| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

শ্রদ্ধাঞ্জলি: ‘সে’ ও চিলি । মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
আজ তার জন্মদিন বলে মায়ের কথায় এত দূরে আসতে হয়েছে। আজ দোকানটাও বন্ধ রাখতে হবে, এমন অর্ডার করেছে মা। মা’টা যদিও তার নিজের, মানে তার পেটে জন্মেছে ‘সে’, কিন্তু তিনি আবার বাবার বিয়ে করা বউ নয়। বিধবা হয়ে বাড়ি বাড়ি বাসন মাজত, বাবা তাকে আশ্রয় দিয়েছিল, মর্যাদা দেয়নি। কথাটায় আগে খুব জ্বলন হত, এখন আর হয় না। এখন ‘সে’ বড় হয়েছে, সাতাশ বছরেরটি হল আজকে। তবে তার যে মেয়েটির সঙ্গে ভাবসাব ছিল, বিয়ে করবে বলে রেখেছিল, আজ নিয়ে তিন মাস হল চলে গিয়েছে। চলে গিয়েছে নয়, কেঁদে কেটে পালিয়েছে। পালিয়েছে বলে বেঁচে গিয়েছে, নইলে ‘সে’র পাল্লায় পড়লে তার যে কী দুর্গতি হত, কে জানে। অথচ ‘সে’ খারাপ নয়, তার ‘সে’ নামটাও খারাপ নয়, তার মা’টা খারাপ নয়, বাবাটা তো নয়ই। বাবাটা মরে গিয়েই তো যত দুর্গতি।
তারকেশ্বরে কেন পুজো দিতে পাঠাল মা, সে কথা ‘সে’ বুঝবে না, বুঝতে চায়ও না। ভোর-ভোর ঠেলে তুলে দিয়ে মা বলল ওঠ ওঠ, উঠে পড়। আজ তোর জন্মদিন, তোকে তারকেশ্বরে পুজো দিতে যেতে হবে।
মাথা খারাপ নাকি? রাত থাকতে উঠে চান করে মায়ের হাতের রেডি করে রাখা একটা সাজিতে ফলফুল মিষ্টি হাতে করে টিটাগড় থেকে তারকেশ্বর? মামদোবাজি নাকি? তবে মায়ের কথা তো নয়, আদেশ। মায়ের জন্যেই সে আছে। মায়ের কথাতেই তার বাড়বাড়ন্ত। মা-ই তাকে বলেছিল আমার হাতের একগাছা বালা বিক্রি করে দিয়ে টলিটা করে নে। ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে গড়িয়ে দিস আবার।
চার চাকার ট্রলির ওপর তার বিড়ি-সিগারেট-গুটখার সঙ্গে মোজা, রুমাল, মানিব্যাগ, লাইটারের দোকান। আর থাকে একটা গোপন আইটেম। খারাপ ছবি দেওয়া বই। লুকিয়ে রাখতে হয়, পুলিশে দেখলে ধরে নিয়ে যাবে। আসলে ওই সব বই থেকেই আয় বেশি, পাঁচ টাকার বই কুড়ি টাকায় বেচে। তিরিশ টাকা বললেও ছেলেরা কিনবেই। গোটা চারেক বই বেচলেই ব্যস, সে দিনের মতো রোজগার ভালই হল। কোনও কোনও দিন আট-দশটাও বিক্রি হয়। এ সব ধান্দার কথা মা জানে না। কী দরকার মাকে বলার? তিন মাস আগে চলে গিয়েছে চিলি, সে ওই বইয়ের জন্যেই। দেখে ফেলেছিল। তার পর সে কী কান্না, ‘তুমি খারাপ, তুমি খারাপ’ বলতে বলতে আর এমুখো হয়নি। চিলির মা বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে সংসার চালায়। দাদা একটা জুটমিলে ক্যাজুয়েল লেবার। ভেবেছিল ‘সে’ ওকে বিয়ে করলে জীবনটা তরতর করে বয়ে যাবে নদীর মতো। হল না, একখানা বই তার সর্বনাশ করে দিল। মেয়েটার ওই এক দোষ, সব সময় দেখবে কোথায় কী লুকিয়ে রেখেছে ‘সে’।
 
 
