাজিন এবং দৈনিক অসম, আজির বাতরি, অসমবাণী ইত্যাদি খবরের কাগজে ছোটগল্প প্রকাশিত হয়ে আসছে। তার প্রকাশিত ছোটগল্প গ্ৰন্থদুটির নাম যথাক্রমে ‘তাত এখন নদী আছিল’ এবং ‘সেই ক্ষণবোর’।
‘ অসম গৌরব’ এবং ‘রং রং নানা রং’ নামে দুটি শিশু গ্রন্থ ও রয়েছে।
মোবাইলের আউট বক্সে থাকা মেসেজগুলি ডিলেট করতে গিয়ে এই বিশেষ মেসেজটিতে অর্পিতা সব সময় থমকে যায়। ম্যাসেজটির মধ্যেসে দর্শনা বৌদিকে খুঁজে পায়। বিশ্বাসের অযোগ্য একটি সত্যকে অর্পিতা বহন করে নিয়ে বেড়ানো মোবাইলটিতে বন্দি করে রেখেছে। সেই মুহূর্তে এই দুটি বাক্যই সে কষ্ট করে লিখে পাঠিয়েছিল। মুখে একটা বাক্য উচ্চারণ করে সমবেদনা জানানোর সাহস তার হয়নি। এই ধরনের অবস্থায় কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলা যায়, অর্পিতা জানেনা। তার কাছে এই ধরনের সময় গুলিই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়।
মানসদার মোবাইলে অর্পিতা লিখে পাঠিয়েছিল–’ আপনাদের দুঃখের আমিও সমভাগী। ভগবান আপনাদের দুঃখ সহ্য করার শক্তি দিন এটাই কামনা করছি।’
তারপরে অনেক দিন পার হয়ে গেল, মানসদাদের বাড়ির মানুষগুলির কী হল সেই বিষয়ে অন্যের থেকে খবরা খবর পেয়ে থাকে। কোনোদিনই ওদের সঙ্গে কথা বলার সাহস সে জোগাড় করে উঠতে পারেনি, আসলে সঠিক সময়ে ঠিক কাজগুলি করে না ফেললে পরে এক ধরনের অপরাধ বোধ মনের মধ্যে কাজ করতে থাকে এবং সেই কাজ করায় বাধা দেয়। অর্পিতার ক্ষেত্রেও তাই হল। দর্শনা বৌদির পরিবারের মানুষগুলির দুঃখে পরিপূর্ণ মুখগুলি সে দেখতে চায় না।
অর্পিতার জীবনের শুরু থেকে অনেকদিন পর্যন্ত সে শিবসাগরে ছিল। চাকরির সূত্রে বর্তমানে ধুবড়ির বাসিন্দা যদিও বছরে একবার সে শিবসাগরের বাড়িতে আসে। অন্যান্যবারের মতো এবারও বাড়িতে এসে বিকেলের দিকে আশেপাশের মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছায় অর্পিতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। অনেকদিন পরে মানুষগুলির সঙ্গে দেখা হলে তার ভালো লাগে, প্রতিবারই চোখে পড়ার মতো জায়গাটির পরিবর্তন ধরা পড়ে। পরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে এগিয়ে যেতে থাকা অর্পিতার পা দুটি হঠাৎ নির্দিষ্ট একটি জায়গায় থেমে গেল। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সুন্দরভাবে তৈরি বাড়ি দুটির মাঝখানে এটা কি ধরনের খাপ না খাওয়া দৃশ্য, দৃশ্যটি অর্পিতাকে দর্শনা বৌদির কথা মনে পড়িয়ে দিল।
মানুষের জীবনের রং গুলি কখনও কোনো ঘটনা ধূসর করে ফেলে। বেঁচে থাকার অর্থই হারিয়ে যায়। তবুও জীবন থেমে থাকে না। হয়তো মলিন পোশাকগুলি পরিবর্তন করে তার জায়গায় নতুন পোশাক পরে নিতে সময় লাগবে। কিন্তু মলিন পোশাকেই জীবন এগিয়ে যাবে । অর্পিতার চোখের সামনে এটা দর্শনা বৌদির বাড়ি। শিবসাগরে এলেই দর্শনা বৌদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করাটা অর্পিতার কাছে খুবই সাধারণ কথা । মাঝখানে একবার বাড়িতে গিয়ে অর্পিতার দর্শনা বৌদির সঙ্গে দেখা হয়নি । হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য রাস্তায় দেখা হয়, কথা বলার মতো সময় হয় না। দ্রুত পায়ে দর্শনা বৌদি পার হয়ে যায়।