‘সে’ তার নাম নয়, আছে একটা বিশাল মাপের নাম, বিকাশরঞ্জন দে সরকার। তার থেকে কেমন করে তার নামটা ‘সে’ হয়ে গেল সে এক বৃত্তান্ত। মোটকথা খারাপ বইয়ের দৌলতেই মায়ের হাতের বালাটা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। আবার খারাপ বইয়ের কারণেই চিলি চলে গিয়েছে।
টিটাগড় ঘাট থেকে ডিজেল ইঞ্জিন লাগানো নৌকো পার হয়ে মাহেশের লক্ষ্মীঘাট, ওপারে শেয়ারের অটো সব সময় চলছে শ্রীরামপুর ইস্টিশন, ট্রেনে তারকেশ্বর। এখন শ্রাবণ মাস নয়, ভিড় নেই, আটটার মধ্যেই কাজ শেষ। মা বলেছে পুজো দিয়ে প্রসাদ খেয়ে তার পর চা-টা কিছু খাবি। এ দিক ও দিকে অনেক খাবার দোকান, তারই মধ্যে একটা ভাল দেখে রেস্তোরাঁয় ঢুকে একটু ভেতর দিকে বসে বুঝল এখানে মদ পাওয়া যায়। এমনিতে সে খুব একটা মোদো-মাতাল নয়, তবে আজ জন্মদিন, ইচ্ছে করল। ছুটিছাটা তার ভাগ্যে নেই, পড়ে পাওয়া ছুটিটা তাকে ফুর্তি করতে উৎসাহিত করল।
সেখান থেকে যখন সে বের হল, তখন তার পা টলছে। খালি পেটে একপাঁট দেশি তার পক্ষে বেশিই। চানাচুর আর কুচো নিমকি খেয়েছিল, তাতে কী হবে? একশো টাকার মধ্যে এখনও তার কাছে ষাট টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা আছে। টিকিট কেটে ট্রেনে বসে হিসেব করছিল, মন্দিরে দিয়েছে দশ টাকা প্রণামী। তার পরের হিসেবটা কিছুতেই করতে পারছিল না। মাথাটা কাজ করছিল না। হিসেব মতো ফেরার রাস্তায় শ্রীরামপুর, শেয়ারের অটো, লক্ষ্মীঘাট, হেঁটে চলে যাবে মোটর লাগানো নৌকোর ঘাটে। হল না হল না, চাইলেই কী আর সব হিসেব মতো হয়? নজর পড়ে গেল রাস্তার ধারে। তা সে নজর দিয়ে দেখতেই পারে এ দিক ও দিক, তাতে দোষের কী আছে?
মস্ত একটা হাতের ছবি পিছনে টাঙিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হস্তরেখাবিদ বসে আছেন আসন পেতে। তার সামনে একটা টুল।
কত টাকা?
কোচ্চেন পোতি আট আনা।
বসে গেল ‘সে’। মাথাটা একটু একটু ঘুরছে। মানে ঠিক লাগছে না, ঠিক বুঝতে পারছে না। নেশাটা একটু যেন বেশিই লাগছে, তবে মাতাল তো হয়নি। চিলির কথাটা জানতে খুব ইচ্ছে করে, সেই জন্যেই বসা। দশ মিনিট দেরি হলেই বা কী হয়েছে, আজকে তার ছুটির দিন। বলা কি যায় কে কোন কথাটা ঠিকঠিক বলে দিতে পারে? হাতটা ধরেই লোকটা বলল আপনাকে পেথমে সাবধান করে দি, কোনও কালো লোক আপনাকে জ্বালাবে।
জ্বালাবে? তার মানে?
দু’নম্বর, কোনও ফর্সা মেয়ে আপনাকে মারবে।
চিলি কি ফর্সা? ভেবে দেখল ‘সে’, চিলি তো ফর্সা নয়। তবে দেখতে মন্দ নয়। একটু রোগা আছে, তবে ফর্সা নয়? তা হলে চিলির কথা হচ্ছে না।
তিন নম্বর, এক জন টিকোলো নাকওলা লোক আপনাকে ভালবাসবে, খেতে দেবে।
লোক? মানে ভদ্রলোক? ভালবাসবে? মেয়ে নয়?
চিলির নাকটা টিকোলো কি? মনে হয় না। আর চিলি তো লোক নয়। বার বার চিলির মুখটাই মনে পড়ছে আজ।
আর কিছু বলবেন?
সেই মেয়েটি আসবে, আপনাকে মান ভাঙিয়ে দিতে হবে। তার বড় মনখারাপ হয়েছে।
তার নামটা যদি বলতে পারেন আপনাকে দশ টাকা দেব।
নামটা বলা যায় না, তবে আদ্যি অক্ষর হবে ‘চ’ কিংবা ‘ল’।
ঝট করে উঠে পড়ল ‘সে’। দুটোই ঠিক বলেছে। তার নাম তো চিলি। ফস করে দশ টাকা বের করে দিল। ভাবতে ভাবতে চলল, আজ দিনটা চিলির নামেই উৎসর্গ করা যাক। মোট চারটে প্রশ্ন করেছে, তার মানে দু’টাকা লোকটার পাওনা, ফট করে দশ টাকা দেওয়া কি ঠিক হল? যাকগে, লোকটা যখন চিলির নামটা ঠিক ঠিক বলতে পেরেছে তখন ভালই জানে হাতের রেখা পড়তে। ঝিম মেরে বসেছিল অটোতে ড্রাইভারের পাশে। মাথাটা টলছিল, কিন্তু টিপে ধরে রেখেছিল মাথার কাছের শিকটাকে।
লক্ষ্মীঘাটের গলিটাতে একটু হাঁটতে হয়। ভাবছিল চারটে জিনিসের কথা বলেছে নালার ধারের বিশ্ববিখ্যাত হস্তরেখাবিদ, চারটেই ঠিক হবে নাকি? গঙ্গার ঘাটে বাঁশের মাচার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় একটা প্যাংলা কুচকুচে ছেলেকে বিড়ি খেতে দেখেছিল ঠিকই, কিন্তু যাকে বলা যায় নজর করেনি। ছেলেটা আচমকা ওর কাঁধে বিড়িটাকে চেপে ধরল। ‘উঃ’ করে একটা শব্দ করেই প্রচণ্ড ঠেলা মারল ছেলেটাকে। ঝপাং করে গঙ্গার জলে পড়ল প্যাংলাটা। খেপে গেল ‘সে’, বলল উঠে আয় শালা, আজ তোর গুষ্টির পিণ্ডি চটকাব।
ছেলেটা উঠে আসছিল না, ‘সে’ও নৌকোয় উঠছিল না। দু’মিনিট পরে লোকে অধৈর্য হয়ে বলল, চলে আসুন দাদা, নৌকো ছাড়বে এ বার। সে ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে উঠল নৌকোয়। হাত দেখা লোকটা বলেছিল, কোনও কালো লোক আপনাকে জ্বালাবে। বলেছিল কিনা?
নৌকোয় উঠে ‘সে’ এই সব ভাবতে গিয়ে দেরি করে ফেলল। নৌকোটা লগির ঠেলা খেয়ে নড়ে উঠতেই ‘সে’ টলে গেল, মাড়িয়ে দিল এক জনের পা। এবং পড়েই যেত, এক জনকে ধরে সামলালো। ঠিক সেই সময়েই তার গালে এসে পড়ল এক সপাট চড়। মাথাটা ঘুরেই গিয়েছিল, সংবিৎ পেতেই চেয়ে দেখল মহিলা বেশ ফর্সা। কিছু বলতে পারল না ‘সে’। মারতেই পারে। ফর্সা মহিলা বলে কথা, আর উপুড় হয়ে খিমচে ধরে ফেলেছিল তো তাকেই। গালটা চিড়বিড় করছিল, এক বার হাত বুলিয়ে থেমে গেল। আশ্চর্যের কথা শালপাতায় বাঁধা প্রসাদ সমেত মায়ের সাজিটা তখনও হাতে ঠিক ধরা আছে। বসে পড়ল পাটাতনের ওপর। বেশ জোরেই বলল নৌকোটা, মানে আপনার লাগেনি তো?
সকলের সহানুভূতি আদায় করে নিল ‘সে’। কেউ বলল, কথায় কথায় চড় মারা যেন ছেলেখেলা হয়েছে। উনি তো পড়েই যাচ্ছিলেন, সামলাতে গিয়ে না হয় একটু…। কেউ বলল, দেখছেন না পুজো দিয়ে আসছেন, ইচ্ছে করে তো…। কেউ বলল, মায়া-মমতাগুলো লোপ পাচ্ছে আজকাল।
মানে উপবাস করে ঠিক…
বলুন দেখি, উপোস করা মানুষ, মাথা ঘুরে কী কাণ্ড! তা ঘাটে কী হচ্ছিল আপনাদের?