অর্পিতা জানতে পারল দর্শনা বৌদিরা একটি বাড়ি তৈরি করছে। মিস্ত্রি আসার আগে বৌদি বাড়ি তৈরির জায়গায় পৌঁছে যায়। ছেলেমেয়েদের সকালে স্কুলে পাঠিয়ে দুপুরবেলা ওরা ফিরে আসার আগেই বৌদি চলে আসে। মিস্ত্রিকে তদারক করা থেকে শুরু করে সন্তানকে লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব বৌদির। দর্শনা বৌদির স্বামী মানসদা শিবসাগরে থাকে না। তার চাকরি অসমের বাইরে। তাই বৌদি ভীষণ ব্যস্ত।
এই ধরনের ব্যস্ততায় ভরা দিনগুলির মধ্যে অর্পিতা খবর পেল দর্শনা বৌদি মুম্বাই গিয়েছে। কী যেন অসুখ করেছে, ডাক্তার দেখাবে। সাধারণ কথার মতোই অর্পিতা কথাটা শুনে রাখল। মনের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। আজ-কাল-পয়সা থাকা মানুষ শরীরে কোনো বিসংগতি দেখা দিলেই অসমের বাইরে চলে যায়।
মুম্বাই থেকে এসে দর্শনা বৌদি একদিন অর্পিতাকে ফোন করেছিল–’ বুঝেছ অর্পিতা,পেটের একটা ব্যথা খুব বিরক্ত করছিল। দাদা একেবারে মুম্বাই নিয়ে গেল। সেখানে গেলে মনের শান্তি এবং ভালো ডাক্তার দেখবে।’
হয়তো ধীরে ধীরে বেড়ে চলা সংসারটির বৌদি হল মেরুদন্ড। বৌদিকে বাদ দিয়ে সংসারের উন্নতির কথা ভাবাই যায় না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার তদারক করা থেকে শুরু করে সংসারটা সামলে সুমলে দাদাকে নিশ্চিন্তভাবে চাকরির স্থলে পাঠিয়ে দিয়ে বৌদিই ঘর-সংসার দেখছে। মেয়েটি দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই বৌদির চিন্তা বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে দাদাও অসমের বাইরে চলে গেছে। এদিকে বাড়ির কাজটাও শুরু হয়েছে।
অর্পিতা শেষবার যখন শিবসাগরের গিয়েছিল তখন দর্শনা বৌদিদের নতুন বাড়িতে যাবার খবর পেয়েছিল। দর্শনা বৌদির কষ্ট সফল হওয়ায় অর্পিতার ভালো লেগেছিল। নতুন বাড়িটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে বৌদির সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে বলে অর্পিতা ভেবেছিল।
‘ দর্শনা বৌদিরা বাড়ি করার পরে দেখা করতে গিয়েছিলে কি?’ অর্পিতা মাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘ গৃহপ্রবেশের আর কোথায় সময় পেল, কোনোমতে তাকে নতুন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
‘ মানে?’– মায়ের কথায় অর্পিতা অবাক হল।
‘ ওর শরীর খুব খারাপ। অবস্থা ভালো নয়।’
‘ কেন?’– মুম্বাই থেকে দেখিয়ে এসেছিল তো। বৌদি আসার পরে আমাকে ফোন করেছিল।’– অর্পিতার হাতে-পায়ে কম্পন উঠে গেল।
‘ দর্শনাকে কথাটা বলা হয় নি,ও জানে না । ব্যথাটা না কমায় ও হয়তো কিছুটা সন্দেহ করেছে। লাস্ট স্টেজ, এখন আর নাকি কোনো চিকিৎসা নেই।’