বিড়ির ছ্যাঁকা দিল ঘাড়ে, দেখুন।
পকেট দেখুন, ছেলেটা পকেটমার। আপনাকে চমকে দিয়ে পকেট মেরেছে।
পঞ্চাশ টাকার নোটটা গায়েব। খুচরোগুলো আছে। লোকে মুখ দেখেই বুঝেছে। বলল, কত টাকা গেল?
পঞ্চাশ।
এখন মুশকিল হল মাত্র কয়েক টাকা খুচরো আছে। মায়ের কথায় তারকেশ্বর না গেলেই হত। কিন্তু লাভ হয়েছে। কালো লোক জ্বালাবে ঠিক হয়েছে। ফর্সা মেয়ে মারবে, সেটাও ঠিক হয়েছে। তার পর কী বলল লোকটা? সবগুলোই ঠিক হবে নাকি? চিলির কথা মনে আসছে, মাঝে আর একটা কী বলেছিল যেন?
ওপারে এসে ঠেকল নৌকোটা। একে একে সবাই নামল। যে মহিলা চড় মেরেছিল সে অপ্রস্তুত হয়েছিল ঠিকই, তবু বলেনি মদের গন্ধ পেয়েছে। তাড়াতাড়ি করে নেমে যাওয়ার সময় ফিরে ফিরে দেখছিল ‘সে’ আসছে কি না পিছনে পিছনে। ভয় পেয়েছে মনে হল। ভয়ই যদি পাবে তা হলে চড় মারতে যাওয়া কেন বাপু?
সাবধানে একটু একটু করে ঘাটে উঠে এল ‘সে’। পকেটে দেখল তিনটে এক টাকার কয়েন আছে। তাতে একটা রিকশা পাওয়া যাবে না। হেঁটেই যেতে হবে। ঘাটের ওপর উঁচুতে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এক জন। লোকটার সব কিছু ঠিকঠাক, কিন্তু মাথায় একটা অহেতুক টুপি। সেটাই তাকে দর্শনীয় করে রেখেছে। অথচ লোকটার এ বিষয়ে কোনও হুঁশ নেই। ‘সে’ কাছাকাছি আসতে তাকেই বলল দেখেছেন, গঙ্গার চেহারা কেমন সকালের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে।
‘সে’ এক বার গঙ্গার দিকে তাকাল, কিছু নজরে এল না। ভাবল লোকটা পাগল-ছাগল হতে পারে। যাত্রীদের তাড়া আছে, তারই নেই, অতএব তার চলন বেশ ঠান্ডা। বিশেষ করে চড়টা খেয়ে তার খারাপ লেগেছে। বেশ খারাপ লেগেছে। অথচ সবাই জানে তার মোটেই কোনও বদ উদ্দেশ্য ছিল না। এই লোকটাকে কিছু জবাব দিতে হয়, বলল যা বলেছেন।
সবাই চলে যাবে, এখানে কেউ থাকবে না। তবু দেখুন এই যে গঙ্গার জল, মিষ্টি হাওয়া, দিনের আলো, ক্ষণে ক্ষণে রং পাল্টে যাওয়া, এ সব মজার নয়? এ সব দেখতে জানা চাই।
সাজিটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিয়ে ‘সে’ বলল ঠিক বলেছেন আপনি।
আপনি নিশ্চয় কবি?
কবি? না, না, কবি হতে যাব কোন দুঃখে? আমি বিকাশ, মানে স্টেশন রোডে আমার ট্রলির দোকান আছে।
আমার সঙ্গে আসবেন? আমার যে আপনাকে খুব দরকার। মানে আপনার মতো কবিমনকে আমার খুব দরকার।
আমার খিদে লেগেছে খুব। পুজো দিতে গিয়েছিলাম তো?
আমারও খিদে পেয়েছে খুব। আসুন একসঙ্গে খাব।
লোকটা চলতে লাগল বি টি রোডের দিকে। ‘সে’ পিছন নিল, তার পর আস্তে আস্তে বলল আমার কাছে মাত্র তিন টাকা আছে। বাড়ি গিয়ে ভাত খাব।
বেশ তো, আমিই না হয় দাম দেব, আজ বাড়িতে নাইবা খাওয়া হল।
চলতে চলতে ‘সে’ দেখল লোকটি নেহাত ভাল লোক। ভাল লোকের গায়ে লেখা থাকে সে ভাল লোক। ঠিক তখনই মনে পড়ল হাত দেখে বলেছিল এক জন টিকোলো নাকের লোক ভালবাসবে, খেতে দেবে। নাকটা দেখবার চেষ্টা করল ‘সে’ বার দুয়েক। টুপির বাধায় ব্যর্থ হয়ে ভাবল টিকোলো নাকের না বলে বলা উচিত ছিল এক জন টুপি পরা লোক ভালবাসবে, খেতে দেবে। নির্বিবাদে ‘সে’ চলতে লাগল তার সঙ্গে। লোকটা বড় সুন্দর সুন্দর কথা বলে। ‘সে’ এক সময় জিজ্ঞেস করল আপনি নিশ্চয় কবি?