দর্শনা বৌদির সঙ্গে দেখা করার মনের মধ্যে পুষে রাখা ইচ্ছাটা দুঃখে পরিণত হল। মুখের সামনে গড়ে ওঠা সংসারটায় নেমে আসতে চলা অন্ধকার তাকে উদাসীন করে তুলল। অর্পিতাদের কলেজের দিনগুলিতে নতুন করে বিয়ে হয়ে আসা প্রায় তার সমবয়সী দর্শনা ওদের বাড়ির পাশেই থাকত। মেয়েলি ভাবটা দর্শনার মধ্যে চিরকালই ছিল। সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারা দর্শনার বড় ছেলেটি অস্ফুট কন্ঠে কথা বলা শুরু করার পরেই অর্পিতাকে ডাকে –’অপি বা’।
দর্শনার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বিকেলবেলা অর্পিতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়িতে ঢোকার পথে নতুন করে বাঁশের গেটটা দিয়ে সে ঘরটার খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল । ঘরটার বাইরের দিকটা রং করা হয়নি। প্লাস্টার করে রেখেছে। ভেতরটা আধুনিক কারুকার্যে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে। একটা গম্ভীর পরিবেশ বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। অর্পিতা দর্শনা বৌদির মেয়ের নাম ধরে ডাকল। সে বেরিয়ে এসেই অর্পিতাকে দেখে’ অপি বা’ বলে দু হাতে জড়িয়ে ধরল। দর্শনা থাকা ঘরটির উদ্দেশ্যে সিঁড়ি দিয়ে অর্পিতা ওপরে উঠে গেল। এটা বেশ বড়সড় ঘর। দেওয়ালের একদিকে দেওয়াল আলমারি তৈরি করে কাঠের দরজা লাগানো হয়েছে । অন্যদিকে পরিবারের চারজন সদস্যের একটি বড় ওয়াল পেন্টিং। সুখের দিনের ছবি, ঘরের মাঝখানে দাদা বৌদির যুগ্ম জীবনের সাক্ষী বিশাল বিছানাটা। বিছানার ওপরে ওই যে – অর্পিতা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। কঙ্কাল সদৃশ একটি নারী দেহ। মাথায় একটি কালো কাপড় বাঁধা রয়েছে । মানুষটার মুখ থেকে কাতরোক্তির শব্দ ভেসে আসছে।’ ইস ব্যথা করছে’ – মানুষটা পেটটা চেপে ধরেছে। বিছানার কাছে কয়েকটা চেয়ার, কেউ এসে বসে যাওয়ার চিহ্ন। তারই একটিতে মানস বসে আছে– নির্বিকার মানুষটা। অজস্র টাকা পয়সা খরচা করেও তিনি স্ত্রীর পেটের ব্যথার উপশম ঘটাতে অক্ষম । চোখের সামনে তিল তিল করে শেষ হয়ে যেতে থাকা আদরের মানুষটির শেষ অনুরোধ–’ পেটের ব্যথাটা ভালো করে দাও’ বাক্যটি দাদাকে ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত করছে। এরকম একটি পরিবেশে কী জিজ্ঞেস করবে স্থির করতে না পেরে অর্পিতা চুপ করে বসে রইল। দর্শনা তার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি হাসতে চেষ্টা করল। আমি মরতে চলেছি– অস্পষ্টভাবে দর্শনা কথাটা বলল।’ এত ব্যথা, অসহ্য।’
অর্পিতাকে দর্শনার কাছে ছেড়ে মানস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ‘মেয়েটির মেট্রিক পরীক্ষা, এ সময় আমার এরকম অবস্থা হল। আমি ওকে কোনো ধরনের সাহায্যই করতে পারলাম না।’– হাঁপাতে হাঁপাতে দর্শনা কথাটা শেষ করল।
‘ সব ঠিক হয়ে যাবে’– অর্পিতা একটা মিথ্যা কথার আশ্রয় নিল।
সেই দর্শনা বৌদির এই রূপ অর্পিতার কাছে অকল্পনীয় ছিল। কে জানত, দর্শনার স্বপ্নের ঘরে গৃহপ্রবেশ এইভাবে ঘটবে। এই কয়েকদিন মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে থাকা মেয়েটি এসে অর্পিতার কাছে বসল। দর্শনা মেয়ের দিকে যে কাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, তার শীতলতা অর্পিতার বুক ভেদ করে হৃদয় স্পর্শ করল। কত কথা জমে থাকলে মানুষের দৃষ্টি এরকম হতে পারে।
পরীক্ষার মাত্র চল্লিশ দিন বাকি। মায়ের শেষ অবস্থা সমাগত, বাড়ি আত্মীয়-স্বজনে ভরে আছে। পড়াশোনার পরিবেশ নাই হয়ে গেছে। তবু মেয়েটি তার জন্যই তৈরি করা নতুন পড়ার ঘরের চেয়ারে বসে টেবিলে বইপত্র নিয়ে বসেছে। বলের পেছনে পেছনে দৌঁড়ানো আট বছরের ছোট ছেলেটি মাঝেমধ্যে মায়ের কাছে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন মায়ের হাতে খাওয়া-দাওয়া করা ছেলেটি মায়ের দিকে জলের প্লাস এগিয়ে দিচ্ছে। এই কয়েকদিনে সে অনেক বড় হয়ে উঠেছে।
এরকম পরিবেশে অর্পিতা বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না। দর্শনাকে বলে ছেলে মেয়ে দুটিকে আদর করে এল। তারপর খবরটা পেতে মাঝখানে মাত্র একটি মাস পার হয়ে গেল। সেদিন অর্পিতা স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। দুঃখের সম্মুখিন হওয়ার মতো সাহস অর্জন করতে না পারায় মানসের কাছে মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছিল।
কিছুদিন পরে মানস চাকরির জায়গায় ফিরে যাবার খবর অর্পিতা পেয়েছিল। দর্শনা বৌদির মেয়েটি সেই ঝড় তুফানের মধ্যে মায়ের আশা করা মতেই কৃতকার্যতার সঙ্গে পরীক্ষায় পাশ করেছিল। মেয়েটি কটন কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে লাগল। ছোট ছেলেটিকে দিদিমার হাতে তুলে দিল, নতুন করে তৈরি বাড়িতে তালা লাগিয়ে বাড়ির তিনটি প্রাণী তিন জায়গায় চলে গেল।
ঘটনাটা ঘটে যাবার প্রায় দুই বছর পরে অর্পিতা শিবসাগর এসেছে। আশেপাশের পরিবর্তন গুলি দেখার জন্য বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে। হটাৎ পাদুটি থেমে গেল। অর্পিতা নিজেকে প্রশ্ন করল–’ তার চোখের সামনে এটাই কি দর্শনা বৌদির স্বপ্নের ঘর? চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা ঘন বন জঙ্গল বাড়িটাকে গ্রাস করে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। বহুদিন মানুষের প্রবেশ না ঘটার সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটার ভেতরে হয়তো দর্শনা বৌদির পরিবারের সুখের দিনের ছবি এখনও আগের মতোই দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে।
ইট- বালি- সিমেন্ট দিয়ে বাড়ি একটা তৈরি হয় কিন্তু বাড়ির ভেতরের আত্মাটা হল তাতে বসবাস করা মানুষেরা । আত্মা বিহীন শরীরকে কি শরীর বলা যায়। দর্শনার স্বপ্নের ঘরটির এই অবস্থা অর্পিতা চেয়ে দেখতে পারল না। সে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। দর্শনার মৃত্যুতে মানসদাকে পাঠানো মোবাইল মেসেজটা অর্পিতা আউটবক্স থেকে ডিলেট করে ফেলল। মানুষ তো সব সময় দুঃখকে নিয়েই বেঁচে থাকতে পারে না।
অনুবাদক