মুখ ফিরিয়ে লাজুক হাসলেন তিনি। তখনই তাঁর নাক দেখতে পেল ‘সে’, কই তেমন টিকোলো নয়তো?
কবি বললেন, আপনার জহুরির চোখ।
বি টি রোডের ওপর একটা ভাল রেস্তোরাঁয় ঢুকল কবি। এখানে খাবারের দাম বেশি। ধীরেসুস্থে হাত ধুয়ে এলেন কবি বেসিন থেকে, দেখাদেখি ‘সে’ও। দু’জনে আয়েশ করে বসল একটা টেবিলের দু’পাশে। এক জন এসে অর্ডার নিয়ে গেল, কবি বললেন, দুটো মাছ ভাতের থালি।
মিনিট চারেক পরে থালি নিয়ে এল যে, সেই মেয়েটা চিলি। অবাক হয়ে দেখছিল ‘সে’। চিলিও তাকে দেখেছে, কিন্তু মোটে অবাক হয়নি। অমন রোজই কত কত চেনা লোক খেতে আসে।
‘সে’ খেতে লাগল, কবিও বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছিল। কত কথা বলছিলেন কবি। এখন মানুষের মন নিয়ে পড়েছেন। মেয়েদের মন আর পুরুষদের মন এক রকম হয় না। কেন এমন হয় তার ব্যাখ্যা করতে লেগেছেন। ‘সে’ ভাবছিল চিলিকে রেস্তোরাঁর কাজ করতে হচ্ছে। কেন হচ্ছে, তা সে জানে, ভাল করেই জানে। বাড়িতে নিশ্চয় বলেছে অত বড় ধুমসো মেয়েকে খাওয়াতে পারবে না তারা। মা’টাই নিশ্চয় বলেছে, কেননা দাদাটা ভাল। ‘সে’ জানে দাদাটা বোনকে খুব ভালবাসে। ‘সে’ আপনমনে বলল চিলিকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হল না, এখন দেখুন রেস্তোরাঁতে ওয়েটার।
কে চিলি? ওই মেয়েটা?
ইশারায় তাকে ডাকলেন কবি। বললেন
তুমি মানুষ চিনতে পারোনি চিলি, আমি দশ মিনিটে চিনেছি। ও আমার মতোই কবি। আমাদের জাতটা আলাদা। তুমি ওর সঙ্গে যেতে পারো। তবে কথা হল, সেটা তোমার মনের ব্যাপার। ভেবে দেখো এখন।
ও যদি বইটই বিক্রি না করে তা হলে আমি আছি।
কেন, বই তো ভাল জিনিস। বই বিক্রি না করলে খাবে কী?
ও সব খারাপ খারাপ বই।
বই কখনও খারাপ হয় না গো, খারাপ হয় মন। তুমি মন খারাপ কোরো না। মনটাকে ঠিক করে ফেল, ব্যস। হাত ধুয়ে পয়সা দিয়ে চলে গেলেন কবি। চিলি থালা দুটো তুলে নিয়ে গেল। ফিরে এসে বলল
ওই কবি কোনও ভাল সঙ্গী না পেলে খেতে পারেন না, আমি জানি। আজ তোমাকে সঙ্গে দেখে মনে হল তুমিও তা হলে খারাপ নও। কবি খারাপ লোকেদের সহ্য করতে পারে না। আমার কথা শোনো, খারাপ ছবির বই রেখো না, লোভ কোরো না, পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। আমি কাল সকালে আসব তোমাদের বাড়িতে, বেশ?
‘সে’ একটু হাসল কী হাসল না। তার মাথায় তখন শ্রীরামপুরের নালার ধারের বিশ্ববিখ্যাত হস্তরেখাবিদের চেহারাটা ঘুরছে। লোকটা সত্যি অনেক কিছু জানে। প্রথম অক্ষর ‘চ’ কিংবা ‘ল’ বলেই দিয়েছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত